যবনিকা পর্ব-০৫

0
256

#যবনিকা। (পর্ব-৫)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

মানুষ ভেদে অবস্থার সংজ্ঞা আলাদা। প্রচন্ড অসুখে নেতিয়ে যাবার পর ও কাজ থেকে রেহাই মেলে না আমার, উদ্ধিগ্নতার বদলে নির্বিকার স্বরে মনে করিয়ে দেয়া হয়, এটাই সংসার। সংসারে বউদের আরাম বলতে কিছু নেই। আবার একই অবস্থায় যদি রাহেলা পড়ে তবে তার ভাগ্যঝুলিতে উদ্ধিগ্নতা পড়ে। সেক্ষেত্রে হয় মানবিকতা। অসুখ নিয়ে কাজ কিভাবে করবে? আরাম করাই সাজে তার। এটা বিয়ের পরের নিত্যকার দৃশ্য।

পেটে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, শরীরের পুরো গিটেগিটে ব্যাথা। একে এই সময় তারউপর আবহাওয়া বদলের ঠান্ডা লেগেছে। দুটো মিলে নাজেহাল অবস্থা। উপরিলাভ হিসেবে সংসারের কাজ তো আছেই। সব সামলাতে হিমসি খাচ্ছিলাম আমি। ইফতার, সেহরি, রাতের খাবার তৈরির পর শরীরটা কুলাচ্ছিল না। একটু আরাম করে শুয়েছিলাম। ওমনি শ্বাশুড়ি ডাকলেন। রুগ্ন শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতেই আম্মা জানালেন, কাল বাসায় ইফতারের আম্মা তার ভাই বোনদের দাওয়াত দিয়েছেন। আদেশ দিলেন ৫০জনের আয়োজন করতে।
আমি শুধু আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাহেলা নেই। আম্মু রান্নাঘরের ঢুকেন না। কাজের দিকটা একাই আমাকে সামলাতে হয়। আমার শরীরের অবস্থা ভালোই জানেন তিনি। তবুও কালকের দাওয়াতটা দিলেন তিনি! শরীরের এ অবস্থায় আমি এত কাজ কিভাবে করব?
সারাদিনের ধকলে জ্বর এসে বাসা বেঁধেছে। গা পুড়ে যাচ্ছে। থেমে থেমে কাশি আসছে, গলাও প্রচন্ড ব্যাথা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও বেশ সময় নিয়ে বললাম,
” দাওয়াতটা আর দু’দিন পর দিলে হতো না? এ অবস্থায় কিভাবে আমি…

এ অবধি বলতেই আম্মা চেঁচিয়ে উঠলেন,
” তোমরা আলেদা বউ হইছো? আমরা বউ আছিলাম না? আমরা সংসার করিনাই? অসুখ লোইয়্যা তেরো বিয়ার কাম করছি। উঃ শব্দ ও কইরিনাই। এসব বাহানা আসেনাই। কামচোর হইলে আসে বাহানা। কী এমন রোগ হইছে তোমার? অল্পতেই হেইল্যা পড়ো কাম করবার ডরে। বুঝিনা ভাবছো? তোমারে আনছি কি নখরা করতে? বাহানা ছাইড়া কামে বসো। ”

আমার কথা তো ফললোই না। উলটো নতুন কথা বেরিয়ে এলো। আমাকে ফিরিয়ে আনার পেছনে কারণটা হচ্ছে এই দাওয়াত। কাজের কেউ নেই। আমাকেই তো পিষে ফেলা যাবে। তাই ওমন রটনা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আনলেন আম্মা।
আমি প্রতিবাদ কর‍তে নিয়েছিলাম, কিন্তু মায়ের মুখটা ভাসল চোখে। মনে পড়ল, আসবার কালে মা শক্ত গলায় বলেছিলেন,
“শ্বশুর বাড়ি কঠিন জিনিস। মাইন্যা চলন লাগে। শ্বাশুড়ির মন জুগাইয়্যা চলন লাগে। ওগো সব কতা হুনবি। ওইটাই তোর বাড়ি। এইডা না। এইখানেই থাকবি। ঝগড়া কইরা আর আইবিনা। ”

আর ঝামেলায় যাওয়া যাবেনা। গেলে একবারেই অন্য ঠিকানায় যেতে হবে। কিন্তু আমার সেই ঠিকানা কোথায়?

_______________

রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে। টুকটাক কাজ এগিয়ে সবে আরামের ফুরসত মিলেছে। শরীর ভেঙে আসছে। কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। একটা ওষুধ অবধি নেয়া হয়নি। ঘরে কোন ওষুধ নেই। আতিফ ও নাগালের বাইরে। অফিস ছুটি দিয়েছে। তাকে আজকাল পাওয়াই মুশকিল। বন্ধুদের সাথে আজ শপিং এ গিয়েছিল। ইফতার ও বাইরে করেছে। এখনো ফিরেনি। ফিরবে কি না তাও সন্দেহ।
হাসি মজায় দিন কাটছে ওর। এই যে আমার শরীরের উপর যে একটা ধাক্কা যাচ্ছে সেই খেয়ালটি নেই ওর। সে ব্যস্ত নিজের মতো। আতিফ দায়সারা আর সুবিধাবাদী গোছের লোক। অসুবিধাতে পা বাড়ায়না। দায়িত্ব পাশ কাটায়। দায় এড়িয়ে চললেই বাঁচে।

তীব্র জ্বর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নামল। প্রচন্ড শীত লাগছিল। ক্ষীণ হুঁশে আমি বুঝতে পারছিলাম, গা কাঁপুনি দিচ্ছে। কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল! আর কিছু মনে নেই। হুঁশ এলো কারো ঝাঁকুনিতে। কানে ভাসল আবছা স্বর,
” এ্যাই কবিতা! এমন করতেছো কেন? কী হইছে?”

আমি চোখ মেললাম। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে দেখলাম না কিছু। আবার চোখ বুঝলাম। তখন কপালে ঠান্ডা একটা স্পর্শ পেলাম। তারউপর একটা স্বর,
” এই রোজা রমজানে জ্বর বাধাইছো ক্যামনে? ওষুধ খাইছো?”

আমি উত্তর দিলাম না। ফের চোখ মেললাম। এবার নিভু চোখে দেখলাম, কপালে ভাঁজ ফেলে আতিফ বসে আছে আমার শিওরে। একটা হাত রাখল আমার কপালে। এতদিনের কষ্ট, গ্লানি সব যেন উগড়ে এলো ওই এক স্পর্শে। হুট করে কেন যেন বুক ভেঙে কান্না এলো আমার। আমি কাঁপা হাতে ওর হাতটা ধরে ডুকরে উঠলাম। আতিফ চিন্তিত মুখে কী যেন বলছিল, আমি উত্তর না দিয়ে কেবলই কাঁদছিলাম।
আতিফ একবার ধমকাচ্ছিল, ” উত্তর না দিয়া কাঁদতেছো ক্যান? ”

আবার রাগ সরিয়ে বলছিল, ” আগে কইবা না, ওষুধ নিয়া আইতাম।”

আমি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে বকতেই ঘুমিয়ে গেলাম। আমার ঘুম ভেঙেছে পরদিন সকালে। চারদিকে আলো দেখে আমার মাথায় ভাঁজ পড়ল। সকাল হয়ে গেছে! সাহরিতে কেউ আমাকে জাগাল না! এটা কিভাবে সম্ভব! ঘুমটা এদিক ওদিক হলেই আম্মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেন, সেখানে আজ গোটা একটা রাত পেরিয়ে গেল, কেউ জাগাল না আমায়! আশ্চর্য!

শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথা উঠাতে পারছিনা। তবুও উঠতে হবে। কত কাজ! উঠে আতিফকে পেলাম না। তবে গায়ে কম্বল আর শিওরে জলপটির বোলে আতিফের অস্তিত্ব প্রমাণ মিলল। রাতে সে সত্যিই ছিল।

শুধু আতিফ না, বাসায় কেউ নেই। আমাকে রেখে সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। আজ তো বাসায় দাওয়াত, সবাই আসবে। তার বদলে সবাই গেল কোথায়?

আতিফকে ফোন দিলাম। ধরল না। বেরিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করব, তার সুযোগ নেই। বাইরে থেকে তালা দেয়া। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আমার। ভার মাথা নিয়ে আমি বসে রইলাম। সকাল থেকে আবার কাশি হচ্ছে।

আতিফ আসল আধঘন্টা বাদে। হাতে একটা প্যাকেট। আমাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো। নিজ থেকেই বলল,
” বড় খালু এক্সিডেন্টে করছে। আম্মারা সবাই ওখানে গেছে রাতে।”

“তুমি যাওনি যে?”

আতিফ উত্তর দিল না। হাতের প্যাকেটটা আমার পাশে রেখে বলল,
” কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।”

থেমে বলল,
“দাওয়াতটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। আর আজ আম্মারা কেউ আসবে না। আমি বাইরে ইফতার করব।”

পরোক্ষভাবে আমাকে বুঝানো হলো, আজ কাজের চাপ নেই, বিশ্রাম নিতে।
ওষুধের প্যাকেট ওষুধের সাথে কেক, বিস্কুট আছে। আমি আতিফের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই যত্নবান আতিফটাকেই আমি চেয়েছিলাম। এই আতিফকেই আমি বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু যাকে পেলাম, সে তো এ নয়। হয়তো আজ বাদে কাল আর থাকবে না। সেই আতিফকে আমি পাইনা কখনো। আজ পেলাম কেন?
দীর্ঘ অবহেলার পর হুট করে আতিফের যত্নটা আমি যেন হজম করতে পারলাম না। ঠাট্টায় না কি খুশিতে কে জানে, আমার কেবল কান্না পাচ্ছে। কেকটা মুখে তুলতেই চোখ ভিজে উঠল। ভালোবাসার কাঙালরা কি ভালোবাসা পেলেই এমন করে?

চলবে…..