মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০১

0
221

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-১
©Farhana_Yesmin

আমি ডিভোর্সি তকমা গায়ে লাগাবো না বলে পাঁচ বছরের সংসার ফেলে রাতের আঁধারে পালিয়েছিলাম। তখন সবে মাত্র আমার ডাক্তারি ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে। লোকে ভালো ডাক্তার হিসেবে আমাকে চিনতে শুরু করেছে। আমার চেম্বারের বাইরে লোকের ভীড় জমতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই জীবনের সবচেয়ে বাজে আর হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমাকে। যেই আমি স্বামী সংসার ছেড়ে দূরে যাব না বলে বিসিএস এর চেষ্টা করিনি কখনো সেই আমাকেই কিনা প্রিয়তম স্বামী আর সংসার ফেলে পালাতে হয়েছিল। এইজন্য হয়তো বলে, জীবনে কোন কিছুই স্থির না বরং সর্বদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনটা বলে কয়ে আসবে না। তবে যখন আসবে তখন মেনে নিয়। যত তাড়াতাড়ি মানবে তত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারবে জীবনে। আমি মেনে নিয়েছিলাম কিনা কিংবা কতোটা মেনে নিয়েছিলাম জানি না তবে জীবনে এগিয়ে গেছি অনেক পথ। অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে কষ্ট বেশি করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও পাঁচ বছরে আমার উন্নতি ইর্ষনীয় রকমের। আমার হারানো ডাক্তারি ক্যারিয়ার আবার ফিরে পেয়েছি। চেম্বারের বাইরে পুরনো সময়ের চেয়ে বেশি ভীড় লেগে থাকে। লোকে আমাকে চিনে সন্মান দেয়। পার্থক্য এই যে শুধু স্হানটা পরিবর্তন হয়েছে।

আমার এই ইর্ষনীয় উন্নতির কারনেই হয়তো আজ পূনরায় আমার অতীত আমার সামনে বসে আছে। প্রথমবার দেখে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি এটা সম্ভব না। সুদূর রাজধানী থেকে এতদূর আসবে কেন সে? ঢাকায় কি ডাক্তারের অভাব হয়েছে? এ শহরে তার পরিচিত কেউ থাকে বলেও মনে পড়ে না। তাহলে কি কারণে এখানে আসবে। এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ চমকে যাওয়া আমি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের চশমাটা আরেকটু এঁটে নিয়ে প্যাডে কলম ধরে প্রশ্ন করি-“নাম?”
“মনোয়ারা আজিম।”
নাম শুনে দুই সেকেন্ডের জন্য কলম থেমে গেলো। নিজেকে প্রবোধ দিয়ে আবার জানতে চাইলাম-“বয়স?”
“৫৬।”
“কি সমস্যা আপনার? সমস্যা বলুন।”
“পেটে ব্যাথা। খুব ব্যাথা করে। খেতে পারি না ঘুমাতে পারি না অসহনীয় ব্যাথার জ্বালায়।”
আমি কথা না বলে খসখস আওয়াজে প্রেশক্রিপশন লিখে ওনার হাতে দিলাম-“দুটো টেস্ট দিয়েছি আর একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফি। টেস্টগুলো করিয়ে আমার সাথে দেখা করবেন।”
উনি প্রেশক্রিপশন হাতে ধরে আমার দিকে তাকালো পূর্ণ দৃষ্টিতে। আমার অসস্তি হচ্ছিল বলে বারবার নজর ঘুরিয়ে নিচ্ছি কিন্তু ওনার দৃষ্টি স্থির। ব্যস্ততার ভান করে নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইছি কিন্তু সফল হতে পারলাম না। হঠাৎ তিনি আমার দিকে ঝুঁকে এলো-“তুমি কি ভেবেছ আমি তোমাকে চিনতে পারবো না?”
আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম-“মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? কে আপনি? এরকম উল্টো পাল্টা বকছেন কেন?”
উনি হাসলেন-“আমি কে তা তুমি খুব ভালোমতোই জানো। আমাকে চিনতে কোন ভুল হয়নি তোমার। ঠিক তেমনি তোমাকেও খুব ভালো মতো চিনেছি আমি। তুমি কি ভেবেছ আমি হুট করে এসেছি তারপর তোমার সাথে কাকতালীয় ভাবে দেখা হলো?”
সামনের মানুষটার চেহারায় রহস্যময় হাসির রেখা দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। এতোদিন বাদে আমার কাছে কি চায় মানুষটা? আমি তো অতীত ছেড়ে এসেছি সেই কবে। তাদের সুখের পথে অন্তরায় না হয়ে আমি আড়াল বেছে নিয়েছি। তবুও কেন আমার পিছু নিয়েছেন? আমি কিছু বলছি না দেখে উনি সোজা হয়ে বসলেন-“জানো, অনেক দিন ধরে খুঁজেছি তোমাকে? শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো বিদেশে চলে গেছ। হঠাৎ করে একদিন পত্রিকায় তোমার ছবি পেলাম। তারপর আবারও খুঁজতে শুরু করলাম। দেখো, এখন আমি তোমার সামনে বসে আছি।”
এবার আর নিজেকে লুকানোর কোন মানে নেই। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তার দিকে তাকালাম। চেহারায় আগের জৌলুশে খানিকটা ভাটা পড়েছে। স্বাস্থ্যও কমেছে খানিকটা। নিটোল ত্বকে ক্লান্তির ছায়া।
আমার আসলে ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে, জানার কৌতুহল। কি এমন কারণ যে মানুষটা এইভাবে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজেছে? যেসব মানুষদের কারণে আমি আমার সাজানো গোছানো জীবন ছেড়ে পালিয়েছিলাম সেইসব মানুষের একজন পাঁচ বছর পরে আমাকে খুঁজে বের করেছে। কেন? আমি মুচকি হেঁসে জানতে চাইলাম-“হঠাৎ করে আপনার মনে আমার প্রতি এতো প্রেম জেগে উঠলো যে? আমি তো কোনকালে আপনার পছন্দ ছিলাম না।”
উনি নিঃশ্বব্দে হাসলো-“কারনটা জানাবো বলেই তো এলাম তোমার কাছে। তোমার বাসা কি কাছাকাছি?”
“কেন?”
আমি সন্দিহান নজরে তার তাকে দেখি। উনি এবার মিষ্টি করে হাসলো-“ঢাকা থেকে সারারাত জার্নি করে এসেছি। তারপর সারাদিন তোমার অপেক্ষায় হাসপাতালের রিসিপশনে বসে ছিলাম। এখন ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তোমার বাসায় বিশ্রাম নিতাম। কি নেবে না তোমার শাশুড়ীকে তোমার বাসায়?”
আমার বিস্মিত হওয়া উচিত কিন্তু হলাম না। বরং পাঁচ বছর আগের চেনা মানুষটাকে দেখতে পেয়ে হাসি পেলো। প্রয়োজনে শত্রুকে আপন বানানোর স্বভাবটা ওনার যায়নি এখনো দেখেই হাসি পেয়ে গেলো। আমি গম্ভীর হয়ে বলি-“এখনো নিজেকে আমার শাশুড়ী ভাবছেন?”
উনি ভ্রুকুটি করে হাসলো-“ভাববো না? আমার ছেলের সাথে তো তোমার ছাড়াছাড়ি হয়নি সেই হিসেবে তুমি এখনো আমার পুত্রবধু বইকি।”
আমি হেসে দিলাম-“পুত্রবধু! এতোদিন পরে এসে আমাকে পুত্রবধু মনেহচ্ছে আপনার? কি দারুণ ব্যাপার। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো সম্পর্ক কি শুধু কাগজে কলমে শেষ হয়? মন থেকে যে সম্পর্কের অস্তিত্ব বিলীন হয় সেই সম্পর্কে এভাবে দাবী করা যায় কি?”
উনি ঠোঁট বাকালেন-“ওসব তো অভিমানের কথা। আসল সত্য হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কাগজের ভ্যালু কম নয়। যাক, এসব নিয়ে আলোচনা কখনো শেষ হবে না। আমি আপাতত ভীষণ ক্লান্ত। বাইরে তোমার রুগী আছে অনেক। তুমি বরং তোমার ড্রাইভারকে বলে দাও আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যাক। তুমি তোমার সময় মতো এসো।”
এবার আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। অবাকও কম হলাম না। যেভাবে ড্রাইভারের কথা বললো মনেহচ্ছে আমার সম্পর্কে অনেক কথা জানেন। আর উনি কি সত্যি সত্যি আমার বাসায় যাবেন? তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চল। ওই চোখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম উনি আমার বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। এবার একটু ঘাবড়ে গেলাম। বাসায় নিয়ে যাওয়া তো যাবেই না। তারপর আবার বায়না করছে একা একা যাবে। অসম্ভব! মহা ঝামেলা হলো তো? এদিকে আমার এসিস্ট্যান্ট মেয়েটা বারবার উঁকি দিচ্ছে। বাইরের রুগীরা শোরগোল শুরু করেছে। কি করবো আমি মাথা কাজ করছে না। উনার হয়তো দয়া হলো আমার উপর। শান্ত কন্ঠে বললো-“শোন, আমি বাইরে বসছি। তুমি রোগী দেখো। ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলো এসে আমাকে নিয়ে যেতে। আমার সাথে লাগেজ আছে একা চলাফেরা সম্ভব না।”
যেন কর্মচারীকে কাজের অর্ডার করলেন এমন ভাবে বলে উঠে গেলো। মনেহচ্ছে আমি ওনাকে বাসায় নেওয়ার জন্য বসে আছি। আমার মাথা ওলট পালট হয়ে গেলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। উনি হুট করে কেন আমার পেছনে পড়লেন বুঝতে পারছি না। কি চায় আমার কাছে? রঙ্গনকে কি ফোন দেব? নাহ, ওকে জানানো ঠিক হবে না এখনই। আনমনা হয়েই দু’টো রোগী দেখলাম। আর পারছি না। ছটফট করছি ভেতর ভেতর। যতটুকু চিনি ওনাকে সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। তাই ওনার একটা গতি করতে হবে। বাড়িতে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি কিছুতেই চাই না আমার সাজানো গোছানো জীবনে আবার কোন কালোছায়ার আগমন ঘটুক। কিন্তু করবো টা কি? মুখের উপর মানা করতে পারি না আমি। এই স্বভাবের কারণে অনেক ভুগেছি তবুও স্বভাব দূর করতে পারিনি।এখন মনে হচ্ছে এই কেন এরকম নরম হলাম আমি। আচ্ছা! ওনাকে কোন হোটেলে তুলে দিয়ে আসবো কি? আমি নিজে নিয়ে কোন হোটেলে রেখে আসলে নিশ্চয়ই মানা করতে পারবে না। হ্যা এটাই ঠিক হবে। যা ভাবা তাই কাজ। আমি এ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটাকে আজকের সব এপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করতে বলে দেই। আজকের রোগীদের কাল দেখে দেব বলে সব গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাথে অবশ্যই আমার প্রাক্তন শাশুরিমা। আমাকে আসতে দেখে উনি প্রথমে বেশ অবাক হলেন তারপর খুশি। কিন্তু ওনার সেই খুশি বেশিক্ষণ স্থানী হলোনা যখন আমার গাড়ীটা আগ্রাবাদে একটা হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। উনি গাড়ি থেকে তো নামলেনই না উল্টো এমন একটা কথা বললেন যে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।

চলবে—