#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৯|
সাদিয়া মেহরুজ
ঘড়িতে আটটা বেজে দশ মিনিট। অম্বরে কালশিটে আঁধার লেপ্টে। কুচকুচে কালো আকাশটাতে আজ তারার অভাব নেই। মেঘহীন আকাশে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে তাদের। প্যারিসে বৃষ্টির মাত্রা কমে এসেছে। বর্ষার যাই যাই অবস্থা। মেঘলা আকাশ আস্তেধীরে হচ্ছে গুমোট, মেঘহীন। ব্যাস্ত সড়ক। ফুটপাত ধরে হাঁটছে তীরু। পিছে অরোন। ছেলেটাকে ভীষণ ব্যাস্ত দেখাচ্ছে। অনবরত কথা বলে যাচ্ছে এই আধাঘন্টা হলো। আশপাশে ধ্যান নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ফোনে কথা বলা ব্যাতীত দুনিয়াতে এই মূর্হতে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবশিষ্ট নেই। ক্যানে শেষ চুমুকটা দিয়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলল তীরু। বিরক্তি নিয়ে হাঁটা থামাল। কন্ঠে কাঠিন্যতা টেনে বলল,
-” এই আপনি আপনার এই হাসেরঁ প্যাক প্যাক করা থামাবেন? ”
তীরুর কন্ঠ ছিল জোড়াল। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দু’জন শ্বেতাঙ্গ আঁড়চোখে ওদের পানে তাকাল। বা হাতে ধরে রাখা ফোনটা কান থেকে সরাল অরোন। কল কে টে দিয়েছে। তার চোখমুখে লুটোপুটি খাচ্ছে বিভ্রান্তি, অস্বস্তি! ও কন্ঠের খাদ নামিয়ে শুধাল,
-” কি হয়েছে তীরু? তোমার কিছু চাই? ”
প্রতিত্তুর করার ইচ্ছে হারাল তীরু। পা বাড়াল। তার অফিস শেষে ছেলেটা যখন নিতে এলো তাকে তখন কি যে খুশি হয়েছিল! গাড়িতে যাওয়ার বদলে সে চট করে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো। বাঁধা দেয়নি অরোন। মেনে নিয়েছে। সুপারশপ থেকে সফট ড্রিংক’স কেনার সময় তীরু ভাবছিলো এবার একটু কাছাকাছি আসা উচিত। অনেক তো চললো অভিমান, অনুযোগ, শাস্তি দেয়ার পর্ব। এবার নাহয় একটু কাছাকাছি আশা যাক? পদচারণ শুরু করার খানিকক্ষণ বাদেই তীরুর পরিকল্পনায় পানি ঢেলে আসে ফোন কল! অতঃপর, অতঃপর সবটা হয়ে যায় এলোমেলো।
-” কথা বলছো না কেন তীরু? ”
অরোন দ্রুত পদে তীরুর পাশাপাশি এলো। মেয়েটা হুট করেই বেশ দ্রুত হাঁটছে। মুখোশ্রীতে চাপা ক্রোধ। কি আশ্চর্য! এতোটুকু সময়ের মাঝে হলোটা কি এই মেয়ের? ভাবনাকালীন অরোনের হুঁশ এলো তীরুর কর্কশ কন্ঠ শুনে।
-” আমি কি কোনো টকিং মেশিন যে অযথা পকপক করেই যাবো? ”
থতমত খায় অরোন। শুধায়,
-” তা বলিনি। কিন্তু তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি এর আগে। উত্তর দাওনি। ”
রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম। এদিকটায় তেমন গাড়ি চোখে পড়ে না। সড়কটা ফাঁকাই থাকে বেশিরভাগ সময়ে। তীরু আনমনে হাঁটছিল। আচানক অনেক দিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়লো তার। চঞ্চল হলো তার মন! অতশত না ভেবে ও চট করে জিজ্ঞেস করলো,
-” আপনি কি আমার কাছে কোনো কিছু লুকাচ্ছেন অরোন? এমন কোনো বিষয় যা আমি জানি না। ”
গলদেশ শুকিয়ে এলো অরোনের। বলল,
-” হটাৎ এ কথা বলছো কেন তীরু? তোমায় কেও কি কিছু বলেছে নাকি? ”
-” কেও কিছু বলেনি তবে আপনিই বলেছেন। ”
-” আমি! ”
-” জি। আপনার সেদিন জ্বর ছিল। বেশ আগের কথা এটা। আপনি জ্বরের ঘোরে বলছিলেন ‘ বাবা মা কে মা রে নি ‘ বারবার একই কথাই রিপিট করছিলেন। আপনার মা কে মা র তে যাবে কেনো? যতদূর জানি উনি পালিয়ে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। ”
তপ্তশ্বাস ছাড়ল অরোন। বিতৃষ্ণা, বিরক্তি, হতাশা ঝাপটে ধরল তাকে। নিজেকে শাসন করতে গিয়ে ও ভাবল, ভালোই তো হয়েছে! তীরুকে এখন সবটা জানাতে সুবিধা হবে। পাশেই একটা পার্ক রয়েছে। অরোন সেদিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-” বাসায় পরে যাই আজ। চলো ওদিকটায় গিয়ে বসি। তারপর বলছি সব। ”
ওরা পার্কে ঢুকলো। কপোত – কপোতী বাদে আর কেও উপস্থিত নেই সেখানে। পার্কটা শিশুদের জন্য তৈরি করা। শিশুরা মূলত দিনের বেলাতে আসে। বেন্চিতে বসে লম্বা শ্বাস টানল অরোন। শীতল কন্ঠে শুধাল,
-“আমার মা মা রা যায় যখন আমি বারো বছরের ছিলাম। মায়ের মৃ ত্যু টা স্বাভাবিক ছিল না। তাকে খু ন করা হয়েছিল। ”
তীরু উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-” কি বলেন! কে করেছে এ কাজ, আল্লাহ মাবুদ। ”
-” জানা নেই। সে ঘটনার পরদিন বাবা থানার কেস করেছিলেন। কাজ হয়নি। পুলিশ তদন্ত করলেও কোনো সুষ্ঠু কারণ খুঁজে পায়নি। মাকে হ ত্যা করা হয়েছিল এটা নিশ্চিত কিন্তু কে করেছে? কিভাবে করেছে? এটা কেও জানে না। পুলিশ তদন্ত করার পরও যথাযথ বিচার করতে পারেনি। তারপর আমি বড় হলাম। বাবাই সংসার চালাত। তবে মাঝে বাবা এক্সিডেন্ট করে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আমি চলে আসি প্যারিসে সংসারের হাল ধরতে। টাকা পয়সা যখন হাতে আসতে লাগলো তখন আমি সি.আই.ডি এর কাছে মায়ের কেসটা সম্পর্কে কথা বলছি। চার বছর হতে চললো। তারাও আশানুরূপ কোনো ফল আমায় দিতে পারেননি। জানা নেই কেনো। কি কারণে! তারপর লাস্ট কয়েকবছর ধরে হুট করে গ্রামে গুঞ্জন উঠেছে বাবা মায়ের হ ত্যার জন্য দায়ী। গুঞ্জন দিনদিন বাড়ছে। হটাৎ করে গ্রামের মানুষের এরূপ আচরণ মাথায় ঢুকছে না। এতোকাল কোনো কথা বলল না কিন্তু শেষে এসে তারা আমার বাবার ঘাড়ে দো ষ চাপিয়ে দিলো! ”
পুনরায় আর কোনো কথা বলল না তীরু। একমনে তাকিয়ে ছিল অরোনের পানে। ছেলেটার মুখোবয়ব পরিবর্তন হয়েছে। শীতলতা ছেয়ে থাকা চেহারায় ভর করেছে অমাবস্যা, ভীষণ ভীষণ কালচে দুঃখ! আকাশের পানে তাকিয়ে অরোন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশা নিয়ে আওড়াল,
-” মায়ের হ ত্যা কারীকে কখনো শাস্তি দেয়া হবেনা হয়তো। বিনা দোষে মা রা যাওয়া আমার মাকে, কে কেনো মা র লো তা হয়ত জানা হবেনা। নিজেকে কেমন ব্যার্থ সন্তান মনে হয় আমার। ”
ব্যাতিব্যাস্ত হলো তীরু। বলে উঠলো,
-” এভাবে বলবেন না। আপনি চেষ্টা করেছেন তো। বাকিটা আল্লাহ তায়ালার ওপর। তার কাছে দোয়া করুন। দেখবেন সমাধান পাবেন। ”
রাত বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অরোন এর বুক ঘাপটি মে রে বসে থাকা হাহাকার, বে দ না! সটান হলো অরোন। কিয়ৎক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে ও আচানক পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল। মাথা পাতলো তীরুর কোলে। আকুল গলায় শুধাল,
-” আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো তীরু। ”
তীরু তাই করলো। অরোন চোখ বুঁজেছে। তৎক্ষনাৎ তার অক্ষিকোটর হতে গড়িয়ে পড়ল একবিন্দু জল। ঠোঁট দু’টো তির তির করে কাঁপছে তার! কাঁদতে পারলে শান্তি লাগতো বোধহয়। কিন্তু তীরুর সামনে কাঁদে কি করে? লজ্জা লাগবে না! মায়ের কথা মনে পড়লে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে অরোন। নিজের সত্বাকে হারিয়ে ফেলে। পৃথিবীতে এই একটা মানুষই ছিল যাকে সে পাগলের মতো ভালোবাসতো। মায়ের সেই ক্ষত বিক্ষত দেহ চোখের সামনে ভেসে উঠলে তার মনে হয় সে এক্ষুণি মা রা পড়বে! ওমন নি ষ্ঠু র দৃশ্য সইতে পারবে না।
অরোনের মনবস্থা তীরু খানিকটা আচঁ করলো। ও কাঁধে হাত রাখল অরোনের। কানের কাছে অধর জোড়া নিয়ে ভরসা দিয়ে বলল,
-” আপনি আপনার মায়ের খু নী কে ঠিক খুঁজে পাবেন অরোন। হতাশ হবেন না! আমি আছিনা পাশে? ”
চলবে~
#যেখানে_পথচলা_শুরু |২০|
সাদিয়া মেহরুজ
কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা প্রিয় শব্দ শ্রবণ মাত্রই চমকাল! কি আশ্চর্য! এতো সকালে কিচেনে কে? বাড়িতে চোর – ডাকাত ঢুকলো নাকি? সে ব্যাতীত এই ভোর বেলা তো কেও কিচেনে যায় না। লম্বা কদম ফেলল প্রিয়। কিচেনের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে তীরুকে রান্না করতে দেখে ভারী চমকাল! খানিকটা লজ্জাও পেল। আজ বোধহয় তার ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
-” দুঃখিত ভাবি। আজ ঘুমটা এতো দেরীতে কিভাবে যে ভাঙল। আপনি রুমে যান আমি রান্না করছি। ”
প্রিয় ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল।
পেছন তাকায় তীরু। প্রিয়র মুখটা চুপসে রয়েছে! এমন ভাব, যেন সে বড়সড় অপরাধের আসামী। ও চমকাল! ভাবল, মিষ্টি মেয়েটার এই হাল কেন?
-” কোথায় দেরীতে উঠলে প্রিয়? ঘড়িতে সময় দেখেছ তুমি? মাত্র ৫ টা বাজে। এতো সকালে কেও ঘুম থেকে উঠে! যাও ঘুমোও গিয়ে। আজকে আমি রান্না করবো। ”
ছটফটিয়ে উঠলো প্রিয়। বলল,
-” না, না ভাবী। তা কি করে হয়? এটা তো আমার কাজ। তুমি পারবে না। কষ্ট হবে তোমার। ”
-” এটা যে তোমার কাজ তা কোথায় লেখা আছে শুনি? কষ্ট হবে না আমার। বললাম না? এখন আর আমাকে বাঁধা দিলে কিন্তু আমি রেগে যাবো। ”
তীরুর রূঢ় গলা শুনে প্রিয় হতভম্ব! কি করবে তা বুঝতে পারল না। জড়তা নিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে যখন ও দাঁড়িয়ে ছিল, তখন ঠেলে – ঠুলে তীরু তাকে বের করে দেয় রান্নাঘর থেকে। প্রিয় হতবিহ্বল! কিছুক্ষণ থম মে রে দাঁড়িয়ে রইল। পা ধরে আসতেই ও হাঁটা ধরল। দাঁড়িয়ে থেকে বিশেষ লাভ হবে না। তীরুকে পুনরায় ডাকার পর যদি রেগে যায়!
সংসারটাকে আগলে ধরা দরকার। নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয়ার দরকার। সবকিছু পরিপাটি করা দরকার। ভাবনা গুলো মাথায় ঘুরছিলো বেশ কয়েকদিন যাবৎ। কিন্তু কোথায় যেন জড়তা, এক গাদা সঙ্কোচের পাহাঢ়! অবশেষে পাহাড় ডিঙিয়ে সবকিছু আগলে ধরার পালা। তীরু ঘুম থেকে উঠে লেগে পড়েছে কাজে। ও অনেকদিন যাবৎ ভেবেছে, এ সংসারটা তার পক্ষে ছাড়া সম্ভব নয়। অরোনকে তালাক দিতে পারতো। সিদ্ধান্ত অব্দি নিয়েছিলো। কিন্তু অরোন তো অনুতপ্ত, ক্ষমাপ্রার্থী! ছেলেটাকে আরেকটা সুযোগ দিলে তো খুব বেশি অপরাধ হয়ে যায় না। তীরুকে হতাশ করছে না অরোন। এইযে এ বাড়িতে আসার পুরো আট – আটটা দিন একদম চোখের পলকে কে টে গেল! অরোন এ কয়েকদিনে অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে। তীরুকে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে। চাপা স্বভাবের মানুষটা কথা না বলুক অনন্ত বাড়ি ফিরে খোঁজ – খবর নিয়েছে। এতটুকুই তো যথেষ্ট! সময়ের সাথে সাথে হয়তো বা অরোনের আরো উন্নতি হবে। আরেকটু স্বাভাবিক হয়ে কাছাকাছি আসবে।
-” তুমি! ”
পেছন হতে ছিটকে এলো বিষ্ময় ভরা কণ্ঠ স্বর। হাত ধুয়ে ঘাড় ফিরে তাকাল তীরু। ফর্মাল ড্রেস পরে পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে অরোন। চোখেমুখে তার উপচে পড়া অবাকতার রেশ! তীরু এগিয়ে গেলো। ভ্রু দু’টো কুচকেঁ বলল,
-” হু আমি। এতো অবাক হওয়ার কি আছে আশ্চর্য তো! আমি কি কিচেনে আসতে পারি না? আসা নিষিদ্ধ নাকি? ”
আমতা আমতা করলো অরোন।
-” না তেমন না বিষয়টা। আগে কখনো দেখিনি তো। তাই আর কি! তুমি রান্না করছো কেন? প্রিয় কোথায়? অ সু স্থ নাকি?? ”
-” প্রিয় ঠিক আছে। অ সু স্থ নয়। ওকে আমি ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন থেকে এ বাড়ির রান্না আমিই করবো ভাবছি। ”
অরোন সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-” রান্না পারো তো? আমি কিন্তু কোনো অখাদ্য – কু খাদ্য খেতে পারবো না। ”
কান লাল হলো তীরুর। ছেলেটা তাকে মুখের ওপর অপমান করে দিলো! ও রূঢ় গলায় বলে উঠলো,
-” খেয়ে তারপর মন্তব্য করুন। আগেই নেগেটিভিটি আনছেন কেন মাথায়? ”
অরোন বলল না কিছু। কিয়ৎক্ষণ কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। প্রিয়, অন্তিক এলো বাদেই। তীরু খাবার সার্ভ করার পর টুকটাক কথা চলল তাদের ভেতর। খাওয়া শুরু করতেই তীরু তার নজর আটকাল অরোনের মাঝে। অরোন কথা না বলে চুপচাপ খাচ্ছে। প্রিয়, অন্তিক দু’জনই তীরুর হাতের রান্নার প্রশংসা করলেও মৌন অরোন। শেষ অব্দি সে মৌনতাকেই আঁকড়ে ধরে রইল। খারাপ লাগল তীরুর! দুই চারটা ভালো হোক কি মন্দ কথা বললে কি এমন হতো?খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অরোন তাড়া দেখিয়ে অন্তিককে নিয়ে চলে যায়। সেদিকে ভগ্নহৃদয়ে তাকিয়ে থাকে তীরু। তার মনবস্থা বোধহয় বুঝতে পারল প্রিয়। এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে নম্র গলায় শুধাল,
-” অরোন ভাই কিছু বলল না দেখে মন খারাপ করো নাতো ভাবী। ভাইয়া এমনই। অনুভূতি প্রকাশ করতে জানে না। সেই কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি। ”
অস্বস্তিতে পড়ল তীরু! প্রিয় তার মন পড়লো কি করে? ইশ! ভারী লজ্জা হচ্ছে এখন। সে কখনো কাওকে তার মনের কথা জানতে দেয় না। বুঝতে দিতে চায় না। মনের অব্যাক্ত কথা খুব কাছের মানুষ ব্যাতীত কাওকে বোঝাতে চায় না। আপাতত কাছের মানুষের তালিকায় তানহা রয়েছেন। এই তালিকাতে না অরোন স্থান পেয়েছে আর না ইলি। প্রিয় চলে গেল। তীরু আরো কিছুক্ষণ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
_
কি – বোর্ডে টাইপিং এ ব্যাস্ত তীরু। লাইব্রেরিতে নিম্ন শব্দের ঝংকার! কক্ষ শীতল। আলো নেই। ল্যাপটপ এর মৃদু আলো ব্যাতীত কক্ষ আঁধার। এসি অন করা থাকা সত্বেও ঘামছে তীরু। ললাট জমেছে বিন্দু বিন্দু জল। সরু বলিরেখার উৎপত্তি হয়েছে। চিন্তায় মন আকুপাকু করছে। মিলছে না হিসাব! কোথায় যেন গড়বড়। টানা চার ঘন্টা বিশ্রাম বিহীন দেহ। তবুও টেনশনে ক্লান্তি আসছে না। চোখ দু’টো কি নিদারুণ লালচে হয়ে! আরো কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো। সমাধান মিলতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল ও। নতুন চাকরি। প্রথমেই গড়মিল দেখা দিলে বিষয়টা কেমন দেখায় না?
চেয়ার ছেড়ে উঠতেই পা চিনচিন করে উঠল। বেশ সময় নিয়ে বসেছিল। রাত হয়েছে। সাড়ে বারোটা বাজে। অরোনের তো এসময় এসে যাওয়ার কথা। ছেলেটা কি এখনো বাড়ি ফিরে নি? ফিরলে তো তীরুর সাথে দেখা করে আসা মাত্রই! অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তবে আজ কি হলো? সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তীরু খেয়াল করলো সদর দরজা দিয়ে কেবলমাত্র ঢুকছে অরোন। শার্টের হাতা গুটিয়ে পা ফেলছে লম্বা লম্বা। সিঁড়ির গোড়ায় মুখোমুখি হলো দু’জন। প্রথমে কথা বলল তীরু।
-” এতো রাত হলো যে? ”
অরোন ভারী ক্লান্ত গলায় জবাব দিল,
-” ব্যাস্ত ছিলাম প্রচন্ড। আজ তো ভেবেছিলাম আসা হবে না বাসায়। ”
আশপাশ দেখতে দেখতে তীরু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
-” অন্তিক আসেনি? ”
-” উঁহু। ও আসবে না আজ। ”
কদম ফেলে সামনে এগোতে নিচ্ছিল তীরু। অমনি তার হাত খপ করে ধরে নিজের কাছে নিকটে অরোন। প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” তোমাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? কি করছিলে এতক্ষণ? ”
-” অফিসের কাজ ছিল। ওগুলোই করছিলাম। ”
ভ্র নাচাল অরোন। বলল,
-” রাতে রান্না করেছ তো? সকালে তো বেশ বলছিলে এখন থেকে তুমি রান্না করবে। ”
সলজ্জে নতজানু হলো তীরু। ইশ! কি সাংঘাতিক লজ্জা! সকালে বড় গলায় বলল আর তা পূরণ করা হলো না। মাথায়ই ছিল না তার। এসেই ব্যাস্ত হয়েছে অফিসের কাজে। বাসার সবাই এখন খাবেটা কি? মুখোশ্রী পাংশুটে বর্ণের হলো! চেহারায় শোভা পেল মলিনতা।
-” ইট’স ওকে তীরু। এভাবে কষ্ট পাওয়ার কিছু হয় নি। রান্নার কাজটা আমি মনে করি তুমি না করাই বেটার। মাঝেমধ্যে শখের বসো ইট’স এনাফ! বাট অন্যান্য সময় প্রিয়কেই নাহয় এই কাজটা করতে দাও? বেচারা এ বাড়িতে থাকতে নাহলে আনইজি ফিল করবে। ওকে আমি কোনো জব করতে দেইনি। ও দূর্বল প্রকৃতির বলে। জেদ ধরে রান্নাবান্নার দায়িত্বটা ও নিয়েছে। আমি নিষেধ করিনি। এখন যদি এই কাজটা তুমি করো তাহলে ও আমার কাছে জব করার আবদার করবে যেটা আমি চাচ্ছিনা। মেয়েটা অসুস্থ তীরু। বছরের বেশিরভাগ সময়ই ও সিক থাকে। ডাক্তার সবসময় ফ্রী থাকতে বলেছে। চাপ নেয়া নিষেধ ওর। আর এখানে জব করা মানেই হাজার হাজার প্রেশার নিজের কাঁধে তুলে নেয়া যা তুমি জানো। আমি ওকে আমার আপন বোনের মতো স্নেহ করি। আমার বোন আমার এতো টাকা পয়সা থাকতে কেনো ক ষ্ট করতে যাবে বলো তো? আশা করি আমি তোমাকে বোঝাতে পেরেছি। ”
-” জি, বুঝেছি। ” ছোট্ট করে প্রতিত্তুর করল তীরু।
ওপরে যেতে নিয়ে কি ভেবে যেন তীরুর সন্নিকটে এলো অরোন। তীরুর কাঁধ চেপে ধরে অধর ছোঁয়াল কপালে। অধর জোড়া গালে নামিয়ে এনে কন্ঠের খাদ নামিয়ে শুধাল,
-” এটা তোমার গিফট ছিল ফর মোটামুটি ভালো রান্না করার জন্য। ”
চলবে~