যদি তুমি জানতে পর্ব-৩২+৩৩

0
401

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_32
কয়েকদিন যাবৎ তুরান খুব ব্যস্ত। তুরানের বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। তুরানের বেশি ভাগ সময়ই কাটে হসপিটালে। রুপার সাথে ব্যস্ততার জন্য কয়েকদিন যাবৎ তেমন কথা হয় নি। মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা হয়েছে। রুপা যে ভীষণ মন খারাপ করে আছে তা তুরান বুঝতে পারছে। হসপিটালে আসার সুবাদে তুরান এটাও জেনেছে যে সাহেলা বেগম একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। রুপার মেন্টাল প্রবলেম এটাও বুঝতে পেরেছে তুরান। রুপার এই প্রবলেম টার জন্যই রুপার প্রতি ইমপ্রেসড হয়েছে তুরান। তাই এটা নিয়ে তুরানের কোন প্রকার প্রবলেম নেই। উপরন্তু তুরানের মনে হয় যে রুপার এই পাগলামি গুলোর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট কেন? থাকুক না এমন পাগলামি সারা জীবন। কিন্তু এই পাগলামির শুরুর কারন আর কবে থেকে শুরু এটা অবশ্যই জানতে হবে তুরানের। কিন্তু হসপিটালে সারাদিন দৌড়াদৌড়ির উপর আছে তুরান। রুপা বলেছিল ওর আম্মু এসেছে। তুরানের সাথে দেখা হয় নি । তুরানের ইচ্ছা ছিল রুপার মা নামক মানুষ টা কে দেখা। আর তুরান জানে রুপা ওর মা-বাবা কে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এবার বুঝি একটু চেঞ্জ হয়েছে রুপা। তাছাড়া রুপা আগের মত পাগলামিও করে না। রুপা এর আগেও অনেকবার বলেছে যে ওর আম্মু আসছিলো কিন্তু তুরানের সাথে কখনো দেখা হয় নি।
কালকে তুরানের বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। তুরানের বাবা এখন প্রায় সুস্থ। অন্যদিকে তুরানের টিউশনি, ভার্সিটি সব অফ। এ মাসে বেশ বন্ধ দিয়েছে টিউশনি। গার্ডিয়ানদের কথাও শুনতে হয়েছে, এখন আবার শুনতে হবে।
রুপার সাথে কবে যে আবার ভালোভাবে কথা হবে কে জানে? রুপা তো রাগের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে। তাছাড়া রুপা কে নাকি এখন বেশ চোখে চোখে রাখে। তুরানের বাবা-মাও এখানে তাই কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনা। তুরানের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
.
রুপার মা আজ চলে যাবে। রুপার ছোট ভাই আর ওর বাবাও এসেছে । রুপার মন এখন বিষন্নই থাকে। সব কিছু আগের মত হয়ে যায় না কেন? রুপা একটা বিষয় বুঝতে পারছে যে রুপার বাবা-মা,ভাই নামক মানুষ গুলোকে আজকাল তেমন অসহ্য লাগে না । রুপা বাবা-মা চাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য রুপা কে নিয়ে যেতে কিন্তু রুপা নারাজ। কিছুতেই এখান থেকে যাবে না। রুপার বাবা-মাও তেমন জোর করছে না। কারন তাঁরা চায় রুপা সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু না করাই ভালো।
রুপার ছোট ভাই অন্তিম বার বার কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,
-‘ বাসায় চলো না দি। কতদিন তুমি বাসায় থাকো না। তোমায় অনেক বেশি মিস করি।’
বলতে বলতে চোখ গড়িয়ে পানি পরে অন্তিমের। রুপা শুধু অপরিচিত ভঙ্গিতে তাকায়। কি বলা উচিত বুঝে উঠে পারে না। যাওয়ার সময় রুপার বাবা-মা , অন্তিম সবাই কাঁদলো। এঁদের কান্না দেখে সাহেলা বেগমও না কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলো না। রুপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের মত সব কান্ড দেখছে। এতসব কান্নাকাটির মানেই বুঝতে পারছে না আর কারনও খুঁজে পাচ্ছে না।
.
রুপার মা-বাবা চলে গেলো। রুপার মন কেন জানি বিষন্নতায় ভরে গেলো। খুব একাকিত্ব অনুভব করছে রুপা। তুরানও আগের মত সময় দিচ্ছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে রুপার, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রুপা ড্রেসিং টেবিলের কাছে রাখা ফুলদানিটা ফ্লোরে আচরে ফেললো। বিকট শব্দ গিয়ে পৌঁছেলো সাহেলা বেগমের কানে। সাহেলা বেগম দৌড়ে রুপার রুমে আসলো।রুপা কে নানা ভাবে বুঝিয়ে শান্ত করলো।
কিন্তু রাতের বেলায় ভীষণ জ্বর আসলো রুপার গায়ে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সাহেলা বেগম রুপার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। হঠাৎ এমন জ্বর আসার কারন খুঁজে পেলো না সাহেলা বেগম। রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। রুপা ঘুমাচ্ছে না শুধু জ্বরে কাঁপছে। সাহেলা বেগম রুপার মাথার কাছে বসে রইলো। আজিজ চৌধুরীও অনেকক্ষণ সজাগ ছিলো। ধৈর্য হারা হয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়লো।
সাহেলা বেগম রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম আদরে। রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লো রুপা। সাহেলা বেগম রুপার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। রুপার পুরো রুমটা অগোছালো। সাহেলা বেগম দক্ষ হাতে নিঃশব্দে রুম গোছাচ্ছে।
হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের ফাঁকে একটা টিনের বক্স চোখে পড়ে। সাহেলা বেগম কৌতুহলী মনে বাক্সটা খুলে দেখলো। কতগুলো টুকরো টুকরো কাগজ। সাহেলা বেগম কাগজ গুলো খুলে দেখতে লাগলো। সাহেলা বেগমের মাথায় যেন বাজ পড়লো। বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে ঘামতে লাগলো। ধপ করে চেয়ারে বসে পরলো।
প্রথম যে কাগজটার ভাঁজ ভাঙলো সেটায় লেখা-
‘ ভার্সিটি যাচ্ছি আমি, তুমি খেয়ে নিয়ো কিন্তু, পাগলামি করো না কোন রকম।’
সাহেলা বেগম আবার একটা কাগজের ভাঁজ ভাঙলো! সেটায় লেখা-
‘ওই কালো শাড়ি টা আর নুপুর জোড়া পরে ছাদে এসো। কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিয়ো।’
সাহেলা বেগম যেন হতবাক,নির্বুদ্ধি হয়ে যেতে লাগলো। আবার একটা কাগজের হাতে নিলো। সেটায় লেখা-
‘ মায়াময়ী আমি ভার্সিটি তে যাচ্ছি। লেট হয়ে যাচ্ছে আমার।’
সাহেলা বেগম হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরকমটা কখনো ভাবতেও পারিনি। সাহেলা বেগম ভিমড়ি খেয়ে বসে রইলো। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। রুপার বাবা-মা কে কি জবাব দিবে। তাঁরা এসব জানলে কি বলবে সাহেলা বেগম? এসব কখনো কি সম্ভব? ভুল পথে পা বাড়িয়েছে দুইজন। দুই জনের পথ এক হওয়া কখনোই সম্ভব না।
সাহেলা বেগম একে একে সবগুলো কাগজ পড়লো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। আজিজ চৌধুরী ঘুমাচ্ছে। সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে ঘুম থেকে জাগালো। হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে থ মেরে বসে রইলো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম এক গ্লাস পানি এনে আজিজ চৌধুরীর হাতে দিলো চোখে দেওয়ার জন্য। সাহেলা বেগম কে খুব বেশি অস্থির দেখাচ্ছে।
আজিজ চৌধুরী চোখে পানি দিয়ে বললো,
-‘ কি ব্যাপার ? পাগল হয়ে গেছো নাকি? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’
সাহেলা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে আজিজ চৌধুরীর পাশে বসলো। তারপর নিচু গলায় বললো,
-‘ ঘুম গেছে তোমার? জরুরি কথা ছিল?’
-‘ এত রাতে কি জরুরী কথা যে এভাবে ঘুম থেকে উঠালে? সকালে বলা যেতো না?’
খানিকটা বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম চিন্তিত গলায় বললো,
-‘না এক্ষুনি বলতে হবে। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। কি করা উচিত আমার?’
আজিজ চৌধুরী এবার বুঝতে পারলো নিশ্চয় সিরিয়ার কিছু হয়েছে। নয়ত সাহেলা বেগম এমন করতো না। আজিজ চৌধুরী নড়েচড়ে বসে বললো,
-‘ কি হয়েছে বলো? চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমায়?’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ রুপার সম্পর্ক চলে তুরানের সাথে।’
আজিজ চৌধুরীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কনফিউজড হয়ে বললো,
-‘ তোমার কিছু ভুল হচ্ছে মনে হয়। তুরানের মত মিউচুয়াল ছেলে রুপার সাথে সম্পর্কে জড়াবে? আর ওদের সাথে সম্পর্ক সম্ভব নাকি? তুরান কি জানেনা রুপা হিন্দু? আর তুরান সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে। কোন দিক থেকে ওদের সাথে যায়? তাছাড়া প্রনয়..।’
সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ উফ! চুপ করো তুমি। এসব যাওয়া না যাওয়ার হিসেব বাদ দেও। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।’
দুই জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিরবতা ভেঙে আজিজ চৌধুরী বললো,
-‘ এখন তুমি কি করতে চাচ্ছো?’
সাহেলা বেগম হতাশ হয়ে বললো,
-‘ এসব যদি পূজার কানে যায় আমি কি করবো বলো?’
আজিজ চৌধুরী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-‘ওই ছোট লোকের বাচ্চায় আর মেয়ে খুঁজে পেলো না । ব্যাচেলর ছেলে ভাড়া দেই না। ছেলেটার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে দয়া করে ভাড়া দিয়েছি। কি কান্ড টা করলো! ওরে ডেকে আনো। এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে বলো সকাল হওয়ার আগে। রাতেই সব ঝামেলার মিটমিট হয়ে যাক। রুপা কিছু জানবে না।’
আজিজ চৌধুরীর আইডিয়া টা মন্দ না। সাহেলা বেগম বললো,
-‘ কিন্তু তুরান তো বাসায় না। ওর বাবার সাথে হসপিটালে। কালকের মধ্যে ওদেরকে বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করো। আমি নয়ত ওরে পুলিশে দিবো। মানুষ সুযোগ সৎ ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক।’
তারপর দুই জন আবার চুপ করে রইলো। সাহেলা বেগমের এখনো এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। রুপা কে কত চেষ্টা করে এই পর্যায়ে এনেছে। আবার এই আঘাত কি রুপা সহ্য করতে পারবে? এসব রোগীরা এমনিতেই খুব সেনসেটিভ হয়। রুপা আবার কি পাগলামি শুরু করবে? চিন্তায় মাথায় ধরে যাচ্ছে সাহেলা বেগমের।
সেদিন যদি তুরানকে বাসা ভাড়া না দিতো তাহলে এইদিন দেখতে হতো না। সাহেলা বেগম চিৎকার করে উঠে বললো,
-‘ হসপিটালে ফোন দেও। ওদের এলাকা ছাড়তে বলো। হসপিটাল থেকেই যেন চলে যায়। ওদের সব মালামাল ঘর থেকে ফেলে দিতে বলো। ওরা যেন এই বাসার কাছে আর না আস্তে পারে সেই ব্যবস্থা করো। দরকার হলে পুলিশের সহায়তায় নেও।’
চলবে..

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_33
সকাল সকাল তুরানের ঘুম ভাঙে তুরানের মায়ের ডাকে। হসপিটালেই তুরানের বাবার পাশে আড়মোড়া হয়ে কোন রকম ভাবে ঘুমাচ্ছিলো তুরান। তুরানের মা বাসায় ছিলো। হঠাৎ হসপিটালে এসে এভাবে ঘুম কেন ভাঙালো? এই কয়দিনে খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তুরান। ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘ মা তুমি হসপিটালে আসলে কেন এই সকাল বেলা? আমি তো বাবাকে নিয়ে আরেকটু বাদে বাসায় যেতাম। দেখো বাবা এখন প্রায় সুস্থ।’
তুরানের মা এক দৃষ্টিতে তুরানের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন কথা বলছে না, দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে শুধু। মায়ের এমন অস্বাভাবিক কান্নার কারন বুঝতে পারছে না হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে। তুরান ভালো ভাবে তাকালো এবার। এমন কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। বললো,
-‘ মা কি হয়েছে কাঁদছো কেন? আরে বাবা তো সুস্থ।’
তুরান একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। তুরানের মা কান্নার কারনে কোন জবাব দিতে পারলো না। কোন রকম ভাবে কান্না থামিয়ে বললো,
-‘ হসপিটালের ওদিকে সব মালপত্র। এত কষ্ট করে এই দিন দেখার জন্য তোকে লেখাপড়া করিয়েছি? এই অপমান সহ্য করার জন্য?’
তুরান বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছে না কি হয়েছে? কিসের মালপত্র হসপিটালের সামনে? কিসের অপমান? তুরান বললো,
-‘ কান্না থামাও মা। কি হয়েছে ভালো করে না বললে কিছুই বুঝতে পারবো না।’
তুরানের গালে কষিয়ে কয়টা চড় দিলো তুরানের মা । তুরান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। তুরানের বাবার ঘুম ভেঙে যাবে তাই তুরান কে বারান্দায় আসতে বললো তুরানের মা। তুরান ধীর পায়ে মায়ের পিছু পিছু বারান্দায় গেলো। তুরানের মনে নাড়া দিলো রুপার কথা। এই নিয়ে কি কিছু হয়েছে ।
বারান্দায় গিয়ে তুরানের মা অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে বললো,
-‘সাহেলা বেগম সব মালামাল পাঠিয়ে দিয়েছে বাসার। আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে।’
তুরানের মায়ের কান্না আবার বেড়ে গেলো। তুরানের মাথায় যেন বাজ পড়লো। কি বলছে এসব ? তুরান হতবাক হয়ে গেল! স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব তাও বুঝতে পারছে না। একদম নির্বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তুরানের। সব কি শেষ হয়ে গেলো? রুপা কে নিয়ে কি কিছু হলো? তুরান নিচু গলায় বললো,
-‘মা কিসের জন্য অপমান করেছে তোমায়? মালামাল কেন পাঠিয়ে দিয়েছে? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’
তুরানের মা রক্ত বর্ন চোখে তুরানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ তোর মতো জানোয়ার পেটে ধরেছি বলে অপমান করেছে। কিছুই বুঝিস না এখন? ওই রুপা মেয়ের সাথে কিসের সম্পর্ক তোর? ‘
তুরানের মা এ পর্যায়ে আরো চেঁচিয়ে আবার বললো,
-‘কিসের সম্পর্ক?’
তুরান কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তুরানের মাথায় কিছুই খেলছে না। তুরানের বুক জুড়ে ভূমিকম্প বয়ে যেতে লাগলো। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সবই তো ঠিক ভাবে চলতে ছিলো। হতভম্ব হয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে তুরান। তুরানের মা আবার চেঁচিয়ে উঠে বললো,
-‘দেশে আর মেয়ে ছিলো না তোর জন্য? একটা বিয়াত্তা মেয়ের সাথে প্রীত করছোস?’
তুরান চোখ বড় করে তাকালো। কোন রকম ভাবে বললো,
-‘কে বিয়াত্তা? কি বলছো তুমি মা এসব? মা তোমায় কে বলছে এগুলো? মা…।’
তুরান আর কিছু বলতে পারলো না। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না। এটা কি করে সম্ভব রুপা বিবাহিতা? এমনটা কখনো হতে পারে না। কখনো না! তুরানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস হওয়ার মতো কথা না এসব। তুরানের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। তুরান কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বললো,
-‘ মা কে বিবাহিতা রুপা? মা তুমি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছো।’
-‘ আমি মিথ্যা বলছি না?’
তুরান কথা বাড়ালো না । কি থেকে কি হয়ে গেলো। সবকিছু অস্পষ্ট, সব মেঘাচ্ছন্ন। তুরান কিছুই বুঝতে পারলো না। আস্তে আস্তে ফ্লোরে বসে পড়লো। তুরানের মা মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছে।
তুরান দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো। নাকমুখ কুঁচকে বললো,
-‘মা কি হয়েছে সবটা বলো। মা আমি রুপা কে ভালোবাসি। অনেক বেশি মা। সাহেলা বেগম তোমায় অপমান করার কে? বাসা থেকে মালপত্র সব পাঠালো কেন?’
তুরান কষ্ট ভেজা কন্ঠে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলো। তুরানের মা কান্না থামিয়ে দুই চোখ ভালোভাবে মুছলো। তারপর কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
-‘খুব সকালে দরজার কড়া নাড়লো। আমি ভেবেছি তুই আর তোর বাবায় এসেছিস। আমি দরজা খুলে দেখি সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী। এত সকাল সকাল তাঁদের দেখে আমি কিছু টা চমকে গেলাম। উনাদের মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই আমি বুঝেছি কিছু একটা হয়েছে। উনারা আমায় যা ইচ্ছে তাই বলতো লাগলো। তোকে যা তা ভাষায় গালি দিতে লাগলো। বললো রুপার সাথে তোর সর্ম্পক। তোরা ভুল পথে এগোচ্ছিস। রুপা বিবাহিতা। তাই তাঁরা চায়না এ সম্পর্ক আর এক পা আগাক। যা ভুল হয়েছে এ পর্যন্ত সমাপ্ত হোক। তাই আমাদের তাঁদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে।আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । আমি কিছু বলার আগেই উনারা বাসার সব মালপত্র কুলি ডেকে বের করে দিলো। আর তুই যদি রুপার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস তাহলে তোকে পুলিশে দিবে।’
মায়ের মুখে এসব শুনে নির্বাক হয়ে রইলো তুরান। মায়ের চোখের অন্তরালে চোখের জল মুছলো। গায়ের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলল তুরান। গুলো কি হয়ে গেলো একটু সময়ের ব্যবধানে?
তুরান‌ কোন জবাব দিচ্ছে‌না। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করছে , শূন্যতা আর হতাশায় ছেয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব রঙ বোধ হয় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সব স্বপ্ন গুলো আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করছে। খানিকক্ষণের ভিতর পৃথিবী বদলে গেলো বোধ হয়। বদলে গেলো আগামীর স্বপ্ন,আশা , কল্পনা। তুরান কখনও এমন না হবে ভাবেনি। কখনোই না। রুপা বিবাহিতা কিছুতেই তুরান বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ যেন তুরানের গলা টিপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তুরানের। তুরানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছেনা। তুরান একদম নির্জীব হয়ে আর্তনাদ করে বললো,
-‘মা রুপা বিবাহিতা না বলো? বলো অন্তত এটা মিথ্যা।’
তুরানের মা হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলো। পুরো সংসারের ভরসা ছিলো তুরান। ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন বাবা-মায়ের। তুরানের মা শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। কষ্ট ভরা কন্ঠে বলল,
-‘ ভালোবাসার জন্য আর মেয়ে পেলিনা? আমাদের কথা একবারও ভাবলি না? একটা বিয়াত্তা মেয়ে! এতটা নীচ তুই! এত ছোট মনের! এত খারাপ রুচির তুই?’
তুরানের মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আবার। তুরান কোন কথা বলছে না। তুরানের মা আবার বললো,
-‘ তোর বাবা এসব জানলে শেষ হয়ে যাবে। নিজে কখনো ভালো কাপড় পরিনি তোকে লেখাপড়া করিয়েছি। কখনো ভালো বাজার করে খাই নি । তোর লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। আজ সেই তোর জন্য মানুষ কুকুরের মত অপমান করে আমায়।’
তুরানের চোখ বেঁয়ে পানি পড়ছে এবার। কোন কথা বলতে পারছে না। তুরানের মা আবার বলল,
-‘হসপিটাল থেকে তোর বাবাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবো এবার? বাসা ভাড়া পাবি কই ? থাকবি কই? খাবি কই?’
তুরানের মা আর্তনাদের বুলি বুলতে লাগলো। তুরানের অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে..! তীব্র যন্ত্রণা! সহ্য না করার মতো যন্ত্রণা!
এই যন্ত্রার চেয়ে বোধ হয় মৃত্যুতে শান্তি। বোধ শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ক্রমে ক্রমে তুরান। যেন এখনই ঢলে পড়ে যাবে।
চলবে…