#রঙীন ফানুস
#আফরিন ইভা
#পর্ব-১৫
__________________
——-“পরী ফজরের নামাজ পড়ে আজ আর ঘুমায় নি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রশান্তমনে ভোর হওয়া দেখছে, আর প্রশান্ত মনকে শান্ত করছে।
চারদিক থেকে অন্ধকারের মৌনতা কাটিয়ে একটু একটু আলোর রেখা ফুটে উঠেছে। ভোরের আলোতে পাখি গুলোরও ঘুম ভাঙলো খুব সকাল সকাল ।
ডানা ঝাপটিয়ে একে অন্যকে জানান দিচ্ছে, এ বাসা থেকে ঐ বাসায় ছুটাছুটি করছে। পাখির কলরব গুলো দূর আকাশ থেকে ভেসে আসছে, যেনো মনোমুগ্ধকর দলীয় সংগীত গাইছে । দিনের আলোতে ব্যাস্ত হয়ে পরবে যান্ত্রিক মানুষগুলো।
প্রতিদিনের মতো যে যার কাজে বের হয়ে যাবে খানিক বাদে।”
“পরীর মনে পরলো রাজ তো বলেছিলো গতরাতে,পরী কে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
ব্যালকনিতে আর দেরি করে নি পরী, দ্রুত রুমে আসলো। রাজের দিকে এক নজর ফিরে তাকালো।”
“রাজের মায়াভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে একগুচ্ছ শুভ্র সাদা গোলাপের মতো ফুটে উঠল পরীর মন ।
পরী দু-চোখ সারাক্ষণ যেনো এ মানুষটাকে খুঁজে বেড়ায়। এ মানুষটা পৃথিবীর সবার সেরা যাঁর সবকিছুই শ্রেষ্ঠ।
পরী একপা দু’পা করে রাজের কাছে এগিয়ে গেলো। আরো সামনে গিয়ে রাজ কে দেখতে লাগলো গভীরভাবে। রাজের দু’চোখে যেনো অভিনব মায়া খেলে যাচ্ছে, মুখের আদল খানায় যেনো নূরের ছোঁয়া লেগে আছে ।
পরী একপা দু’পা এগুতে গিয়েও পিছিয়ে গেলো।
রাজের কাছাকাছি থাকলে পরী কে যেনো চুম্বকের ন্যায় টানে।
পরী লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।
দ্রুত গতিতে পরী রুম প্রস্থান করলো। ”
.
.
.
” পরী কিচেনে গিয়ে দেখলো, পরীর শাশুড়ি নাস্তা বানাতে ব্যাস্ত।
পরী মা বলে দ্রুত এগিয়ে গেলো।
পরীর শাশুড়ি পরীর দিকে তাকিয়ে বললো, একদম নয় পরী তুই রুমে যা আমিই বানাতে পারবো।”
“পরী পেছন থেকে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে মধুর স্বরে মা বলে ডেকে উঠলো। ”
” পাগলি মেয়ে আমার। তুই তো দেখছি ভারি দুষ্ট মেয়ে কাকে কিভাবে হাত করতে হয় সবই জানিস।
এখন বল তোর শরীরটা কেমন? ”
” আমার শরীর আমার এই মা’টার মতোই ভালো বুঝলে তো? ”
” তুই এখন রুমে যা, তোর শ্বশুর তো খুব রাগ করে আছে আমি না-কি তোর কোন খেয়ালই রাখি না।”
” পরী শাসনের ভঙ্গিতে বললো,চিন্তা করোনা মা, আমি বাবাকে আচ্ছা করে বকে দেবো। আমার কিউটি মা’কে কেন বকলো?”
” হয়েছে হয়েছে আমার হয়ে তোকে আর উকালতি করতে হবে না।
পরীর গালে কোমল হাতে স্পর্শ করে পরীর শাশুড়ি বলতে লাগলো, আমি মিষ্টি না, মিষ্টি হলি তুই। যে নামেও পরী দেখতেও পরী। এখন রুমে যা, রাজের কি লাগবে দেখে আয়। আর শুন ওকে আমার কথা বলবি, আজ যেনো অফিসে না যায়।
আমি বলে দেবো তোকে যেনো ঘুরতে নিয়ে যায়।
বাহিরের হাওয়া বাতাস লাগলে তোর আরো শরীরটা ভালো লাগবে।”
” পরী মনে মনে ভাবছে একবার কপাল পোড়ার পরও ভাগ্যক্রমে এমন ফ্যামিলির ভালোবাসা পাওয়া যায়। ”
.
.
.
“পরী চলে যেতে গিয়েও একনজর কিচেনের দিকে ফিরে তাকালো।
তাকিয়ে দেখলো ইতু এসে হাতে হাতে হেল্প করছে।
পরী আর কিছু না ভেবেই রুমে চলে গেলো।”
“রুমে গিয়ে দেখলো রাজ এখনো ঘুমচ্ছে।
পরী মনে মনে দুষ্টু ফন্দি আটলো।
পরী কাপড় পেচিয়ে রাজের কানে সুড়সুড়ি দিলো।”
“রাজ হুড়মুড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো।
রাজ চেচিয়ে বললো, এ-ই কে কে?”
“রাজের কান্ড দেখে পরী হেঁসে কুটি কুটি। পরীর হাসিতে পুরো রুম ঝংকার দিয়ে উঠলো। পরী হাসি থামিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালো।
বুঝতে পেরেছে রাজ হয়তো রাগ করেছে পরীর কান্ডে ।”
“হয়েছে টা কী পরী?
” তুমি কী এখনো ছোট? ”
“পরী ভয় পেয়ে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, দুঃখিত, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।
ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এতোটা রাগ করবেন। ”
“কর্কশ চেহারায় রাজ পরী কে বললো,তাহলে ভেবেছো কি?”
“রাজের কথায় পরী ভীষণ ভয় পেতে থাকলো। রাজের রাগ সম্পর্কে পরীর কোনো ধারণা নেই।”
“পরী ভয় পেয়ে যখন নিচে তাকালো, রাজ পরীর হাত ধরে একটানে নিজের পাশে এনে বসালো।”
” পরী একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে রাজের দিকে তাকালো। ”
“ভেবেছ কী?
আমি আমার পরী কে ধমকে চমকাবো!
না তো সেটা কখনোই পারবো না।
পরী কে কি ধমকানো যায় বলো, এই পরী কে যে অনেক কষ্টে হাজির করেছি ধমকাবো কেন?
এমনটা ভুলেও ভাববে না।
সে যা-ই হোক এখন তারাতাড়ি ফ্রেশ হবো।
ফ্রেশ হয়ে দু’জন বের হবো কোনো এক স্নিগ্ধ মায়াপুরীতে।”
“রাজ উঠে চলে গেলে রাজের হাত ধরা জায়গায় পরী স্পর্শ করলো। মুহুর্তেই পরীর মন খুশিতে ভরে গেলো।”
” সবাই নাস্তা করার সময়, রাজের মা রাজ কে বললো,” যতোক্ষণ পরী তোর সাথে থাকবে তুই কিন্তু খেয়াল রাখবি রাজ। ”
” ইতু অবাক হয়ে রাজকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ রাজ তুই কি কোথাও যাচ্ছিস পরী কে নিয়ে? ”
” রাজ আর কিছুই বলতে হয়নি। ”
“রাজের মম জবাব দিলো, হুম।
রাজ পরী কে নিয়ে একটু বাহিরে বেড়াতে যাচ্ছে। ”
“মুহুর্তেই ইতুর মুখে রাগের রেখা ফুটে উঠল। ইতু মুখ ফুটে কিছুই বলতো পারছে না, ভেতরে ভেতরে ঠিক জ্বলে যাচ্ছে। ”
ইতুর রাগটা কেউ না দেখলেও পরী ঠিকই দেখেছে। ”
“পরী খেয়ে উপরে চলে গেলো রেডি হতে।
.
.
.
“রাজ সোফায় বসে বসে মায়ের সাথে কথা বলছে।”
মুহুর্তেই রাজের চোখ একজায়গায় আটকে গেলো।”
“পরী কে নীল শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে, একদম অনিন্দ্য। ইতুসহ সবাই পরীর দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো । ”
“সবাই এভাবে তাকিয়ে থাকাতে পরীর ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।
লজ্জার জন্য হাঁটতে গিয়েও যেনো পা আটকে যাচ্ছে শাড়িতে। তবুও বহুকষ্টে নিচে নামলো পরী।
“সবাই এখনো ডেঁপ ডেঁপ করে দেখছে পরী কে।”
“পরী তাকিয়ে দেখলো, রাজ হা করে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে, চোখের পলকও ফেলছে না।”
“রাজের মা অস্ফুটে বলে উঠলো মাশাআল্লাহ। আল্লাহ আমার মেয়েকে নেক হায়াত দিয়ে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক। কোনো অশুভ শক্তির নজর যেনো না পড়ে।”
“এই রাজ মশা ঢুকবে তো বাবা, আর এভাবে তাকাস না, নজর লেগে যাবে যে।”
“পরী লাজুক হেঁসে রাজের দিকে তাকালো।”
“রাজ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে গাড়ির কাছে চলে গেল। ”
” পরীর শ্বাশুড়ি পরী কে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে বললো, বদনজর যেনো না লাগে আমার মিষ্টি মেয়েটার উপর । ”
” পরীও শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।”
“রাজ ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে আর পরী কে আঁড়চোখে দেখছে। যে দেখায় মন ভরে না রাজের।
আচ্ছা তুমি কী আমাকে মেরে ফেলবে?”
—পরী এদিক ওদিক তাকিয়ে রাজ কে জিজ্ঞেস করলো,” কাকে বলছেন?”
—“কেন ভূত কে!
আমার সাথে তো ভূত বসে আছে?
এতো সাঁজগোঁজের কি দরকার ছিলো? ”
“পরী মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করলো, কেন বাজে লাগছে বুঝি? ”
রাজ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, বাজে না ছাই,আমাকে শুধু শুধু মেরে ফেলার ফন্দি , এমনি ধরে রাখতে পারি না নিজেকে, আর এখন তো পুরোই পরী সেজে বসে আছো। যদি তুমি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে বুঝতে।
নিজের তো কষ্ট হয় না শুধু শুধু অন্যকে কষ্ট দেওয়ার প্লেন করো।”
“পরী রাজের দিকে তাকিয়ে বললো,” বিড়বিড় করে কি বলছেন, ক্লিয়ার করে বলুন বুঝি নাতো? ”
“রাজ এবার একটু উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,যেভাবে নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, নীল টিপ পড়ে নীল পরী সেজেছ, কখন না জানি কিডন্যাপাররা এসে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। ”
“পরী মিষ্টি হেসে ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকিয়ে রাজ কে বললো, সুপারম্যানের মতো জামাই থাকতে কিসের চিন্তা আমার! ”
” রাজ বির বির করে বলতে লাগলো,নামেই জামাই শুধু আমি। জামাই হ’য়ে একটু কাছে গেলেই তোমার জ্বর ১০৩ ডিগ্রী হয়ে যায়।
তা আর বলতে, তোমার মতো পরী পাশে থাকলে সব পারবো আমি।
রাজ পরীর হাত টা কাছে নিয়ে ভালোবাসার ঠোঁট ছোঁয়াল।”
“রাজের আলতো স্পর্শে হৃদয় আজ শিহরিত পরীর।
মুহুর্তেই গাড়ি থেমে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখলো বিশাল নদী।”
“রাজ গাড়ি থেকে নেমে পরী কে নামালো।
পরীর হাত ধরে রেখেছে রাজ।
দুপুরের তপ্ত রোদে চারদিক জ্বলজ্বল করছে। নদীর পারে দু’জন আজ এক মন করে হাঁটছে। হাত দুটি যেনো সারাজীবনের জন্য আবদ্ধ। রৌদ্র তপ্ত দুপুরে নদীর পারে হাঁটার মজাই আলাদা। প্রচন্ড গরমে যখন নদীর বুক থেকে বাতাসের ছোঁয়া এসে শরীর স্পর্শ করে, তখন মন থাকেনা মনের কিনারে, তৃপ্ত এক শান্তি এসে দোলা দেয় হৃদয়ে।
আজ ভীষণ রকম ভালো লাগছে পরীর। নদীর বুক ছিঁড়ে ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছে পরীর কর্ণ পাতে। যেনো কেউ নৃত্য করছে আপন বেখেয়ালি মনে। নদীর আছে বিশাল দীর্ঘতা, যে দীর্ঘতা সবার অজানা।
পরীর আছে বিশাল মন, মনে আছে ভালোবাসা, আছে আবেগ কিন্তু পরী যে কাউকে ভালোবাসতেই পারেনা।
পরীর মতো মানুষদের আছে রূপ কিন্তু এ রূপে আছে অনেক কলংক।
পরী এসব আপন মনে ভেবে যাচ্ছে।
পরীর ইচ্ছে করছে রাজের কাঁধে মাথা রাখতে।
পরী আজ সে আশা অপূর্ণ রাখবে না, সে যা হবার হয়ে যাক।”
“পরী আস্তে করে রাজের কাঁধে মাথা রাখলো।
দু’জন খুব নিবিড়ভাবে হাঁটছে।
আজ নেই কোনো ক্লান্ততা, আছে কিছু চাওয়া আর কিছু পাওয়ার মুগ্ধতা।
—পরী……
এ-ই পরী….
—হুম…
–“এই ক্লান্ত দুপুরটা কেমন লাগছে?
নিশ্চয়ই এই শরীর নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তোমার ?
—“উঁহু…”
তা হবে কেনো?
ভীষণ রকম ভালো লাগছে আমার, যা প্রকাশ করার সাধ্য নেই আমার।
আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও সেটা কম হবে। ”
“তাহলে থাক ধন্যবাদ দিও না, অন্যকিছু করো..
“মানে! পরী মাথা উঠিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো রাজের দিকে। ”
“রাজ দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বললো, ” লাজুকলতা এতো ভয় পাচ্ছো কেন?
এমন খোলামেলা কোলাহলে অন্যকিছু করতে বলবো বুঝি?
আমি তো বলতে চাইছি একটা গান করো?”
” পরীর প্রাণ যেনো স্পন্দিত হলো। এ বাবা আমি গান পারিনা বিশ্বাস করেন।”
“রাজ পরীর হাত ধরে বললো,ওকে তাহলে আমিই গাই… বলে রাজ একটি রবীন্দ্র সংগীত গাইলো।
রাজের কন্ঠ যে এতো টা চমৎকার পরী জানতোই না। ”
“পরী মুগ্ধ নয়নে বেশ কিছুক্ষণ রাজের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
দু’জন খুব কাছাকাছি, পরীর খোলা চুলে বাতাস এসে দোলা দিচ্ছে রাজকে , যা রাজের মন মন প্রাণ সব জুড়িয়ে দিচ্ছে। রাজ পরীর কপাল ছুয়ে দিলো,রাজের গভীর ছোঁয়া পেয়ে পরী চোখ বন্ধ করলো।”
“খুব ভালোই আছো দেখছি বেশ খুশিতেই আছো।”
“রাজ লোকটাকে তাকিয়ে দেখলো, চিনে বলে মনে হয় না রাজের , স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
–” পেছন ফিরে তাকালো পরী , পরীর অন্তরআত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো।”
চলবে—