যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব-০৯

0
259

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৯)
~মিহি

৯.
ইদানিং অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছে সন্ধি। চোখ বন্ধ করলেই মাহিদের মুখ তার সামনে ভাসে। এটা যদিও মানা যায় কিন্তু খোলা চোখেও সে সারাক্ষণ মাহিদকে দেখে। যখনি স্পর্শ করতে যায় তখনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মাহিদ। মাহিদের সাথে এই লুকোচুরি খেলাটা মোটেও ভালত লাগে না সন্ধির। এত কাছে অথচ ছোঁয়া যায় না তাকে। অদ্ভুত রকমের কপট রাগের আভা সৃষ্টি হয় সন্ধির মুখে। তার উপর নেহার সাথে মাহিদের অতিরিক্ত ঘেঁষাঘেঁষি আরো বিরক্তিকর। লোকটা একটুও বোঝে না সন্ধিকে, বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। কাল ধর্ম পরীক্ষা, সবশেষে ইংরেজি প্রথম। এই বাহানায় মাহিদের সামনাসামনি বসে কিছুটা সময় অন্তত কাটাতে পারবে সন্ধি। কালকের পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে সে।

তূর্ণার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। রাফি আজকে পরীক্ষা দেয়নি, অবশ্য সে পরীক্ষা না দিলেও কিছু যায় আসে না। বাবার ক্ষমতা বলে ঠিকই পাস করিয়ে দেওয়া হবে কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো রাফি তূর্ণার কল রিসিভ করছে না। রাফির ফোন বন্ধ বলছে। এতবার ট্রাই করার পরও রাফির ফোন বন্ধ পেয়ে চিন্তার শেষ নেই তূর্ণার। রাফির চিন্তায় পড়াতেও মন বসছে না তার। আজকের পরীক্ষাটাও খুব বাজে গেছে, পাস উঠবে কিনা সন্দেহ। দু হাতে মাথা ধরে বসে আছে তূর্ণা। আচমকা ফোনের মেসেজ টোনের শব্দে চমকে উঠে। রাফির নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। একটা এম.এম.এস এসেছে। ভিডিওটা ওপেন করতেই তূর্ণার মাথায় বাজ পড়ে। এটা সেদিনকার হোটেলের ভিডিও। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তূর্ণা আর রাফির কাছাকাছি আসা। রাফির মুখ বিন্দুমাত্র দেখা না গেলেও তূর্ণার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁপা হাতে ফোনটা রাখে তূর্ণা।পরক্ষণেই আবার একটা মেসেজ আসে। ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করে তূর্ণা,

‘ ভিডিওটা দেখেছো, পাখি? আরো এক্সপ্লেইন করতে হবে? যাই হোক, এ ভিডিও আমি কাউকে দেবো না। বিশ্বাস করো, তবে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। সন্ধিকে আমার কাছে পাঠাতে হবে। কখন, কোথায়, কবে পাঠাবে সেটা তোমার ব্যাপার কিন্তু দুদিন সময় আছে তোমার কাছে। এর বেশি সময় কিন্তু পাবে না। টেক কেয়ার বেব।’

মন ভেঙে চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল তূর্ণার। এত বড় একটা প্রতারণা! সন্ধিকে পাওয়ার জন্য রাফি তাকে ব্যবহার করলো তাও এইভাবে? নিজের উপর রাগ হলো তূর্ণার। তার চেয়ে বেশি হচ্ছে চিন্তা। এ ভিডিও কারো চোখে পড়লে সন্ধির মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। রাফির উপর রাগ নাকি ঘৃণা ঠিক কোন অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না তূর্ণা। এই মুহূর্তে রাফিকে সামনাসামনি প্রশ্ন করতে পারলে শান্তি পেত সে কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। চোখের পানিও শুকিয়ে এসেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বুকের বা পাশটা চিনচিন করছে। ‘প্রথম ভালোবাসা সবসময়ই ভুল মানুষের সাথে হয় কেন?’ আনমনে লাইনটা আওড়াচ্ছে তূর্ণা। এক আকাশ গ্লানির পরশ তার কোমল হৃদয়টাকে ক্রমশ আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে।

ধর্ম পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই ক্লাসের একজন ডাক দেয় সন্ধিকে। বলে,’মাহিদ স্যার তোমায় স্টাফ রুমে অপেক্ষা করতে বলেছে।’ মাহিদের নাম শুনে ভ্রু কুঁচকায় সন্ধি। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সকাল থেকে মাহিদকে দেখেনি সন্ধি তবে চোখ বন্ধ করতেই মাহিদের মুখটা ভেসে উঠছে। শুভ্র সাদা শার্ট পড়া মাহিদের এলোমেলো চুলগুলো কপালে খেলছে। ঠোঁটে মাউথ অর্গ্যান, মাউথ অর্গ্যানের সুরে মুগ্ধ সন্ধি আবেশে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রয়। চোখ খুলতেই সে দৃশ্য কর্পূরের ন্যায় অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃশ্যের সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায় সন্ধির ভালোলাগাও। অদ্ভুত রকমের মন খারাপ ভাব এসে ঘিরে ধরে তাকে। ‘অপেক্ষা …’ বারবার আওরায় সন্ধি।

মাহিদের ডেস্কে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সন্ধি। স্কুল ছুটি হয়েছে আরো আধঘণ্টা আগে। টিচাররাও বাড়িতে চলে গেছে অথচ মাহিদ তাকে বসিয়ে রেখে কোথায় হাওয়া হলো কে জানে! ‘নির্ঘাত ঐ নেহা ম্যামের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। হুহ! বদ লোক একটা।’ কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতেই সন্ধির কানে আসলো মাউথ অর্গ্যানের সুর। আশেপাশে তাকালো সন্ধি। স্টাফ রুমের জানালার পাশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে আছে মাহিদ। পড়নে সাদা শার্ট, ঠোঁটে মাউথ অর্গ্যান। সন্ধি ধরেই নিয়েছে এটা স্বপ্ন ব্যতীত কিছু নয়। ধীরে ধীরে মাহিদের কাছে এগোয় সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে সামনাসামনি দাঁড়ায়। সন্ধি লম্বা বটে তবুও মাহিদের কাঁধের বেশি উচ্চতায় উঠতে পারেনি সে। গভীর মুগ্ধতায় ছেঁয়ে আছে সন্ধির সর্বাঙ্গ। ধ্যান-জ্ঞান সব যেন মাউথ অর্গ্যানের সুরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্যটা সম্পূর্ণই কল্পনা তা বুঝতে পেরেছে সন্ধি, হাত বাড়ালেই সব অদৃশ্য হয়ে যাবে তবুও এ মুহূর্ত তার ভালো লাগছে।

আচমকা একটা ভয়ানক কাজ করে বসলো সন্ধি। পা দুটো একটু উঁচু করে মাহিদের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। দু চোখ বন্ধ সন্ধির। চোখ খুলতেই মাহিদের হতবিহ্বল মুখটা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেল সন্ধি। সে তো ভেবেছিল এসব কল্পনা। তবে কী এসব সত্যি? মাহিদ সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়েছিল! লজ্জায় চোখজোড়া নমিত করলো সন্ধি। দ্রুত পায়ে প্রস্থানের চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো মাহিদের হাত। সন্ধির হাত ধরে রেখেছে মাহিদ।

– ‘কোথায় পালানো হচ্ছে ছাত্রীসাহেবা?’

– ‘স্যার, বিশ্বাস করেন। আমি ভেবেছি এটা আমার কল্পনা। আমি যদি জানতাম এটা সত্যিই আপনি, জীবনেও অমন করতাম না।’

– ‘কল্পনা? তুমি আমায় নিয়ে কল্পনা করো? তা কী কী কল্পনা করো?’

– ‘কিছু না। আমি বাসায় যাবো।’

– ‘আমি কাল চলে যাচ্ছি।’

– ‘মানে?’

– ‘ঢাকায় কাজ পড়েছে কিছু। মাস দেড়েকের জন্য চলে যাবো।’

– ‘ওহ।’

মুহূর্তেই মুখটা বেরঙ হয়ে যায় সন্ধির। লোকটা কত সহজে বলে দিল চলে যাবো! সন্ধির যে কষ্ট হবে, তা তো বুঝলো না। মাহিদ ব্যাপারটা বুঝলো ঠিকই তবে সন্ধিকে একটু জ্বালাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।

– ‘তোমার খারাপ লাগবে না আমি না থাকলে?’

– ‘খারাপ কেন লাগবে? কে আপনি আমার?’

– ‘সেটাই তো। কে আমি তোমার?’

শেষ কথাটা অনেকটা কাছে এসে বললো মাহিদ। সন্ধির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। কোনরকম রুম ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করতেই মাহিদ মৃদু স্বরে বলে উঠলো, ‘বিদায়বেলার ছোঁয়াটা আগামী দেড় মাস সযত্নে তুলে রাখবো।’ মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন থেমে গেল সন্ধির। মৌমাছির ঝাঁক যেন কানের কাছে এসে ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। এই ছুটে স্কুল মাঠ পেরোলো সে। পেছনে ফিরলেই দেখতে পেত কেউ একজন গভীর দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া অবলোকন করছে। মনের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ব্যথা সেও অনুভব করছে, প্রিয়জন থেকে দূরে থাকার ব্যথা।

সন্ধি ভেবেছিল আজ সে মাহিদের গালে চুমু খেয়েছে এর থেকে ভয়াবহ কিছু হতেই পারে না কিন্তু এর থেকেও ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে তার অগোচরে। তার এ কীর্তি দেখেছে তূর্ণা। তূর্ণা আপাতত ফুরফুরে মেজাজে আছে। সন্ধিকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা সে পেয়ে গেছে। এ পরিকল্পনা দিয়েই রাফির হাতে সন্ধিকে তুলে দিয়ে সে মুক্ত হবে। ব্যস! তারপর আর কোনোদিন ঐ রাফির মুখও দর্শন করবে না। প্রচণ্ড রাগে গা রিঁ রিঁ করছে তার। এত বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিল রাফি? সন্ধিকে পাওয়ার জন্য এভাবে ব্যবহার করলো তাকে? ভাবতেই কষ্টে চোখজোড়া ছলছল করে উঠে তূর্ণার।

‘ বিশ্বাস …সে তো কাঁচ,
তুমি বোঝার আগেই ভেঙে যাবে।
ভালোবাসা …সে তো মোহ,
কখন যে বিরক্তিতে রূপ নেবে।

দিনশেষে ভালো লাগবে না আর চিরপ্রিয় মুখখানা
ভালো লাগবে প্রিয় মানুষের হাজার শাসন, নিষেধ, মানা।
দিনশেষে তুমি একা, খুব একা,
রাতের মতো নিঃসঙ্গ তুমি, ঠিক রাতের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন
আলোর উপস্থিতি আর পাবে না তুমি, পাবে না জীবনের ছন্দ।’

তূর্ণার একটু পর পর ইচ্ছে করছে মরে যেতে, কখনো বা ইচ্ছে হচ্ছে রাফিকে মেরে ফেলতে। রাফির প্রতি তার বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। এত ঠুনকো ছিল বুঝি তার বিশ্বাস? চোখের জল মুছে এক হিংস্র পরিকল্পনায় মেতে উঠে সে।

চলবে…