যবনিকা পর্ব-০৭

0
75

#যবনিকা। (পর্ব-৭)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

নিয়তি বড়োই অদ্ভুত! চোখের সামনে, হাতের নাগালে থাকা আমাদের জন্য বরাদ্দ খুশিগুলোও অনেকসময় আমাকে ভাগ্যভাণ্ডারে জুটে না, খুবই তুচ্ছ আঁচে সরে যায়। এই যেমন; সারাবেলার কাজের পর ইদের দুপুরটা সুন্দর হলেও পারতো। আমার হাতে এক চিলতে অবসর, ঘরে কোণে থাকা সুন্দর শাড়ি, অখন্ড অবসরের প্রিয় মানুষটা, সবই আছে হাতের নাগালে। ভেজা গায়ে আতিফের দেয়া লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সুন্দর সেজে এক মুঠো খুনসুটি হতে পারতো। আতিফ মুগ্ধ চোখে তাকাত, আমি লাজুক হেসে সালামি চাইতাম।
মুঠোফোনে কয়েকটা হাস্যজ্বল ছবিও তোলা যেত। সময়টা কতই না স্মৃতিবহুল কাটতো? কিন্তু কাটল না, পাতের খুশিটা দূরে সরে গেল, আতিফের বেজায় রাগের কবলে পড়ে।

শরীর ভরা ক্লান্তি বালাই না করে শাড়ি পরবার মননে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে আমি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রইল। ডাকলাম আতিফকে। কিন্তু সে শুনল, কিন্তু দরজা খুলল না। না নিজে বের হলো, আর না আমাকে ডুকতে দিল। বিবাহিত জীবনের প্রথম ইদটায় আমার কপালে এক টুকরো হাসি ও জুটল না। বাবা মাকে ছাড়া প্রথম ইদ, যাদের জন্য ইদ রাঙাতো এবার তাদের সাথে এক সেকেন্ডের জন্য কথাও হলো না।

ইদের সেমাই, নতুন কাপড়, স্বামীর সান্নিধ্য, বাবা মায়ের কুশল কিছুই জুটল না। জুটল কেবল দুঃখ, ভারি কটাক্ষ।

দুপুরের পর আম্মা এদিকে এলেন। আমি তখনো ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে দেখেই আম্মা চড়া গলায় বললেন,
” দুইডা কাম কইরাই খালাস? আর উঁকি দিয়া ও চাইয়্যা দেখবার দরকার মনে করলা না। আমি একা মানুষ পারি এত কিছু? কী করতাছ এখানে? কাপড় বদলাও নাই ক্যান? পুরান কাপড় পিন্দা কী বুঝাইতে চাইতেছ, আমরা তোমারে কাপড় দিই না? মাইনসের কাছে আমাগো মান ডুবাইবার চেষ্টায় থাহো। ”

আমি বললাম,
” আপনার ছেলে দরজা খুলতেছে না।”

আম্মা আঁতকে উঠলেন,
“ক্যান খুলতেছে না? সকাল থেইক্যাই পোলাডা দোর দিয়া বইসা আছে। কী হইছে?”

দরজায় কড়া নাড়লেন,
“আতিফ? কী হইছে বাপ? বাইর হ, মারে ক? দুপুর হইল ভাত খাইবিনা?”

আতিফের উত্তর এলো না। ডেকে ডেকে ক্ষান্ত হয়ে আম্মা ফের আমার দিকে মোড় নিলেন।
” হতচ্ছাড়ি কী করছস আমার পোলারে? ওয় বাইর হইতাছে না ক্যান? পোলাডার সুখ সইয্য হয়না তোর। একটু ভালা থাকলেই ভেজাল বাজাইয়্যা দেস। এমন ইদের দিন পোলাডা না খাইয়্যা আছে। কোন অলক্ষুণে যে তোর মত মাইয়্যা বিয়া কইরা আনছে? পোলাডার জীবন শ্যাষ। ”

আম্মা গালমন্দ করলেন। সবকিছুর দোষ শেষ অবধি আমার ঘাড়েই এসে পড়ল। সংসারে ছেলেদের দোষ হয়না, সব দোষ বউয়ের। আম্মার কথা আজকাল আমার গায়ে লাগেনা। সয়ে গেছে বোধহয়। কম তো শুনলাম না।
আতিফের উপর খুব অভিমান হলো। সে আমাকে বুঝল না একটু? সকাল থেকে কি আমি অবসর ছিলাম? এত এত কাজ সে কি দেখেনি? এই রাগটা কি অনর্থক নয়?
এই ছেলেটা বিয়ের আগে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালো বুঝতো। ওর কথায় আমার প্রতিমুহূর্ত নিজেকে ভাগ্যবতী অনুভব হতো, এমন একটা মানুষকে পেয়ে। আমার প্রতি তার এত ভালোবাসা, আগ্রহ, বুঝজ্ঞান সব কোথায় চলে গেল? সংসারের ছোঁয়ায় সব হারিয়ে গেল? এই ছেলেটাকে তো আমি চিনিনা।
মানুষ ঠিকই বলে, প্রেমিক কখনো স্বামী হয়না। স্বামী হতেই প্রেমিক সত্তা বিলীন হয়ে যায়। প্রেমিক প্রেম বুঝে, আর স্বামী কেবলই হুকুম।

____________

বিয়ের আগে আমার রাগ ছিল নাকের ডগায়। মা সামান্য বকলে রেগে মুখ ফুলাতাম। ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম, ভাত খেতাম না। মা বাবা মানিয়ে ভাত খাওয়াতেন।
অথচ এখন বকা টকা খেয়েও কোথাও গিয়ে বসে থাকতে পারিনা। আমাকে কাজে বসতে হয়। বউদের রাগের বালাই কে করে? আম্মার এত কথার পর আমি দু’দন্ড নিরিবিলি দুঃখের শ্বাস ফেলতে পারিনি। তার আগে ডাক এলো। মেহমানরা খেয়েছে। এঁটো বাসন নিতে।

ফের বাসন নিয়ে ধুতে গেলাম। সকাল থেকে কিছু খাইনি। ক্ষিধে মাথা ঘোরাচ্ছে রীতিমতো। কেউ জিজ্ঞেস করল না খেয়েছি কিনা। মা নেই বলেই বোধহয়। বিয়ের পর বুঝলাম, আসোলে বাবা মায়ের মতো কেউ আমাদের যত্ন নেয়, আমাদের কথা ভাবেনা।

মেহমানদের খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করতে বিকেল হলো। আতিফকে ও দেখলাম, বেরিয়ে যেতে।

আমাকে ফোন না পেয়েই বোধহয় শেষ বিকেলে বাবা মা এলেন দেখা করতে। এত দুঃখের মাঝে মাকে পেয়ে আমার বুকটা ভরে গেল। কেঁদেই ফেলেছিলাম। মা অভিমানী স্বরে বললেন,
” কিরাম আছোস? এমন ইদ গেল, একটা ফোন ও দিলি। সকাল থেকে তোর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি। কলিজা পুড়তেছে। ”

আমি মায়ের বুকে মাথা রাখলাম। ছোটো করে বললাম,
“মেহমান এসেছে তো, সময় পাইনি।”

মা হঠাৎ চমকে উঠলেন। কপালে হাত দিয়ে বললেন,
“তোর গা পুড়ে যাইতেছে। এত জ্বর ক্যামনে বাধাইলি? ওষুধ খাইছিলি? মুখডা এরাম শুকনা লাগতাছে ক্যান? কিছু খাস নাই?”

এক দেখাতে মা সব ধরে ফেললেন। মায়েরা সব জানেন, বুঝেন। আমি মিথ্যা বললাম,
“তেঁতোমুখে রুচি নাই।”

মা বাবা আসার সময় বিস্কুট, কেক, ফল এনেছেন। নিজ হাতে আমাকে একটু খাইয়ে দিলেন। মায়ের চোখে তখন পানি।

আম্মা আমার বাবা মাকে দেখেই এক মিনিট কুশল বিনিময় করে একটা বিচার দিলেন। আপনাদের মেয়ে এই করে সেই করে, কাজ পারেনা, বেয়াদবি করে, আজও বেহুদা পোলার লগে কাইজ্জা লাগছে। পোলাডাকে ভাত ও খাইবার দেয়নাই। ঘরে আটকাইয়্যা রাখছে।

বাবা মলিন মুখে বসে রইলেন। ঘটনা না জেনেই আমার হয়ে ক্ষমা চাইলেন। মা বললেন,
” মাইয়্যাডার অসুখ দেখি। এর লেইগ্যাই এরাম করতাছে। আমাগোন লগে দেন। কদিন বেড়াইয়্যা আইয়োক।”

আমি খুশিই হলাম। যাক, কটাদিন শরীরটা আরাম পাবে। কিন্তু আম্মা দিলেন না। সরাসরি মানা করে দিলেন। কাল তার মেয়ে, মেয়ে জামাই আসবে। ঘরের বউ না থাকলে হয়! কত কাজ?

মা কেঁদেই ফেললেন। এত অসহায় লাগছিল তাকে? বিয়ের পর মেয়ের উপর বাবা মায়ের অধিকার থাকে না কেন? কেন জোর দিয়ে কথা বলতে পারেন না?

বাবা মা যাবার কালে আতিফ ফিরল। বাবা মায়ের সামনে এত আন্তরিকতার সাথে পেশ এলো। থাকার জন্য জোরাজুরি করল, এগিয়ে দিয়ে এল। ওর আন্তরিকতায় যে কারো প্রাণ জুড়াবে। যে কারো মনে হবে, এমন মানুষ কোন ভুল করতেই পারেনা। ভুল যদি করতে পারে কেউ, তবে আমি। আমারই দোষ। বাবা বোধহয় আতিফকে বুঝাতে চাইছিলেন, কিন্তু ওর ব্যবহার দেখে দ্বিধায় পড়ে গেলেন।

নিরব অভিমানে আমি আতিফ থেকে দূরে রইলাম। অসুস্থ শরীর টেনে সারাদিন বাইরে রইলাম। আমার ইচ্ছেই হলোনা, ও ঘরে যেতে। কোন টান পাচ্ছিনা। কিন্তু তবুও যেতে হবে। এ বাড়িতে এ ঘর ছাড়া আর কোন ঘরে আমার জায়গা হবেনা।

বেশ রাত করেই ঘরের দিকে গেলাম। ভাগ্য ভালো, এ যাত্রায় দরজা খোলাই পেলাম। আতিফ বারান্দায় ফোনে কথা বলছে।

ঘরে ঢোকার পর সর্বপ্রথম আমার চোখে পড়ল মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা টুকরো কাপড়। ইদের মতোই ইদের শাড়িটাতেও বিষাদী ঘা। তীব্র রোষে কত ছিঁড় ধরেছে! আমি তাকিয়ে রইলাম, মনে হলো এ আমার জীবন। আমার ধৈর্য ও এমন করে ছিঁড় ধরছে। কোনদিন বাঁধভেঙে পালাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাসে দুঃখ লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম। জ্বরে কাতর শরীর। আতিফের জায়গা থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দেয়াল ঘেঁষে কাঁথা মুড়ে শুলাম। প্রতিজ্ঞায় অটল রইলাম, সবকিছুর জন্য সর্বজ্ঞানে দুঃখিত হওয়া ছাড়া আতিফের সাথে কথা বলব না, কাছে ও যাব না।

আমি যেন ভুলেই গেছিলাম, আঁধার ঘরে রাজত্ব স্বামীর চলে। ঘন্টাখানেক বাদে আতিফ এলো। পাশে শুলো। মনের তাড়ানায় দুঃখিত হলো না। কিঞ্চিৎ অনুশোচনা রইল না ওর মাঝে। কেবলই শরীরের তাড়ানায় কাছে টানল। এইতো প্রয়োজন ওর।

____________

আমার জ্বর সেরে উঠবার পর বেশ অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। রাহেলা বাড়ি এলো। শ্বাশুড়ি বলে কয়ে এনেছেন। বংশের প্রথম সন্তান আসতে চলেছে, তার কাছেই রাখবেন। রাহেলার বাবা মাকে কথা দিলেন, ফুল বেড রেস্টে থাকবে বউ। কোন কাজ করবে না। কাজের জন্য আমি তো আছি। যাক, রইল।

সন্তান না হবার খোঁটা আর জা’র সেবায় সপ্তাহখানেক পার হলো আমার। তারপর একদিন রান্না করবার সময় বড়ো ঘর থেকে চেঁচামেচি কানে এলো। গিয়ে দেখি রাহেলা আর আম্মার তর্কাতর্কি চলছে। আম্মার সামান্য কথায়, বলা বাহুল্য, আমার ক্ষেত্রে আম্মার সামান্য কথা গালাগালি হলেও রাহেলার ব্যাপারে তা নরম আদরই।
রাহেলা বাপের বাড়ির খোঁটা দিল, শ্বাশুড়িকে ফকির উপাধি দিল….

আদরের বউ থেকে এমন আচরণ পেয়ে আম্মা বাকহারা। অপমানে লাল! আমি কেবল আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জীবনের প্রথমবার অপমানিত হবার মুখভঙ্গি দেখতে ভারি করুণ হয়।

আমাকে পেটালেও টু বলি, আর রাহেলা নরম কথায় এত অপমান করল ব্যাপারটা আম্মার হজমই হলোনা। এত দুঃখ পেলেন।

চলবে…..