#রঙীন ফানুস
#আফরিন ইভা
#পর্ব-১৯
________________________
—“রাজের কথাগুলো পরীর যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
মাথাটা যেন ঘুরছে,চারদিকে যেনো অন্ধকার দেখছে।”
রাজের মা হতাশ ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,”রাজ কিছুতেই আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আরেকটা বিয়ে করবি!
“পরী কে রেখে তুই আরেকটা বিয়ের কথা বলবি আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।
রাজের মা রাজের গালে আলতো করে হাত রেখে বললো, বাবা তুই কি রাগ করেছিস্ পরীর সাথে বল,আমায় বল আমি সব সল্ভ করে দেব।
শুন এসব রাগ অভিমান স্বামী স্ত্রীর মাঝে হয় সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তুই এমন একটা কথা বলতে পারলি।”
” রাজ মায়ের চোখে না তাকিয়ে পরীর চোখে তাকিয়ে বললো, তোমাকে কে বলেছে, আমি পরী কে ছেড়ে দিয়ে আরেকট বিয়ে করবো?
পরীও থাকবে নতুন কেউও আসবে।”
“রাজের কথা শুনে কাঁপা কাঁপা চোখে তাকালো পরী। রাজ কে অনেক স্বাভাবিক লাগছে পরীর কাছে।
—রাজ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,” হুম মা আমি ইতু কে বিয়ে করতে চাই। ”
—” ইতুর কথা শুনে রাজের মা টলমলানো চোখে তাকালো।
ইতু কে উনার কোনকালেই পছন্দ নয়।
মনে মনে উনি ছেলের পছন্দ নিয়ে বিদ্রুপ করলো।”
–” এদিকে ইতুর খুশি যেনো বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ইতু পারছে না রাজ কে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে।”
–” ভেজা-ভেজা চোখে ইতুর দিকে তাকালো পরী। ইতু যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি, ইতু কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কষ্টে বুক টা ফেটে যাচ্ছে পরীর ।
“পরী পারছে না রাজ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কেঁদে কেঁদে পা জড়িয়ে ধরে বলতে, রাজ আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, আপনি কেন করছেন এমন?
পারবো না, কিছুতেই পারবোনা সইতে।
এতো কষ্ট কেন দিচ্ছেন?
কিন্তু না কিছুই বলবেনা পরী।
পরীর যে সেই ক্ষমতাটাই নেই।
পরী যে অক্ষম, তাঁর স্বামী কে ধরে রাখতে।
পরী যে একটা অসহ্যকর কীট এ সমাজের কাছে। শত হোক রাজ তো পরী কে রাখবে বলেছে।
ঘরের কোন এক কোণে জায়গা নিয়ে নিবে পরী।
দুচোখের জল যেন থামতে চাইছে না পরীর।
নিজেকে অনেক কিছু বলে শান্ত করলো পরী”
–” রাজ চিৎকার করে বললো, মা বিশ্বাস করো আমি ইতু কে বিয়ে করতে চাই, আর পরী কেও ডিভোর্স দিচ্ছি না, ও থাকবে, ইতুকেও বিয়ে করবো।”
“” রাজের মা খুব কঠিনভাবে উত্তর দিলো, তোর যা ইচ্ছে তাই কর আমাকে এসবে টানবিনা। এই বলে উনি চলে গেলেন।”
.
.
.
–“এদিকে পরী কাঠের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাজ কে দূর থেকে দেখছে।
পরীর কাছে রাজ কে বড্ড অচেনা লাগছে আজ । ”
–” ইতু সুযোগ পেয়ে রাজ কে জড়িয়ে ধরলো। ”
—“মুহুর্তেই পরীর দু-চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো। পরী লুকিয়ে চোখের নোনাজল গুলো মুছে ফেললো। ”
— “রাজ ইতু কে বললো, ইতু চল শপিংয়ে যাওয়া যাক। বিয়ের জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে। ”
–” ইতু যেন আকাশ থেকে পরলো।
কি বলিস রাজ?
তাই বলে এতো তারাতাড়ি।”
—” রাজ হিসহিসিয়ে বললো, এতো তারাতাড়ি কোথায়?
আমি আগামীকালই তোকে বিয়ে করবো।”
—” রাজ এতোটা হিসহিসিয়ে বললো, যা পরী ঠিকই শুনতে পেলো। পরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। মূহুর্তেই নিজের রুমে চলে গেলো।
রুমে গিয়ে বালিশ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।
কান্নায় পরীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
এ সঙ্গীকে চাইলেও ছাড়াতে পারেনা পরী।”
” পরী বিধাতার কাছে দু-হাত তুলে ফরিয়াদ জানালো,বিধাতা কেন এতো পরীক্ষা নিচ্ছ আমার?
আমি যে আর পারছিনা সইতে।
কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি হাজারো কষ্টের সাথী হয়ে আমি জীবনভর লড়ে যাবো।
আমি কখনো আত্মহত্যা করবো না, ভেবোনা আমি কষ্ট পাচ্ছি?
চোখের জল জড়িয়ে নিজেকে শক্ত করছি, মনকে আরো বলিয়ান করছি।
যাতে সামনের দিনের কষ্টগুলো সহ্য করতে পারি।
পরীর কিছুই ভালো লাগছে না।
পরী গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরের তপ্ত রোদ গায়ে লাগাচ্ছে। এই তপ্ত রোদে নিজের সব দুঃখ আরো তপ্ত হোক পরী সেটাই চায়। পরী ভাবছে সীমান্তর মতোই প্রতিটা পুরুষ। আসলে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের কোন মূল্যই নেই।
পরী মনে মনে হাসলো।
পরী নিজেকে নারী বলে দাবী করছে বলে।
পরী তো মানুষের মধ্যেই পড়ে না, আর থাক নারী দাবি করবে।
.
.
.
—” রুমে গিয়ে ভাবলো পরী চলে যাবে, বিয়েটার পর-ই চলে যাবে।
পরী চায় রাজ ভালো থাকুক, একসময় রাজ পরীকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে।
আর এতে তো রাজের কোন দূষ-ই নেই।
রাজ তো চেয়েছিল পরী কে নিয়ে ভালো থাকতে কিন্তু বিধাতাই তো চায়নি তাই রাজকে পায়নি ——–
” এ জীবনে নাহি পেলাম তোমায়,
পরজীবনে ঠিকই পাবো তোমায়
তুমি যে আমার স্বপ্ন,
যা করবো আমি রপ্ত ”
পরী ইতস্তত করে চিঠিটা লিখেই ফেললো।
লিখে বালিশের নিচে রাখলো।
কারণ পরী জানে আগামীকাল থেকে এই ঘর ইতু আর রাজের।
পরীর বলে কোন কিছুর চিহ্ন-ই থাকবে না এ ঘরে।”
” রাজ রুমে আসলে পরীর বুকে আর তুফান উঠবেনা, আঁটকাবে না নিশ্বাস, শীতল হবে না হাত-পা, কাছে আসবে না কেউ ।
না চাইতেও দু’ফোটা চোখের জল চিঠির খামে পড়ে গেল।
যাতে লেখা ছিল #রঙীন ফানুস।
চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে দিলো। আলমারি থেকে রাজের একটা শার্ট বের করলো।শার্টটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
শার্টে রাজের গায়ের গন্ধটা যেনো এখনো তীর্যকভাবে লেগে আছে।
এ ঘ্রাণে পরীর মন প্রাণ যেন মুগ্ধতায় উজার হয়ে যাচ্ছে।
বিছানার চাদরে কোমলহাতে হাত বুলিয়ে দিলো। বরটা-ই যখন থাকবেনা তখন ঘরটা দিয়ে কি করবে পরী।
শার্টটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইল পরী।
এখন নিচে যাওয়ার মতো সাহস নেই পরীর তাই নিজেকে এই বদ্ধ রুমেই আবদ্ধ করে রাখলো।”
–” রাজ ইতু কে নিয়ে শপিংয়ে চলে গেলো।
এই বিয়েতে কেউ রাজি নেই, না রাজের মা, না রাজের বাবা, এমনকি এ বাড়ির কাজের লোক গুলোও। কেউ ইতু কে পছন্দ করেনা।”
—” দুপুরে পরীর খাওয়া হয়নি।
পরীর শাশুড়ী অনেক বার ডেকে গেলেও পরীর সাড়া পায়নি।
সাড়া পাবেই কিভাবে পরী যে ঘুমচ্ছিল।
ক্লান্ত মন নিয়ে ঘুমিয়েছিল পরী।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা
রুমেই আবদ্ধ রাখলো নিজেকে।
এদিকে রাজ আর ইতুর বাড়ি ফেরবারও কোন নাম নেই।
— “পরী ফ্রেশ হয়ে ভাঙা মন নিয়ে নিচে গেলো।”
নিচে গিয়ে দেখলো সব একদম নিস্তব্ধ।
পরীর ভীষণ ভয় করতে লাগলো।
কাজের লোক গুলোকে জিজ্ঞেস করলো, পরীর শাশুড়ী কোথায়?
লোকগুলোর জবাবে পরী বাকরুদ্ধ।
এমনিতেই পরীর শাশুড়ির প্রেশারের সমস্যা, তাঁর উপর আবার উনি নাকি সারাদিন না খেয়ে রুমে নিজেকে আঁটকে রেখেছেন।
আসলে ভুলটা পরীরই।
পরীর রুমে অনেকবার নক করা সত্বেও পরী দরজা খুলে নি।
কিন্তু এতে তো পরীর কোন দূষ ছিলোনা। পরী তো ঘুমচ্ছিল।”
” পরী মা বলে কয়েকবার ডাকলো।
কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।
মা আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে আপনি এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন বলে।”
এতো বার ডাকবার পরও দরজা না খোলায় ভয়ে পরীর হাত পা শীতল হয়ে আসছে ।
মনে মনে নিজেকে দায়ী করছে।
এর জন্য নিজেকে দায়ী করার একমাত্র কারণ হলো রাজ কষ্ট না পেলে তো আর বিয়ে টাও করতোনা, না এতো ঝামেলা হতো।
.
.
.
–“বেশকিছুক্ষণ পর দরজা খুললো । চোখ মুখ ভীষণ ফুলা দেখাচ্ছে।
“– উনাকে দেখে পরীর নিজেরও যেন কান্না পাচ্ছে । বহুকষ্টে নিজের কান্না আটকিয়ে
শ্বাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরলো পরী।
পরীর শ্বাশুড়িও আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। এ জড়িয়ে ধরায় আছে বেশ উত্তেজনা, আছে আকাঙ্খা, আছে আবেগ মাখা ভালোবাসা।”
” পরী আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি, হুহু করে কেঁদে ফেললো। ”
” পরীর শাশুড়ি পরম যত্নে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, আমি জানি মা তোর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
কোন মেয়েই চায় না তাঁর স্বামীর ভাগ অন্যকে দিতে।
আর তুই বা দিবি কিভাবে?
তোর মনের অবস্থা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আমি ।
রাজ তো তোকে অনেক ভালোবাসতো। নিজের জীবনের চাইতেও বেশি । বহু প্রতীক্ষার পর তোকে পেয়েছে। কিন্তু হঠাৎ ওর কি হলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা তুই ওকে জোর করছিসনা কেন, বলতো আমায়?”
” কথাগুলো শুনতে পরীর বেশ কষ্ট হচ্ছে।
পরী মনে মনে বললো, মা যদি পারতাম সত্যি এমন করতে দিতাম না আপনার ছেলেকে।
পরী নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, রাজ সত্যি ইতু কে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
পরী শাশুড়িকে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো, বলতে লাগলো, মা আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
আপনার বুকে মাথা রেখেই থাকবো সারাটি জীবন। ”
” পরীর শ্বাশুড়ি আদর মাখা কন্ঠে বলতে লাগলো, পাগলি মেয়ে, তুই তো আমারি মেয়ে।
শুধু পেটে ধরলেই কি মেয়ে হয়?
ভিন্ন সম্পর্কেও অনেকেই আপন হয়, যা পেটে ধরলেও হয়না।
রাজ যা-ই করুক না কেন তুই আমারি মেয়ে বুঝলি তো।
রাজ ইতু কে বিয়ে করুক, ইতু মেয়েটাকে কখনো মেনে নিব না আমি।
তুই আমার সব,মেয়েও তুই পুত্রবধূও তুই ।”
” পরী মনে মনে বেশ শান্তি পাচ্ছে শাশুড়ির কথা শুনে। মায়ের মতো এমন কাউকে জীবনে পাবে বলে ভাবতে পারে নি পরী।
পরী শাশুড়ির রুম থেকে বের হয়ে যা দেখলো, হৃদয়টা কাঁচের টুকরোর ন্যায় ভেঙে গেল।”
” রাজ ইতুর হাত ধরে ইতুর রুমে চলে যাচ্ছে।
বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে ইতু আর রাজ কে।
বুক টা কাঁপছে পরীর।
নিজের স্বামী কে অন্যের সাথে এভাবে দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে পরীর।
চোখগুলো ইদানিং বড্ড জ্বালাচ্ছে পরী কে।
না চাইতেও জল এসে ভীড় করছে পরীর চোখে। কাঁদতে কাঁদতে পরী নিজের রুমে চলে গেল। ”
” এদিকে রাজের বাবা সব শুনে বাড়িতে হাঙ্গামা লাগিয়ে দিলো।
উনি কিছুতেই চান না, পরী কে রেখে রাজ আরো একটা বিয়ে করুক।
” বাবার সাথে সব কথায় রাজি থাকলেও আজ কোন কিছুই শুনতে রাজি নয় রাজ। ইতুর জন্য যেন মরিয়া হ’য়ে উঠেছে রাজের মন। ”
” পরী দূর থেকে অবলোকন করছে রাজ কে। পুরুষরা আসলেই ভিন্ন জগতের। এদের মন প্রাণ বোঝা বড্ড কঠিন।
কাকে কখন ভালো লেগে যায় এঁরা নিজেও জানে না।
কষ্টে পরীর চোখমুখ ভারী হয়ে আসছে।
সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে । যাওয়ার জায়গা থাকলে আরো আগেই চলে যেত পরী।
চলেতো যাবেই পরী শুধু বিয়েটা হওয়ার অপেক্ষা। ”
” বাবার সাথে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করে রাজ উপরে চলে যেতে গিয়ে থেমে গেল।
পরীর দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে রইলো।
” রাজের সাথে অনেকদিন হলো কথা হয়না চোখে চোখ রাখা হয়না পরীর। যে মানুষটা এতো ভালোবাসতো পরীকে মিনিটে মিনিটে খবর রাখতো , সেই মানুষটা এতোটা ভুলে গেলো পরী কে ? চোখের ভাষা আজ বুঝতে পারছেনা পরী। রাজের চোখ যেন ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে।
যে মানুষটাই অপরিচিত হয়ে যায়, চোখের ভাষা টাও অপরিচিত হয়ে যায়। ”
চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল।”
“রাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উপরে চলে গেল।
” পরী রাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। যে দেখায় হবে না শেষ,
যে দেখায় ভরবেনা মন। ”
চলবে———-