যদি তুমি জানতে পর্ব-৪১

0
281

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_41
প্রায় আধা ঘন্টা ধরে তুরানের চোখ বেঁয়ে পানি পড়েই চলেছেন। তুরান ভুলে গেছে ও কোথায় আছে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো যন্ত্রণা গুলো গর্জে উঠছে। এমন একটা অতীত ছিলো রুপার! অথচ তুরান কখনো আঁচ করতেই পারেনি।
পূজা রায় ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। যেন এ কষ্ট তাঁর অনেক আগেই সয়ে গেছে। মানিয়ে নিয়েছে কষ্টের সাথে নিজেকে।
পূজা রায় তুরানের দিকে তাকিয়ে রইল নিখুঁত দৃষ্টিতে। বড্ড মায়া হচ্ছে তুরানের জন্য! কি অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে ছেলেটার পূজা রায় সেটা উপলব্ধি করতে পারছে। কিছু কিছু বিষয় উপলব্ধি করতেও পারলেও কিছু করার থাকে না।
পূজা রায় নিরবতা ভেঙে আবার বললো,
-‘তোমার নিজেকে সামলাতে অনেক বেশি সময় লাগবে জানি। দেখো সৃষ্টিকর্তাই তোমাদের ভিন্ন ভিন্ন পথে পাঠিয়েছে, এই নির্মম সত্যিটা মেনে নেওয়াই শ্রেয়। আমি তোমায় আজকে এখানে ডেকে এসব না বললেও হয়ত আমার কোন ক্ষতি হতো না কিন্তু তোমার প্রতি অন্যায় হতো। তুমি তো একটা মেধাবী, বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে তুমিই বলো তোমাদের পথ এক হওয়া সম্ভব?’
তুরান বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-‘কোন উপায় নেই এক হওয়ার?’
-‘ তোমার বিবেক কে প্রশ্ন করো। কেঁদো না! ছেলে মানুষের এভাবে কাঁদা বেমানান। আরো কিছু বিষয় আছে শোনো, রুপা এখন যে সময়টা পার করছে, জীবনের কোন একটা পর্যায়ে হয়ত এর কিছুই মনে থাকবে না। তুরান নামক মানুষ টা কে চিনবে না, সেদিন হয়ত খুব বেশি দূরে না। একজন সুস্থ, স্বাভাবিক শতরুপা শুধু প্রনয় কে ই ভালোবাসবে। আর আমি একজন মা আমি চাইবো আমার মেয়ে একটা ছেলের জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে আমার থেকে দূরে সরে যাক? নাকি তুমি শতরুপার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করবে? জানি এটা কখনোই তুমি করবে না। যাক কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাটা মূর্খতা তাই এসব নিয়ে কথা না বলি। কিন্তু ধরো একটা মিরাকেল ঘটে গেলো শতরুপা মুসলমান হয়ে গেলো , তোমার সাথে বিয়ে হলো কিন্তু কিছুদিন পর ও যদি তোমায় চিনতে না পারে? ও যে ধর্ম পরিবর্তন করেছে তাও তো ওর মনে থাকবে না তাই না? ও তো ছুটে যাবে প্রনয়নের কাছে!
তুমি অনেক সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছো, কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে এ পর্যায়ে এসেছো! আমি তোমায় ছোট করার জন্য এসব বলছি না বরংচ তোমার এই সংগ্রামী মনোভাব দেখে তোমার প্রতি শ্রদ্ধা হয় আমার। তোমার বাবা-মা এতটা কষ্ট করে কি পাবে তোমার কাছ থেকে? কত দায়িত্ব তোমার কাঁধে। সাহেলা যে তোমার মা’কে অপমান করেছে‌ কি পরিমান কষ্ট পেয়েছে তোমার মা তা জানো?
আজ তোমার উপর নির্ভর করছে কত গুলো মানুষের ভালো থাকা।’
তুরান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে পূজা রায়ের দিকে তাকায়।‌ পূজা রায় আবার বলতে শুরু করলো,
-‘ বিষয়টা হচ্ছে তুমি যদি রুপাকে এখন বলো যে তুমি বিয়ে করেছো, রুপা কে বলবা তোমায় ভুলে যেতে। আর সে জন্যই তোমায় এখানে ডেকেছি। দেখো রুপা মানসিক ভারসাম্য হীন একটা মানুষ। ওকে যদি তুমি বলো যে তুমি বিয়ে করেছো, ও যেন তোমায় ভুলে যায়! তাহলে রুপা হয়ত পাহাড় সমান তীব্র অভিমান করবে তোমার উপর! আর যদি রুপা জানে যে আমরা তোমাদের আলাদা করেছি তাহলে ও আত্মহত্যা করবে! আমি ওকে চিনি ও বড্ডো জেদি। আমার কথা গুলো খুব স্বার্থপরের মতো শুনাচ্ছে তাই না? কিন্তু এটাই বাস্তব।
যদি তুমি আমার কথা টা শুনো তাহলে রুপার মঙ্গল, তোমার পরিবারের মঙ্গল, আমাদের সবার মঙ্গল। তুমি না শুনলেও আমার খুব বেশি সমস্যা হবে না কিন্তু রুপার রাগের সাথে পেরে উঠা খুব মুশকিল হয়ে যাবে। রুপা কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি এখন! কয়দিন বাদে ওকে ট্রিটমেন্টের জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাবো, কিন্তু ও এভাবে পাগলামি করতে থাকলে কোথায়ও নেওয়া সম্ভব না! তাই তোমায় ডেকেছি এখানে। তোমার এই হেল্প টুকু আমার খুব প্রয়োজন। আর কতটা কষ্ট সহ্য করবে ও বলো?’
কি প্রত্যুত্তর করবে তুরান? তুরানের আত্মত্যাগ করতে হবে! সকলের কথা ভেবে নিজের ভালোবাসা বলি দিতে হবে। এছাড়া এর সমাধান কি হতে পারে? ভালোবাসা ত্যাগ করতে হবে! ইস কি অসহ্য যন্ত্রণা! মৃত্যুর যন্ত্রণা কি এর থেকে বেশী? ভালোবাসার মানুষ টা কে সারা জীবনের জন্য ত্যাগ করতে হবে। আর কখনো এই মুখটা দেখার সুযোগ হবেনা। কখনো না.. কখনোই না! কি নির্মম সত্যি! জীবনের কোন একটা সময়ে রুপার মনেই থাকবে না তুরান নামে কাউকে! জীবনে কোন এক সময়ে রুপার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে রাস্তায়,বাসে কিংবা মার্কেটে দেখা হলেও রুপা চিনতে পারবে না তুরান কে! কি বিশ্রী রকমের বাস্তবতা।
আত্মহত্যা মহাপাপ কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পাপ- পূন্যের হিসেব করা যায়? পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে! বাস্তবতার শিকলে আবদ্ধ তুরান! মুক্তি নেই এই যন্ত্রণা থেকে।
তুরান কে নিরুত্তর দেখে পূজা রায় আবার বললো,
-‘কি করবে তুমি এখন বলো? ভালোবাসার মানুষটা কে এভাবে হারিয়ে ফেলা খুব কষ্টের। না পাওয়ার যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে সারা জীবন। কিন্তু বিয়েই কি প্রেমের পূর্ণতা বলো? যত প্রেমের ইতিহাস রচিত হয়েছে আজ অবধি তা তো সব ভালোবাসার মানুষটা কে না পাওয়ায় গল্পে রচিত । সকলের মঙ্গলে জন্য ভালোবাসা ত্যাগ করাটা ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পাওয়ার থেকে কম কিসে? তুমি ভাবো পুরো বিষয়টা ঠান্ডা মাথায়। আমি যা বলেছি তার থেকে ভালো সমাধান পাবে না কারন সমীকরণ টা খুব জটিল।’ এমন জটিল সমীকরণের সমাধান ভালোবাসার মানুষ টা কে ভুলে যাওয়া। একজন সুস্থ, স্বাভাবিক শতরুপা তো শুধু প্রনয় কে ই ভালোবাসবে। কি করা উচিত তুরানের তা স্বচ্ছ কাঁচের মত স্পষ্ট! কিন্তু উচিত কাজ টা করা তো খুব দুর্বিষহ।
এত কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে প্রচন্ড রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে তুরানের। তুরানের এই জটিল সমীকরণ থেকে পালিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আগের দিন গুলো ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে! এগুলো যেন স্বপ্নের মত নিছক হয়ে যায়। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব?
ভিতর থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছে তুরানের। ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে অনেক মানুষ কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু এভাবে ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা যায়? এভাবে কি কেউ কখনো হারিয়েছে তাঁর মানুষ টা কে?
সব বাঁধা, ব্যবধান, বিপত্তি মিরাকেল মতো শেষ হয়ে যাক! কিন্তু তা কি হবে কখনো?
তুরান আচমকা পূজা রায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। হাত জোড় করে বলে,
-‘প্লীজ কিছু একটা করুন। আমি রুপা কে ছাড়া বাঁচতে পারবো না.. কিছুতেই না। এই সত্য, এই বাস্তব সব মিছে হয়ে যাক।’
পূজা রায় চেয়ার থেকে উঠে পা সরিয়ে নেয়। তুরান এমন টা করবে বুঝতে পারে নি। সাহেলা বেগম হাঁ করে তাকিয়ে রইল
চলবে..