রঙীন ফানুস পর্ব-১১

0
1683

#রঙীন ফানুস
#আফরিন ইভা
#পর্ব-১১

_______________________

——-“পরী ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলার শক্তিটুকু যেনো হারিয়ে যাচ্ছে ।
চোখের সামনে এমন একটা মর্মান্তিক দৃশ্য দেখবে পরী কখনো ভাবতে পারে নি।
ভাবতে পারে নি রাজ এভাবে নিজেকে
ক্ষতবিক্ষত করবে।
রক্তে পুরো বারান্দা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পরীর বিশ্বাস হচ্ছে না, চোখ দিয়ে দেখেও যেনো নিজের চোখ কে আজ অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে ।”

“পরীর বুক ডুকরে কেঁদে উঠলো।
পরী কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
রাজ ধারালো ছুরি দিয়ে হাত কে রক্তাক্ত করেই যাচ্ছে। যেনো শত্রুর হাতে আঘাত করছে। রাজ নিজের হাত যে ক্ষতবিক্ষত করছে, যেনো কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে।
রাজের স্বাভাবিকতা দেখে পরী অবাক হচ্ছে। ”

“পরী চিৎকার দিয়ে রাজের হাত থেকে ছুরি টা কেড়ে নিলো। রাজ কে জড়িয়ে ধরলো।
রাজের উষ্ণ বুকের আদ্রতায় নিজেকে শীতল করতে বড্ড উতলা পরীর হৃদয়।
পরী গভীর স্পর্শে রাজকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
পরীর কান্না আজ কোন বাঁধা মানবে না, যতো পারবে চোখের জল বিসর্জন দিবে।
পরী কখনো পারবে না নিজেকে মাফ করতে।
পরীর জন্যই আজ এই বেহাল দশা।
পরী রাখবে না এ জীবন রাখবে না আর, কষ্ট পেতে দিবে না রাজ কে। ”

“পরী রাজ থেকে সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়ালো।”

রাজের চোখ দু’টো ভীষণ রকম ফোলা, ঠোঁটের কালো তিল টায়ও আজ হতাশার ছোঁয়া লেগে আছে , চোখে অশ্রু জমে আছে, যে কোনো সময় গড়িয়ে পরবে।”

“পরী ছুরি টা নিজ হাতে নিয়ে, নিজের হাতের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।”

“মূহুর্তেই রাজের মুখ টা ফ্যাকাশে ছেয়ে গেলো।
পরী কি করছো?
প্লিজ লক্ষীটি এমন কিছুই করবে না তুমি?”

“পরী কান্না জনিত কন্ঠে বললো,” রাজ আপনি আমাকে আটকাবেন না।
আপনি কেনো নিজেকে কষ্ট দিলেন তাহলে?
আমার জন্য?
হা হা হা বিদ্রুপ করে হাসলো পরী।
আমার মতো অভাগী যেখানে যায়, নদীর পানি শুকিয়ে যায়।
আর আপনি আমার জন্য নিজের কাজিন কে কষ্ট দিলেন।
আর এখন রক্ত জরিয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন?”

” রাজ মায়া ভরা চাহনিতে পরীর দিকে তাকালো।
পরী তুমি কী চাও আমি নিজেকে শেষ করে দেই?

“না!
তা চাইবো কেনো?
আমি চাই আপনি হাজার বছর বেঁচে থাকুন।”

“হ্যাঁ পরী আমি বাঁচতে চাই হাজার বছর নয়, কোটি বছর তাও তোমাকে নিয়ে। তোমার বুকের উষ্ণতার ছোঁয়ায়।
তুমি পাশে থাকলে আমি মরে গিয়েও বেঁচে থাকবো তোমার হৃদয় কোটরে।
শুধু তুমি হাতে হাত রেখো।
তোমার ঠোঁটের পরশে আমি হতে চাই নীল জোৎস্না, ভালোবাসার নীল পদ্ম, রঙিন আকাশের রঙীন ফানুস,।
পরী তুমি কি আমার স্বপ্নের পরী হবে না বলো? প্লিজ নিজেকে কষ্ট দিও না।
আমি তো এটা ভেবেই নিজেকে কষ্ট দিয়েছি, তোমার হাতে আমার পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে জখম করে দিয়েছি। কতোটা না কষ্ট পাচ্ছো। জানিনা ক্ষমা করবে কিনা?
ভালবাসার শীতল পরশে ব্যাথার পরশ ছুঁয়ে দিয়েছি আমি অপরাধী পরী আমি অপরাধী বলে কাঁদতে কাঁদতে রাজ পরীর পা জড়িয়ে ধরলো।”

–” পরী রাজের কথা শুনে স্তব্ধ।
রাজের কথাগুলো পরীর মস্তিষ্কে গিয়ে ভিড় করছে।
রাজের এতো ভালোবাসার মূল্য পরী কিভাবে দেবে পরীর তা জানা নেই।
.
.
.
“পরী রাজ কে উঠিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো । ”

“রাজ পরীকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো।
পরী তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তাই না?
প্লিজ ক্ষমা চেয়ে তোমাকে ছোট করবো না। তোমার বুকে একটু জায়গা দাও।
আমি বেশি কিছু চাই না আর।
তোমার শীতলে আমি যে সিক্ত, তোমার আবেগে আমি যে বিমোহিত।
তোমার আগুন রূপে আমি ডুবতে চাই না, তোমার প্রেমে আমি ডুবতে চাই পরী।”

“পরী রাজকে আড়ষ্টতায় জড়িয়ে ধরলো।
আজ নেই কোনো বাঁধা, নেই কোন সংশয়।”

“রাজ পরীর বুকে হু হু করে কেঁদে উঠলো।
জানো পরী আমি তোমাকে কতটা চাই, কতটা গভীরভাবে চাই।
সমুদ্রের গভীরতা যেমন মাপা যায় না তেমনি আমার ভালোবাসাটাও মাপা যাবে না।
একমাত্র তুমিই বুঝবে আমার গভীরতা আমার দুর্বলতা।
জানো পরী সেই কবে থেকেই তোমাতে আমি ডুবেছি।
আরো চার বছর আগে থেকেই তোমাকে আমি চিনি।
যখন তুমি ইন্টারে পড়ো তখন থেকেই তোমাকে জেনেছি, চিনেছি। তোমার কলেজের নবীন বরনের কথা মনে আছে?

—” পরীর সেই দিন টির কথা আবারো মনে পরলো।কতো খুশিই না ছিলো পরী।”

তোমাকে সাদা, লাল মিশ্রিত শাড়িটায় কি যে লেগেছিল। এখনো চোখে লেগে আছে সেই সৌন্দর্য টা।
ড্যাডের হয়ে আমিই গিয়েছিলাম অতিথির মধ্যমনি হয়ে
তোমাকে দেখে তো আমি বিমোহিত।
কলেজের সেই বটতলার অপেক্ষা করতাম তোমাকে এক নজর দেখবো বলে।
এভাবে প্রতিদিন আমার চলতো।
হঠাৎ একদিন তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলি।তোমাতে আমি এতোটাই বিভোর ছিলাম যে, কখনো তোমার ঠিকানা টা জানা হয় নি।
তোমাকে কতো খুঁজেছি।
মনের চোখ দিয়েও খুঁজেছি কিন্তু তোমায় পাইনি।
মনের তুলি দিয়ে অনেক ছবি এঁকেছি, কতো চিঠি লিখেছি কিন্তু কোনো ডাকঘরে দোওয়া হয়নি সেই চিঠি।”

“এসব শুনে পরী যেনো পাথর হয়ে গেলো।
পরীর কোনো সাড়া নেই।
হাত থেকে ছুরি টা পরে গেলো।
পুরো শরীরটা যেনো ঢ’লে পরছে।কিছু বলার শক্তিটুকুও নেই পরীর। ”

“পরী আমার আঁকা ছবিগুলো দেখবে? ”

” পরীর কোনো সাড়া নেই।
সাড়া দিবেই কি করে রাজ পরী কে ভালোবাসে তাও অনেক আগ থেকেই।
কিন্তু পরী কখনো জানলো না বুঝলোও না।”

” রাজ পরী কে কোলে করে বদ্ধ রুম একটায় নিয়ে গেলো।
রুমটা একদম অন্ধকার।”

“রাজ রুমের আলো জ্বালিয়ে দিলো।”

“পরী পুরো রুম দেখে তো অবাক।
জায়গায় জায়গায় পরীর ছবি আঁকা।
পরী চার বছর আগে কি কি রঙের ড্রেস পরে কলেজে যেতো সব পোশাক পরা ছবি এঁকে রেখেছে।

–“বাহ্!”

“রাজ তো খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে।”
একটা ছবি বিশাল কাপড় দিয়ে ঘেরাও।
পরীর খুব কৌতুহল হলো ছবিটা দেখবার।
গুটিগুটি পায়ে পরী এগিয়ে গিয়ে ঢাকা কাপড় টা সরালো।মুহূর্তেই পরীর চোখে জল নেমে আসলো।
যা দেখলো পরীর চোখ কপালে।
পরী কে লাল, গোল্ডেন পাড়ের ভারি চমৎকার একটি লেহেঙ্গা পরিহিত ছবি আঁকা, নাকে নত,চুলে শিউলি ফুলের মালা, চোখে কাজল রেখা আঁকা , গালে টোল পড়া যেনো শিল্পীর আঁকা ছবি খুব খুব জীবন্ত।
এতোটাই জীবন্ত যেনো ছবিটা এখুনি কথা বলবে। ”

“পরী অবাক চোখে আঁকা ছবিটার দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রাজের দিকে তাকালো।
মনে মনে ভাবলো মানুষটা আসলেই প্রেমিক পুরুষ। যাকে না চাইলেও ভালোবাসতেই হয়।
এমন প্রেমিক পুরুষ প্রতিটি নারীর হৃদয়ের খোরাক, প্রাণের স্পন্দন, স্বপ্নের ছোঁয়া।

পরী রাজের হাত ধরে সামনে নিয়ে আসলো।
পরী চোখে চোখ রেখে রাজের গালে আলতো করে হাত রাখলো।
রাজের শীতল শরীরে পরীর স্পর্শ পেয়ে রাজ পরী কে জড়িয়ে ধরলো।
দু’জন দু’জনার স্পর্শে আজ শিহরিত, হৃদয়ের স্পন্দনে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে আজ দুটি মন।”

পরী জানো আমি কতো হাজার চিঠি লিখেছি তোমার মনের আকাশে কিন্তু পায়নি কোনো উত্তর। কতো পতীক্ষার পর পেলাম তোমায় হারিয়ে যেতে বুঝি?”

“মাঝে আমি অনেক বছর হতাশায় কাটিয়েছি, মম,ড্যাড আমার চিন্তায় কতোদিন ঘুমায় নি সেটা বিধাতা ভালো জানে।
মনে পড়ে তোমার, যে-দিন ড্যাড তোমাকে অফিসে দেখে তখুনি বুঝতে পারে অফিসের মেয়েটি এই ছবির মেয়েটি। তখন ড্যাড এক মূহুর্তের জন্যও দেরি করে নি, তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।”

“রাজ পরীর চোখে চোখ রাখলো, আজ এ চোখে প্রেমের তিলোত্তমা।
রাজ পরীর হাতে গভীরভাবে চুমু খেলো।
জানো পরী আমি যখন জানতে পারি ড্যাড তোমাকে খুঁজে পেয়েছে তখন যেনো আমি আমাতে নেই।
খুশিতে আমি আত্মহারা হয়েছিলাম তখন।
জীবন যেনো আবার পূর্ণতা পেলো।

তোমাকে হারিয়ে আমি লন্ডন চলে গিয়েছি শুধু তোমাকে ভুলে থাকবার জন্য। কিন্তু কি হলো আমি তো পারিনি তোমাকে ভুলে থাকতে।
দিন দিন যেনো আমার প্রেম গভীর নেশায় মত্ত হতে থাকলো।
মম, ড্যাড অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কারো কথাই আমার ভালো লাগতো না তখন।
.
.
.
—“পরী মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রাজ কে দেখছে। ব্ল্যাক গেঞ্জিতে রাজের ফর্সা রঙটা যেনো আরো চকচক করছে আজ।
রক্তিম ঠোঁটগুলো যেনো পরী কে খুব কাছে টানছে, চুল গুলো হিমেল বাতাসে ছলনার ছলে যেনো কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
রাজ আমিও যে আপনার প্রেমের তরী বাইতে চাই।
আপনার পরশে এ হৃদয় সিক্ত হতে বড্ড আকুল। নীল আকাশ ছুঁতে পারি আপনাকে নিয়ে, দূর আকাশে হারিয়ে যাবো যদি থাকেন পাশে।
এই পৃথিবী কে সাক্ষী রেখে বলতে চাই, জীবনে মরনে রাজ আপনাকেই চাই।
আমি ভালোবাসতে চাই আমার রাজ কে।
বিধাতা তুমি শুনতে পাচ্ছো, আমি রাজের ভালোবাসার সাগরে ভাসতে চাই।
মাঝি বিহীন নৌকার ন্যায় আমি যে আর নৌকা বাইতে পারছি না, পথ হারা পথিকের ন্যায় উদ্দাম হয়ে ছুটতে চাই না আর।
পরী নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না আর। রাজ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।”

“রাজ পরী কে বুকে জড়িয়ে ডাকতে লাগলো-
পরী এই পরী তুমি তো আমার স্বপ্নের পরী তুমি কি তা জানো?

–” পরীর কান্না যেনো আরো বেড়ে গেলো।

–” পরী এমন করে কাঁদছো কেনো?
আমি কী কিছু করেছি বলো?
সেই কবে থেকে ভালো বেসেছি আমার পরী কে।
আমার ভালোবাসা একটুও কমে নি দেখো আমার এ চোখে তাকিয়ে দেখো।
এ চোখে আছে শুধু পরীর নেশা, আমার পরী সবার চেয়ে ভিন্ন তা আমি জানি ।
তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আমি। ”

“পরী অবুঝের মতো রাজ কে জড়িয়ে ধরে রাখলো।রাজের কোনো কথাই যেনো পরীর কানে ঢুকছে না।”

“রাজ আহ্লাদী কন্ঠে পরী কে ডাকলো।
পরী এভাবে থাকলে হবে চলো, তোমার হাতে ক্রিম লাগাতে হবে। তোমার কষ্ট মানে আমার কষ্ট।
তাছাড়া আমার হাতেও ব্যাথা হচ্ছে। ”

“রাজের ব্যাথা শুনে রাজ কে ছেড়ে দিয়ে বড্ড ব্যাকুল হয়ে রাজকে নিয়ে রুমে আসলো পরী।
রাজের হাত টা দেখে পরীর হৃদয় টা যেনো কেঁপে উঠলো।
পরী রাজের হাত টা টেনে চুমু খেলো।
রাজের চোখে তাকিয়ে অভিমানী স্বরে বললো, আপনি যদি এগুলো আর করেছেন তো তাহলে সত্যি সত্যি আমি অনেক দূরে চলে যাবো, যেখান থেকে চাইলে আর আসা যায় না —

বলতে যাবে এমন সময় রাজ পরীর মুখে আঙুল দিলো।
পরী প্লিজ বলো না, আমি তোমাকে হারাতে চাই না আর।
আমি নিজেকে কষ্ট দিতে গিয়ে অজান্তে তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি।
কথা দিচ্ছি এমনটা আর হবে না।”

“পরী রাজের হাত ব্যান্ডেজ করে দিলো।”

“রাজও পরম যত্নে পরীর হাতে ক্রিম লাগিয়ে দিলো।”

“দু’জন নিচে গেলো।
মায়ের সাথে খেতে বসলো।

হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।
রাজ পরী দু’জনের বুক টাও ভয়ে কেঁপে উঠলো।”

“দরজা খুলতে পরীর শ্বাশুড়ি যতো এগোচ্ছে দুজনার ভয় ততো বাড়ছে। পরীর শ্বাশুড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলো।”

“দরজা খোলার পর রাজ যাকে দেখলো বুকটা মুচড়ে উঠলো। রাজ কখনো ভাবে নি রাজ পরীর জীবনে আবার কেউ আসবে বাঁধা হয়ে । পরীর ভালোবাসা পেয়েও বুঝি হারিয়ে যাবে, রাজ গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো।”

#চলবে—-