#রঙীন ফানুস
#আফরিন ইভা
#পর্ব-১৪
_______________
—“পরী, ইতু দু’জনই বেশ অবাক চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে রইলো।”
“রাজ ইতুর কাছ থেকে শাড়িটা নিজের হাতে নিলো।
ইতু এটা আমি তোর জন্য নিয়ে আসিনি। এটা তো আমি আমার নীল পরীর জন্য নিয়ে এসেছি পরীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে কথাটা বললো।”
আজ চোখে চোখ রেখেছে কিছু বলবে বলে, মনে মনে অনেক কথা হয়, রাজের না বলা কথাগুলো যা হয়তো পরী শুনতে পায় না। ”
” ব্যাপারগুলো এতো দ্রুত ঘটেছে যে সব যেনো পরীর মাথার উপর দিয়ে গেলো।
পরী রাজের দিকে উদাসীন চোখে তাকালো। রাজের চোখে যে অসীম লীলা দেখেছে পরী ,তা দেখে পরীর অনাকাঙ্ক্ষিত মন আনচান করছে। ”
পরী ভাবনায় ডুব দিলো। ভাবনার রেশ যেনো কাটতে চাইছে না।
পরী মনে মনে চিন্তা করলো, ইতুর সব কথা তাহলে পুরোটা ঠিক নয়।
পরীর জন্য রাজের একটু হলেও ভালোবাসা আছে। নয়তো শাড়িটা এভাবে নিয়ে নিতো না।
পরী ইতুর দিকে তাকিয়ে দেখলো, ইতু বেশ মন খারাপ করে আছে তাছাড়া ইতু তো বাড়ির মেহমানও বটে। পরীর খারাপ লাগছিলো ইতুর মন খারাপ দেখে।
পরী রাজের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো, ” রাজ শুনছেন আমার কথা?
ইতুর হয়তো শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে, শাড়িটা বরং ইতুকে দিয়ে দিন। পরে না হয়
আমাকে আরেকটা শাড়ি কিনে দিবেন!”
” রাজ পরীর মুখপানে তাকিয়ে মিষ্টিমুখে জবাব দিলো, “না পরী এই শাড়িটা আমি তোমার জন্যই ভেবে কিনেছি।
দরকার হলে ইতু কে পরে কিনে দেবো।
ইতু এতে কিছুই মনে করবেনা?
কি বলিস ইতু? ”
“ইতু মুখ টাকে হাসি-হাসি করে বললো,” হুম নো প্রবলেম। ঠিক আছে আমি এখন আসি বলে ইতু চলে গেলো।”
” এদিকে পরী ঠিকই বুঝতে পারলো, ইতু মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে।
পরীর খুব খারাপ লাগলো ইতুর জন্য।”
” রাজ পরীর হাত স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করলো, ” এই পরী তোমার হয়েছে কী বলো তো? তোমাকে সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি। আচ্ছা তুমি কি আসলেই পরী, নাকি মানুষ বলো তো ? ”
” পরী রাজের দিকে অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,” কেনো আপনার কি সন্দেহ আছে? ”
” রাজ এক ঠোঁট দিয়ে আরেক ঠোঁট কামড়ে ধরে জবাব দিলো, ” আমার তো খুব খুব সন্দেহ।
পরী অবাক হয়ে বললো,”কেন?”
রাজ আস্তে করে পরীর গালে হাত রেখে আবেগ মাখা কন্ঠে চুপিচুপি বললো,” জানি না পরী। ”
“কি আছে তোমার কাজল কালো চোখে, বারবার হারিয়ে যা-ই দূর আকাশে।
নীল শাড়ি, নীল চুড়ি পড়িয়ে, কপালের কালো টিপে লুকিয়ে পরতে চাই আমি।
তোমার দুকানের ঝুমকা হয়ে দুলতে চাই তোমার মায়াবী কানে, তোমার মনের রঙীন ফানুস হয়ে উড়াতে চাই সকল দুঃখ।”
” “রাজের কথাগুলো শুনতে পরীর ভীষণ ভলো লাগছে। ”
“রাজের এমন হৃদয় ছোঁয়ানো কথা হৃদয়ে গিয়ে নাড়া দিচ্ছে। ”
হৃদয়ের অতল গহ্বরের প্রতিটি কোষে গিয়ে যেনো দোলা দিচ্ছে পরীর।
রাজের হাসি মাখা সূর্যের ন্যায় মুখপানে তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগছে পরীর।
দাদীর কথা ভীষণ মনে পড়ছে পরীর।
দাদী ঠিকই বলতো পতি হচ্ছে পরম ভক্ত।
যাকে শুধু ভক্তি করেই হৃদয়ে ছোঁয়া যায়।
যে ছোঁয়ায় মনের সমস্ত অসুখ হার মানতেও রাজি। ”
” পরী আর পারছেনা দাঁড়িয়ে থাকতে ”
চোখমুখ সব অন্ধকার হয়ে আসছে।
নিজেকে শক্ত রাখতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
শেষ পর্যন্ত পরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা ঢ’লে পড়ে যেতে লাগলে রাজ বাহুডোরে ধরে ফেললো।”
.
.
.
” বেশখানিক্ষণ পর মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে পরীর। পুরো শরীর যেনো পুড়ে যাচ্ছে পরী উঠতে গিয়েও যেনো পারছে না। শরীরটা বেশ ভারী-ভারী লাগছে।
বেশ নিভু নিভু চোখে তাকালো পরী।
পরীর চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
বহু কষ্টে চোখ দু’টি মেলে তাকালো পরী।
তাকিয়ে বেশ চমকে গেলো।
” রাজ পরীর হাতটা বুকে নিয়ে গভীরভাবে ধরে রেখেছে।
রাজের দু-চোখ ঝর্ণা ধারার মতো অশ্রুসিক্ত হচ্ছে।
পরীর বুক টা কাঁপছে, রাজ এমনভাবে কাঁদছে কেন কিছুই যেনো বুঝতে পারছেনা পরী।
পরী হাত বাড়িয়ে রাজের দু-চোখ মুছিয়ে দিলো।
রাজ পরী কে বললো,” পরী তুমি আমাকে কেন বলনি তুমি যে অসুস্থ?
তুমি জানো আমি কতটা চিন্তিত ছিলাম? ”
” পরী রাজের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাজের মুখ টা শুকিয়ে বেশ নিস্তেজ দেখাচ্ছে, চোখগুলো কেমন ফোলা ফোলা,চুল গুলো এলো-মেলো হয়ে এমনভাবে আছে যেনো অনেকদিন উনি মাথায় চিরুনি লাগায় না। পরী রাজের মাথায় আদর মাখা হাত বুলিয়ে চুলগুলো ভাজ করে দিলো।”
” রাজ এক ঠোঁট দিয়ে আরেক ঠোঁট ভিজিয়ে আবার বলতে লাগলো, জানো পরী তুমি যখন পড়ে যাচ্ছিলে তখন মনে হয়েছিল এই বুঝি আমার নিঃশ্বাস আটকে যাবে, আমার পৃথিবীটা বুঝি অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো বলার সময় রাজের মুখ টা খুবি ভয়ার্ত লাগছিলো।
রাজ আবার দমিয়ে বলতে লাগলো, তুমি কতোক্ষণ সেন্সলেস ছিলে জানো?
টানা একঘন্টা, আমি তো পারছিলামনা আল্লাহর কাছ থেকে তোমায় কেড়ে নিয়ে আসি। আল্লাহ’র কাছে নফল নামাজ পড়ে কতো তাওবা করে তোমার জীবন ভিক্ষা চেয়েছি। অশেষ শুকরিয়া আল্লাহর কাছে তোমার জীবন যে ফিরে পেয়েছি। বুঝতে পারছো তুমি কতোটা কষ্ট পেয়েছি, ঠিক এই বুকের মাঝখানে। ”
” পরী বুঝতে পারছেনা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা মানুষটা এতো এতো ভালো কেন?
রাজ কেনই বা এতটা ভালোবাসে পরী কে ?
পরীর দু-চোখ যেনো আজ অশ্রুসিক্ত।
বলি বলি করেও বলতে পারছে না পরী কিছু একটা রাজকে। ”
“রাজ পরীর মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ” পরী এখন কেমন লাগছে তোমার? খিদে পেয়েছে খুব, খাবে কিছু, একটুখানি স্যুপ নিয়ে আসবো?”
” পরী রাজের বাহু আঁকড়ে ধরে বললো,” না কিছুই খাবনা আপনি বসুন আমার পাশে আমার আর কিছুই লাগবে না। ”
কিছুক্ষণের মধ্যে পরীর শাশুড়ি রুমে এসে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ” কিরে মা তুই ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করেছিস না কেন বলতো?
আমরা বুঝি তোর পর, নিজের মনে করে কি থাকা যায়না?”
” পরী শাশুড়ির হাতটা বুকে চেপে ধরে বললো, নিজের মনে করবোনা কেন?
তুমি তো আমার মা’ই। ”
” পরীর শ্বাশুড়ি পরী কে বুকে জড়িয়ে ধরলো। দু’জন এক মায়ার জালে যেনো বন্দী, একে অন্যের যেনো খুব চেনা বহু বছর আগ থেকেই। ”
” রাজ অভিমানী চোখে তাকিয়ে মা’কে বললো,” মা আমি কিন্তু আছি আমাকে কি তুমি ভুলে গেলে? ”
” পরী দুষ্টুচোখে রাজের দিকে তাকিয়ে বললো, হিংসুটে। ”
” রাজের মা মৃদু হেসে বললো,হয়েছে হয়েছে রাজ আর ইর্ষা করতে হবে না, দু’জন কে জড়িয়ে ধরে পরম মমতা মাখা কন্ঠে বললো,তোরা দুজনই আমার ছেলে মেয়ে।”
” পরীর শ্বাশুড়ি পরী কে ছেড়ে দিয়ে রাজকে বললো , রাজ পরীর আর কোন বাহানা শুনবিনা, আমি সোপটা নিয়ে এসেছি, গরম গরম খাইয়ে দে। এ কয়েকদিন আমি আর তুই ওর খেয়াল রাখব । ”
” রাজ মায়ের কথায় মিষ্টি হাসি হাসলো। মাকে ইশারায় আশ্বাস দিলো যে পরীর খেয়াল রাখবে। ”
“রাজের মা চলে গেলে রাজ স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে পরীর মুখেধরলো।
পরী প্রথমে খেতে না করলেও রাজের হাতে খাবে বলে রাজি হলো।
এক চামচ দু’চামচ করে রাজ পুরোটা খাইয়ে দিলো পরী কে। খাওয়া শেষে পরীর ঠোঁটের পাশে একটু স্যুপ লেগেছিল, রাজ টিসু বের করে কিছু একটা ভেবে টিসুটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো।
রাজ পরী কে কাছে টেনে খুব কাছে এসে নিজের ঠোঁট দিয়ে পরীর ঠোঁট মুছিয়ে দিলো।”
” রাজের স্পর্শে পরীর পুরো শরীর একদম জমে গেলো।
” একে অন্যের খুব কাছাকাছি থেকে যেনো নিশ্বাস শুনতে পাচ্ছে। শরীরে হীম বাতাস এসে যেনো কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে পরীর।”
” পরী অবাক হয়ে রাজের কান্ড দেখছে, কান্ড টা এতো দ্রুত ঘটলো যে পরীর কিছুই বলার ছিলো না। পরী নিশ্চুপ দৃষ্টিতে রাজের চোখে চোখ রাখলো।
রাজের চোখে যেনো খুশির ঢেউ খেলা করছে। রাজের এই হাসি মুখটা দেখে ক্লান্ত মন আজ শ্রান্ত হয়েছে। আজ আর কিছু বলে রাজের মনে তিক্ততার ছোঁয়া লাগাতে চায় না।
রাজের এমন কান্ডে পরী আর কিছুই বলেনি। নির্বিঘ্নে তাকিয়ে রইলো। ”
” রাজও যেনো ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে নিজেও এমন কিছু করবে রাজ নিজেও ভাবতে পারছে না।
রাজ আর কিছু না বলে লাইটটা নিবিয়ে শুয়ে পরলো।”
” এদিকে পরীর চোখে ঘুম নেই। পরী এপাশ-ওপাশ করছে। ”
” তা দেখে রাজ পরী কে ডাকলো।
পরী প্রথমে সাড়া না দিলেও পরে সাড়া দিলো।”
” রাজ পরী কে ডেকে বললো, পরী জানো আমাদের চোখে হাজারো স্বপ্ন থাকে, যা হয়তো আকাশকুসুম, হয়তো কিছু পূর্ণ হয়, আর কিছু অপূর্ণ থেকে যায় ।
তাতে কি বলো,?
স্বপ্ন না-ই বা ছুঁতে পারে মানুষ কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো নিষেধ নেই তা-ই না? ”
” রাজ কেন কথাগুলো বললো,পরী কিছুই বুঝলোনা। কথাগুলো পরী কে ভীষণ ভাবাচ্ছে। ”
” পরীর কোন আওয়াজ না পেয়ে রাজ পরী কে আবারো ডাকলো। পরী এই পরী পাগলিটা বিয়ের পর তুমি তো এই চারদেয়ালেই বন্দী হয়ে আছো।
আমি ভেবেছি আগামী দিন তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। যেখানে থাকব আমি,তুমি আর নদীর পাড়ের স্বচ্ছ পানি। যাঁর মিষ্টি সুভাসে দু’জনে ভেসে যাবো দূর থেকে বহুদূরে। যাবে তো পরী? ”
” মুহূর্তেই পরীর মন আনন্দে দোলা দিয়ে উঠলো। পরী রাজের কথায় সায় দিয়ে বললো যাবো।
কিছুক্ষণের মধ্যে পরীর ক্লান্ত চোখে ঘুম এসে ধরা দিলো।”
#চলবে—–