#রঙীন ফানুস
#আফরিন ইভা
#পর্ব -১৮
____________________
–“পরী ঘামছে ভীষণ ঘামছে, পরীর নিশ্বাস আঁটকে আসছে, যেনো এখুনি মারা যাবে।
“রাজ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পরীর পানে।কিচ্ছুটি যেনো শুনতে পাচ্ছে না রাজ। চারদিক থেকে যেন শোঁশোঁ আওয়াজ আসছে কানে। ”
” হ্যাঁ রাজ আপনি যা শুনছেন তাই ঠিক।
আমি Hermaphrodite.
” কানে হাত দিয়ে চেপে ধরলো রাজ।
রাজ শুনতে চাইছে না আর, এই শব্দটা।
রাজের বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই।
পরীর সাথে এ কিছুতেই হতে পারে না।
রাজ হয়তো ভুল শুনছে।
” কথাগুলো বলছে পরী আর কাঁদছে।
কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরলো পরী।
পৃথিবী টা আজ থেমে যাক, পাখিদের কিচিরমিচিরের শব্দ হারিয়ে যাক, বাতাসরা অভিমান করুক, তবুও এটাই চায় পরী, রাজ সব জানুক, পুরোটা জানুক। রাজ ভুকে যাক পরী কে।
পরী আর লুকাতে চায় না নিজেকে।
” ফুলা চোখ নিয়ে পরীর কাছে এসে দাঁড়ালো রাজ।
পরীকে টেনে দাঁড় করালো।”
” পরী উঠতেই পারছেনা নিস্তেজ দেহটা নিয়ে, তবুও উঠে দাঁড়ালো। ”
” পরী তাকাও, আমার এ চোখে তাকাও।”
“আর্তনাদ চোখে তাকালো পরী। ”
” রাজের নিস্তব্ধ চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলো পরী। ”
” পরী তুমি মজা করছো আমার সাথে তাই না! আমি কিচ্ছুটি চাই না বিশ্বাস করো, সত্যি করে বলছি, একবার বলো,শুধু একটিবার, যা বলেছো সব মিথ্যা, পুরোপুরি মিথ্যা। আমি কখনো স্বামীর দাবি নিয়ে আসবো না, তবুও বলো যা বলেছো সব মিথ্যা।”
” না…না…. রাজ
আমি যা বলেছি সব সত্যি।
আপনি যা শুনেছেন সব সত্যি।
আমি সত্যি হিজরা।
আমি সমাজের ঘৃণ্য ব্যাক্তি, আমি অপরাধী।
আমার জায়গা এই পৃথিবীর ডাস্টবিনগুলোতে। আমি অভাগী, আমি আমার মা’কেও খেয়েছি।
.
.
.
” শব্দটা আবারো শুনবার পর, রাজের কানে যেন আর কিছুটি যাচ্ছে না।
রাজ পাথর হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।
শব্দটা রাজের বুকে এসে লাগলো।”
” রাজ পরীর হাত টা ছেড়ে দিলো।”
“পরী অনূভুতি হীন চোখে রাজের দিকে তাকালো। পরীর ভয় হতে লাগলো।
তাহলে রাজও কী সিমান্তের মতো পরী কে তাড়িয়ে দেবে। ”
রাজ যেভাবে ছিল ওভাবেই আছে। পরী চিন্তিত মন নিয়ে রাজের হাত ধরলো।
পরী কাঁদতে কাঁদতে রাজের গালে হাত রেখে বললো,বিশ্বাস করুন রাজ, আমি এমনটা ছিলাম না কখনো।
আমি জন্মগতভাবে এই অভিশাপ নিয়ে আসিনি।
আমার একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল। আমার যখন পাঁচ বছর তখন অনেক বড় অপারেশন করানো হয় আমাকে।
কিন্তু……. বলে
পরী থেমে গিয়ে আবারও বলতে লাগলো।
কিন্তু অপারেশন সাকসেসফুল হয়নি।
যাঁর কারনে আমার এই করুন দশা।
বিধাত হয়তো আমার উপর রুষ্ট ছিলো, যার কারণে আমার এই করুন পরিণতি, এই অভিশাপের ভুক্তভোগী আমি।
বলতে পারেন রাজ আমার সাথে কেন এমন হলো। কথাগুলো বলছে পরী আর অঝোরে কাঁদছে। ”
আমার দাদী কথাটা লুকায়িত রেখেছিলো।
পুরনো দিনের মানুষ ভেবেছিল বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আপনিই বলুন দূর্ঘটনা কী কখনো এমনি ঠিক হয়।
আমি হয়তো এই পৃথিবীর জন্যই নয়, তা-ই বিধাতা আমাকে এই অভিশাপে রেখেছেন।
” কাঁদতে কাঁদতে পরী আবারও বলতে লাগলো —
সীমান্তও অভিশাপ দিয়েছে, যেখানেই থাকিনা কেন আমি যেন খুব খুব কষ্টে থাকি। বলতে পারেন রাজ এতে আমার দূষ কোথায়?
আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই নি রাজ, আপনার জীবনটা নষ্ট করতে চাই নি। আমার আর আপনার বাবার দিকে তাকিয়েই বিয়েটা করেছি। ”
“পরীর কথায় রাজের কোন সাড়া নেই, রাজ এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
পরীর কথাগুলো যেন কানেই যাচ্ছে না রাজের। ”
” রাজের এমন নিস্তব্ধতা পরী কে ভীষণ বিদীর্ণ করছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে আবারো হাত ধরলো রাজের। কিন্তু রাজের কোন রেসস্পন্স নেই। ”
“বিমূর্ত মূর্তির ন্যায় রাজ দাড়িয়ে রইলো।”
” আমাকে আল্লাহ রূপ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ রূপের ব্যাবহারবিধির শক্তি দেয়নি, আমার এই রূপ, লাবণ্যের মায়াজালে অনেকেই ফেঁসেছে, কিন্তু পায়নি আমায় কেউ। আমার এ বুক আজও তপ্ত বালুকার ন্যায় মরুভূমি। যেখানে নেই, কোন অক্সিজেন, যা নিজে জ্বলে অন্যকেও জ্বালায়। কারো ডাকে সাড়া দিতে চাইলেও সাড়া দিতে পারিনি আমি।
আমি জানতাম আমার এই দূর্বলতা।
সীমান্তও প্রথম প্রথম আমার রূপের মায়াজালে ফেঁসেছিল। প্রথম প্রথম আমাকে অনেক যত্ন করতো।
কিন্তু যখন জানতে পারলো আমি তৃতীয় লিঙ্গের শিকলে বন্দি, তখন তার ঘরের এককোনায়ও আমার জায়গা মেলেনি।
আমি ওর পায়ে পড়ে কেঁদেছি কিন্তু ওর মন গলেনি।
গলবেই কি করে বলুন, পরিত্যাক্ত জিনিসগুলোর জায়গা হয় স্টোর রুমে বা ডাস্টবিনে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের জায়গা হয় ঘরের বাহিরে নয়, এই সমাজের বাহিরে। একমাত্র দাদী আমার কষ্ট বুঝতো।
কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস উনাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো।
তবুও শুকরিয়া জানাই উনি আমাকে মানুষ হিসেবে পাঠিয়েছেন।
যতোটুকু পারবো মন ভরে উনার আরাধনা করে যাবো।
.
.
.
” রাজ পরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো পরী মাথাটা নিচু করে খুব কাঁদছে।
” পরী রাজের কাছে এসে রাজের পা জড়িয়ে ধরলো।
রাজ বিশ্বাস করুন আমিও মানুষ আমারও অনূভুতি আছে। আমারও কষ্ট হয়।
আমারও বাসনা হয় কারো তীর্যক ভালোবাসা পেতে।
আমি পেয়েছিও বটে, কিন্তু তা পেয়েও হয়তো আজ হারাতে বসলাম বলে চোখ মুছলো।”
” পরীর কতাগুলো রাজের মনকে খুব করে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
বলিদান করতে ইচ্ছে করছে নিজেকে।
দ্বিখন্ডিত করতে চাইছে নিজেকে।
রাজের মাথা কিছুতেই কাজ করছেনা।
মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে নিজের চুলকে।
রাজের ইচ্ছে করছে এমন কিছু করতে যাতে এ বুকের সব ব্যাথা উধাও হয়ে যায়।”
“রাজ আমি যে কোন পুরুষ কে ভালোবাসতে পারবো না তা আমি জানি।
কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে মন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছি।
জানি যা ভাবা নিতান্তই আকাশ কুসুম।
কিন্তু কি বলুন তো, মন কি মানে কোন বারন।
মনের উপর যে জোর খাটেনা কারো।
প্লিজ আপনি কষ্ট পাবেন না।
আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না।
আমার যে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা যদি জানতে পারে এবারের বিয়ে টাও ভেঙে গেছে সত্যি উনি মরে যাবেন।
আমি আর হারাতে চাই না রাজ বিশ্বাস করুন, হারানোর বেদনাটা খুবি তীব্র হয়।
আর সহ্য করতে পারব না আমি।
বলতে পারেন রাজ আমাকে কেন এই হারানোর ব্যাথাটা সহ্য করতে হয়।
মৃত্যুযে কোন কিছুর সমাধান নয়, তা আমি জানি। জগতে অনেকেই হারানোর ব্যাথা নিয়ে বেঁচে আছে। কই তাঁরা তো মরেনি, তাহলে আমি কেন মরবো?
আর আমি না হয় আমার ইহকালকে হারিয়েছি, ইহকালে না হয় সব কিছু নাই বা পেলাম, তাই বলে পরকাল কেও হারাতে পারবো না।
পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে সব সুদে আসলে ভিক্ষা চাইবো।
একালে নাই বা পেলাম আপনার ভালোবাসা।
পরকালে ঠিকই পাবো এ আশায় বুক বাঁধিব। ”
” পরী কথাগুলো একদমে বললেও এখন বেশ হাঁপাচ্ছে। আজ কথা যেন থামছেই না পরীর। সব কথা যেন আজ এখানেই থেমে যাবে।
পরী যেন মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে, এগুলো বলবে বলে।
—-“বুকে নাই বা দিলেন জায়গা কিন্তু এই ঘরের কোন এক কোনে পড়ে থাকবো আমি। ”
আপনি আবার বিয়ে করুন।
আমার কোন আপত্তি থাকবেনা।
আমিও চাই আপনি সুখে থাকুন ভালো থাকুন।
আপনার সন্তান আসুক।
আমি এ বাড়ির চাকরানী হয়েই থাকতে চাই।
—রাজ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা, রুম ছেড়ে চলে গেল।
–রাজের এ যাওয়াটা পরীর যেন সহ্য হলো না।
পরী কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পরলো।
দুঃখ হলো পরীর একমাত্র সাথী।
যা কখনো পরী কে ছেড়ে যায়না।
সবাই ছেড়ে গেলেও দুঃখ ছেড়ে যায়না,যা পরী কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে।
যা হাজারো বাহানা দিয়ে পরী কে ঘিরে ধরে।
শিউলি ফুলগুলো এখনো সুভাষ ছড়াচ্ছে, মোমবাতিগুলো এখনো জ্বলছে, হয়তো আর কিছুক্ষণ পরেই বিলীন হয়ে যাবে পরীর মতো। পরীর ভালোবাসা টাও বিলীন হয়ে যাবে এভাবে পরী ভাবতে পারছে না।
“পরী নিজেকে একমনে বোঝাচ্ছে এটাই তো হওয়ার ছিল। তাহলে পরী কেন কষ্ট পাচ্ছে।
পরী যে কোন পুরুষের খোরাক হতে পারবে না। তাহলে তাঁরাই বা কেন পরী কে রাখবে।
অতীব কষ্টে মনকে বোঝালো।
কিন্তু অবুঝ মন যেনো মানতেই চাইছে না।
রাতটা পরী আজ নির্ঘুম নিবেশে কাটিয়ে দেবে। রাজ কে ছাড়া ঘরটা যেমন ফাঁকা এ মনটাও তেমনি বিষন্ন।
বিষন্ন মনে পরী আকাশের পানে তাকিয়ে চুপিচুপি চিঠি লিখছে,
” জানো আকাশ, তোমার এই বিষন্নতাকে কেউ ভালোবাসেনা।
কিন্তু জানো আমি কিন্তু খুব খুব ভালোবাসি। তোমার ঐ আঁধার কালো চাঁদ টা-ই আমার ভীষণ প্রিয়। কেন জানো?
কারণ আমি-ই যে ঐ বিষন্ন চাঁদটা।
জানো রাজ না খুব ভালো।
ও তোমার সাথে আড়ি পেতেছে।
আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো ও অভিমানে হয়তো কথা বলছে না।
ও যদি তোমার বিষন্নতাকে না পছন্দ করে তাতে কি আমি তো আছি,কেন কাঁদছো বলো তো?
পরী বিষন্ন মনে মনের ঠিকানায় চিঠি লিখছে, আর অজড় নয়নে কাঁদছে।
এ কান্না যে বিষন্ন আকাশ ছাড়া আর কেউ দেখছে না।
জানো আকাশ আমার না খুব খুব ভালো লাগে যখন তোমার মেঘলা আকাশ বৃষ্টি জল ঝরিয়ে সব মুছিয়ে দেয়। তুমি কি পারবে আমার কষ্টগুলো মুছিয়ে দিতে।
জানি পারবে না।
পরী আর থাকতে পারলোনা, চিৎকার করে বলতে লাগলো, রাজ আমি ভালো নেই।
রাজের পরী যে রাজকে ছাড়া বিলীন হয়ে যাবে, আপনি কি বুঝতে পারছেন না।
এক সময় পরী নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
,.
,.
.
আজ খুব দেরি হয়ে গেছে, পরীর ঘুম ভাঙতে।
পরী ফ্রেশ হয়ে তারাতাড়ি নিছে নামলো।
—“রাজ কে খুব স্বাভাবিক লাগছে দেখতে।”
— পরীর শ্বাশুড়ি পরী কে বললো,কিরে মা আজ এতো লেট কেন?
আর তোর চোখগুলো এমন ফুলা কেন দেখাচ্ছে? শরীরটা কি আবার খারাপ করলো।
—” পরী রাজের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাজ খুব স্বাভাবিক ভাবেই খাচ্ছে। পরীর দিকে তাকাচ্ছেই না।
পরী রাজের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো
না মা কিছুই হয়নি। এলার্জির প্রবলেম থেকে চোখ গুলো ফোলা হয়তো।
— “পরীর কথায় রাজের কোন ভাবনা নেই। ”
— “রাজ ওর মাকে যা বললো, ইতু সহ সবাই অবাক। ”
— “পরীর পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল।”
— রাজের মা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
রাজের কাছে এসে বললো, পরীর মতো বউ থাকতে তুই এটা বলতে পারলি।
আর পরী আমার পুত্রবধূ নয় ও আমার মেয়ে বুঝলি তুই।
আজ থেকে তুই আমার ছেলে নয়। “