#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৫]
মোবাইল হাতে ভীতু চোখে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমেদের হাতটা কাপছে, যে কোন সময় তার হাত থেকে মোবাইলটা পরে যেতে পারে। তার সামনেই অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ। চক্ষু তার লাল বর্ন ধারন করেছে। দুই হাতই শক্ত মুঠি করে রেখেছেন তিনি। চোখ-মুখে ক্রোধ উপছে পরছে তার। কাঁধে ঝুলে থাকা কোটটা নিচে ফেলে দিলেন তিনি। আফিয়া আহমেদ ভীতু চোখে ধীর পায়ে এক পা এগিয়ে এসে বললেন,
– নওশাদ আমি,,,
– এত নীচে তুমি কি করে নামতে পারলে আফিয়া। হাত উঁচু করে আফিয়া আহমেদকে থামিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে তার কাছে এসে ঠাস করে আফিয়া আহমেদের গালে চড় বসিয়ে দেন তিনি। অতঃপর বলেন।
– মেহেরের এত বড় ক্ষতি কেন করলে তুমি। বলেই আরো একটা চড় বসিয়ে দিলেন আফিয়া আহমেদের গালে।
আফিয়া আহমেদ সৈয়দ নওশাদকে ধাক্কা দিয়ে কয়েকপা দূরে ঠেলে দেন। অতঃপর চিৎকার বলে বলেন,
– আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি। ওই মেয়েটার জন্যে তোমার কেন দরদ উতলে উঠছে নওশাদ। নওশাদ ওই মেহেরের জন্যে আমাদের রাহি কষ্ট পেয়েছে। রাহি ওর ভালোবাসা পায়নি। তুমি আমাদের মেয়ের কষ্টটা দেখতে পাওনি নওশাদ।
– মেহেরও আমার মেয়ে আফিয়া। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ নওশাদ। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর আফিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠেন,
– আল্লাহর কাছে প্রে করো যাতে মেহের তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। না হলে তোমার কি অবস্থা হবে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এতদিন সৈয়দ নওশাদ আহমেদের ভালোবাসাটা দেখেছো এবার তার বিপরীত টাও দেখতে পাবে। বলেই হন হন করে নিজের রুমে চলে যায় সৈয়দ নওশাদ। সৈয়দ নওশাদ চলে যেতেই স্বস্তিকর শ্বাস ফেলে আফিয়া আহমেদ। গালে হাত রেখে অধোর চেপে হাসে। তারপর হাতে থাকা মোবাইলটা দিয়ে কল লিষ্টের প্রথম নাম্বারে ডায়াল করে বলে,
– সময়মতো টাকাটা পেয়ে যাবে। আমাকে আর কল করবে না। প্রয়োজন হলে আমিই তোমাকে ডাকাবো। কল কেটে দেয় আফিয়া আহমেদ। পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,
– ভালোবাসা হাড়ানোর যে কষ্ট সেটা রাহি কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। আমার মেয়ের সুখের জন্যে এটুকু অন্যায় আমি করতেই পারি। নিজের সুখের কথা ভেবে যদি কারো,,, বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে আফিয়া আহমাদ অতঃপর সে বাগানের দিকে চলে যায়।
সৈয়দ নওশাদ নিজের রুমের কাছে আসতেই শুনতে পেলেন তার স্ত্রী আফিয়া আহমেদের উৎফুল্ল কন্ঠ। সে উৎফুল্ল হয়ে কাউকে বলছেন, মেহেরকে প্রাণে মেরে ফেলার কথা। অপর পাশে থাকা ব্যাক্তি কথা শুনতে পায়নি সৈদয় নওশাদ কিন্তু আফিয়া আহমেদের কথায় তিনি যতটুকু শুনেছেন তাতেই বুঝতে পেরেছেন আফিয়া আহমেদ কাউকে সুপারি দিয়ে মেহেরেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। তবে এই কাজে তিনি সফলও হয়েছেন। মেহের এখন হসপিটালের বেডে মৃত্যর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। অপর পাশে থাকা লোকটাকে তিনি বলছেন, কাজটা করে দেওয়ার জন্যে যে টাকা দিতে চেয়েছে, মেয়েটার মৃত্যর খরব এনে দিলে তত টাকাই তাতে উপহার হিসাবে দিবে। আফিয়া আহমেদের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সৈয়দ নওশাদ। সে সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আফিয়া আহমেদের কথা শুনে তার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে মেহের এত বড় ক্ষতি কে করিয়েছে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে যায়। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এলে এক পা সামনে রাখে সে তখনি রুমের বাহিরে থাকা একটা ফুলদানির সাথে পা লেগে যায় তার আর ফুলদানিটা নিচে পরে বিকট শব্দ হয়। এই শক্ত শ্রবণ হতেই পিছনে ফিরে তাকায় আফিয়া আহমেদ। তার পিছনে সৈয়দ নওশাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফিয়া আহমেদ চমকে উঠে। কখন যে তার কানে থাকা মোবাইলটা নিয়ে নামিয়ে ফেলছে সেটা বুঝতে পারেনি। ভিতু চোখে সৈয়দ নওশাদের দিলে তাকিয়ে কাঁপতে থাকে সে।
৩৬,
করিডোরের পাশে চিন্তিত মনে অপেক্ষা আছে রাহনাফ আলিহান আর মৌ। অপেক্ষা সময় বুঝি একটু বেশীই দীর্ঘ হয় তাইতো আলিহান করিডোরে পায়চারী করছে আর রাহনাফ বসে বসে একবার মাথায় চেপে ধরছে আর মুখে হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। তাদের এই অপেক্ষিত সময় যেন শেষই হচ্ছে না। মৌ কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলছে। সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে চুপটি মেরে বসে আছে। তার দৃষ্টি স্থির সামনে থাকা অটির দিকে যেখানে মেহের রয়েছে। রাহনাফ যখন আলিহান আর রাহিকে কল করে মেহেরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলে তৎক্ষণাৎ ওরা হসপিটালে চলে আসে। রাহি আসার পরেই ওকে কিছু ফলমূল খেতে দেওয়া হয়। তারপর একটা নার্স রাহির রক্তের কয়েকটা পরিক্ষা করে নেয়। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে ডক্টর রাহির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বলে জানিয়ে দেয়। কারন রাহির পিরিয়ড চলছে। এই অবস্থায় কোন ডোনারই রক্ত দিতে পারে না। তখন খুব ভেঙে পরে রাহনাফ ও রাহি, তবে কি তারা মেহেরকে আবার তাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তখনি হসপিটালে উপস্থিত হয় মৌ আর সৈয়দা মাহবুবা। রাহনাফের টিশার্টের রক্ত দেখেই থমকে যায় সৈয়দা মাহবুবা। দুপুর পেরিয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে সন্ধা হতে চলল তবুও বাসায় ফিরেনি মেহের তাই মৌ একটু বেশী চিন্তিত ছিলো। মেহেরকে কল করে পায়নি। যতবার কল করেছে ততবারই সুইচ অফ দেখাচ্ছে। আলিহানকে কল করেছে কয়েকবার কিন্তু সেও কল রিসিভ করে নি তাই মৌ এলমাদের বাসায় চলে যায়। কারন এই সময় সৈয়দা মাহবুবা এলমাদের বাসায় থাকে। সেখানে গিয়ে মৌ সৈয়দা মাহবুবা বলে মেহের এখনো বাসায় ফিরে নি আর ওর মোবাইল বন্ধ ওকে কলে পাওয়া যাচ্চে না। সব শুনে সৈয়দা মাহবুবা চিন্তিত হয়ে পরেন। এলমাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে মৌ-কে নিয়ে রওনা দেয় জাতীয় ডিবেট ক্লাবের সামনে। কোন কিছু হাড়ালে যেমন শুরু থেকে খোজা হয় তেমনিভাবে কোন ঘটনা গভীরে পৌঁছাতে হলে সুত্রপাত জানতে হয়। ডিবেট ক্লাব বন্ধ।ফিরে আসছে তারা তখন কাউকে বলতে শুনলো,
– মেয়েটা বাঁচবে তো। ছেলেটাকে দেখলাম পাজা কোলে করে হসপিটালে নিয়ে গেলো। গাড়ি তাকতেও গাড়িতে উঠলো না। একটা মেয়ের জিবন কি এতটাই ঠুনকো, মেয়েটার জিবন মরনের প্রশ্ন এখানে আর ছেলেটা কি করবো! মেয়েটার কথা না ভেবে নিজের জেদটাকে বজায় রাখতে হেটে হেটে গেলে।
একজন পথিকের কথা শুনে অপরজন বলে উঠে,
– ঠিকই বলছো ভাই। মেয়েটার জন্যে আমারও ভিষন খারাপ লাগছে। কি সুন্দর কথাগুলো বলছিলো সে।
পথিকদের কথা শুনে সৈদয়া মাহবুবা তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করে তারা কোন মেয়েটার কথা বলছে। কিন্তু পথিকরা সেটা বলতে পারে না। সৈয়দা মাহবুবা সবার মতো স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে না যে তাদেরকে মেহেরের ছবি দেখাবে। মৌ-কে দেখাতে বললে সে বলে মোবাইল বাসায় ফেলে এসেছে। মন খারাপ হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবার। তখনি সেখানে একটা লোক আসে আর সে সৈয়দা মাহবুবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চট করে বলে উঠে,
– আপনিই তো সেই যাকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ফেলে রেখে স্বামি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে।
লোকটার কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই লোকটাকে সে চিনে না, আজকের আগে কখনো তাকে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না তাহলে সে এসব কথা কি করে জানলো। অবাকের সূরে জিগ্যেস করে সৈয়দা মাহবুবা বলে উঠে,
– আপনি এসব কি করে জানেন।
– আপনাকে দেখে। আসলে আজকাল কোথাও কালো মেয়ে দেখা যায় না সেই হিসাবেই বললাম।
লোকটার কথা শুনে মৃদু হাসে সৈয়দা মাহবুবা। প্রতিউত্তরে কিছু বলে না সে। তখনি সে আবার বলে উঠে,
– আপনার মেয়ের কি অবস্থা! জ্ঞান ফিরেছে তার। অনেক রক্ত বের হয়েছে।
লোকটার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে মানে কি? কি হয়েছে মেহেরের! সৈয়দা মাহবুবা উল্টা প্রশ্ন করে,
– কি হয়েছে আমার মেহুর! কোথায় আমার মেহু?
একজন মেহেরের সম্পর্কে তাকে বলতে চাইলে অন্যজন তাকে থামিয়ে দিয়ে তাদের নিয়ে সোজা হসপিটালে চলে যায়। কারন সে মেহেরকে হসপিটালে এডমিশনের সময় সেখানে ছিলো।
সৈয়দা মাহবুবাকে দেখে অবাক হয়ে যায় রাহনাফ আলিহান আর রাহি। তারাতো সৈয়দা মাহবুবাকে জানায় নি তাহলে সে এখানে আসলো কি করে। রাহনাফ টিশার্টে রক্তদেখে বেহুশ হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহের কোথায়! কি হয়েছে মেহেরের সেটা জানার জন্যে বেকুল হয়ে পরেন তিনি। এরপর আলিহান সৈয়দা মাহবুবা করিডোর বসিয়ে সবটা বলে। সব শুনে সৈয়দা মাহবুবা সেখানেই তার জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলে আর মৌ কান্নাশুরু করে দেয়। সৈয়দা মাহবুবাকে কেবিনে নিয়ে সেলাইন করা হয় আর মৌ-কে সামলাতে থাকে রাহি।
অবশেষে হসপিটাল কর্তিপক্ষ রক্তের ব্যাবস্থা করে মেহেরকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ওরা সকলে অটির বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকে।
অটির আলো নিভে যেতেই দাঁড়িয়ে যায় মৌ। ডক্টর বেড়িয়ে আসতেই রাহনাফ আলিহান আর মৌ আর রাহি তার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করতে থাকে।
সবার প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে ডক্টর। সে সবাইকে অবলোকন করে নেয়।
চলবে,,,,
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৬]
– কি হলো ডক্টর, আপনি চুপ করে আছেন কেন? বলুন মেহু কেমন আছে?
ডক্টর মেহের সম্পর্কে কিছু বলছে না তাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলল আলিহান। ডক্টর এখনো কিছু বলছে না নিচের দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। মৌ রাহি রাহনাফ সবাই তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখের দিকে। ডক্টর বলবে পেশেন্ট সুস্থ আছে এই আশা নিয়ে। আলিহান ডক্টরকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মৌনতা ভেঙে ডক্টর বলে উঠলো,
– আই এম সরি। আমরা পেশেন্টকে,,, আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরলো। মৌ আর রাহি দুজনে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। রাহনাফ দু-পা পিছিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। অশ্রুতে ভরে গেছে তার চোখের কোটর। কানের কাছে এখনো ডক্টরের বলা কথাটা ভেজেই চলেছে। আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলতে লাগলো, কি বললেন আপনি, আমার মেহু! আমি আপনাকে ছাড়বো না। ডক্টর আলিহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। ডক্টর আর আলিহানকে এভাবে হাতহাতি করতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,
– কি হয়েছে আলিহান! তুই ডক্টরকে মারছিস কেন?
সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা কি সব শুনে ফেলেছে, কখন জ্ঞান ফিরেছে তার। সকলে চিন্তায় পরে যায়। সৈয়দা মাহবুবা দ্রুত পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় ততক্ষণে আলিহান ডক্টরের কলার ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। সৈয়দা মাহবুবা এসে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– ডক্টর আমার মেহু কেমন আছে ডাক্তার সাহেব?
ডক্টর কোন জবাব দেয়না। অধোর চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌ এসে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। রাহিও কাঁদছে। আলিহান অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখ পানে। সৈয়দা মাহবুবা ডক্টরকে চুপ করে থাকতে দেখে ধৈর্য হারা হয়ে আবারও প্রশ্ন করেন,
– আমার মেহু কেমন আছে ডক্টর! আপনি কিছু বলছেন না কেন? আলিহান, রাহনাফ তোমরা আমাকে আমার মেহুর কাছে নিয়ে চল।
ডক্টর মাথা তুলে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ওটির ভিতর থেকে একটা নার্স এসে বলে,
– স্যার, পেশেন্ট রিসপন্স করছে। নার্সের কথা শুনে একপ্রকার চমকে উঠে ডক্টর। সে সৈয়দা মাহবুবার মুখ পানে এক পলক তাকিয়ে ততক্ষণাৎ অটির ভিতরে প্রবেশ করে। রাহনাফ আলিহান ওরা যেন তাদের প্রান ফিরে পেল। সৈয়দা মাহবুবা দু-পা পিছিয়ে যেতেই মৌ তাকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
– মেহুর কিছুই হবে না, তুমি দেখে নিও আন্টি। মেহু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আর যে আমাদের মেহুর এই অবস্থা করেছে তাকে খুঁজে বের করে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তুি দিবো আমরা। তুমি একদম চিন্তা করো না আন্টি।
মৌ-য়ের কথা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। তার কানের কাছে শুধু একটা কথাই বেজে চলেছে” স্যার পেশেন্ট রিসপন্স করছে” তাহলে কি এতক্ষণ মেহু রিসপন্স করছিলো না। হাত পা আলগা হয়ে আসে তার। হাটু গেরে নিচে পরেন। আলিহান আর রাহনাফ এসে তাকে তুলে করিডোরে বসিয়ে দেয়। হসপিটালের দেয়ালে সাঁটানো বড় এলইডি টিভির ভিতরে ঘড়ির টাইম দেখে রাহনাফ। এগারোটয় বাজে ছত্রিশ মিনিট। অনেক রাত হয়েছে।এবার মৌ আর রাহিকে বাড়ি ফিরতে হবে। রাহির মা বাবা হয়তো তার জন্যে চিন্তা করছে। সে আলিহানকে বলে ওদের বাড়ি পাঠাতে চায় কিন্তু মৌ বায়না ধরে মেহেরকে না দেখে সে কোথাও যাবে না। রাহিরও একই মতামত। তাই তারা সবাই মিলে অপেক্ষা করতে থাকে ডক্টরের। কখন ডক্টর আসবে আর মেহের ভালো আছে সুস্তি আছে এই খবর শুনতে পারবে তারা।
৩৭,
বেলকনিতে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। উপরের দিকে তাকিয়ে ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি আর সেই ধোয়া নিমিষেই অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি স্থির করেছেন বিশাল আকাশের ওই রুটির মতো দেখতে চাঁদের দিকে। রাত যত গভীর হচ্ছে কষ্ট গুলো যেন আরো তীব্র হচ্ছে। আফিয়া আহমেদকে এক প্রকার ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন তিনি। তাকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগেছিলো তার, আফিয়াকে যখন প্রথম দেখে তখন তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। মাহবুবাকে বিয়ে করার তিন মাসে পরিচয় হয়েছিলো আফিয়ার সাথে। পরিবারের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল স্বপ্নপূরী। আর সেখানে গিয়েই আফিয়াকে প্রথম দেখেছিল সৈয়দ নওশাদ। নওশাদের সেদিন মনে হয়েছিলো স্বপ্নপূরীতে পরি পাওয়া যায়। কারন আফিয়া দেখতে পরির চেয়েও কোন অংশে কম ছিলো না। নওশাদের ধরেই নিয়েছিলো পৃথিবীতে যদি পরি বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা আফিয়াই হবে। তারপর আফিয়ার সাথে আলাপ হয় তার। আফিয়া তখন বেশী কথা বলতো না সারাক্ষণ নিজের ভাবনায় ব্যাস্ত থাকতো সে। নওশাদের কিছু জিগ্যেস করলে শুধু তার দিকে একপলক তাকাতো। প্রয়োজনের দু একটা কথা বলতো সে। আফিয়ার সাথে কথা বলে জানতে পারলো সেই স্বপ্নপূরীতে একটা কাজে এসেছে। তিন দিন সেখানে ছিলো তারা আফিয়াও ছিলো সেখানে। তিন দিন পর যখন সেখান থেকে চলে আসে নওশাদ তখন পথিমধ্যে মনে হয় ইশ আফিয়ার নাম্বারটা কেন নিয়ে আসলাম না। গাড়ি থেকে নেমে যেতে চায় নওশাদ কিন্তু তার বাবার কারনে যেতে পারে না। নওশাদ ছিলো তার বাবার বাধ্য সন্তান।
বাড়ি ফিরে আফিয়ার কথা খুব মনে পরতো তার। রাতে ঘুমাতে পারতো না সে, চোখ বন্দ করলেই আফিয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। স্বপ্নপূরীতে থাকাকালীন লুকিয়ে আফিয়ার কয়েকটা ফটো তুলেছিলো বাড়িতে বসে সেই ছবি দেখতো নওশাদ আর আফিয়াকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনতো। বাসা থেকে বের হলেই আফিয়ার খুজ করতো সে। কিন্তু আর কখনো আফিয়ার দেখা পায়নি সে।
একদিন হঠাৎ করেই নওশাদের বাবা এসে নওশাদকে বলে, তিনি তার অফিরে এক কর্মচারীর মেয়ের সাথে নওশাদের বিয়ে ঠিক করেছে। সেদিন প্রথমবার নওশাদ তার বাবার কথা অমান্যতা করে বলেছিলো আমি এখন কাউকে বিয়ে করবো না। তাছাড়া আমিও একজনকে ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো। নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের পছন্দের মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলো। কারন তিনি তার ছেলের পছন্দের সম্মান দিতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ জানতো না মেয়েটার বাড়ি কোথায়! কোথায় থাকে? কার সাথে থাকে? মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো নওশাদ। রেগে গিয়ে নওশাদের বাবা বলেছিলো,
-আমি তাকদীরে বিশ্বাসী, যদি তুমি কোন ভিখারির মেয়েকেও পছন্দ করে বিয়ে করতে চাও করবে। মনে রাখবে এটা তোমার ভাগ্যে ছিলো। কারন তোমার বাম পাজরের হার থেকে তাকে তৈরী করা হয়েছে শুধু মাত্র তোমার জন্যে। আমি তোমাকে সাত দিন সময় দিলাম তোমার পছন্দের মেয়েকে খুঁজে বের করো অন্যথায় আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে তোমার।
সাত দিনের জায়গায় দশদিন কেটে যায় তবুও আফিয়ার কোন খুজ পায়না নওশাদ। ব্যর্থ মনে ভেবে নিয়েছিল, আফিয়াকে তার জন্যে তৈরী করেনি সৃষ্টিকর্তা। তাই সে তার বাবার কথায় তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। নওশাদের বাবা নওশাদকে বলেছিলো, মেয়েকে একবার দেখে নিতে। সেদিন নওশাদ হাসি মুখে বলেছিলো,
– নিজের থেকে তোমার উপর বেশী ভরসা করি বাবা। আমি জানি বাবা তুমি আমার জন্যে সবসময় ভালো কিছুই বেছে নিবে।
নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলো,
– আমি তোর জন্যে এমন একজনকে বেছে নিয়েছি যাকে আগলে রাখলে তোর জিবনটাই বদলে যাবে।
বাবার কথাশুনে মৃদু হেসেছিলো নওশাদ। তারপর ধুমধাম করে মাহবুবার সাথে নওশাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। নওশাদ তখনো জানে না সে কাকে বিয়ে করেছে। কনে বিদায়ের পর যখন সৈয়দ বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছায় তখন নওশাদের মা আসে বউ বরণ করে ঘরে তুলতে। মাহবুবার মুখ তখন লম্বা ঘুমটার আড়ালে। বরণ শেষে নওশাদের মা বউয়ের মুখ দেখার জন্যে ঘোমটা খুলে দেয়। নতুন বউয়ের মুখ দর্শন করেই চিৎকার করে উঠেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সকলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। নওশাদের মা তার ছেলের দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলে,
– তুই কাকে আমার বাড়ির বউ করে এনেছিস নওশাদ। এতো কয়লার খনি।
নওশাদের মায়ের কথা কথা শুনে অবাক হয়ে যায় নওশাদ। হাত আলগা করে মাহবুবার হাত ছেড়ে দেয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে মাহবুবার দিকে তাকাতেই চক্ষুদ্বয় সংকোচিত হয়ে যায় তার। ঘটনার আকস্মিক দু-পা পিছিয়ে যায় সে।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।