যবনিকা পর্ব-০৪

0
246

#যবনিকা। (পর্ব- ৪)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

আমার সংসার বাঁচাতে মা তার গলার চেইন বিক্রি করে দিলেন। এই চেইনটা আমার নানীর শেষ স্মৃতি। ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছি মা এই চেইনটাকে বেশ আগলে রাখতেন। সবসময় গলায় পরতেন, এক মুহুর্তের জন্য খুলে রাখতেন না। অভাবের হাজার স্রোত ভেসে এলেও মা এই চেইন বিক্রি নাম নেননি কখনো। সেই চেইনটা মা বিক্রি করে দিলেন আমার সংসার ভাঙনের গান শুনে।
পাড়া-প্রতিবেশীদের সান্ত্বনার নামে কটাক্ষে টেকা দুষ্কর হচ্ছিল। বিয়ের বছর গড়ানোর আগেই মেয়ের ছাড়াছাড়ি কথা উঠল, এ নিয়ে সে কি ছিঃছি! মা নিরুপায় হয়ে আমার শ্বাশুড়িকে কল দিলেন। আমার শ্বাশুড়ি, আমার মাকে কী বলেছেন শুনিনি, তবে দেখেছি কান থেকে ফোন নামিয়ে মা আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠেছিলেন। মাকে দেখাচ্ছিল অসহায় হরিণীর মতো, যার বাচ্চা বাঘের মুখে অথচ তিনি কিছু করতে পারছেন না।

ঘরে তখন কানাকড়ি ও নেই। ধার চাইতে গিয়ে ধার ও পেল না। শেষমেষ মা এক ফাঁকে গিয়ে নিজের মায়ের শেষ স্মৃতি বলি দিয়ে এলেন। সেই টাকায় বাবা বস্তা ভরা বাজার করে আনলেন। আমি এর কিছুই জানতাম না। মা বাবা আঁচ লাগতে দেননি। ঘুম থেকে উঠে ঘরে বুট, মুড়ি, তেল, পেয়াজ সহ ইফতার আইটেমে ভরে যেতে দেখে আমার কলিজায় ফাটল ধরল যেন। টাকার উৎস জানতে পেরে কেঁদেই উঠলাম। জেদী স্বরে বললাম,
” এক জিনিস নিয়েও আমি যেতে পারব না, মা। দরকার নেই এমন ঘর করার।”

মা কপাল চাপড়ালেন, ” এ অলক্ষুণে কথা বলতে নেই। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থাকাই মাইয়্যাগো সৌন্দর্য । বাপের বাড়ি হইলো অপমান।”

ঠিক এই মুহুর্তে আমার কী করা উচিত? ও বাড়ি যাওয়া? না কি এমন নিঁচু মানুষ ছেড়ে দেয়া। কিন্তু ছাড়লে আমি থাকব কোথায়? যেখানে আমার বাবা-মা আমাকে রাখতে চাচ্ছেনা সেখানে সমাজের কাছে কী আশা করব? বাবাবাড়ি ছাড়া তো আমার আর কোন গতি নেই। নেই পড়ালেখা। সব ছেড়ে-ছুঁড়ে যাবার মতো সাহস ও নেই। এই গ্রামে মেয়েদের করবার মতো কিচ্ছু নেই। শহরে ও আজকাল দেহ বেঁচা ছাড়া আর কোন চাকরি মেলা ভার । কোথাও গেলে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই লাগে, সম্মানে বাঁচার মতো পরিবেশ লাগে। আমার কোথাও কিচ্ছু নেই। কী করব আমি?

পরাজিত সৈন্যের মতো মাঠ ছাড়লাম। নিজেকে আরও নিচে নামিয়ে ইফতার নিয়ে রওনা হলাম সংসারে। যাবার পর ভেবেছিলাম আম্মা কথা শুনাবেন। কিন্তু সিএনজি থেকে কাপড়ের ব্যাগের সাথে বড় বড় ইফতারের বস্তা দেখে গলা নামিয়ে নিলেন। চোখে খুশি টেনে ইফতার নিয়ে বসলেন। বসার ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন ইফতারের আইটেম। তারপর পাড়া-পড়শীদের ডাকলেন,
“দেইখ্যা যাও, আমার পোলার শ্বশুর বাড়ি থেইক্যা ইফতার আইছে।”

মহিলামন্ডলের আসর বসল। আমার মায়ের কলিজা কেটে দেয়া টাকার বদনামই হলো। মুখ বাঁকানো তাচ্ছিল্যতা ভেসে এলো,
” এই মুড়ি গুলান ওক্কেবারে সস্তা। রাস্তা থেইক্যা তুইলল্যা ধরাই দিছে তোমার বাপে। রাহেলার বাপে আনছে গিউজের মুড়ি। খাইতে মজা আছে।”

” এত অল্প খেজুর তো মুই ফকিররেও দিইনা। এরা মাইয়্যার শ্বশুরবাড়ি পাঠাইছে। এক্কারে খাইচ্ছত। ”

” ইফতার ত চোখে লাগে না। কী আনছো এগুলো, আমরারই শেষ হইয়্যা যাইব। মাইনসেরে কী দিমু?”

দাওয়া পালটা দাওয়া চলছে তুলনা, সমালোচনা। আমি বুকে পাথর চেপে দেখছি, অকৃতজ্ঞতার নমুনা। আমার বাবা মায়ের কত কষ্টের টাকা, সব বিফলে গেল। এত কষ্টের বিনিময়ে বদনাম ছাড়া কিছুরই ভাগিদার হলেন না। ঘরে বুট নেই, মা একমুঠো বুট ও নিজেদের জন্য রাখেন নি, সব দিয়ে দিয়েছেন। আজ তারা চিড়া ভিজিয়ে ইফতার করবেন। সব ইফতার যখন গাড়িতে উঠাচ্ছিল তখন ছোটোবোনটা হাহাকার নিয়ে তাকিয়ে ছিল। মাকে ফিসফিস করে বলেছিল, মা সব দিয়ে দিবে? আমাদের ঘরে তো কিছুই নেই। আমরা কী খাব? একটু রাখো।
মা রাখেন নি। সব দিয়ে দিয়েছেন। আবার না কম পড়ে, মেয়েটাকে কথা শুনায়।
এত ত্যাগের বিপরীত কী পেল?

সেদিন আমার বাবার বাড়ির ইফতার পরিবেষণ হলো টেবিলে। খেতে খেতে ও সে কি বদনাম! এটা ভালো না, দূর এটা কি!
যা-তা শরবত বলে আমার দেবর দু’গ্লাস শরবত খেল। সস্তা মুড়ি, এগুলা আমরা খাইনা বলে আম্মা দু’মুঠো মুড়ি বেশি নিলেন। আতিককেও দেখলাম, বেশ আয়েশ করেই খেতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতার এসেছে বলে কথা।

কিন্তু আমি খেতে পারলাম না। একটা খেজুর মুখে তুলবার পর মনে হলো মায়ের চেইনটা গলায় আটকে গেছে। খালি গলায় মা নানীকে স্মরণ করে কাঁদছেন। সেই কান্নার আওয়াজ এলো কানে। আর কোন আইটেম নামল না। অবশ্য আজ আমার প্লেট ভরতি ইফতার। বাবার বাড়ি থেকে আসার সুবাধে ইফতার জুটেছে কপালে।

______________________

আমার জা রাহেলা মা হতে যাচ্ছে, সুখবরখানা শুনেই আম্মা আনন্দে আটখানা। রাহেলার পেট ছুঁয়ে বললেন,
“বেঁচে থাক । আর বংশের প্রদীপ আইয়োক। ”

রাহেলাকে বারবার বলে দিলেন, মোর নাতিই চাই।
ভাবখানা এমন যেন, নাতি নাতনির ঠিক ঠিকানা রাহেলার কাছে। রাহেলার মুখে হতাশা দেখলাম। সারাদিন বমি হয়, পেটে কিছু থাকে না। মুখে দিলেই গা গুলিয়ে আসে। শরীর দুর্বল, মাথা ঘুরায়, দাঁড়াতে পারে না। রোজা ও রাখতে পারেনা। এত কষ্টের ধন তার, এত বাঁধাধরা নিয়ম করবে কেন? আল্লাহ যাই দিক, তাতেই খুশি।

ঘরে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবার মনে আনন্দ, কেবল আমিই ছাড়া। আমি এত হতভাগী যে এই খুশিটাতে ও নিজেকে ছোঁয়াতে পারলাম না। পরিবার বা বংশে একই সময়ে বিয়ে হওয়া দম্পতির মাঝে যে আগে যে সুখবর শোনায় সে যেমন বাহ্বা পায়, তেমন যে গর্ভবতী নয় সে কটুক্তি ও পায়। আমি ও পেলাম। আমার আগে রাহেলার বিয়ে হলো, সে মা হয়ে যাচ্ছে, আমার কোন খবর নাই। আমার তো আগে সংবাদ দেয়ার কথা ছিল।
আমার শ্বাশুড়ি বিয়েরই দিনই বলে দিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে তার নাতি চাই। সেদিন সবার তাড়া দেখে মনে হচ্ছিল, পরদিনই সুখবর শোনানো বাধ্যতামূলক।
বিয়ে হয়েছে মানে বছর ঘুরতেই বাচ্চা হওয়া চাই। ‘না’ কোন শব্দ নেই। সুবিধা অসুবিধা বলে কিছু নেই। হতেই হবে। বাচ্চা হতে দেরি হলে দোষটা গিয়ে পড়ে বউয়ের ঘাড়ে। এখানে যদি স্বামী বাচ্চা নিতে অনাগ্রহী হয়, কিংবা তার কোন সমস্যা হয় তবুও দোষ হয় স্ত্রীর। তার বাচ্চাধারণ নিয়েই প্রশ্ন তুলে। একেকটা কথায় এমনভাবে ফোঁড়ায়, কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।

রাহেলার সুখবর জানার পর প্রত্যেকটা মানুষ এসে প্রশ্ন করছে, “তুমি কবে শুনাইবা? বিয়া আগে হইল, বাচ্চা হইল না। সমস্যা টমস্যা আছে না কি?”

কেউ শ্বাশুড়ির কানে এসে বলল,
” ছোডোডায় পরে আইসা খবর শুনাইয়্যা দিল। বড়োডার অহনো খবর নাই। এত দিন হইয়্যা গেল। লক্ষণ ত ভালা না। দেইখ্যেন বান্ধা টান্ধা না পইড়া গেল আবার। ”

বাচ্চা আমার ভীষণ পছন্দ। একটা বাচ্চার দোয়া করেছিলাম সেই কবেই। কিন্তু আতিক বাচ্চা চাইছেনা। এ কথা আম্মাকে বলতেই আম্মা উলটো আমাকেই কথা শুনালেন। আমি নাকি নিজের দোষ তার নিরীহ ছেলের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। আমার ভাগ্য ভার, কোন কিছুতে সুফল হয়না। যাই ধরি তাই খারাপ হয়। আমাকে, আমার ভাগ্য, আমার কোলকে গালি দিলেন।

আম্মা আতিককে বলেছেন বোধহয়। রাতে আতিক স্পষ্ট বলল,
” বাচ্চার কথা মাথা থেকে সরাও । বাচ্চা মানেই দায়িত্ব। চাকরিটা সবে ধরেছি, আরও ভালোবাসে প্রতিষ্ঠিত হই। এখন এত দায় দায়িত্ব নেয়ার অবস্থায় নেই। মাকে বলে দিবে।”

আমি শুনলাম, শোনা-ই তো আমার একমাত্র কাজ। আম্মা প্রতিদিন, বাচ্চার জন্য তাড়া দিয়ে গেলেন। তিনি এমন পর্যায়ে চলে গেলেন যে, সাহরিতে উঠে চুল ভেজা না দেখলেও কথা শুনাতেন। তারপর রোজার মাঝে যখন আমার ঋতুবতী সময় এলো, আমি রোজা রাখিনি টের পেতেই আম্মা যেন বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলেন। খুব অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করলেন, যেগুলো বউ শ্বাশুড়ির নয়। শুধুমাত্র পিরিয়ড হওয়ার দোষে আম্মা পারলে আমার গায়ে হাত তুলেন। চোখ রাঙিয়ে হুশিয়ারি দিলেন,
” আবার ও নাপাক হইছস কালমুখী! কোলে কী ভরাসাইস? বাচ্চা ভরে না ক্যান?
পরের মাসে যদি তোর নাপাক সময় আহে, তয় আমার পোলারে আরেক বিয়া করামু। একখান বাচ্চা দিবার মুরোদ নাই। কী লোইয়্যা দুনিয়াত পাঠায়ছে আল্লাহ তোমারে? না জানি কোন বান্ধা পোলার কপালে জুটল।”

চলবে……