যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-১৭+১৮

0
159

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৭|
#সাদিয়া_মেহরুজ

অলিন্দে কমলাটে রৌদ্দুরের ছড়াছড়ি। নরম, মিঠা রোদ। খুব বেশি উত্তাপ নেই। নীলাভ অম্বরের কিয়ৎ অংশ জুড়ে পদচারণ ধূসর মেঘেদের। বৃষ্টি নামার তাল বুনছে তারা। দৈত্যসম গাছ গুলো এলোমেলো, জোড়ালো বাতাসের তালে দুলছে। পাতার ঝনঝন শব্দ, মেঘেদের হুটহাট গর্জন আপাতত বাতাবরণ ব্যাস্ত এসবের মাঝে। শুভ্রাকাশ লহমায় ছেয়ে গেলো আঁধারে। গুড়ুম, গুড়ুম মেঘেদের গর্জন প্রখর হয়ে উঠলো। অলিন্দে অবিন্যস্ত হয়ে বসে থাকা তীরুর চট করে ধ্যান ভাঙল। তাকাল আকাশপানে। ভারী বিরক্তি নিয়ে শুধাল,

-” এই বর্ষাকালটা যাবে কবে? বিরক্তিকর! ”

বর্ষা মোটামুটি পছন্দ ছিল তীরুর। তবে পরিস্থিতি এবং অবস্থা সাপেক্ষে পছন্দটা পাল্টেছে। বর্ষাকাল আজকাল তাকে পীড়া দিতে শুরু করেছে। পানষে লাগছে পছন্দের সবকিছু। কেমন বিরক্তি, একগুঁয়ে ভাব জুড়ে সবকিছুতে। ধুর! এ কেমন জ্বালা জুটল নতুন করে।

পা চালাল তীরু। প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতর। মৌন পরিবেশ। কেমন এক নি ষ্ঠু র শীতলতা, নীরবতা ছেয়ে বাড়িটা জুড়ে। তীরুর কষ্ট হয়! সবকিছু ঠিক আগের মতো স্বাভাবিক কখন হবে? তীরু ওপরে উঠে আসে। সিঁড়ি বরাবর রুমটায় ও চট করে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার চক্ষু বরাবর দৃশ্যমান হয় এক নি ষ্ঠু র দৃশ্য! অরোন, ছেলেটা চোখ বুঁজে ম রা র মতো পড়ে আছে। শরীর ভীষণ দূর্বল। পুরো একটা দিন হাসপাতালে এডমিট থাকতে হয়েছে। বাসায় ফিরেও স্যালাইন দিতে হচ্ছে। ছেলেটার সাথে তার কথা হয়না। সেই যে আহত হয়ে চোখ বুজল জ্ঞান ফেরার পরও নির্লিপ্ত। নীরবতা পালন শুধু তীরুর সাথেই নয় সবার সাথে। কারো সাথে কথা বলছেনা। বাসায় ফেরার পর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে গেছে। সেই থেকে ঘুমে অরোন, এখন বিকাল।

জানালার কপাট উন্মুক্ত। বৃষ্টির ছাটঁ আসছে। তীরু জানালা বন্ধ করল। পর্দা টেনে গিয়ে বসল অরোন এর পাশে। অরোনের চুল গুলো ভীষণ লম্বা। কপাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একগাছি চুল। চোখ অ – দৃশ্যমান হয়ে গেছে। হাত বাড়াল তীরু। সন্তর্পণে সরিয়ে ফেলল চুল গুলো। তপ্তশ্বাস ছেড়ে আওড়াল,

-” কখন চোখ খুলবেন অরোন? আ’ম ফেড আপ! এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে আপনার ভালো লাগছে? ”

ডাক্তারের ভাষ্যমতে, অরোনের জ্ঞান ফিরে আসার কথা। কিন্তু এখন বিকাল পেড়িয়ে সায়াহ্ন নামার উপক্রম। ছেলেটার জ্ঞান কেন ফিরছে না? চিন্তিত হলো তীরু। চটজলদি আধশোয়া থেকে উঠে বসে যখনই দাঁড়াতে নিবে তখন আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে অরোন।

-” ঠিক আছেন? ”

চোখ দু’টো খিঁচে মাথা চেপে রেখেছে অরোন। মাথা কেমন ভার ভার লাগছে। শরীরটা অবশ হয়ে গেছে! কি ভীষণ জড়তা লেপ্টে। তীরুর কন্ঠ কানে এসে বাজতেই দেহের সকল সমস্যা চট করে উবে গেল। চোখ খুলে তাকাল ও, তীরুকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে। পরিশেষে দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-” তুমি ঠিক আছো তীরু? লাগেনি কোথাও? ”

বিছানার পাশ লেপ্টে তীরু বসল। গলার স্বর নম্র করে শুধাল,

-” আমার কোথাও লাগেনি। আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। আপনার ঘাড়ে ব্যা থা টা কমেছে কি? ”

সামান্য নড়চড় করল অরোন। অমনি বিষ যন্ত্রণাটা গা চাঁড়া দিয়ে উঠল! গলা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে নেওয়া আ র্ত না দ টা গিলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

-” হু, কমেছে ব্যা থা। ”

বোকা কিংবা অ ন্ধ নয় তীরু। অরোনের প্রতিক্রিয়া সবটুকুই গহীন চোখে পরখ করলো। য ন্ত্র ণা টুকু তার নজরে বেশ ভালোভাবেই গেঁথেছে। ও গলার স্বর নামিয়ে স্বগতোক্তি করল,

-” লোকটা এতো চাপা স্বভাবের! নিজের সমস্যার কথা কোনোদিনও আমায় মুখ ফুটে বলল না। ”

পরক্ষণেই অন্তঃকরণ থেকে তার উপচে বেড়িয়ে এলো তাচ্ছিল্য।

-” অবশ্য বলবেই বা কেন? দয়ার পাত্রী না আমি! আমাকে কি সবকিছু বলা যায় নাকি। অরোন তো কখনোই আমায় আপন ভাবেনি। ”

উঠে বসার চেষ্টা করছে অরোন। গায়ের অতশত আ ঘা ত! বসতে গিয়েই জুটল যতো ঝামেলা। আ ঘাতে চাপ পড়ছে। টান খাচ্ছে! সঙ্গে অরোনের মনে হচ্ছে তাকে কেও প্রতি মূর্হতে ধা রা লো ছু রি দিয়ে কা ট ছে ভারী য ন্ত্র ণা দিয়ে।

-” উঠছেন কেন? থামুন। ব্যা থা লাগছে না? বেড রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। ”

আশপাশে তাকাল অরোন। কাছে ধারে ফোন নেই। অন্তিকটাও নেই! নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্টে। ভারী সঙ্কোচ আর জড়তা নিয়ে অরোন নিম্ন গলায় বলল,

-” ওয়াশরুমে যাবো তীরু। ”

তীরু চটপট বলল, ” আসুন আমি হেল্প করছি। এ সময় তো অন্তিককেও পাবেন না। ও রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। ও বাদে রেস্টুরেন্ট কে সামলাতো? তাই আমি পাঠিয়েছি। আমি আমার কাঁধে হাত দিন তো দেখি। ”

অমত পোষণ করেনি অরোন। তীরু যা বলল তাই করেছে। আস্তে ধীরে পা নামিয়ে তীরুর কাঁধে হাত রেখেছে। সম্পূর্ণ ভর অবশ্য দেয়নি। এইটুকুন মেয়ে! তার ভর কি আর সামলাতে পারবে? উঁহু! অরোনের ডান পায়েও কা ম ড়ে দিয়েছে পাঁজি শেয়ালটা! তাই তো এতো জ্বালা। একা কারো সাহায্য তার হাঁটাটা দুষ্কর!

ওয়াশরুমের কাছাকাছি আসতেই অরোন অস্বস্তি নিয়ে বলল,

-” হয়েছে দাঁড়াও এখানে। বাকিটা আমি যেতে পারব। ”

দেয়াল ধরে ধরে অরোন বাকিটা পথ একাই গেল। তীরুর অবশ্য ইচ্ছে ছিল অন্ততপক্ষে ওয়াশরুমের দরজা অব্দি এগিয়ে দেয়ার। কিন্তু ছেলেটার মুখে খেলা করছিল অস্বস্তি। তাই বাড়াবাড়ি করেনি আর তীরু।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই অরোন সর্বপ্রথম তাড়া দিয়ে বলল,

-” একা যেতে পারব। তোমার কষ্ট করা লাগবে না। ”

তীরু ঠোঁট বাঁকাল অরোনের অগোচরে। ব্যাঙ্গ করে বলল,

-” ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারছে না আবার নাকি একা একা হেঁটে যেতে পারবে। যাক! আমার কি? ”

ভারী কষ্টে বিছানা পর্যন্ত এসে হাফ ছাড়ল অরোন। টাওয়াল দিয়ে হাত দু’টো মুছে ব্যাস্ত গলায় শুধাল,

-” আমি হাসপাতালে কি করে এলাম তীরু? জ্ঞান হারানোর পর কিভাবে সবটা ম্যানেজ করেছিলে?”

তীরুর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। অতঃপর কি যেন ভেবে ও ভারী গলায় বলে উঠলো,

-” আপনাকে সেখানে রেখেই আমি সাইকেলের কাছে এসে ব্যাগ থেকে ফোন নিয়েছি। অন্তিককে কল দেয়ার পর পুলিশকে কল দিয়েছিলাম। বাকিটা তারাই করেছে। ”

-“অহ। আমিও স্টুপিড! তোমাকে সেফলি বাসায় না পৌঁছে দিয়েই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছি। সরি তার জন্য। ”

দু’জনকে ঝাপটে ধরল মৌনতা। তীরুর অস্বস্তি হচ্ছে এবার। তার হোস্টেলে ফেরার সময় হয়েছে। এসময় না ফিরলে মাদার তাকে আর ভেতরে যেতে দেবেন না। একটা দিন তো হাসপাতালে অরোনের পাশে কাটিয়ে দিয়েছে। আজ অপেক্ষা করছিল ছেলেটার জ্ঞান ফেরার। হুঁশে এসেছে অরোন। তার কি এখন চলে যাওয়া উচিত? নাকি থাকা উচিত? দ্বিধাদ্বন্দে ভোগাকালীন তাকে উদ্ধার করে অরোন।

-” তোমার জিনিসপত্র কি এনেছো নাকি অন্তিককে পাঠাব? ” অরোনের স্বাভাবিক কণ্ঠ।

কিয়ৎক্ষণ হাসঁ ফাসঁ করলো তীরু। শেষে চট করে বলে উঠলো,

-” আনিনি। আনার দরকারও নেই। আমি থাকছিনা এখানে। এক্ষুণি চলে যেতাম। আপনার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষাতে ছিলাম। থ্যাঙ্ক’স দেয়ার ছিল। থ্যাঙ্ক’স ফর সেভিং মাই লাইফ! চললাম। ”

অরোনের মুখোবয়ব পাল্টাল। গম্ভীরতা ছেয়ে গেল মুখোশ্রী জুড়ে। দেহের য ন্ত্র ণা টুকু ভুলে ও চটপট উঠে দাঁড়াল। এগোল তীরুর নিকট। মেয়েটার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নিল কানের কাছে। কানের পিঠে ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে অরোন রূঢ় গলায় বলল,

-” সাতটা মাস দূরে ছিলে তীরু। আমি মেনে নিয়েছি কারণ আমি ভুল করেছিলাম। এখন আর নিতে পারছিনা আমি। তুমি কোত্থাও যাবেনা। শুনতে পেরেছো? আমি যেতে দিব না। ”

অরোনের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া এসে থামল তীরুর গালে, বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই কাটল। অতঃপর তীরুকে ছেড়ে খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বাহিরে চলল অরোন। যাওয়ার পূর্বে স্ব – শব্দে লাগিয়ে গেল দরজা সঙ্গে রেখে গেল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তীরুকে।

চলবে~

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৮|
সাদিয়া মেহরুজ

ধুপধাপ পা ফেলার শব্দ। অরোন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। সে এতক্ষণ যাবৎ নিচে ছিল। ব্যাকইয়ার্ডে পায়চারি করছিল। বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। অন্ধকার লেপ্টে আষ্টেপৃষ্টে। বড়সড় পর্দার ফাঁক গলে আসছে চাদেঁর স্নিগ্ধ রশ্মি। পশ্চিম দিকের জানালার কপাট উন্মুক্ত। সেখান হতে শো শো করে ছুটে আসছে গা হীম করা শীতল সমীর। অরোনের দেহ কেপেঁ উঠল! দ্রুত পা চালাল। দরজার কাছাকাছি আসতেই তার ভ্রু কুঁচকাল! দরজাটা যেভাবে ভিড়িয়ে রেখেছিলো সেভাবেই রয়েছে। তীরু রুমের বাহিরে বের হয়নি। মেয়েটা রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমোচ্ছে তবে!
ভেতরে প্রবেশ করলো অরোন। তার সারা দেহ জুড়ে লাল, নীল ব্যাথা, অত্যাধিক যন্ত্রণা! ভীষণ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। রুমটা অন্ধকার। বিছানার কাছটায় চাঁদের আলো পড়েছে। ঠিক তীরুর পুরো দেহজুড়ে ছেয়ে আছে চন্দ্র রশ্মি।

অরোন শুষ্ক ঢোক গিললো। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে তীরু। লম্বা চুলের দলের বিচরণ মুখোশ্রীতে। ওড়নাটা অবিন্যস্ত হয়ে ভারী অবহেলায় পড়ে আছে বিছানার এক প্রান্তে। বিড়াল পায়ে এগোল অরোন। বসল তীরুর সন্নিকটে। ভূমিতে পা গুটিয়ে। আবছা গলায় বলল,

-” চাঁদের গায়ে কলঙ্ক থাকে। কিন্তু আমার চাঁদের গায়ে তো কলঙ্ক নেই পৃথিবী। আমার চন্দ্রকন্যা পবিত্র, স্নিগ্ধ। ”

বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল! হৃদপিণ্ডের স্পন্দন অস্বাভাবিক। তাকে ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা, তাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা গুলোকে গলা চেপে হ ত্যা করলো অরোন। উঁহু! চাঁদকে স্পর্শ করা কি এতোই সহজ নাকি? তীরু! এই মেয়েটা সাত মাস ধরে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলেছে! বহুকালের ধৈর্যবান অরোন তীরুর এহেন কর্মকান্ডে মাঝেমধ্যে ধৈর্য হারা হয়ে পড়েছে। বলা হয় ‘ দূরত্ব বাড়লে গুরুত্ব বোঝা যায় ‘ কথাটা কি মিথ্যা? নাহ্! একদমই না। এইযে তীরুটা অরোনকে ছেড়ে চলে গেল তারপর অরোন ভেবেছিল এবার বুঝি জীবনে শান্তি আসবে। কেও নেই, যত্ন নেই, ভালোবাসা নেই! মন মতো নিজের জীবনটা নিজেই নিজ মতানুসারে পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু আমরা সবসময় যা ভাবি তাই কি হয়? হয়না। তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখী মানুষ থাকতো না। তীরুর অভাবটা অরোনকে পোড়াতে শুরু করে তিন মাসের বেলায়। আশপাশে কি যেন নেই! কিসের যেন নিদারুণ শূন্যতা। তিন মাস গিয়ে অরোন সেই শূন্যতা অনুভব করার কারণ উদ্ধার করে। তৎক্ষনাৎ সে চমকায়! থমকায়! তার বিশ্বাস হয় না। পরে গিয়ে সবটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়। তীরুকে অরোন ভালোবেসে ফেলেছে? উঁহু, তা নয়। তবে তীরু অরোনের জীবনের এক অপরিহার্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে। ভালোবাসা হয়নি। ভালোবাসা অরোনের কাছে বিশাল ব্যাপার। বিশাল ব্যাপার গুলো অতো দ্রুত ঘটতে পারে না। ধীরে সুস্থে ঘটে।

আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে তীরু। চোখ দু’টো কচলে তাকাতেই ও হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। বুকে হাত চেপে লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে ভীতি নিয়ে শুধায়,

-” ওহ আল্লাহ! অরোন আপনি? এভাবে অন্ধকারের মাঝে আঁধারের ভূত সেজে বসে আছেন কেনো? আশ্চর্য! ”

বিছানার কার্নিশে হাত চেপে উঠে দাঁড়ায় অরোন। কাল বিলম্ব না করে চট করে শুয়ে পড়ে তীরুর বাম পাশে। বলে,

-” না খেয়ে ঘুমোচ্ছো কেন? ”

ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নেয় তীরু। লজ্জা লাগছে! এভাবে অরোনের সামনে ছিল ভাবতেই গা কাটাঁ দিচ্ছে। জড়তায় আঁটসাঁট হয়ে যাওয়ার উপক্রম যখন তখন অরোন থমথমে গলায় শুধাল,

-” এখন লজ্জা পেয়ে কি লাভ? যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছি। ”

হতবিহ্বল তীরু! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” মানে কি দেখেছেন? সামান্য ওড়না ছাড়াই তো ছিলাম কেবল। ”

অরোন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল! দুষ্ট কন্ঠে আওড়াল,

-” তো আমি কি বলেছি নাকি ড্রেস ছাড়া ছিলে তুমি? আর অতো গভীরে কেনো যাচ্ছো? আমি তো তোমার চুল দেখার কথা বলছিলাম। ”

গাল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তীরু দেখে বেশরম ছেলেটাকে। কি সাংঘাতিক ঠোঁট কাটা কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে! তীরু শব্দগুচ্ছো হারাল। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অরোন! এই ছেলেটা অরোন তো?

তীরুর নির্লিপ্ততা দেখে অরোন আদেশের স্বরে বলল,

-” আমার জন্য খাবার নিয়ে আসো যাও। রাতে যে ঔষধ খাইনি তা তোমার খেয়াল আছে? আমি যে অসুস্থ মানুষ তোমার কি একটুও মায়া দয়া হয়না? হাঁটতে চলতে কষ্ট হয় বুঝোনা? ”

ঠোঁট বাঁকাল তীরু। ” এ্যাহ্! হাঁটতে চলতে কষ্ট হয়! এতক্ষণ যে টো টো করে ব্যাকইয়ার্ড চক্কর মে রে এলো। তখন কষ্ট হয়নি? ”

গলার স্বর নিম্নতর। তবুও কি করে যেন অরোনের কান অব্দি সব কথা গুলোই পৌঁছাল। উঠে বসলো অরোন। উদাস গলায় বলল,

-” ঘরে বউ পাত্তা দেয় না। তাহলে বাহিরে যাবোনা তো কি করবো? ”

হেঁচকি উঠে গিয়েছে তীরুর! ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল? কি অদ্ভুত ব্যাবহার। অরোন তো এমন নয়। তাহলে হলোটা কি? নাকি তীরুকে আঁটকে রাখার নতুন কৌশল এটা? জানা নেই! কিচ্ছু জানা নেই তার। ঝটপট বিছানা থেকে নেমে তীরু ছুটল। এখানে থাকলে না জানি আরও কত কি শুনতে হবে তার! তীরুর বিভ্রান্তিকর চেহারা দেখে অরোন মনে মনে হাসল। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। তীরুকে অস্বস্তিতে ফেললে দেখি ভীষণ আনন্দ হয় তার!

_

চাকরি হয়েছে তীরুর। ছোট খাটো একটা কোম্পানি এর চাকরি। বেতন ভালো হলেও কোম্পানি পছন্দ হলো না তার! তবুও মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরিটা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না। আপাতত টাকা পয়সার ভীষণ দরকার। অফিস থেকে বেড়িয়ে হাঁটা ধরলো ও। আজ রোদ উঠেছে। রোদের তেজ প্রচুর। ছাতাটা সঙ্গে না আনার জন্য নিজেকে শ’খানেক গালাগাল করলো সে। এতোটা বেখেয়ালি মানুষ হয়? তাও এই ভীনদেশে এসে! সড়কে হাঁটতে হাঁটতে স্বগতোক্তি করল,

-” স্টুপিড তীরু! তোর মতো মদন দুনিয়াতে আর একটাও নেই। ”

রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো। ঘুমিয়েছিল তিনটায়। উঠতে হয়েছে ছয়টা বাজে। অরোনের কারণে তার ঘুমোতে বেশ দেরী হয়েছে। একে ছেলেটাকে হাত দিয়ে খাইয়ে দিতে হয়েছে দ্বিতীয়ত খাবার শেষে আবার তাকেও খেতে হয়েছে। কি জ্বালা!

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তীরুর মেজাজ খারাপ হলো। অরোন বাহিরে। আবারও! তার নিষেধাজ্ঞা ছেলেটা শুনলো না, মানলো না। মেনেছে কখনো তার কথা? বোধহয় না। ও লম্বা পা ফেলে এগোল।

-” আপনাকে আমি শতবার বারণ করে গিয়েছিলাম না রুম থেকে বের হবেন না? ”

অরোন পেছন তাকাল। রগচটা তীরুকে দেখে আমতা আমতা করে অভিযোগ করলো,

-” একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কতক্ষণ পারে ঐ চার দেয়ালে বন্দী থাকতে বলো তো? আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিলো তাই বাহিরে এসেছি। ”

আকস্মিক উত্তরে তীরু হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারলো না। সে বাহিরেই গিয়েছিল বোধহয় এক ঘন্টা আগে।

-” কতক্ষণ? আমি বাহিরে গিয়েছি মাত্র এঘন্টা হয়েছে। এতটুকু সময় আপনি পারবেন না ঘরে থাকতে? ”

প্রিয় আসছে। এসে ও তীরুর সাথে জরুরি আলাপে মশগুল হলো। অরোন হাফ ছেড়ে বাঁচল! জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে নেবে তৎক্ষনাৎ তার হাত খপ করে ধরল তীরু। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-” যাচ্ছেন কোথায় ওদিকে? ওপরে চলুন। ”

পূর্বের সেই শাষণ! পূর্বের সেই যত্ন! অরোনের ভাল লাগল। যেতে যেতে ও আঁড়চোখে শত বার তাকাল তীরুর পানে। তার অন্তরাল তখন ব্যাকুল হয়ে চেঁচাচ্ছে,

-” এই তীরুকেই তো চাচ্ছিলাম আমি। মায়ের মতো যে আমায় আগলে রাখতো সর্বক্ষণ। ”

চলবে~