যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-১০+১১

0
378

যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: দশ|

“ মিষ্টিকে তো খুব পছন্দ হয়েছে। আমার কোনো সমস্যা নেই, অন্তিক।”

সাংঘাতিক কথা, পছন্দ হয়েছে মানে? শেষে মোল্লা বাড়ির দুই ছেলের বউ একসাথে হতে হবে তাকে? মিষ্টির অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। পিয়াস যে অন্তিকের চাচাতো ভাই জানলে সে কখনোই পিয়াসকে সাহায্য করতো না। পিয়াস মিষ্টির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মিষ্টিকে ধাঁধায় রেখে সে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। অন্তিকের কোনো হেলদোল নেই। বড়ো ভাই বিয়ে করেনি কিন্তু সে ছোট হয়ে বিয়ে করে ফেলেছে ভেবেই লজ্জায় মাথা নীচু করে রেখেছে। পিয়াস খুব রশিক ধরণের মানুষ। দুজনের লজ্জাজনক পরিস্থিতি দেখে উচ্চ স্বরে হেসে বলতে শুরু করে, “ ছোট ভাইয়ের বউ হিসেবে মিষ্টিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু একটাই আফসোস, আমার এখনো কোনো হিল্লে হলো না।”

মিষ্টির বুকের উপর থেকে যেন বড়ো একটি পাথর নেমে গেলো। সে মনে মনে বলল, জীবনে আর কখনো অপরিচিতদের সাহায্য করব না। শেষে দেখা যাবে ভবিষ্যতে আমার সন্তানাদির শ্বশুর শাশুড়ি বের হয়ে যাবে।
অন্তিক এবার মুখ খুলল, “ মিষ্টি মেয়েটাকে অপছন্দ করার কোনো অপশন নেই ভাই!”

“ বাব্বাহ, বাবু দেখি দুই তিনদিনে অন্তরে অন্তস্তল থেকে বউকে ভালোবেসে ফেলেছে। তা কী খাইয়ে তোকে বউ পাগল বানালো রে, অন্তিক?”

মিষ্টি হালকা বিষম খেয়ে উলটো দিকে দৌড় লাগালো। পিয়াস যা রসিকতা শুরু করেছে,শেষে মিষ্টির মান সম্মান নিয়েও টানাটানি শুরু করে দিবে। অন্তিক উত্তর দেয়, “ পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অর্ধেক হয়েছিলাম তার, যখন তাকে মনের গহীনে জায়গা দিয়েছি তখন পুরোপুরি হয়েছি তার!”

পিয়াস ভাইয়ের বাহ্যিকদিক পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হয়। মনেপ্রাণে মিষ্টিকে ধন্যবাদ জানায়। অন্তিক কিছু একটা ভেবে পিয়াসকে প্রশ্ন করল, “ তুমি মিষ্টিকে পূর্ব থেকে চিনতে? মিষ্টির ছবি তো আমি তোমাকে পাঠাইনি।”
” হ্যাঁ চিনি।”
পিয়াসের স্বাভাবিক উত্তর। এদিকে অন্তিকের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার মনের গহীনে উঁকি দেয় সন্দেহের উৎপত্তি। অন্তিক অহ বলে চেপে যায়। পিয়াস তখন ফোনে মগ্ন ছিল অন্তিকের মন খারাপের দিকটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে হয়তো আজ সন্দেহ নামক বিষক্রিয়া থেকে দুই মন রক্ষা পেত।

রাতের খাবারের ঘরে হৈ হুল্লোড় পরিবেশ। নাজিমউদ্দীন দুই নাতিকে কাছে পেয়ে গল্প জুড়ে বসেছেন। মিষ্টি খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছিল। লায়লা বেগম এতোদিন পর ছেলেকে পেয়ে দিশেহারা। মিষ্টির পিছুলাগা ভুলে তাকে আদেশ করছে এটা সেটা পিয়াসের দিকে এগিয়ে দিতে। মিষ্টি বিনা বাক্যে খাবার এগিয়ে দেয়। পিয়াস মিষ্টির সাজানো গোছানো সংসারের কাজকর্ম দেখে খুশি হয়ে বলে, “ বাব্বাহ, কতো পার্ফেক্ট কাজ করছো মিষ্টি? তা কীভাবে এতো গুছিয়ে কাজ শিখলে?”

অন্তিকের কেন যেন মিষ্টির ব্যাপারে পিয়াসের এতো আগ্রহ পছন্দ হলো না। মিষ্টির ব্যাপারে তার আগে কেন পিয়াস জেনেছে এই ভেবে নাকি অন্য কারণে তা বোধগম্য হচ্ছে না। সে বিনাবাক্যে খাবার খেয়েই যাচ্ছে। কলি আজ অন্তিকের পাশটায় জায়গা পায়নি। মিষ্টি ঘাপটি মেরে বসে নিজেও খাচ্ছে সবাইকে বেড়ে খাওয়াচ্ছেও। তার ভাইয়ের মিষ্টির ব্যপারে কথা বলা আদিখ্যেতা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। সে লায়লার কানে ফিসফিস করে বলে, “ ভাইয়াকে কী খাইয়ে বড়ো করেছো, মা! আমার, তোমার আমাদের সবার বিপরীত ভাইয়া। দেখছো কীভাবে মিষ্টির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আমার তো ঐ মেয়েকে দেখলেই শরীর জ্বলতে শুরু করে।”

লায়লা বেগম মেয়ের কথা শুনে সকলের দিকে তাকিয়ে হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, “ ছেলে কার মতো হয়েছে জানি না। তবে বাড়ি ফিরে এসেছে সেটাই অনেক। সুযোগ পেলে এমন হুমকি দেব! দেখবি হুড়মুড় করে সে আমাদের দলে চলে এসেছে।”

“ খাইতে বসছো নাকি রাজ্যের সকল আলাপ জুড়ে বসছো? এত কথা কী কও বউমা! তোমাদের মা মেয়ের জন্যই আমার নাতি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসেছে শুকরিয়া আদায় না করে ফুসুরফুসুর করা শুরু করছে তারা।”

শ্বশুরের ধমকে চুপসে যায় লায়লা বেগম। খাবার খেয়ে বিনা বাক্যে ঘরে চলে গেলেন।

গভীররাত পর্যন্ত নাজিমউদ্দীন অন্তিক ও পিয়াসের সাথে গল্প করেন। অন্তিক ঘরে ফিরে এসে মিষ্টিকে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। অন্তিকের ঘরের বারান্দাটা কখনো খোলা হয় না। পুরোনো বাড়ির এই ঘরটার বারান্দায় ছোট নয়তো সব ঘরের বারান্দা বড়ো বড়ো। লায়লা বেগমের হাতে সংসার বসার পর থেকে অন্তিককে এই ঘরে পাঠানো হয়। পিয়াস অন্যায় সহ্য করতে পারতো না। লায়লা বেগমের অন্তিকের ব্যাপারে উদাসিনতা দেখে একসময় অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। প্রায় তিন বছর যাবত পিয়াস বাড়ি ছেড়ে থাকে। পেশায় কলেজের প্রফেসর। কলেজের কোয়াটারেই থাকে সে। ছোট ভাইয়ের বিয়ের সংবাদ শুনেই বাড়ি এসেছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি ও পিয়াসের কথা ভাবছিল সে। এই না সে সব ছুঁড়ে মিষ্টির কাছে সুখ খুঁজে পেয়েছে? যেই মিষ্টির হাসিতে সে পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেই মিষ্টির মবে কী পূর্বে অন্য কেউ ছিল! পরক্ষণে অন্তিক ভাবে, এমন তো হওয়ারই ছিল। অন্তিকের জীবনের সত্যিটা জানলে তো মিষ্টি এমনিই চলে যেত। তখন সে কষ্ট বেশি পেত। এখন হয়তো কম হচ্ছে! অন্তিকের ভাবনার মাঝেই একজোড়া হাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। অন্তিক জানে হাতজোড়ার মালিক কে! সে পিছনে না ফিরেই বলে, “ ঘুমিয়ে যাও, আমার একটু দেরী হবে।”

মিষ্টি অন্তিকের কথা শুনে বুঝতে পারে কোনো কারণে তার মন খারাপ। সে অন্তিকের পিঠে পরপর দুই তিনটে চুমু এঁকে বলে, “ তোমার কী মন খারাপ?”
“ না।”
“ একা দাঁড়িয়ে আছো যে? ঘরে চলো, তোমার বুকের বাম পাশটার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করছে।”

অন্তিকের কী হলো জানে না। মিষ্টির হাত ঝাড়া দিয়ে তার দিকে ফিরে বলতে শুরু করে, “ আমার ইচ্ছে করছে না, বুঝতে পারছো না? এতো মায়া দেখিয়ে সেই তো চলেই যাবে তবে কেন আমার মনটাকে রাঙাতে আসছো। দূরে সরো, আমাকে একা থাকতে দাও।”

অন্তিকের ব্যবহারে মিষ্টির চোখে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। সে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ এত জোরে কথা বলছো কেন অন্তু? আমার কোনো ভুল হলে বলো সংশোধন করে নিব। একজন মেয়ে বিয়ের পর স্বামীকেই আপন ভাবে। তুৃমি আমাকে কষ্ট দিলে আমার সইতে পারব না, ম’রেই যাব।”

মিষ্টির চোখের পানি অন্তিকের সহ্য হয় না। সে চোখ বন্ধ করে রাখ সংযত করার চেষ্টা করে পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিষ্টি তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে একজন বুদ্ধিমতি মেয়ে। স্বামীর হুটহাট রাগে তার উপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বিনা দোষে অন্তিকের উচ্চ আওয়াজের কথা তার সহ্য হয় না। অন্তরে আঘাত হানে চোখ বেয়ে অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে। মিষ্টি কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে অন্তিকের ব্যাবহারের মূল কারণটার ব্যাপারে।পরিশেষে বুঝতে পেরে নিজেই রেগে বসে। অন্তিককে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার হাতে জোরে কামড় বসিয়ে দেয় সে।আকস্মিক আক্রমণের জন্য অন্তিক মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে মিষ্টিকে বাঁধা দিতে চেষ্টা করে কিন্তু মেয়েটা যেন তার হাতের সাথে আঠার মতো লেগে আছে। অবশেষে মেয়ের সবচেয়ে দুর্বল স্থান অর্থাৎ মিষ্টির মাথার চুলের মুঠোয় হাত দেয় অন্তিক।মিষ্টিকে ছাড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “ রাক্ষসের নানীর ভুত কী চেপেছে? কামড়াচ্ছো কেন?”

মিষ্টি রাগে হিসহিস করছে। অন্তিকের হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এসে তার উপর চড়ে বসে বুকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি দিয়ে বলতে থাকে, “ পিয়াস ভাইয়াকে আমি পছন্দ করি না হাঁদারাম গাধা। না পিয়াস ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে। তোমার মাথায় কী বুদ্ধি নাই? এই আমাকে বিশ্বাস করলে। তুমিই না বলেছিলে আমাদের মধ্যে বিশ্বাস সবচেয়ে দরকারী! এই আমার উপর তোমার বিশ্বাস! তুমি খুব খারাপ অন্তু,খুব খারাপ।”

পিয়াসের সাথে মিষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। এই কথাই অন্তিকের জন্য যথেষ্ট ছিল। মিষ্টিকে সে বিশ্বাস করে কিন্তু হঠাৎ করে মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। এখন তাও পরিষ্কার। এছাড়াও তারা কীভাবে পূর্ব পরিচিত তা জানতে হবে। কিন্তু প্রথমে তার হিংস্র বাঘিনীকে থামাতে হবে। অন্তিক খুব ভালোভাবেই জানে মিষ্টিকে কীভাবে থামাতে হবে।
“ হয়েছে তো! এবার থামো মিষ্টি। আমার হাত জ্বলছে, বুকের উপর পাথর চেপে আছে মনে হচ্ছে।”

মিষ্টি থামে না। সে অন্তিককে একটার পর একটা আঘাত করছে। শেষে অন্তিক কোনো উপায় না পেয়ে মিষ্টির ঠোঁট জোড়া দখল করে নেয় অন্তিক। মিষ্টির আবেদনময়ী স্থানে ঘুরতে থাকে অন্তিকের হাতজোড়া। মিষ্টিকে আজ নিজের করে নিতে বড্ড ইচ্ছে করছে তার। মিষ্টির রসালো ঠোঁটে শক্ত করে চুমু এঁকে অস্থিরচিত্তে অন্তিক বলে, “ মাথা ঠিক ছিল না বউ! একাকীত্ব আমাকে জা’নো’য়া’রে পরিনত করে ফেলেছে। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও!”

মিষ্টি অন্তিকের কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলে, “ তোমার উচ্চ আওয়াজ আমার সহ্য হয় না, অন্তু! ভেতরটা জ্বালিয়ে দেয়। আমাকে তোমার বুকের বাম পাশটায় জায়গা দিও তাতেই হবে।”

অন্তিক মিষ্টির কপালে চুমু এঁকে আবদার করে, “ একটু বউ সাজবে মিষ্টি?”

মিষ্টি বিস্তর হেসে বলে, “ এখনই?”

“ হ্যাঁ, লাল টকটকে শাড়ির সাথে তোমাকে দেখতে চাই। লাল গোলাপের স্থান তোমার ঐ চুলে দিতে চাই। লাল চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে মাতাল হতে চাই। তোমার শুদ্ধতাময়ী জীবনে অশুদ্ধতা ছড়িয়ে দিতে চাই।”

মিষ্টি অন্তিকের গাল ধরে বলে, “ এতো আবদার!”

অন্তিক হেসে বলে, “ এ তো অল্প! আমার বিশার মনের আবদারও বিশাল। যা তুমিই পূরণ করতে পারবে।”

মিষ্টি অন্তিকের বুকে মুখ গুঁজে। কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল তার সাজানো সংসার গড়ার আগেই ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন সে সাজবে, অন্তিকের জন্য বউ সাজবে।

—————————-

লাল শাড়ি পরিধান করে বিছানায় ঘোমটা টেনে বসে আছে নব বঁধু। পুরো ঘর মোমবাতি দিয়ে সাজানো। রোমাঞ্চকর পরিবেশেষে অন্তিকের রোমান্টিক মনোভাব। মিষ্টিকে আজ কীভাবে মেনে নিবে! তার নব বঁধু আজ কীভাবে সেজেছে? প্রথমদিনের মতো ভারী সাজ! নাকি হালকা কাজল ও ফ্যাকাসে বর্ণ ঠোঁটে হাজির হয়েছে। অবশ্য অন্তিকের কাছে মিষ্টির ফ্যাকাসে ঠোঁটের স্বাদ বিশ্বের সকল মিষ্টান্ন স্বাদের চেয়ে সেরা মনে হয়। অন্তিক বাহিরে গিয়েছিল গোলাপের মালা কিনে আনতে। ফিরতে কী বেশি দেরি হয়ে গেছে? ঘরে প্রবেশ করে নব বঁধুর সমনের দিক থেকে ঘোমটা খোলার পরিবর্তে গোলাপের মালা খোঁপায় গুঁজে দিতে ইচ্ছে পোষণ করে সে। সে পিছনে ফিরে ঘোমটা সরাতে নিতেই মিষ্টির উচ্চস্বর ভেসে আসে কানে। দরজার কাছটায় মিষ্টি অবাকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।অন্তিক একবার দরজার দিকে তো একবার তার সামনে বসা মূর্তি মানবীর দিকে তাকায়। অবাক হয়ে বলে, “ তুমি সেখানে থাকলে এখানে কে?”

সাথে সাথে অন্তিকের সামনে বসে থাকা কলি মাথার ঘোমটা সড়িয়ে পিছনে ফিরে অন্তিককে জড়িয়ে ধরে বলে, “ আমাকে তোমার করে নাও, অন্তিক ভাই! দেখো আজ তোমার জন্য আমি বউ সেজেছি।”

অন্তিক শুকনো ঢুক গিলে মিষ্টির দিকে তাকায়। তার হিংস্র বাঘিনী আবারও ক্ষেপে যাচ্ছে। কলি বাঁশের ফলির কিছু না হলেও অন্তিকের আজ রফাদফা হয়ে যাবে ভাবতেই মনে দুঃখের গান বাজছে।

চলবে………….

যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: এগারো|

মিষ্টির রাগ ঊর্ধ্বে। এ রাগ নিবারক ঔষধি নেই। অন্তিকও আজ ভীতু ছানা মিষ্টির রাগের সামনে। মিষ্টি পাকেরঘরে দুধ গরম করতে গিয়েছিল। ঘরের সাজসজ্জাকরণ তারই করা। অন্তিকের অসহায়ত্ব নয়নও তার নজরে আসছে না। সে রাগে গর্জে উঠে, “ তোর মতো নির্লজ্জ মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি, কলি ক্যাকটাস গালের ফলি।”

কলিকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে অন্তিক দাঁড়িয়ে পড়ে। কলির আজকের সাজসজ্জা নতুন নয়। অন্তিকের বিয়ের আগেও প্রায়শই রজনীতে সেজেগুজে তার ঘরে বসে থাকতো। কোনোদিন অন্তিক বুঝতে পেরে নিচে বাবার সাথে ঘুমাতে যেত আবার কোনদিন কলিকে দুই চারটে কথা শুনিয়ে ঘর থেকে বের করে দিত। কলির বেহায়াপনা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিল তাই হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্তিক ভেবেছিল বিয়ের পর কলি ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমানিত হয় আজকের কলির কাজে। সে মিষ্টির মতো গর্জে ওঠে, “ কথা বলছিস না কেন? তোর এখানে কী কলি?”

কলি এবার মুখ খুলে। অন্তিকের দিকে তাকিয়ে বলে,“ আমার তোমাকে চাই, অন্তিক ভাই! তুমি আমাকে বিয়ে করে নাও না!”

অন্তিকের চোখ লালচে রূপ ধারণ করেছে সে কলির গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে বলতে শুরু করে, ” তোর মাথা ঠিক আছে? ভাই বোন নামক সুন্দর সম্পর্ককে তোর জন্য নষ্ট করেছি তা জানিস? আমি একা ছিলাম, তোকে আর পিয়াস ভাইয়াকে ভাইবোন ভাবতাম কিন্তু তুই! এই সম্পর্কটা নষ্ট করেছিস। বুঝদার হয়েও অবুঝের মতো কাজ করছিস। তোর মাথায় আমাকে পাওয়ার লোভ! আমি কী কোনো পন্য? পৃথিবীতে আম ছাড়া আর কোনো ছেলে নাই? আমাকে ভাই ভাবলে কী এমন হতো! তোকে আপন বোনের মতো আদর করেছি সর্বদাই। এখনও সময় আছে কলি, ভালো হয়ে যা। পূর্বে যা করেছিস তা সংশোধন করে সঠিকপথে ফিরে আয়। ভাই বোন নামক সুন্দর সম্পর্ককে হাসি মজা খেলায় রূপান্তর করিস না।”

কলি কী বুঝেছে জানা না গেলেও মিষ্টির রাগ এই মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে। সে ভাবছে, মানুষটা এত সুন্দর করে বুঝাতে পারে! কলি অন্তিকের দিকে ক্রন্দনরত অবস্থায় তাকিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে নিয়ে মিষ্টিকে দেখে থেমে যায়। মুখশ্রী তার রক্তিম চোখজোড়ায় কঠোরতার ভরপুর। মিষ্টির উদ্দেশ্যে বলে, “ এই কলি তোকে কখনো অন্তিকের হতে দিবে না।”

কলি চলে যেতেই মিষ্টি অন্তিকের দিকে এগিয়ে আসে।হাতের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলে, ” কয়লা যেমন হাজারবার ধুয়ে মুছলেও পরিষ্কার হয় না তেমনি তোমার বোন ও চাচী কখনো ভালো হবে না, অন্তু।”

অন্তিক ভাবনায় পড়ে। তার মা চলে যাওয়ার পর থেকে কাউকে পাশে পায়নি। চাচী সর্বক্ষণ ভয় ও হুমকির মধ্যে রাখতো। সেও চাচীকে মানতো বলেই মীরবে সব সহ্য করতো। কিন্তু কেন সব সহ্য করতো? তার পাশে কেউ ছিল না বলে? একাকীত্ব তাকে অন্ধকার কালকুটুরীতে আবদ্ধ করে রেখে তার মনকেও ভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছে। মিষ্টি অন্তিকের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্তিকের কাঁধে হাত রেখে বলে, “ ভয়কে জয় করতে শিখো,অন্তু! আপনজনের মাঝের শত্রুকে প্রশ্রয় দিও না। তুমি দুর্বল হলে অপরপক্ষ সারাজীবন তোমাকে ডুবাতে থাকবে, একসময় তুমিও তলিয়ে যাবে।”

অন্তিক মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, “ তুমি কেন আরো আগে আমার জীবনে আসলে না, মিষ্টু!”

——————————-

লায়লা বেগম রাগে গড়গড় করছেন। তার কারণ কলি। সকালে থেকেই মেয়েটা বিনা কারণে উলটা পালটা কাজ করছে। যেই মেয়ে কখনো কাপড় ভাজ করা তো দূরের কথা ধুয়েও দেখে না সে আজ নিজের কাপড়ের সাথে সাথে লায়লা বেগমের কাপড়ও ভিজিয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই বলছে, “ মায়ের কাজ করলে কী ক্ষতি হয়?”
লায়লা বেগমের বুঝে আসছে না তিনার অকার্যকরী মেয়ে কীভাবে কর্মঠ হয়ে গেল। নির্বোধ মেয়েটাকে এনেছে সে মিষ্টিকে তাড়ানোর জন্য কিন্তু তার মেয়ে কি না পাগলামি করছে!

মিষ্টি এই পথেই যাচ্ছিল, মা মেয়ের অবস্থা দেখে পেট চেপে হাসতে শুরু করে। কাছে এসে শুধায়, “ কাজ করলে হাত পা, শরীরের সাথে মনও পরিস্কার হয়ে যায়। চাচী আপনিও হাত লাগান, কলি বাঁশের ফলির কষ্ট হচ্ছে তো!”

লায়লা বেগম রাগে ঝাড়ি দেয় মিষ্টিকে, “ অসভ্য মেয়ে, যাও এখান থেকে।”

মিষ্টি হাসতে হাসতে চলে যেতে নিতেই পিছন থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পায়। মিষ্টি পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায়, লায়লা বেগমকে বাথরুমে পড়ে আছে। কলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরাধবোধ মুখশ্রীতে ছেঁয়ে আছে তার। মিষ্টি দৌঁড়ে গিয়ে লায়লা বেগমকে ধরে। কলির মায়ের দিকে তাকালে মায়ের শয়তানী হাসি নজরে আসে। কলিও মায়ের হাসির তালে হেসে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে,“ ও আল্লাহ গো! কে কোথায় আছো! নতুন ভাবী মাকে মে’রে ফেলছে গো!”

কায়েস ও পিয়াস বাড়িতেই ছিল। কলির চিৎকার শুনে এসে দেখতে পায়, মিষ্টির কোলে লায়লা বেগম শায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। পিয়াস ও কায়েসকে দেখে গলার স্বর আরো বাড়িয়ে আহাজারি করতে থাকে, “ দেখো চাচা, দেখো ভাইয়া, মা নতুন ভাবীকে বলেছিল শুধু আমার সাথে কাপড়গুলো রোদে দিতে। ভাবী কাজ করতে না চাইলে সুন্দর করেই বলতো তা না করে মাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিছে। ও আমার কী হবে গো! মা ও মা চোখ খুলো মা!”

কলির আহাজারি শুনে মিষ্টি ভ্রু যুগল কুঁচকে কলির দিকে তাকায়। তার চেহারায় ভয়, চিন্তা কিছুই নেই। অপরাধীরা অপরাধ করলে মুখশ্রী দেখে ধরা পড়ে যায় মিষ্টি মুখশ্রী দর্শন করলে অপরাধের কোনো আলামত পাওয়া যাবে না। পিয়াস মাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জ্ঞান ফিরাতে চেষ্টা করতে থাকে তখন কলি আবারও বলতে শুরু করে,“ ভাবীকে মা কতো আদর করতো! আর ভাবী কী করল, মাকে মে’রে ফেলতে চাইলো; ও ভাবী তোমার মনটা কী একটুও পোড়ায়নি?

কলির কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিষ্টি শান্ত স্বরে বলে, “ অপরাধীরা অপরাধ করে সবসময় অন্যের উপরই দোষ চাপিয়ে দেয়। চাচীর মতো পালোয়ান মহিলাকে আমার মতো শুঁটকি কী ধাক্কা দিতে পারবে?”

মিষ্টির কথাটা হাস্যকর শোনা গেলেও ভুল বলেনি। কায়েস নিজেও জানে, মিষ্টি এরূপ কাজ কখনোই করতে পারে না। লায়লা বেগমের স্বভাব সম্পর্কে অবগত আছে তার। নিজের সার্থ হাসিল করার জন্য কতোটা নিচে নামতে পারে তাও জানা আছে। কলির আহাজারি থামছেই না একসময় পিয়াস জোরে ধমক দেয় কলিকে।
” তোর ম’রা কান্না বন্ধ করবি, কলি? মায়ের কিছু হয়নি, ভয়ে অজ্ঞান হয়েছে মাত্র। আমি ফার্মেসির নুরুলকে ডেকে নিয়ে আসি।”

পিয়াস চলে যেতেই কলি তেড়েমেড়ে আসে মিষ্টির দিকে। মিষ্টির হাত ধরে জমিনে ফেলে দেয় সে। কিড়মিড় করে বলতে শুরু করে,” আমার অন্তিককে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস, তোর জীবন আমি নরক করে ছাড়বো।”

মিষ্টির রাগ হয়। শরীর কাঁপুনির মতো রাগ। কায়েস তখন সামনেই ছিল। শ্বশুর বাবাকে উপেক্ষা করে মিষ্টি উঠে কলির হাত মুচড়ে ধরে বলে, “ মিথ্যা অভিযোগ এই মিষ্টি পছন্দ করে না। দোষ আমার হলে অবশ্যই স্বীকার করব ক্ষতিপূরণও দিব। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ছড়ালে তোমাকে শেষ করে দিব কলি বাঁশের ফলি।”

কলিকে ফেলে মিষ্টি হনহনিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে আসে। অন্তিক অফিসে সকালেই গেছে। এই মুহূর্তে ফোন করা ঠিক মনে হয়না তার কাছে। সে মোল্লা বাড়ির পিছনের জামরুল গাছের আড়ালে গিয়ে কান্না সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করে। আমরা মেয়েরা সাধারণত কোমল হৃদয়ের হয়ে থাকি। যতোই লোকজনের সামনে নিজেকে সাহসী অথবা শক্ত করতে চেষ্টা করি না কেন। দিনশেষে আমাদের কোমলপ্রাণ গলে নরম হয়ে যায়। পুরো পৃথিবীর সামনে সাহসী সাজলেও আড়ালে নিজেকে একাই মনে হয়।মিষ্টির ক্ষেত্রেও তাই! গোটা একটা পরিবারের সামনে সে সাহসী নারী কিন্তু অন্তরস্থ তো তার কোমল, নমনীয়! সেও চায় একটু আদর, একটু সোহাগের। কেউ তাকে মা বলে ডাকুক, কেউ তার মাথায় হাত রাখুক। বাবা মা ছাড়া একাকী সে নিজের ও অন্তিকের জন্য লড়াই করেই যাচ্ছে দিনের পর দিন। আজকের ঘটনায় মিষ্টির মনকে অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে দুর্বল করে তুলেছে। এই মুহূর্তে তার একজন আপনজন প্রয়োজন যার বুকে মাথা গুঁজলে সে শান্তি পাবে।

সময় তার যায় পার হতে থাকে। কতোটা সময় মিষ্টি সেভাবে ছিল জানা নেই। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চেতনা ফিরে আসে। বিপরীত মানুষটাকে কলি মনে করে আঘাত করতে গেলেই অন্তিকের মুখশ্রী দেখতে পায় সে। সময় বিনষ্ট না করে মিষ্টি অন্তিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। মনের যতো দুখ যাতনা এই বুকে মাথা রেখেই মুর্ছে নেয় সে। অন্তিক মিষ্টির কান্নার আওয়াজ পেয়ে বিচলিত হয়ে যায়। মিষ্টি পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে। মিষ্টি শান্ত হয় না। অগত্যা অন্তিক মিষ্টিকে পাঁজা কোলে তুলে এক জায়গায় গিয়ে বসে। অন্তিকের বুকের সাথে মিষ্টি তখনো লেপ্টে। পর পর মিষ্টির মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি কিছু সময় পর শান্ত হয়, অন্তিকের কাছ থেকে দূরে সরতপ নিতেই বাঁধা প্রদান করে সে। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট কণ্ঠস্বরে বলে, “ আজ যা যা ঘটেছে, সব আমাকে জানাও। একটা কথাও গোপন করবে না বলে দিলাম।”

অন্তিকের এরূপ আচরণের সাথে মিষ্টি পূর্ব পরিচিত। সে পুরো ঘটনা জানায়।অন্তিক তখন রাগে কাঁপছে।যেই কাজ তার করার কথা ছিল তা মিষ্টি করছে এবং কষ্টও পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সে রাগ সংবরণের চেষ্টা করে। মিষ্টির কপালে চুমু এঁকে বলে,” আমার জীবনের একটি বিশেষ সত্যি চাচী জানে বলে এতদিন চুপ ছিলাম। অন্যায় না করেও নত হতাম। আজ মনে হচ্ছে, এসব করে চাচীকে সুযোগ করে দিয়েছিলাম এতদিন। আর না, তোমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায় চাচী এবং কলিকে শাস্তি পেতেই হবে।”

মিষ্টি হতবিহ্বল দুর্বল দৃষ্টিতে অন্তিককে পর্যবেক্ষণ করে।সে মনে মনে ভাবে, ” মানুষটা কী তার সেই ভোলা ভালা, গাধা স্বামী, যাকে ভালোবেসে সে বিয়ে করেছে? একদিনে এতোটা পরিবর্তন হলো কীভাবে?”

চলবে………………..