যাত্রাশেষে পর্ব-৮+৯

0
480

# যাত্রাশেষে (পর্ব-৮+৯)
#হালিমা রহমান

মহুয়া এখন পাক্কা গৃহিণী।সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সব চিন্তা সংসারকে ঘিরেই।কি করে আবরার ভালো থাকবে,অফিসে যাওয়ার আগে আবরারকে কতোটুকু সাহায্য করতে হবে,ঘরে কোনদিন কি লাগবে,কোন তেল মালিশ করলে বিলকিস বেগমের কোমড়ের ব্যাথা কমবে,বারান্দায় কোন গাছে পানি দিতে হবে,কোন গাছে একটু সার দিতে হবে— এসব চিন্তা-ভাবনা করতে করতেই মহুয়ার বুড়ো হওয়ার জোগাড়।তাকে দেখলে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই,এই মেয়ে একসময় বাইরের কাজে পটু ছিলো।ঘরের কাজে ছিলো আমড়া কাঠের ঢেকি।চাকরি কি জিনিস তা তো এখন মহুয়া চিনেই না।চাকরি করার চিন্তা-ভাবনাও নেই ।মহুয়া এখন সংসারকেই উপভোগ করে।একটু একটু করে প্রত্যেকদিন আবিষ্কার করে।রান্না শেষ হওয়ার পর ধোঁয়া উঠা তরকারি থেকে প্রাণভরে ঘ্রাণ নেয়।কোন সবজি কোন মাছ দিয়ে রাঁধলে ভালো হবে,কোন মশলা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়,কিভাবে কাপড় কাঁচলে ধবধবে সাদা হয়,কিভাবে ঘর-দোর সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার থাকে—এসব বোধহয় মহুয়ার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।মহুয়া হাজারবার ঘর পরিষ্কার করে।শাড়ির আঁচল দিয়ে একটু একটু করে আবরারের সবগুলো বইয়ে জমে থাকা ধুলো পরিষ্কার করে।আয়না মুছে,কাপড় গোছায়,বিছানার চাদর লক্ষবার ঠিক করে।আবরারের সাথে সম্পর্ক এখন বেশ ভালো।আবরারকে মহুয়ার খুব ভালো লাগে।দিনে লক্ষবার প্রেমে পড়ে মহুয়া।আবরারকে দু-চোখ ভরে দেখে।সভ্য-অসভ্য হাজারটা স্বপ্ন বুনে তাকে নিয়ে।আবরারের রাগ অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে মহুয়ার।আবরারের খুব উগ্র মেজাজ।এই দেখা যায় মহুয়াকে সে ভালোবেসে জীবন দিয়ে দিচ্ছে।আবার ক্ষনিকেই রেগে যাচ্ছে।তখন কি চোটপাটটাই না করে মহুয়ার সাথে!মহুয়ারও রাগ বেশি।অনেক সময় আবরারের সাথে সাথে সেও রেগে যায়।মহুয়া এই পর্যন্ত একসেট সিরামিকের প্লেট ভেঙেছে।দুটো কাচের জগ আছড়ে ভেঙেছে রাগের মাথায়।এতো কিছুর পরেও মহুয়া এই সংসারকেই ভালোবাসে।ভালো-খারাপ মিলিয়েই তার দিন কেটে যায়।দেখতে দেখতে বিয়ের আটমাস কেটে গেছে।ছুটির দিনগুলো খুব ভালো কাটে এখন।আবরার সারাদিন বাসায় থাকে।কখনো কখনো মহুয়ার রান্নার কাজে সাহায্য করে।বিকেলগুলো হয় আরো রোমাঞ্চকর।বিলকিস বেগম ছুটির দিনের বিকালগুলো আফিয়ার বাসায় কাটান।আফিয়ার দুটো ছেলে-মেয়ে আছে।নাতি-নাতনীদের সাথে বেলা কাটাতে ভালোই লাগে তার।মহুয়া-আবরার ঘরেই থাকে।ছুটির দিনের বিকালে আসরের নামাজ পড়েই খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি হয় মহুয়া।দুজনের জন্য দু-কাপ ঘন করে চা বানায়।তারপর সেই ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে যায়।মহুয়া বারান্দাটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে।আগে তো শুধু কাঠগোলাপের গাছ ছিলো।এখন পুঁইশাক থেকে শুরু করে ক্যাকটাস -বহু প্রকার গাছ আছে বারান্দায়।আবরার ও মহুয়া দুজনে মিলে বারান্দার মেঝেতে লেপ্টে বসে অলস বিকাল দেখে।চা শেষ করে কখনো কখনো মহুয়া তার মাথা এলিয়ে দেয় আবরারের কাঁধে।মুখে ফুটায় হাজার কথার ফুলঝুরি। এই তো সেদিনের কথা।মহুয়ার এলোমেলো চুলগুলো পড়ে ছিলো আবরারের বুকে।তার মাথা হেলানো ছিলো আবরারের কাঁধে।পাশে ছিলো সদ্য শেষ করে রাখা খালি চায়ের কাপ।মহুয়া সামনের বাড়ির দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললঃ”ঐ বাড়িটা কাদের?শেষ করে না কেন?”
—” ওইটা অন্য এলাকার মানুষেরা করছে।ওই যে সমতির মাধ্যমে ফ্ল্যাট করে না এখন,ওইরকম আর কি।”
—” ওহ।এই দো-তলার ফ্ল্যাটটা অনেক সুন্দর।সুন্দর করে সাজানো যাবে।”
আবরার মহুয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেঃ” তুমি কি করে জানলে?”
—” আমি জানালা দিয়ে দেখেছি।বারান্দাটাও তো এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।”
—” দেখে কি লাভ? তোমার স্বামীর এতো টাকা নেই যে এরকম একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে।”
মহুয়া মাথা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে বলেঃ” আমি কি বলেছি, আমি ওখানে থাকব?আমি শুধু বললাম ফ্ল্যাটটা সুন্দর।তাছাড়া, আমার ঘরই বেশি সুন্দর।ওই খালি ফ্ল্যাটের চাইতে আমার এই ছোট্ট ঘরে বেশি শান্তি।”
আবরার মুচকি হাসে।হাসিমুখে বলেঃ” মানলাম তোমার কথা।মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি ডাক্তারের কাছে যাবে?”
—” হ্যাঁ, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে ইদানিং।”
—” কবে যাবে?”
—” দেখি কাল-পরশু যাব।আপনার কি আমাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় হবে একদিন?”
—” কেন?”
—” বিছানার চাদর লাগবে।কিছু মশলাও লাগবে।এগুলো কিনব।”
—” আগামী শুক্রবারের আগে সময় হবে না।ওইদিন নিয়ে যাই?”
—” আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে দুজনে।কয়েক মিনিটের নিরবতা ভেঙে মহুয়া আবার বলেঃ” আমাকে একটা ময়না পাখি কিনে দিবেন?”
—” ময়না পাখি দিয়ে কি হবে?”
—” আমার অনেক শখ একটা ময়না পাখি পালার।আমি সারাদিন ওকে কথা শিখাব।কিনে দিবেন?”
আবরার মহুয়ার এলোমেলো চুলে আঙুল চালাতে চালাতে মুচকি হাসে।মাথা নেড়ে বলেঃ”ঠিক আছে, দেব।”
মহুয়া শরীরের সবটুকু ভার ছেড়ে দেয় আবরারের বলিষ্ঠ বুকে।আদুরে গলায় আবরারের চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলেঃ” আপনি খুব ভালো টুকুনের আব্বু।”
—” টুকুন কে?”
—” একটা ছোট্ট মেহমান,একদম বিড়াল ছানার মতো তুলতুলে।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।মহুয়া তা দেখে মুচকি হেসে বলেঃ” আরে আমি ভবিষ্যতের কথা বলছি।নিচের ফ্ল্যাটের পুষ্পা ভাবি আছে না,ওনার একটা মেয়ে হয়েছে।দারুন দেখতে।আমাদের ঘরেও একদিন একটা ছোট্ট অতিথি আসবে,ঠিক আছে?ওকে আমরা টুকুন বলে ডাকব।একজোড়া নরম পা আমাদের ঘরে ঘুরে বেড়াবে।ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমাকে ছুঁবে,আপনাকে ধরবে…
মহুয়ার সুখ স্বপ্নে বাধা দেয় আবরার।ভারী গলায় বলেঃ” এতো স্বপ্ন দেখতে নেই মহুয়া।অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।”
মহুয়া চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে।লোকটা কোনো পরিস্থিতি বোঝে না।অসহ্য!

***

মহুয়ার সংসার নাটকের সমাপ্তির শুরু বিয়ের নয় মাসের মাথায়।নাটক নয় নাটিকা ছিলো মহুয়ার সংসার,সাজানো স্বপ্নগুলো।তাই যবনিকাপাতে খুব বেশি সময় লাগেনি।কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ায় ধসে পড়া ঘরের মতো মহুয়ার স্বপ্নগুলোও ভেঙে যায় হুট করেই।মহুমার বিয়ের তখন নয় মাস চলছে।সেদিন ছিলো রবিবার।শুক্র-শনি বন্ধের পর রবিবার থেকেই আবরারের অফিস শুরু হয়।সেই রবিবারে সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিলো।বর্ষাকাল নয় তবুও কি বৃষ্টিটাই না হয়েছিলো কয়েকটা দিন! মহুয়াদের গলির মোড়ে এক হাঁটু পানি জমে গিয়েছিলো প্রায়।আবরার অফিসে যাবে অথচ মহুয়া বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না।সকাল থেকেই তার মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হয়েছে।ব্যাথার তীব্রতায় দু-বার বমি করেছে মহুয়া।বিলকিস বেগম বাড়ি নেই।আবরারের মামা মারা গিয়েছিলো এক সপ্তাহ আগে।ভাইয়ের মৃত্যু উপলক্ষেই গ্রামে গিয়েছিলেন বিলকিস বেগম।আবরারের অফিস দশটা থেকে।আবরার অফিসে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই বিছানা থেকে তার হাত টেনে ধরে মহুয়া।কাতর গলায় বলেঃ” আজ না গেলে হয় না?আমার অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে।মনে হচ্ছে মরেই যাব।”
আবরার বিছানার এককোনে বসে মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।সান্ত্বনার সুরে বলেঃ” আজ সপ্তাহের প্রথম দিন, মহুয়া।একটু সহ্য করো।আমি পুষ্পা ভাবিকে বলে যাচ্ছি তোমার খেয়াল রাখার কথা।চিন্তা করো না।যদি পারি লাঞ্চের সময় ছুটি নিয়েই চলে আসব।”

মহুয়া সান্ত্বনা দিয়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেড়িয়ে পড়ে আবরার।ব্যাংকে না গেলে তার চলবেই না।
তখন বোধহয় বেলা এগারোটা বাজে।আবরার কাজ করছিলো একমনে।এর মাঝে একবার বাড়িতে ফোন দিয়ে মহুয়ার খবর নিয়েছিলো।মহুয়া বলেছে সে ঠিক আছে।সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ খাওয়ার পর নাকি ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে।আবরার কাজের মাঝে আরো একবার ব্যাংকের নির্দিষ্ট স্থানে চোখ বুলালো।কিন্তু,যাকে দেখার জন্য নজর ঘুরিয়েছিলো তাকে দেখলো না।ভিতরটা মুহূর্তেই তেতো হয়ে গেল আবরারের।আজ আসলো না কেন?
মিনিট কয়েকের মাঝে কোথা থেকে দৌড়ে এলো রাফি।সে আবরারের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।তারা দুজন একইসাথে কাজ করে।রাফি আবরারের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললঃ” আবরার, খবর শুনেছিস?”
আবরার বন্ধুর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।ওকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে কাঁধে হাত রেখে বললঃ” শান্ত হ।কি খবর?”
—” অনন্যা আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।ভাগ্য ভালো কিছু হয়নি।হাসপাতালে ভর্তি এখন।তোরা কি আবার ব্রেকাপ করেছিলি?”
পিলে চমকে উঠে আবরারের।খবরটা কি সত্যি?আরো একবার অনন্যার চেয়ারে চোখ বুলায়।মেয়েটা হাসপাতালে ভর্তি বলেই কি আজ আসতে পারেনি??

আবরারের বুকে মৃতের মতো পড়ে আছে অনন্যা।মরে নি কিন্তু নেতিয়ে গেছে অনেকটাই।অনন্যার ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।মেয়েটা বোধহয় গলায় ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো।গলায় মোটা করে দাগ বসে গেছে।গলার নিচটা কালচে হয়ে গেছে একদম।আবরার দু-হাতের আজলায় প্রেয়সীর মুখ তুলে নেয়।কপালে তীব্র আবেগে উষ্ণ চুমু এঁকে দেয়।দু-দিন আগে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো দুজনের মাঝে।রাগের মাথায় আবরার অনন্যাকে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিলো।বলেছিলো,মহুয়াকে রেখে অনন্যার মতো মেয়েকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।এই ছোট্ট কথার জেরে অনন্যা আত্মহত্যার চেষ্টা করবে,তা স্বপ্নেও ভাবেনি।আবরার অনন্যার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেঃ” এরকম পাগলামি কেন করো অনু?তুমি কি ছোট?”
—” ধরবা না তুমি আমাকে।ছাড়ো,যাও মহুয়ার কাছে যাও।আমি তো কেউ না।আমি মরলেই কি আর বাঁচলেই কি?”
আবরারের শক্ত হাতের বাধন থেকে বের হতে চায় অনন্যা।কিন্তু,আবরারের বলিষ্ঠ হাতের সাথে তার মতো অসুস্থ মেয়ে পারবে কেন?অনন্যা হার মেনে নেয় সহজেই।নেতিয়ে যাওয়া ফুলের মতো আবারো আবরারের বুকে ঢলে পড়ে।আবরার অনন্যাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অনন্যাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলেঃ” তুমিই তো সব।মরবে কেন তুমি?আমাকে আর দুটো মাস সময় দেও,অনু।সব ঠিক করে ফেলব।প্লিজ,অনু আর রাগ করো না।মহুয়ার সাথে সব বোঝা-পড়া শেষ করতে অন্তত মাস দুয়েক তো লাগবেই।তুমি ততোদিন আরেকটু অপেক্ষা করো, প্লিজ।”
কথা শেষ করে আবারো অনন্যাকে চুমু দেয় আবরার।অনন্যার এলোমেলো চুলে পরম যত্নে ঠোঁট বুলিয়ে দেয়।

অনন্যাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বেশ সময় লেগেছে।পুরোটা সময় আবরার তার পাশে ছিলো।অনন্যাকে বাড়িতে পৌছে,ঔষধ খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে আবরার যখন নিজের বাড়িতে এসেছে তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে আবরারের।একটু বিছানায় শরীর না দিলে চলবেই না।আবরার বাড়ি ফিরে দেখলো শোবার ঘর ছাড়া সব ঘরের বাতি নিভানো।কপাল কুঁচকে ফেললো আবরার।কি ব্যাপার?মহুয়ার শরীর কি বেশি খারাপ নাকি?নিজেদের শোবার ঘরে পা দিতেই মহুয়াকে দেখলো আবরার।ঘরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।আবরার মহুয়ার পিছনে যেয়ে দাঁড়ায়।কাঁধে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরাতে ফিরাতে বলেঃ” ব্যাথা কমেনি,মহু….”কথা বন্ধ যায় আবরারের।মহুয়ার চোখ-মুখ ফুলে একেবারে মিষ্টি কুমড়োর মতো হয়ে আছে।চোখ দুটো পুরো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে।আবরার আঁতকে উঠে বলেঃ”তোমার কি হয়েছে মহুয়া?ব্যাথা কি এখনো কমেনি?”
মহুয়া চুপ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মাত্র।তারপরেই আবরারের হাত সরিয়ে দেয় নিজের কাঁধ থেকে।
—” আপনি বোধহয় অনেক ক্লান্ত।হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।আমি চা করে আনছি।”
মহুয়া চলে যেতে চাইলেও বাধা দেয় আবরার।হাত টেনে ধরে বলেঃ” চা লাগবে না আমার।তোমার এই অবস্থা কেন বললে না তো?অসুস্থ শরীরে…”
—” হাত ছাড়ুন।আমার অসুস্থতার কথা ভাবতে হবে না।আপনার সাথে কিছু কথা আছে আমার।খুব বেশি সময় লাগবে না।আপনি প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হোন।”
হতভম্ব আবরারকে পিছনে ফেলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় মহুয়া।রান্নাঘরে যেয়ে চুলার কাছে দাঁড়ায়।বুক ভরে শ্বাস নেয়।এতোক্ষণ খুব কষ্টে কান্না আঁটকে রেখেছিলো।আর বোধহয় সম্ভব না।একদিকে মাথা ব্যাথা অন্যদিকে ভিতরের অস্থিরতা।দুটো মিলে একেবারে কাবু করে ফেলেছে তাকে।মহুয়া চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে রান্নাঘরের জানালা খুলে দেয়।মুহূর্তেই এক পশলা হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দেয় মহুয়ার মুখ।বৃষ্টির ঝাপটা মুখ ভিজিয়ে দেয়।মহুয়া গলা বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে।সুনসান রাস্তাগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির পবিত্র পানি।এরকম এক সন্ধ্যায় মহুয়া যা পরিকল্পনা করে রেখেছে তা যদি না করতে হতো,তবে মহুয়া হয়তো বেঁচে যেতো।এই বৃষ্টিমুখর সময় উপভোগ করতে হয়।অলসতার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিতে হয়।অথচ,আজ কি করতে হবে মহুয়াকে? সে পারবে তো?এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মহুয়ার চোখ থেকে।তারপর আরো একফোটা, আরো একফোটা।ফোটায় ফোটায় পড়া চোখের পানি চায়ের পাতিলায় পড়ে।মহুয়া নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে নেয়।এরকম সন্ধ্যা কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক।

আবরার হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।আজ সে সত্যি খুব ক্লান্ত।সকাল থেকে কম দৌড়- ঝাপ করতে হয়নি।ঘরে বউ আর বাইরে প্রেমিকা সামলানো কি চাট্টিখানি কথা!নরম বালিশে মাথা দিয়ে আরামে চোখ বুজে আসে আবরারের।বালিশটা থেকে মহুয়ার চুলের ঘ্রাণ আসছে।মহুয়ার চুল থেকে অন্য এক ধরনের ঘ্রাণ পায় সে।মেয়েটা কি শ্যাম্পু দেয় কে জানে!শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নাকে গেলেই সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করে।আবরারের ঘুমটা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই তাকে জাগিয়ে দেয় মহুয়া।আবরার বিরক্তভরা চোখ নিয়ে তাকায়।মেয়েটা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আবরার চোখ- মুখ কুঁচকে আবারো ঘুমানোর উদ্যোগ নিতেই বাধা দেয় মহুয়া।গলা উঁচিয়ে বলেঃ”তাড়াতাড়ি উঠুন।চা নিন।আপনার সাথে আমার কথা আছে।উঠুন।”
—” এখন না মহুয়া।আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।যন্ত্রণা দিও না ঘুমাতে দেও।”
আবরার চোখ বন্ধ করার আগেই ঠাস করে কিছু ভাঙার আওয়াজ পায়।লাফিয়ে উঠে আবরার।কি হলো?চোখ খুলে দেখে মহুয়া চায়ের কাপটা আছড়ে ভেঙে ফেলেছে। হতভম্ব হয়ে যায় আবরার।মহুয়াকে কি আজকে ভূতে-টূতে ধরলো নাকি?সে বিস্মিত কন্ঠেই বললঃ”সমস্যা কি তোমার মহুয়া?”
মহুয়া উত্তর দেয় না।বরং, গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলেঃ” অনন্যা কে?”
একটা প্রশ্ন।মাত্র দুই শব্দের একটা প্রশ্নে চমকে যায় আবরার।ঘুম কোথায় পালিয়ে গেছে তা আর খুঁজে পায় না।সহসা কথা বলার মতো কোনো শব্দও খুঁজে পায় না।
—” কি ব্যাপার? কথা বলছেন না কেন? আমি প্রশ্ন করলাম অনন্যা কে?”
আবরার বহু কষ্টে গলায় আওয়াজ তুলে বলেঃ” অনন্যাকে তুমি কি করে চিনলে?”আবরারের কন্ঠস্বর অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনায়।তার চোখ দুটো মনে হয় যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে।মহুয়া তা দেখে একবার চোখ বন্ধ করে।লম্বা করে দম নেয়।এখন রাগার সময় নয়।কান্না আসছে খুব।কিন্তু মহুয়া কাঁদবে না।চোখের পানি কি এতো সস্তা নাকি, যে একটা প্রতারকের জন্য তা ঝরবে?প্রতারকদের জন্য অশ্রু নয় শুধু ঘৃণাই কাম্য।মহুয়া শান্ত গলায় বলেঃ”অনন্যাকে আমি কি করে চিনি তা আপনার জানার দরকার নেই।আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।আজ হাসপাতালে আমি অনেক কিছু দেখেছি,নিজের কানেও অনেক কিছু শুনেছি।আমার সাথে তাই মিথ্যা বলবেন না।আপনি তো অনন্যার থেকে দু-মাস সময় চেয়েছেন সবকিছু ঠিক করার জন্য।দুমাস পরেই যা ঘটবে,তা আজ ঘটতে সমস্যা কি?”
—” তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে?তোমার ব্যাথা না কমে গেছিল!”
এতো কষ্টেও মৃদু হাসে মহুয়া।ম্লান হেসে বলেঃ”আপনাকে ফোনে মিথ্যা বলেছিলাম।আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামীটা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছে।তাকে শুধু শুধু টেনশন দেওয়ার কি দরকার?তারচেয়ে আমি বরং হাসপাতালে যাই।ডাক্তার দেখাই।বিশ্বাস করুন, হাসপাতালে যেয়ে আজ খুব উপকার হয়েছে।সেখানে না গেলে তো আমি জানতামই না, আমি যাকে বীরপুরুষ ভাবি সে আসলে কাপুরুষ।সে পরনারীতে আসক্ত।”
মহুয়ার কন্ঠে তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ে।আবরার মাথা নিচু করে ফেলে।মহুয়া তো মিথ্যা কিছু বলছে না।তাহলে?এতো খারাপ লাগছে কেন? সত্যের স্বাদ কি তেতো হয়?
বহুক্ষণ চুপ থাকার পর আবরার ধীরে ধীরে বলা শুরু করল।
—” অনন্যা আমার প্রথম প্রেম।তার সাথে সম্পর্কের বয়স চার বছর।একই ভার্সিটিতে পড়েছি আমরা।ভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকে চাকরিও হয়েছে।অনন্যার বাবা নেই।ওর আয়ের উপরেই ওদের সংসার চলে।তাই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের চিন্তা-ভাবনা ছিলো না ওর।এ নিয়ে আমাদের ঝামেলাও কম হয়নি।আমি বিয়ে করতে চাইলেও সে সবসময় উদাসীন ছিলো।আমাদের বিয়ের আগেও ওর সাথে আমার খুব বিশাল ঝামেলা হয়েছিলো।ওর উপর রাগ করেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম আমি।বিয়ের পর চারবার আত্মহত্যা করতে গেছে ও।ভাগ্যক্রমে প্রতিবার বেঁচে গেছে অনু।”
মহুয়া নিশ্চল তাকিয়ে রইলো।কিছু বলার নেই যেন।আবরার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বললঃ” বিয়ের পর থেকে অনুকে ভুলতে চেয়েছি আমি।কিন্তু পারিনি।অনু আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে মহুয়া।আমাদের বিয়ের পর অনু যেন আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লো আমার উপর।সেও আমাকে ছাড়তে চাইলো না।আর আমি তো আগে থেকেই ওর সাথে মিশে ছিলাম।সবকিছু ছাড়তে পারলেও অনুকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।সে আমার প্রথম প্রেম।সংসারের মায়ায় তাকে আমি কিছুতেই বিসর্জন দিতে পারব না।”
—” তাহলে আমি কে?”
আবরার মলিন চোখে তাকায় একবার।নিচু মাথাটাকে আরো নিচু করে বলেঃ” তুমি বোধহয় আমার মোহ মহুয়া।এমন এক মোহ যাকে আমি ছাড়তে চাই কিন্তু পারছি না।”

#পর্ব-৯

বিশাল আকাশ থেকে সূর্য বিদায় নিচ্ছে।আকাশটা পুরো লাল-কমলা রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে।ঢাকা শহরে সচরাচর সূর্যাস্ত দেখা যায় না।অবশ্য সময় নিয়ে কেউ দেখেও না।ব্যস্ত মানুষের জীবনে এতো সময় কোথায়?মহুয়ার দিনই ভালো লাগে।দিনের বেলা নানা কাজে ব্যস্ত থাকা যায়।তাই অতীতগুলো সহসা হানা দেয় না।কিন্তু রাত যত গভীর হয়,মহুয়ার অস্থিরতা ততোই বাড়ে।তাদের ছোট্ট ঘরের দূর্বল দেয়ালগুলোও যেন ফিসফিসিয়ে ঘোষণা দেয়—“মহুয়া তুই সত্যিই একা।”
পার্কের অশ্বত্থ গাছের নিচে রাখা বেঞ্চে বসে আছে মহুয়া।তুষার নেই তার পাশে।কোথায় যেন গেছে।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে পার্ক ক্রমশ খালি হচ্ছে।কপোত-কপোতীরা বেড়িয়ে যাচ্ছে একে একে।মহুয়া বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে বসলো।হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে নিলো একবার।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।বাসায় ফিরতে হবে।তুষার না আসা অবধি উঠতে পারবে না মহুয়া।তাই অলস নজরে বয়স্ক অশ্বত্থ গাছের বিস্তৃত ডালের দিকে চেয়ে রইলো।ডালে দুটো ছোট ছোট পাখি দেখা যাচ্ছে।মহুয়ার পাখি সংগ্রহের খুব শখ।কিন্তু,সে দু-তিনটা পাখি ছাড়া খুব বেশি পাখি চিনে না।শুধু নাম জানে।এই দুটোও যে কি পাখি তা মহুয়া বুঝতে পারছে না।

—” মহুয়া, পানি খেয়ে নিন।আপনার গলা নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে।”
তুষারের কথায় মহুয়া পাখি দেখায় বিরতি দিল।তুষারের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে,বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললঃ” পানি আনতে গিয়েছিলেন আপনি?”
—” হুম।”
মহুয়া ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেললো। সেই বিকাল থেকে একটানা কথা বলছে।গলাটা সত্যিই খুব শুকিয়ে গেছে।মহুয়া পানি খাওয়া শেষ করে বললঃ” পানির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
—” ধন্যবাদ দেওয়া লাগবে না।আজ যেই গরম পরেছে।আমারই ভুল হয়েছে। আজকে আপনাকে এখানে না ডাকলেই ভালো হতো।”
মহুয়ার নজর ঘুরে ফিরে বারবার অশ্বত্থ গাছের ডালে চলে যাচ্ছে।হলদে রঙা পাখি দুটো কি সুন্দর!মহুয়া আঙুলের ইশারা দিয়ে তুষারকে প্রশ্ন করলোঃ” ওই দুটো কি পাখি?”
—” খুব সম্ভবত বেনে-বৌ পাখি।”
—” আপনি নিশ্চিত?”
—” অনেকটাই।আগে আমাদের গ্রামে অনেক দেখা যেত।মহুয়া,চলুন একটু হাঁটি।একটানা বসে থেকে আমার হাঁড়-মাংস লেগে গেছে একদম।আর বসতে পারব না।”
—” চলুন।”
মহুয়া উঠে আগে হাত-পা ঝারা দিলো।বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে একদম।কিছুক্ষণ হাত-পা নড়াচড়া করার পর তুষারের সাথে পা বাড়ালো সামনে।আজকে গরম পড়েছে খুব।ঘামে তুষারের শার্ট ভিজে গেছে।মহুয়া তুষারের থেকে একপা পিছিয়ে আছে।তুষার একটু থেমে পিছু ফিরে বললঃ” মহুয়া, এরপর কি হয়েছিলো? বললেন না তো।”
—” এরপর আর কি।সেই ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায়, আমি আমার প্রাক্তনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।তখন বাইরে ছিল প্রবল বৃষ্টি,আমার শরীরে ছিল তীব্র অসুস্থতা আর মনের অবস্থা ছিল আরো নাজুক।বুঝতেই পারছেন কি বিচ্ছিরি অবস্থা ছিল আমার।”

—” তখনই বেরিয়ে আসার কি দরকার ছিল?আপনি সেই রাতটুকু তো সেখানেই থাকতে পারতেন।”
তুষারের কথায় খুব অবাক হলো মহুয়া।কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললঃ”আপনি কি পাগল, তুষার সাহেব?আমি এতোকিছুর পরেও ওই হারামজাদার সাথে থাকতাম! ওইদিন যদি আর এক মুহূর্তের জন্য আমি সেখানে থাকতাম, তবে নিশ্চিত কুকুরটাকে খুন করে ফেলতাম।”
মহুয়ার কন্ঠে রাগ ও ঘৃণা একসাথে ঝরে পড়ে।তুষার বুঝতে পারে, মহুয়া এখনো আবরারকে ক্ষমা করতে পারেনি।অবশ্য, এইরকম অপরাধ ক্ষমা করাও যায় না।রাগের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছে–এটা কোনো কথা?বিয়ে কি কোনো ছেলেখেলা? আবরারের উপর তুষারের খুব রাগ হচ্ছে।মেয়েটার কত স্বপ্ন ছিল।একটা মেয়ের স্বপ্ন ভাঙার অধিকার আবরারকে কে দিল?
—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার কথায় ভাবনার সুতা ছিড়ে যায় তুষারের।হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ”কিছুই ভাবছি না।”
—” আজকে অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার।আসলে, আমি শর্ট-কার্টে কথা শেষ করতে পারি না।”
—” কে বলল আপনি সময় নষ্ট করেছেন?এখানে তো আমিই আপনাকে ডেকেছি।আচ্ছা,মহুয়া আপনি যখন এতো অসুস্থতার ভিতরেও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আবরার আপনাকে থামায়নি?”
—” উঁহু। ”
ভীষণ অবাক হয়ে যায় তুষার।আবরার কি মানুষ নাকি অমানুষ?যার শরীরে মানুষের রক্ত আছে, সে কিভাবে একটা মেয়েকে দুর্যোগের রাতে একা বেড়োতে দেয়?তুষার কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলেঃ”আপনাকে একবারের জন্যও নিষেধ করেনি!আপনাকে সেই রাতে একা আসতে দেওয়া উচিত হয়নি।যদি পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো?”
তুষারের কথায় মলিন হাসে মহুয়া।অবিচল চোখে সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” আমাদের সম্পর্কে আমি ছিলাম অনেকটা অ্যাপেনডিক্সের মতো।আমাদের শরীরে যেমন এটার কোনো গুরুত্ব থাকে তেমনি আমারো কোনো গুরুত্ব ছিল না।সবাই মিলে আমাকে জুরে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আবরারের সবটা জুরে আমি ছিলাম না।শুনলেন না, সে আমাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল।আমি নাকি তার মোহ ছিলাম।বিয়ের নয় মাসের মাথায় এসে আমি জানতে পারি, আমি একজন মানুষের মায়া নয় মোহ।হাহ!এটাকে কি বলা যেতে পারে তুষার সাহেব?দূর্ভাগ্য? ”
উত্তর নেই তুষারের কাছে।সে নিজেও তো একটা প্রতারণার শিকার।হয়তো মহুয়ার মতো তুষারের চোখ ভরা এতো স্বপ্ন ছিল না।কিন্তু,মহিমা ও মৃত্তিকাকে নিয়ে একটা সুন্দর পরিবার গড়ার ইচ্ছে তো ছিল।মহিমা যে কেন এরকম প্রতারণা করলো!মাঝে মাঝেই তুষারের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।আচ্ছা,মহিমা কি তাদের কথা মনে করে?তার একটা মেয়ে আছে,মেয়েটা ছোট, নিজের কাজ নিজে করতে পারে না,মা ছাড়া মেয়েটা অসহায়–এসব কথা কি মহিমার মনে পড়ে?তুষার-মৃত্তিকা এদের জন্য কি কখনোই মহিমার মন খারাপ হয় না?দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুষার।যদি তাদের কথা মহিমা চিন্তা করতো তবে কখনোই এমন কাজ করতে পারতো না।প্রতারকরা কেন বেঁচে থাকে পৃথিবীতে? তারা কিভাবে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেয়,চলাফেরা করে?তাদের কি কখনো কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হয় না?খারাপ কাজের জন্য দম বন্ধ হয়ে আসে না?

—” তুষার সাহেব,সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।আমাকে বাড়ি যেতে হবে।চলুন,বেড়িয়ে যাই।”
মহুয়ার কথায় তুষার তার দিকে তাকায়।মহুয়া তার পাশাপাশি হাঁটছে।দুজনের মাঝে অবশ্য দূরত্ব আছে।তুষারের হাঁটতে খারাপ লাগছে না।শেষ বিকালের নরম আলোয় মেয়েটার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছে সে।অনেকদিন পর আজ তুষার কারো সাথে এতো কথা বলল।আজকাল কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।তাছাড়া,সারাদিন কাজ শেষ করে রাতে মৃত্তিকাকে সময় দিতে হয়।মেয়ের খাবার রান্না করতে হয়,তার সাথে খেলতে হয়,মৃত্তিকার অব্যক্ত সব কথা বুঝে নিতে হয়,কথা শিখাতে হয়।কারো সাথে দু-দন্ড কথা বলার সময় কোথায়?

—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
—” না, কিছু না।”
—” আমার সম্পর্কে আর কিছু জানার আছে আপনার?”
—” হ্যাঁ, আরেকটা কথা।আপনাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার ছিল?”
—” দুজনেরই।আমি চলে আসার পর ওই বাড়ির সাথে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না।কারো সাথে কোনো কথা-বার্তাও হয়নি।এভাবে তিনমাস চলেছে।এরপর বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় বিচ্ছেদ।আবরারের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে উকিলের চেম্বারে,ডিবোর্সের সময়।”
—” কোনো কথা হয়নি আপনাদের মাঝে?”
—” নাহ।সেও চেষ্টা করেনি, আমিও বলিনি।কথা কেন বলবে?গলার কাটা নেমে গেলে কি কেউ আর কাটার কথা মনে রাখে?”
—” আচ্ছা,একটা কথা বলুন।আবরার অনন্যাকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাই তো?”
—” হুম।”
—” তাহলে,আপনার সাথে কেন সম্পর্কে জড়ালো?মানলাম বিয়েটা নাহয় রাগের মাথায় করে ফেলেছে।কিন্তু, আপনার কথা মতো সে বিয়ের এক-দেড় মাস পর থেকেই খুব স্বাভাবিক ছিল।যে তার প্রেমিকাকে খুব ভালোবাসে, সে কেন আরেক মেয়ের সাথে এতোটা স্বাভাবিক থাকবে?বিষয়টা কেমন গোলমেলে না?
মহুয়া হাসে।তুষার কি বোকা?এটা বুঝার জন্য প্রশ্ন করতে হয়?এমনিই তো বুঝে ফেলা যায়।
—” তুষার সাহেব,আপনি স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘এজ ইউ লাইক ইট ‘ নাটকটা পড়েছেন?”
মহুয়ার তাল ছাড়া কথায় খুব অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না তুষার।মাথা নেড়ে বললঃ”না।ইংরেজি সাহিত্যে খুব বেশি বিচরণ নেই আমার।”
—” আমি পড়েছি।অবশ্য নাটকের অনুবাদটা পড়েছি আরকি।সেখানে একটা সংলাপ ছিল।সংলাপটা অনেকটা এরকম-চোরদেরকে রূপার চাইতে রূপ বেশি প্রলুব্ধ করে।আবরারের সাথেও হয়তো এমনটাই হয়েছিল।আমাদের সবারই কিন্তু
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে।দুটো নারী-পুরুষ একসাথে একঘরে থাকবে অথচ তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে না,এটা শুধু নাটক-সিনেমাতেই সম্ভব।বিয়ের পর অনন্যা খুব বেপরোয়া আচরণ করতো আবরারের সাথে।আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল।বুঝতেই পারছেন, অনন্যার কাছে তখন স্বস্তি পেত না আবরার।যেখানে শান্তি থাকে না সেখানে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়।অন্যদিকে,আমি তো তাকে এতোটা যন্ত্রণা দিতাম না।বরং, বিয়ের পর থেকেই তার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করে এসেছি। তাই হয়তো আমার দিকেই ঝুকে পড়েছিল।”
—” মহুয়া,কারো প্রতি অভিযোগ নেই আপনার?”
—” কার প্রতি অভিযোগ করব, বলুন তো?আমার বাবা আমার ব্যাপারে খুব সচেতন।আমার জন্য একজোড়া জুতো কিনার আগেও বাবা তিন-চারটা দোকান ঘুরে।যেই দোকানে সবচেয়ে ভালো জুতো পায় সেটাই কিনে নিয়ে আসে।অথচ,বিয়ের আগে আবরারের সম্পর্কে শুধু এলাকাতেই খোঁজ-খবর নিয়েছে।অফিসে যেয়ে কোনো খবর নেয়নি।অফিসের প্রায় সবাই অনন্যা-আবরারের সম্পর্কের কথা জানতো।অফিসে যেয়ে খোঁজ -খবর নেওয়া কি উচিৎ ছিল না?এক্ষেত্রে, দোষ তো অনেকটা আমাদেরও ছিল।তারপর আবার আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ির কথাই চিন্তা করুন।তিনি কিন্তু ছেলের সম্পর্কের কথা জানতেন।তবুও, তিনি আমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে গেলেন।দোষ তো তাকেও দেওয়া যায়।”
তুষার কপাল কুঁচকে ফেললো।তারমানে আবরারের মা সব জানতো!
—” তিনি যদি সবই জানতেন,তবে অনন্যাকে কেন বউ করে আনলেন না?অনন্যাকে তার পছন্দ ছিল না?”
—” না।অনন্যার চলাফেরা অনেকটাই উগ্র।তাই আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি তাকে পছন্দ করতেন না।আমার বিয়ের আগে যখন তিনি দেখলেন আবরার ও অনন্যার মাঝে ঝামেলা হচ্ছে,তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারেন।আমাকে বউ করে নিয়ে যান।তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর হয়তো আবরার বদলে যাবে।”
—” আপনি কি করে জানলেন এসব?”
—” আফিয়া আপা একদিন ফোনে এসব বলেছিল আমায়।তাহলে এখন বলুন, আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব?সবাই তো একটু-আকটু দোষী।তার চেয়ে ভাগ্যের দোহাই দেওয়াই ভালো।এসব আমার ভাগ্যেই ছিল।নাহয়,আমার সাথেই কেন এতো এমন হলো?”

চারদিকে আলো-আধারের লুকোচুরি খেলা চলছে।এখনই হয়তো ঝুপ করে একমুঠো সন্ধ্যা নেমে আসবে।তুষারের পাশ দিয়ে একটা বাদামওয়ালা হেঁটে চলে গেল।তাকে থামিয়ে বেশ খানিকটা বাদাম কিনে নিলো তুষার।মহুয়া একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।তুষার ফিরে এসে মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
—“মহুয়া,নিন বাদাম খান।”
তুষারের প্রস্তাব হাসিমুখে নাকচ করে দেয় মহুয়া।
—” আপনি খান।আমি খাব না।”
—” না করবেন না প্লিজ।নিন।”
—“বিব্রত হবেন না তুষার সাহেব।বাদামের খোসা ফেলে খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।আমি আবার এসব বিষয়ে খুবই অলস।”
মুচকি হাসে তুষার।হাতের মুঠোয় বাদাম নিয়ে খোসা ফেলতে ফেলতে বলেঃ”ওহ,এই কথা।আগে বলবেন না।আমি ছিলে দিচ্ছি আপনি খান।এতে সমস্যা নেই তো?”
মাথা নাড়ায় মহুয়া।তুষার মহুয়ার হাতে বাদাম তুলে দিয়ে কুন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করেঃ”আপনি বোধহয় আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট,তাই না?”
—” আমার সাতাশ চলছে।আপনার?”
—” একত্রিশ।তাহলে আপনাকে তুমি করে বলি?আমি কাউকে খুব বেশিক্ষণ আপনি করে বলতে পারি না।”
মহুয়া হেসে ফেলে।অনুমতি দিয়ে বলেঃ” ঠিক আছে, বলবেন।এ আর এমন কি কথা।”
—” মহুয়া,তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে পারছ না।বিয়েটা তুমি স্বেচ্ছায় করছো না।পরিবারের চাপে করছো, তাই না?”
মহুয়া অবাক হয়ে তাকায় তুষারের দিকে।তুষারের কথা সম্পূর্ণ ঠিক।কিন্তু মহুয়া তো এমন কোনো আচরণ করেনি, যাতে করে তুষার বুঝতে পারবে।তুষার মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তুষারের মুখের দিকে তাকাতে বেগ পেতে হয় না।মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছে।এই প্রথম মহুয়া ভালোভাবে তুষারকে দেখলো।ইনিও যথেষ্ট সুপুরুষ।আগে হয়তো আরো বলিষ্ঠ ছিল।এখন স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।তুষারের একটা গেজ দাঁত আছে।হাসলে সেটা দেখা যায়।

—” কি হলো বললে না যে?”
—” ঠিক ধরেছেন।কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।আপনাকেও আমার ভালো লাগে।অনেকটা স্বার্থপরের মতো লাগে।”
তুষার সরাসরি মহুয়ার চোখের দিকে তাকায়।শান্ত গলায় প্রশ্ন করেঃ” কেন?”
—” মনে আছে,প্রথম দিনের কথা?আপনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, আপনি মৃত্তিকার জন্য আমাকে বিয়ে করছেন।এর মানে কী দাঁড়ায়?আপনার জীবনে আমার প্রয়োজন নেই।আপনার মেয়ের প্রয়োজনেই আপনি বিয়ে করছেন।এই কথার মাধ্যমে কিন্তু পরোক্ষভাবে আপনি মৃত্তিকাকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেন।আপনি নিজেই চিন্তা করুন, আপনার এই কথার পরেও কি মৃত্তিকার প্রতি আমার ভালো ব্যবহার আসবে?ওকে দেখলেই আমার হিংসা হবে।মনে হবে, ওর জন্যই আমার অধিকার খর্ব হচ্ছে।আপনার ওই কথার পর থেকেই আপনাকে স্বার্থপর মনে হয়।যে নিজের দিকটা ষোলো আনা দেখছে।কিন্তু,আমার দিক এক আনাও দেখছে না।”
তুষার মহুয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।তারপর হুট করেই প্রশ্ন করলোঃ”হিজাব বেধে টিপ কেন পরো? ”
অবাক হয়ে যায় মহুয়া। সে কি বললো আর তুষার কি বলল! মহুয়া বিস্মিত গলায় বলেঃ” মানে!”
—” মানে হচ্ছে, তুমি হিজাব পরেছো আবার কপালে টিপও দিয়েছ।বিষয়টা কি ঠিক হলো?”
—” এটা টিপ না তিল।ছোট থেকেই টিপের মতো একটা তিল আছে আমার।”–ভোতা মুখে উত্তর দেয় মহুয়া।
—” ওহ।তুমি কিন্তু আবার কিছু মনে করো না।আচ্ছা, আসল কথায় ?

চলবে।