#যদি_হঠাৎ_ইচ্ছে_হয়
#শেষ_পর্ব
#Saji_Afroz
রাদিন মালা পরাতে এগুলে দিশা কয়েক পা পেছনে সরায়। রাদিন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে ও বলল, পানি খাব।
এই বলে সেখান থেকে সরে অন্যদিকে আসে। রাদিনের বন্ধু পানির বোতল এগিয়ে দেয় ওর দিকে। দিশা ঢকঢক করে পানি পান করে। এমন কেন লাগছে ওর! মনে হচ্ছে অনেক বড়ো ভুল ও করতে যাচ্ছে। ও তো এমন ছিল না! কিসের নেশায় এমন হয়ে গেল ও? রাদিনের? কিন্তু রাদিন ওকে ঠকিয়েছে জানার পর ওর প্রতি কোনো ভালোবাসা কাজ করে না দিশার। তবে কী শুধুমাত্র আরাম আয়েশের জীবনের জন্য রাদিনকে ওর প্রয়োজন? তাই তো! কিন্তু এটা করতে গিয়ে আইরার যে বড়ো ক্ষতি ও করে ফেলছে। এর শাস্তি যদি প্রকৃতি ওকে দেয়! আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। রাদিনকে ওর অনাগত সন্তানের কথা না জানিয়ে অন্যায় করছে দিশা। আর এর শাস্তি যদি দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয় ওকে!
-হলো তোমার?
দিশা ধীরপায়ে রাদিনের কাছে আসলো। এই মুহুর্তে এসে বুকের মাঝে এমন ঝড় বয়ে যাবে ভাবেনি কখনো। সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে দিশা। জানিয়ে দেবে রাদিনকে ওর বাচ্চার কথা?
রাদিনের ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে ও বলল, মা আজ এতবার ফোনকল দিচ্ছে কেন! ফোনটাই বন্ধ করে দেব।
দিশা ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, আরে দেখোই তো কী বলছেন! হতে পারে জরুরি।
আসলে দিশা আরও কিছুক্ষণ সময় চাচ্ছিলো বিয়ের আগে। তাই সময় কাটাতে না চাইতেও রাদিনের মা এর ফোন রিসিভ করতে বলল। রাদিন না চাইলে দিশাই ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকার করে। ওপাশ থেকে হাসিনা খান রেগেমেগে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
রাদিন আমতাআমতা করে বলল, বলো না মা কী বলবে?
-আমি দাদী হতে চলেছি সেই খবর আছে?
একথা শুনে চমকায় দিশা। হাসিনা খান জেনে গেছে বিষয়টা! কিন্তু রাদিন কিছু বুঝতে পারে না। ও অবাক হয়ে বলল, বুঝলাম না!
-আরে আইরা আমার সামনেই। ও প্রেগন্যান্ট।
রাদিন বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে গিয়ে বলল, কীসব বলছ মা?
-তুমি যেখানে আছ এখনিই বাসায় আসো। আর ওই দিশাকে জানিয়ে দাও ওকে বিয়েটা তুমি করবে না।
দিশার দিকে তাকিয়ে রাদিন বলল, এটা সম্ভব না মা।
-তবে তোমাকে আমরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করব। সবকিছু লিখে দেব তোমার সন্তানের নামে। তোমার মতো ছেলে আমাদের দরকার নেই। নাতী বা নাতনী তো চলেই আসবে বংশধর হিসেবে! কী করবে এখন তুমিই ভাবো।
এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেন হাসিনা খান। রাদিন পড়ে যায় ভাবনায়।
এসব শুনে কাজি সাহেব বেশ রেগে যান। রাদিনের আগে বিয়ে হয়েছে জেনে এই বিয়েটা করাতে তিনি নারাজ। তাকে সামাল দিতে ওরা সবাই অফিসের বাইরে চলে আসে।
রাদিন ও দিশা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের বন্ধুরা অন্য কোথাও যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ওদের থামিয়ে দিশার কাছে আসে রাদিন।
রাদিন বলল, মা বাবা ছাড়া তোমাকে কোটি টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি কী এটা জেনেও আমায় বিয়ে করতে চাও?
-আমার জন্য তুমি কী সব ত্যাগ করতে পারবে?
ভাবনায় পড়ে যায় রাদিন। ও আমতাআমতা করে বলল, তোমার সিদ্ধান্ত জানাও!
দৃঢ় কণ্ঠে দিশা বলল, সব সম্পত্তি আইরার বাচ্চার হবে এটা মানতে পারবে?
-তুমি পারবে?
দু’জনেই থমকে যায়। রাদিনের কপালের ভাজ দেখে দিশার বুঝতে বাকি রইলো না, আইরার মতো সেও রাদিনের মোহ। দিশার কাছেও রাদিন তাই!
দিশার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। এতদিন স্বপ্নের জগতে ভাসছিল ও। স্বপ্নটাকে এতটাই আপন করে নিয়েছিল যে, অন্যের ক্ষতি হয়ে যাবে এটা ভাবেনি। লোভ মানুষকে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই পরিবর্তন করতে পারে।
ভাগ্যিস হাসিনা খানের ফোনকলটা এসেছিল! এখন দিশার কাছে সবটা হয়ে গেছে অনেক সহজতর। একটা অনাগত সন্তানের সঙ্গে অন্যায় করা থেকে ও মুক্তি পেল ও ভাবতেই মুখে হাসি ফোটে।
দিশা বলল, বাড়ি ফিরে যাও। তোমার অনাগত সন্তান ও বউ অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। ওদের নিয়ে নতুন করে সব শুরু করো।
এই বলে পিছপা হয় দিশা। আশ্চর্য! রাদিন ওকে আঁটকায় না। ও ভাবে, শূন্য পকেটে এই পৃথিবীতে টিকে থাকা অনেক কঠিন। আর দিশার কাছেও টাকা ছাড়া রাদিন মূল্যহীন। তার চেয়ে বরং নিজের পরিবারের কাছেই ফিরে যাক ও।
যে যার মতো ফিরে যায়। রাদিন বাসায় এসে আইরাকে দেখতে পায়। ও আইরার কাছে আসতেই হাসিনা খান বললেন, সিদ্ধান্ত জানা?
রাদিন মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, সন্তান ও আইরার দায়িত্ব আমি নেব৷
এই বলে আইরার দিকে ও হাত বাড়ায়। আইরাও নিজের হাত এগিয়ে দেয় রাদিনের দিকে। উপস্থিত সকলে বেশ খুশি হোন। তবে মিথ্যে হাসি রয়েছে রাদিন ও আইরার মুখে৷ এ ক’টা দিনে ফুয়াদকে পছন্দ করে বসেছে আইরা৷ পছন্দের মানুষের জন্য সবটা করা যায় এই নীতিতেই বিশ্বাস করে ও। তাই তো আজ ওর খুশির জন্য ফিরে এসেছে রাদিনের কাছে। হাতটা রাদিনের দিকে এগিয়ে দিলেও মনটা পড়ে আছে ফুয়াদের মাঝে।
একই অবস্থা রাদিনেরও।
হাসিনা খান বললেন, আইরা? তুমি এখন থেকেই থাকো।
-আমার বাসার কেউ কিছু জানে না। তাদের জানাতে হবে। আরেকটা অনুরোধ! প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টা তাদের আমি জানাতে চাচ্ছি না। রাদিনকে পছন্দ করার বিষয়টা জানিয়েই চলে আসব আমি।
-যেমনটা তুমি বলো।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আইরা বাড়ি আসে। পথিমধ্যে ফোনকলে এসব ফুয়াদকে জানায় ও৷ ফুয়াদ শুনে খুশি হয় যে, রাদিন আইরাকে মেনে নিয়েছে।
আইরা বাসায় এসেই সবাইকে ডাকলো। সবার উদ্দেশ্যে ও জানায়, বিয়েটা করা ওর পক্ষে সম্ভব না। সবাই বেশ অবাক হয়। একথা শুনে আনতারা বলল, দেখছ মা! আমি জানতাম এই মেয়ের পেটে শয়তানি আছে।
আলেয়া খাতুন বললেন, শেষ মুহুর্তে এসব কী বলছিস আইরা?
আনিয়া বলল, চুপ কেন করে আছিস? কেন করতে পারবি না বিয়ে?
-কারণ আমি গোপনে একজন কে বিয়ে করেছি আগেই।
একথা শুনে শব্দ করে কান্না করে ফেললেন আলেয়া খাতুন। আনতারা মারতে আসে আইরাকে। তখনি ওর হাত ধরে ফেলে ফুয়াদ। ওকে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে আনতারা বলল, একদম ভুল সময়ে এসেছ তুমি।
-ঠিক সময়ে এসেছি। আমি সবটা জানি।
আলেয়া খাতুন কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, ফুয়াদের মতো ছেলে কোথায় পাবি তুই?
সবটা লুকিয়ে ফুয়াদ বলল, আরও ভালো পেয়েছে। ছেলেটা অনেক বড়ো ঘরের। কোটি টাকার মালিক। আইরাকে ও পছন্দ করেই বিয়ে করে৷ একটু মনোমালিন্য হয় ওদের৷ কিন্তু যখনই শুনেছে আইরা এতটাই অভিমান করেছে যে ওকে ছাড়তে চায় তখনিই সে ফিরে এসেছে। আইরাকে ছাড়তে চায় না ও।
আনতারা বলল, তবে গোপন কেন রেখেছিল বিয়েটা?
-রাদিনের বাসার জন্য। ওদের ইচ্ছে ছিল ধনী পরিবারের মেয়ে পুত্রবধূ হিসেবে আনবে। তবে এখন সব ঠিকঠাক। তারাও সব মেনে নিয়েছে।
আলেয়া খাতুন বললেন, সত্যি?
-জি। আর রাগ করবেন না।
আনিয়া বলল, কিন্তু আপনার সাথে যে খারাপ হলো!
-এ কদিনে আইরার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো আমার। আমি রাগ করিনি।
আলেয়া খাতুন ফুয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। সবাই শান্ত হলে ফুয়াদ বিদায় জানিয়ে বের হয়। গেইটের ধারে আসতেই আইরার কণ্ঠস্বর শুনে থামে ও। পেছনে ফিরে বলল, কিছু বলবে?
ফুয়াদকে যেতে দিতে ইচ্ছে হয় না আইরার। খাটি একটা মানুষ হারাচ্ছে ভেবে বুক ফেটে কান্না পায় ওর। কেন যে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের বিষয়টা পরিবারের উপরেই ছাড়লো না!
ও নিজেকে সামলে বলল, এইবার আপনি দিশাকে মনের কথা বলে দিন। নতুবা অন্য রাদিন চলে আসবে।
ফুয়াদ হেসে বলল, ভাগ্য সহায় হয় কি না দেখি! তোমার জন্য শুভ কমানা।
-বিয়ের কেনাকাটা গুলো ফেরত নিতে বলতে এলাম।
-এসব উপহার হিসেবেই রেখে দাও।
এই বলে ফুয়াদ ফিরে আসে নিজের বাসায়৷ ওর মা আলেয়া খাতুনের কাছে ফোনে সব শুনেছে। তিনি ফুয়াদের কাছে এসে বললেন, নিজের পছন্দে বউ আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে নাকি বিবাহিতা। এত বড়ো ধোকা! কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছি আলেয়া কে।
-এসব করো না মা৷ ভুল মানুষই করে।
-এখন তোর কী হবে এখন?
-ভালো কিছুই হবে।
এই বলে নিজের রুমে আসে ফুয়াদ। ওর ফোন বেজে উঠে। দিশার ফোনকল! ও রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দিশা ওকে ধন্যবাদ জানায়। আর বলল, অনেক বড়ো ভুল করা থেকে বেঁচে গেলাম। আমি কখন যে এতটা খারাপ হয়ে গেলাম বুঝতেও পারিনি।
-তুমি মোটেও খারাপ নও। সবচেয়ে ভালো মেয়ে তুমি।
-আপনার চোখেও যে বেশ খারাপ আমি তা জানি।
-একদমই নয়।
-মুখে বলছেন।
-অন্তর থেকে।
-শুধুই শান্তনা।
ফুয়াদ একটু থেমে বলল, ভালো না হলে এতটা চাইতাম না তোমায়।
দিশা অবাক হয়। ও বলল, মানে?
-পছন্দ তো করি অনেক আগে থেকেই তোমায়। বলা হয়নি।
দিশা থতমত খেয়ে বলল, রাখছি আমি।
-দিশা?
-হু?
-যদি হঠাৎ ইচ্ছে হয়, আমার কাছে এসো। আছি তোমার অপেক্ষায়।
এই বলে ফোন রাখে ফুয়াদ। দিশা পড়ে যায় ভাবনায়। কখনো বুঝেইনি, ফুয়াদ ওকে ভালোবাসে!
এক বছর পর…
সেই ঘটনার পর নিজেকে গোছাতে সময় নেয় দিশা। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত হুটহাট ভাবে নেবে না ঠিক করে।
এদিকে ফুয়াদ শান্ত এক মানুষ থেকে হয়ে উঠে পাগল প্রেমিক। দিশাকে নিজের করে পেতে ওর মন জয় করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে ও। দিশার জন্মদিনে রাত বারোটায় এসে ওর বাড়ির পেছনে উপহার রেখে যাওয়া, হুটহাট ফুচকা পার্সেল পাঠানো, বৃষ্টির দিনে ওর সঙ্গে ভেজার আহবান জানানো, রিকশায় সারা শহর ঘুরে বেড়ানো সাধ্যমতো সবটাই করেছে ফুয়াদ। দিশার সাথে কোনো সম্পর্ক ওর নেই। বন্ধু হয়ে দু’জন এতদিন রেখেছে সম্পর্ক।
দিশা বুঝতে পারে, টাকাতেই সব সুখ হয় না। মানুষটা ভালোবাসার হলে, যেকোনো মুহুর্তই সুন্দর লাগে। কই! ওর একবারের জন্যেও রিকশায় বসে কারের জন্য দু:খ লাগেনি! ফুচকা খাওয়ার সময় বার্গারের কথা মনে হয়নি। ফুয়াদের সঙ্গে প্রতিটা মুহুর্ত উপভোগ করেছে ও। বাকিটা জীবনও এমন কাটলে মন্দ হয় না।
এই ভেবে ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে আসে দিশা। ফুয়াদ বলল, আজ তুমি দেখা করতে বললে? না মানে সবসময় আমিই তো বিরক্ত করি তোমায়।
-ভাবছি এখন থেকে আমিই বিরক্ত করব তোমাকে।
ফুয়াদ খেয়াল করলো, দিশা এই প্রথম ওকে তুমি করে বলছে। ও মৃদু হেসে বলল, তুমি করে বললে?
-কারণ আমি তোমার সেই তুমিটা হতে চাই। আর তোমাকে আমার সেই তুমিটা করতে চাই।
-কোন তুমি?
-যে তুমি হলে হঠাৎ ইচ্ছে করলে নয়, সর্বদা একজন আরেকজনের পাশে থাকবে।
এই বলে নিজের হাতটা ফুয়াদের দিকে এগিয়ে দেয় দিশা। ফুয়াদ সেই হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে৷ আজ ওর অপেক্ষা শেষ হলো। নিজের ভালোবাসা কে পেল নিজের করে!
.
সমাপ্ত