যদি তুমি জানতে পর্ব-৩৪+৩৫

0
346

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_34
তুরানের বাবাকে সবটা বললো তুরানের মা। তুরানের বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো তুরানের দিকে। হতাশা আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুরান মাথা নিচু করে বসে রইলো। তুরান কিছু ভাবতে পারছে, আর কিছু বুঝতেও পারছে না। তুরানের বুকে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। রুপার কথা ভেবে অসহ্য যন্ত্রণা , বুকফাটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে যেতে লাগলো তুরান। তুরানের বাবা-মা কেউই বুঝছে না তুরানের এই কষ্ট। কেউ বুঝার মত কষ্ট না এটা। সবার চোখে রুপার সাথে প্রেম টা অপরাধ। প্রেম কি এত ভেবে হয়। তুরান নিজের মনকে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না রুপা বিবাহিতা। এটা কি করে সম্ভব? সাহেলা বেগম হয়ত মিথ্যা বলছে, তবুও তুরানের মন মানছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের ফ্যামিলির কথা ভেবে আরও বেশি কষ্টে পুড়ছে তুরান। এ কষ্ট সহ্য করার মত না। কাউকে বুঝানোর মতোও না। কেউ বুঝতে চাইবে না এই কষ্ট। তুরানের বাবা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুরানের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়তে। মা-বাবার এমন কষ্ট, হতাশা, স্বপ্ন ভাঙ্গার ভয় দেখে তুরানের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, যে অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। তুরান কখনো চায় নি ওর জন্য ওর বাবা-মা কোন রকম কষ্ট পাক। কোন রকম অপমান সহ্য করুর। তাঁদের প্রাপ্য কষ্ট কিংবা অপমান নয়। তাঁদের ভালোবাসা, সম্মান , শান্তি প্রাপ্য। তুরানের বাবা-মায়ের এমন চুপচাপ ভঙ্গি তুরানের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, আরো বেশি অপরাধ বোধ হচ্ছে তুরানের। রুমের নিরবতা ভেঙ্গে তুরানের বাবা বললো,
-‘এই দিন দেখার জন্য আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছে?’
আবার কিছুক্ষণ পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে,
-‘আরে আর মেয়ে পেলি না প্রেম করার জন্য? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে তুই। তোর জন্য তোর বাবা-মায়ের কেন অপমানিত হতে হবে? তোকে কেন মানুষ কুকুরের মত বাসা থেকে বের করে দিবে? একটা বিবাহিতা মেয়ের সাথে কেন সম্পর্কে জড়ালি? এতটা বিবেক,বুদ্ধিহীন তুরান।’
তুরানের বাবার বলা প্রতিটি কথা তুরানের বুকে আঘাত করছে। প্রতিটি কথা যেন কষ্টে জর্জরিত,হতাশা মিশ্রিত। তুরান একদম নিচু গলায় বললো,
-‘বাবা রুপা বিবাহিতা না। মিথ্যা সব। রুপা অনেক ভালো মেয়ে। সাহেলা বেগম মিথ্যা বলেছে।’
তুরানের বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘আচ্ছা মেয়ে যাই হোক। আমায় একটা কথা বল ওই মেয়ে কি এমন হয়ে গেছে যে সাহেলা বেগম এত গ্যাঞ্জাম করলো? কিসে পড়ে ওই মেয়ে? কোন ভার্সিটি তে পড়ে? তোর যোগ্য ওই মেয়ে? মানুষের শুধু টাকা থাকলেই হয় যোগ্যতা লাগে না? মাথায় সমস্যা পাগল কোথাকার!’
তুরানের বাবা কিছুক্ষণ ভেবে আবার বললো,
-‘তুই কি জানতি না রুপা বিবাহিতা? প্রেম করছিস আর এটা জানিস না মেয়ে বিবাহিতা নাকি অবিবাহিত? মেয়ে কোন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে? ওই মেয়ের ফ্যামিলির কাউকেও চিনিস না তুই!হাস্যকর না এটা!’
তুরান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রুপার লেখাপড়া সম্পর্কে কখনো জানার তেমন আগ্রহ হয় নি রুপার। কখনো রুপার যোগ্যতা ,রুপার ফ্যামিলি এটা নিয়ে ভাবে নি। আর রুপা বিবাহিতা এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছে সাহেলা বেগম। একদম যুক্তিহীন কথা এটা! এতগুলো মাস এক ছাদের নিচে ছিলো কখনোও তো এমনটা শুনেনি। রুপার ভালোবাসার ব্যাপারে সন্দেহ নেই তুরানের। কত সহজ-সরল রুপা! এই বিষয় নিয়ে ভাবতে কেমন জানি কষ্টের মাঝেও হাসি পাচ্ছে তুরানের। ভালোবাসার মেয়েটা নাকি বিবাহিতা! কেমন হাস্যকর আর যুক্তিহীন কথা।
তুরান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর তুরানের বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আমায় ক্ষমা করো। আমি কখনো চাইনি যে আমার জন্য তোমরা কোন রকম অপমানের সম্মুখীন হও। আমি সব সময় তোমাদের কষ্টের প্রতিদান দিতে চেয়েছি। জীবনে ভালো কিছু করে তোমাদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছি। এত কিছুর ভিতরও আমি একটা ভুল করে ফেললাম। হ্যাঁ.. তোমাদের চোখে যেটা খুব ভুল। রুপার সাথে সম্পর্কে জড়ানোটা। কিন্তু এখন আমি নিরুপায়। আমার কিছুই করার নেই। ভালোবাসার মানুষ কে ভুলে যাওয়া এত সহজ। তোমরা আমার বাবা-মা তোমরা আমার বন্ধু। তাই তোমাদের বললাম এসব। আশা করব আমায় বুঝার চেষ্টা করবা। তোমরা এত বেশি কঠোর হবে না।’
তুরান কথা শেষ করে তুরানের বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো দুই জনই কাঁদছে। তুরানের আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সন্তানের ভুলের কারনে যদি বাবা-মায়ের চোখে পানি আসে, এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে? তুরানের বাবা নিজেকে সামলিয়ে বললো,
-‘আচ্ছা এখন তুই কি করতে চাস সেটা বল। যা হওয়ার হয়েছে। এটা নিয়ে পড়ে থেকে লাভ কি? ধরলাম সাহেলা বেগম মিথ্যা বলেছে। কিন্তু তারপর এখন কি করবি তুই?’
তুরানের বাবা সবকিছুতে সাপোর্ট দিয়েছে তুরান কে। ভালো কিছু করলে আরো উৎসাহিত করেছে, ভুল কিছু করলে শুধরে দিয়েছে। তুরান জানে আজকে তুরানের বাবা খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে তবুও বরাবরের মত সাপোর্ট দিচ্ছে তুরান কে, বুঝতে চেষ্টা করছে।
তুরান ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আমি এখন সাহেলা বেগমের কাছে যাবো। জিজ্ঞেস করবো উনাকে সব। কিসের জন্য এত সিন ক্রিয়েট করেছে উনি? আর যে করেই হোক রুপা কে আমার করবোই। আমায় তোমরা একটু বোঝার চেষ্টা করো দয়া করে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে,আমি ভালো কিছু করবো। রুপার জন্য আমার তোমাদের স্বপ্ন পূরণে কোন ব্যাঘাত ঘটবে না।’
তুরানের বাবা-মা দুজনই চুপ করে রইলো। হঠাৎ তুরানের মনে পড়লো আজ হসপিটাল থেকে তুরানের বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে? কোথায় পাবে বাসা? তুরানের চিন্তা আরো বেড়ে গেলো। তুরানের বাবা বললো,
-‘আচ্ছা যা তুই সাহেলা বেগমের বাসায় । আমাদের সমস্যা নেই। শুধু তোর যেন কোন ক্ষতি না হয়।’
তুরানের মা এ ব্যাপারে নারাজ। কিছুতেই তুরান কে যেতে দিবে না সাহেলা বেগমের বাসায়। তু্রানের মা তুরান কে আরেকবার মনে করিয়ে দিলো যে সাহেলা বেগম বলেছে তুরান যদি রুপার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাহলে তুরান কে পুলিশে দিবে এসব ভাবতেই তুরানের মায়ের বুক কেঁপে উঠে।‌‌‌‌ এসব শুনে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলো তুরান। কি মূর্খ মানুষ! পুলিশের ভয় দেখায়।
তুরান অনেকভাবে তুরানের মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাথে তুরানের বাবাও। অবশেষে তুরানের মা রাজি হলো। তুরান যেন একটু স্বস্তি পেলো।
তুরানের বাবা বললো,
-‘হসপিটাল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবো বল? বাসা তো আর পাবিনা একদিনের ভিতর। গ্রামের বাড়ি চলো যাবো আমরা। তুই কষ্ট করে বাসের টিকিট কিনে নিয়ে আসিস। আর ইচ্ছে হলে তুইও চল। নয়ত থাকবি কোথায়?’
তুরানের বাবার কথা গুলোয় অভিমানে আবাস পেলো তুরান। কিন্তু রুপার কথা ভেবে শেষ হয়ে যাচ্ছে তুরান। নিরুপায় হয়ে পড়েছে। তুরান অপরাধীর মতো বললো,
-‘তোমাদের কোথায়ও যেতে হবে না। তোমরা এখানে থাকো। আমি একটু পর আসবো তোমাদের নিতে। বাসা ম্যানেজ করে ফেলবো চিন্তা করো না।’
তুরান হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো। এতক্ষণ বাবা-মায়ের সামনে চেপে রাখা কষ্ট গুলো এখন উঁকি দিচ্ছে। তুরানের মন কিছুতেই মানছে না রুপা বিবাহিতা! তুরান বিশ্বাস করছে না । তবুও মনের কোন এক কোণে উঁকি দিচ্ছে এ নিয়ে শঙ্কা। তুরানের চোখের কোণে জল জমছে বার বার। ছেলেদের কান্না একদম বেমানান! তাই বার বার কান্না থামিয়ে রাখার যথা সাধ্য চেষ্টা করছে।
তুরান এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্য সাহেলা বেগমের বাসা। তুরানের বুকের ভিতর টা বার বার মোচড় দিয়ে উঠছে। ভালোই তো কাটছিলো দিন গুলো! হঠাৎ কেন এমন এলোমেলো হয়ে গেলো? নিমিষেই সব বদলে গেলো? আর সাহেলা বেগম ই বা কি করে জানলো ওদের সম্পর্কের কথা? এরকম হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তুরানের মনে। রুপা কেমন আছে? রুপা কি কষ্ট পাচ্ছে না? রুপার মুখটা বার বার ভেসে আসছে তুরানের চোখের সামনে। তুরান নিজেকে সামলাতে পারছে না।‌‌‌ রুপা কে যদি সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলে? এসব ভাবতে ভাবতেই কেঁপে উঠে তুরানের পৃথিবী।
হসপিটাল থেকে হেঁটে কিছু দূরে এসে রিকশা নিলো তুরান। নিস্তেজ ভঙ্গিতে বসে রইলো রিকশায়। একটার পর একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তুরানের মনে। প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে তুরান। প্রত্যেক টা প্রশ্ন তুরানের কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সাহেলা বেগমের বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামালো তুরান।
বাড়িটার দিকে তাকাতেই তুরানের চোখ আরও ভিজে যেতে লাগলো। এই তো সেই পরিচিত বাড়ি! তুরানের চোখ পড়ল সেই বারান্দায়! যেখানে রুপা দাঁড়িয়ে থাকত। আজ রুপা দাঁড়িয়ে নেই। কি করছে রুপা এখন?
তুরান কে দেখেই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো দারোয়ান। তুরান ধীর পায়ে দারোয়ানের দিকে গেলো।
-‘স্যার আপনার মালপত্র সব পাঠাই দিলো যে? কোন ঝামেলা হইছে কি?’
তুরান এসব প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বললো,
-‘আমার একটু সাহেলা বেগমের সাথে দেখা করতে হবে।’
-‘ তাঁরা তো বাসায় নেই। কই যেন গেছো।’
তুরান এমন টার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না । নিজেকে সামলে বললো,
-‘কোথায় গেছে? আপনার পায়ে পড়ি আমায় একটু বলুন। নাকি মিথ্যা বলছেন?’
তুরানের মুখ থেকে এমন অনুরোধ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো দারোয়ান।
-‘মিথ্যা বলমু ক্যা? আপনে বাসায় গিয়ে দেখেন। উনার বাসায় থাকে ওই মাইয়া টা অসুস্থ হাসপাতালে গেছে মনে হয়।’
চলবে…

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_35
দারোয়ানের কাছে রুপার অসুস্থতার কথা শুনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিল তুরান। কিছু সময়ের ব্যবধানে সব ওলটপালট হয়ে গেলো, সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে তুরানের যেন এখুনি ঘুম টা ভেঙে যাবে। দারোয়ানের কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না তুরান। শেষ পর্যন্ত গেটের ভিতরে ঢুকলো। কত পরিচিত সব কিছু! এই সেই বারান্দা যেখানে রুপা দাঁড়িয়ে থাকত। তুরানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। বুকের ভিতরের কষ্ট গুলো আরো প্রকট হচ্ছে ক্রমশ। আজিজ চৌধুরীর বাসার মেইন গেটে বড়সড় একটা তালা ঝুলানো। তুরান বার বার তাকাচ্ছে বাসাটার দিকে,
স্মৃতি বিজড়িত প্রত্যেক টা জায়গা। তুরানের চিৎকার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুরান এলোমেলো পায়ে গেটের বাইরে চলে আসলো। ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে পিছনে। কিছুদূর গিয়ে তুরান আবার ফিরে আসলো। এসে দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলো,
-‘রুপা‌ কে কেন হসপিটালে নেওয়া হয়েছে ?কোন হসপিটালে নেওয়া হয়েছে ?’
দারোয়ানের এক ফালি হেসে বললো,
-‘জানি না বাবা কিছুই।’
দারোয়ানের হাসির মানে খুঁজে পেলো না তুরান। তবে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসির মানুষ টা কেও কুৎসিত লাগবে।
তুরান পুনরায় হতাশ হলো, আশাহত হয়ে ফিরে গেলো।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল রুপা কে দিশেহারা হয়ে খুঁজছে তুরান। দুই চোখ যে দিকে যায় সেদিকেই রুপা কে খুঁজে বেড়ায় তুরান। তুরান জানে রুপা কে এসব জায়গায় থেকে লাভ নেই, তবুও অবচেতন মনে খুঁজতে লাগলো।
তুরানের হঠাৎ মনে হলো বাবা-মায়ের কথা। সকাল হসপিটাল ছাড়ার কথা ছিলো, এখন দুপুর হয়ে গেলো। পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভুলে ছিলো এতক্ষণ তুরান। এপর্যায়ে আরেকটা চিন্তা এসে জড়ো হলো তুরানের মাথায় তা হলো এই মুহূর্তে বাসা পাবে কই?মাসের মাঝামাঝি সময় এখন। বাবা-মা কে নিয়ে কোথায় যাবে এখন? চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে তুরানের। এমন সিচুয়েশন ফেস করার জন্য তুরান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রুপা। জ্বরের চোটে হুঁশ নেই। জ্বর এখনও কমেনি। জ্বরে বেহুঁশ রুপা এখনো জানেই না যে তাঁর ভালোবাসার মানুষটার সাথে কত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। জানবেও বা কেমনে? জ্বরের জন্য চোখ মেলেই তাকাতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সাহেলা বেগমও রুপা কে এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। রুপার বাবা-মাও আসছে হসপিটালে। সাহেলা বেগমের মুখে চিন্তার ছাপ। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে সাহেলা বেগমের। রুপার বাবা-মা সাহেলা বেগমের প্রতি আস্থা রেখে রুপা কে সাহেলা বেগমের বাসায় রেখেছিলো চিকিৎসার জন্য। আর এখন যদি রুপার বাবা-মা তুরান আর রুপার সম্পর্কের কথা জানে তাহলে সাহেলা বেগম কিভাবে মুখ দেখাবে রুপার বাবা-মা কে? রুপার জীবনে কত যে একটা কালো অধ্যায় আছে! সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছে না আজও রুপা। তার উপর বিপরীত ধর্মের দুই জন মানুষ আর রুপাকে এতটা ভালোবাসে প্রনয়! সেখানে সাহেলা বেগম কি করে তুরান কে সায় দিবে? সায় দিলেই কি এই সম্পর্ক সম্ভব? সাহেলা বেগম জানে তুরান যথেষ্ট ভালো মানুষ হিসেবে! কিন্তু রুপা আর তুরানের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেই সাহেলা বেগম হিংস্র হয়ে উঠে। কত চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত রুপা কে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার জন্য , হাজার হোক রুপা সাহেলা বেগমের পেশেন্ট। আর এমন একটা পরিস্থিতি তে বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়েছে রুপা আর তুরানের সম্পর্ক। রুপার জীবন থেকে তুরান কে সরিয়ে দিলে আবার কত শত পাগলামি করে রুপা কে জানে? এরকম একটার পর একটা এক্সিডেন্ট রুপার লাইফে ঘটতে থাকলে মেয়েটি কিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে? সে কি আদৌ সম্ভব? সব বিপদ কি রুপার জন্যই?
এপর্যায়ে খুব বেশি বিরক্ত হয়ে গেছে সাহেলা বেগম। সাহেলা বেগমের এখন মনে হচ্ছে রুপার দায়িত্ব নিয়ে ভুল করেছেন। তুরানের মত একটা মিউচুয়াল ছেলে কিভাবে রুপার সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারলো?
তুরান কি জানে না রুপা হিন্দু? এত কষ্ট করে তিলে তিলে রুপা কে সুস্থ করে তুলছে আর সেখানে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা! সাহেলা বেগমের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।
সাহেলা বেগম কে এভাবে আনমনে বসে থাকতে দেখে আজিজ চৌধুরী এগিয়ে গেলো সাহেলা বেগমের দিকে।
সাহেলা বেগমের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রুপার বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। ব্যাচেলর ছেলেদের এজন্যই বাসা ভাড়া দিতে নেই।
আজিজ চৌধুরী গিয়ে সাহেলা বেগমের পাশে বসলো। আজিজ চৌধুরীর উপস্থিতি টের পেলো সাহেলা বেগম।
-‘এত কি ভাবছো শুনি?’
সাহেলা বেগম মুখ তুলে তাকালো আজিজ চৌধুরীর দিকে। ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো,
-‘কই কিছু না তো।’
-‘অত ভাবাভাবির কাজ নেই আমাদের আর। যাঁদের মেয়ে তাঁদের কাছে দিয়ে দেও।’
আজিজ চৌধুরী একটু থেমে আবার বললো,
-‘মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে একদম রুপা তাই না? দুনিয়াধারির কিছুই বুঝেনা! প্রেমটা তো ভালোই বুঝে। জাতে পাগল তালে ঠিক!’
সাহেলা বেগম এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘এত চেঁচামেচি করেছো কেন? আস্তে কথা বলো এটা হসপিটাল! তাছাড়া রুপার বাবা-মা এখানে, শুনে ফেলবে ওরা। আর স্বার্থপরের মত কথা বলছো? মেয়েটার জীবনে যা ঘটেছে তাতে মানসিক ভারসাম্য হারানো অস্বাভাবিক কিছু না। রুপা যদি তোমার মেয়ে হতো?’
-‘ সব সময় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবা না। ওর জীবনে যা হয়েছে সত্যিই দুঃখজনক। তাই বলে অন্যের মেয়ের গ্লানি আমরা আর কতদিন বয়ে বেড়াবো? আচ্ছা মানলাম ওর সমস্ত দায়িত্ব আমরা পালন করবো! এর মানে এই না ওর জন্য আমাদের মান-সম্মান‌ নষ্ট করবো।’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘তোমার এই আজাইরা প্যাঁচাল আমার শুনতে ভালো লাগছে না সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো?’
-‘এগুলো আজাইরা প্যাঁচাল না? আচ্ছা রুপা তো আমাদের মেয়ের মত। আনফরচুনেটলি রুপার সাথে তুরানের সম্পর্ক হয়ে গেছে , মনে করো আমরা রুপা কে গাইডলাইন দিয়ে ঠিকমতো রাখতে পারি নি এটা আমাদের ফল্ট। কিন্তু এই সম্পর্কের কথা যদি রুপার বাবা-মা জানে তবে আমাদের দিকে আঙুল তুলে দোষারোপ করতে ভাববে না একবার। আমরা তাঁদের মেয়ের জন্য কি করেছি কি না করেছি সেটাও ভাববে না। দুনিয়াটা বড্ডো স্বার্থপর।’
-‘ প্যাঁচিয়ে গ্যাচিয়ে কথা না বলে সোজাসুজি বলো কি বলতে চাও? রুপা কে ওর বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দিবো এটা চাও?’
-‘এছাড়া আর উপায় কি? রুপা যখন সুস্থ হয়ে তুরানের কথা জিজ্ঞেস করবে তখন কি করবে? ওকে ওর বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দেও,কারো কাছে এসব জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাবে না । আর আমাদের জিজ্ঞেস করলে বললো তুরান বাসা ছেড়ে চলে গেছে আমরা কিছুই জানি না।’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-‘হুম।’
-‘ আমরা তুরানের প্রতি রাগের বশে যা করেছি তা অন্যায়।’
সাহেলা বেগম অগ্নিচোখে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তুরানকে যদি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতাম তাহলে কি ও বুঝতো? কখনোই বুঝতো না। হয়ত রুপাকে নিয়ে পালিয়ে যেতো। তাই যা হয়েছে রুপার জন্যও ভালো হয়েছে তুরানের জন্যও ভালো হয়েছে।’
চলবে..