রাজনীতির রংমহল পর্ব-০২

0
561

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০২

“আপনার হা’গু আপনার সম্পদ। দয়া করে উহা অন্যকে প্রদর্শনের জন্য রাখিবেন না।নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করবেন।”

মাঝারি আকারের সাইনবোর্ডে সাইনপেন দিয়ে বড় বড় অক্ষরে কথাগুলো লিখে দম নিল স্পর্শীয়া।এরই মধ্যে পিছন থেকে রিংটোন বাজা অবস্থায় ফোন হাতে ছুটে এলো অনন্দা।

এই স্পর্শী,তোর ফোন।

কথাটা বলে সামনের দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেল অনন্দা।ফোনের কথা ভুলে টয়লেটের দরজার উপর টানানো সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়ে হাসতে হাসতে সেখানেই বসে পড়লো।পেট চেপে ধরে কোনোমতে বললো-

এই স্পর্শী,এসব কি উদ্ভট কথা লিখেছিস তুই?

ভ্রু কুচকে অনন্দার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো স্পর্শী। হাতের সাইনপেন দিয়ে অনন্দার মাথার উপর আলতো আঘাত দিয়ে বললো-

হ, এইসব তো তোমাদের কাছে উদ্ভট লাগবেই।সত্য কথা বললেই দোষ। এই শোন,এগুলো হলো বচন।স্পর্শীর বচন। খনার যেমন বচন ছিলো তেমনি স্পর্শীর ও বচন রয়েছে।নাক-চোখ-মুখ বুঝে হোস্টেলের সবাইকে আমার বচন গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বলবি।নইলে কালকে ভার্সিটি মাঠে সেইটাকে অপমান করবো।

থেমে,

কত্ত বড় খবিশের দল ভাবা যায়। এরা গোসল করতে গেলে এত্ত এত্ত পানি খরচ করে যেন মনে হয় জামাইয়ের থেকে মোহরানা পেয়েছে। আর টয়লেটে গেলে এত্তো কিপটামি করে যেন জামাই যৌতুক হিসেবে পানি চেয়েছে। খবিশ কোথাকার?পুরো টয়লেট গুলোকেই বিশ্রীভাবে………ইয়াক থুহ।
এই শোন অনু,আজ থেকে তোর দায়িত্ব একটাই। টয়লেটে যেই ঢুকুক,বের হওয়ার পর তুই চেক করবি ভালো করে পরিষ্কার করেছে কি না।ওকে

নাক ছিটকালো অনন্দা।এরইমধ্যে পুনরায় ফোনের রিংটোন বাজতেই স্পর্শীর হাতে দিলো।বললো-

এই নে, ধর তোর ফোন।এই নিয়ে তিনবার ফোন দিয়েছে।

চোখের চশমা’টা ডান হাতের তর্জনী দ্বারা উচু করে ফিট করলো।তারপর ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার দেখতে দেখতে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এলো।নাম্বার’ টা বেশ অচেনা লাগছে।রিসিভড করে কানে তুলে ভদ্রতাসহিত সালাম দিলো।

ফোনের ও প্রান্ত থেকে মিষ্টিভাষী কোনো মেয়ের সালাম পেয়ে নড়েচড়ে বসলো পরশ।পাভেল খাটের উপর বসে ফোনের দিকে একদম ঝুকিয়ে বসে আছে।লাউড স্পিকারে দেওয়ার পরেও এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন ফোনের মধ্যে ঢুকে যাবে।ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

ভীষণ বিরক্ত হলো স্পর্শী। ফোন দিয়েছে ঝটপট কথা বলবে তা না। থম মেরে বসে বসে উত্তর দিচ্ছে।মুখ কুচকে প্রশ্ন করলো-

কে বলছেন?কি চাই?

অসস্তিতে হাস-ফাস করতে লাগলো পরশ।রাগ ও লাগলো।এই মেয়েই তো বিকেলে মেসেজ করলো অথচ নাম্বার টাই এখন আর চিনতে পারছে না।মেয়ে বিষয়টাকেই বরাবর এড়িয়ে চলে এসেছে পরশ।তবে পাভেল এই বিষয়ে ভীষণ এক্সপার্ট।ভাইকে নিরব থাকতে দেখে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে কথা বলার জন্য বললো পাভেল।চোখ রাঙালো পরশ তারপর ধীর আওয়াজে বললো-

বিকেলে মেসেজ দিয়েছিলেন আপনি?

থমথম করে হাটতে হাটতে স্পর্শী জিজ্ঞেস করলো-

কি রকম মেসেজ?

পুনরায় অসস্তির জোয়ারে ভেসে গেল পরশ।কি বলা উচিত তার।প্রেগ্ন্যান্সির কথা,কিন্তু সেটা তো শুনতে কটু লাগবে।জীবনে এত্তো এত্তো ভাষন দেওয়া রাজনৈতিক নেতাও সামান্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে/গুলিয়ে ফেলছে,গায়ের ঘাম ছুটিয়ে ফেলছে ভাবতেই মুখ চেপে ধরলো পাভেল।ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার।ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা ছো মেরে নিয়ে বিছানার উপর আয়েশ করে বসলো।স্পিকারের কাছে মুখ এনে তড়তড় করে বললো-

আপনি কি বাবুর আম্মু নাকি?আমরা বাবুর আম্মুকে খুজছি।শুনুন বাবুর আম্মু,আমি সম্পর্কে বাবুর কাকা মশাই হই।চিনেছেন?

তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী।তাহলে এটা সেই নাম্বার।অনেকগুলো অচেনা নাম্বারের মধ্যে খেয়াল ছিলো না এর কথা।মেজাজ বিগড়ে গেল স্পর্শীর।নাক-মুখ বিরক্তিতে কুচকে বললো-

ওই ব্যাটা,এতক্ষণে সময় হলো কল করার।কেন আরো আগে করতে পারতি না।যে সময় মেসেজ দিয়েছি ওই সময় কল করলে কি জাত যেত?তোর জন্য আজকে আমি বাজিতে হেরে গেছি।চার প্লেট ফুচকা মিস করেছি।

থেমে,
এহহ এখন আসছে বাবুর খোজ নিতে।তোর বাবুর বা’ল ও এখন নাই।নষ্ট হয়ে গেছে,নাহ-এবরোশন করে ফেলেছি,না না, ডেলিভারিই হয়ে গেছে। শয়তান ব্যাটা,তোর জন্য জীবনে ফার্স্ট আমি বাজিতে হারলাম।একদম কল করবি না।

স্তব্ধ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে পরশ।পাভেল তো পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।আনমনে পুনরায় পাভেল জিজ্ঞেস করলো-

মাত্র আট ঘন্টার মধ্যেই ডেলিভারি হয়ে গেল।বলছি আর কটা ঘন্টা রাখা যেত না। খুব কি কষ্ট হতো?বাবুর বাবা-চাচা কে না জানিয়েই ডেলিভারি করে ফেললেন।

পরশ দ্রুতবেগে পাভেলের হাত থেকে ফোন আনলো।পাভেল পুনরায় টেনে নিয়ে গেল।রাগত কন্ঠে পরশ বললো –

এক্ষুনি ফোন কাট।এই ভয়ানক মহিলার সাথে কথা বলার কোনো দরকার নেই।বেয়াদপ মহিলা।

ওপাশ থেকে সরাসরি বেয়াদপ-ভয়ানক উপাধি পেয়ে রনচন্ডির রুপ ধরলো স্পর্শী।এত্তো বড় সাহস তাকে বেয়াদপ মহিলা বলে। চেচিয়ে উঠে বললো-

তোর বউ ভয়ানক মহিলা,তোর বউ বেয়াদপ।শয়তানের বাচ্চা, তোর সাহস কত্ত বড়,আমাকে বেয়াদপ বলিস।স্পর্শীকে বেয়াদপ বলিস।তোর সাহস থাকলে একবার জাবি’র ক্যাম্পাসে আয়?তোর হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে গুড়ো করে দেয়ালে মাখিয়ে রাখবো।

ফোন কেটে দিলো পরশ।দু ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিছানায় কতক্ষণ নিরব হয়ে বসে রইলো।মনে হচ্ছে বিশাল কোনো যুদ্ধ করে সবেমাত্র ফিরেছে।মিনিট পাচে’ক চুপ থাকার পর পাভেল ধীর কন্ঠে উঠে বললো-

ভাই,আমার না একটা শখ জেগেছে।মনে করতে পারিস এটাই আমার অন্তিম ইচ্ছা।

বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা পরশ ভাইয়ের কথা শুনে শান্তভাবে বললো-

কি ইচ্ছা?

লাফ দিয়ে উঠে বসলো পাভেল।পরশের হাটুর উপর আলতো কিল মারতে মারতে বললো-

এই ভয়ানক মেয়েটাকে এক দিনের জন্য হলেও তোর সাথে বিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।আহাহা,এটা মেয়ে।কি ভালো-কি ভালো।যখন মুখ থেকে যেটা ছাড়ে সেটাই উপচে পড়ে।বিকেল বেলা মোবাইল ভর্তি প্রেম ছাড়লো এখন আবার গালি।তুই সারাদিন অন্যদের ধমকে -ধামকে রাজনীতি করবি।রাত হলে তোর উপর রাজনীতি করবে।কি দারুন তাই না।

এক হাত দিয়ে পাভেলের মাথা চেপে নুইয়ে অন্য হাত দিয়ে পিঠের উপর দুম করে কিল মারলো পরশ।তারপর কলার ধরে টেনে রুম থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলো।

দরজার ওপাশ থেকে পাভেল এখনো চেচাচ্ছে-

ভাই, বাবুর আম্মুর নাম্বার’টা একটু দে না।দু-দিনের জন্য প্রেম করবো।

পরশ কোনো সাড়া দিল না।চুপ করে বিছানার উপর পড়ে রইলো।মেয়েদের মুখের ভাষাও যে এমন হয় তা আজ সরাসরি জানলো সে।মাথা থেকে সমস্ত ঘটনা ঝেড়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।

স্পর্শীকে চেচাতে দেখে পুনরায় অনন্দা বারান্দায় এলো।ভ্রু কুচকে বললো-

এই রাত একটার সময় ও চেচাবি তুই।ঘুমাবি কখন?
আর কি এমন হয়েছে যে এমন ভাবে গালিগালাজ করছিস?

দুম করে হেটে এসে ছোট্ট সিংগেল বেডের উপর বসলো স্পর্শী।চোখের চশমা খুলে সোজা হয়ে শুয়ে অনন্দাকে বললো-

আরে বিকালে যে বাজি ধরে কয়েকটা রং নম্বরে মেসেজ দিলাম,সেখানকারই একটা নাম্বার থেকে এখন ফোন দিয়েছে।আমাকে ভয়ংকর-বেয়াদব মেয়ে বলেছে।তাই তো একটু আদর দিয়ে দিলাম।যাই হোক,এখন ঘুমাবো।ডিস্টার্ব করবি না একদম।এমনিতেও তোর জন্য তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারি না আমি।

আকাশ থেকে পড়লো অনন্দা।মাথায় হাত দিয়ে নিজের বিছানায় বসে বললো-

আল্লাহ সইবে না স্পর্শী।এরকম মিথ্যা বলিস না।কোথায় তোর জন্য আমি ঘুমাতে পারি না,সেটা না বলে তুই আমাকে দোষারোপ করছিস।সিরিয়াসলি , দিস ইজ ভেরি ব্যাড।

_____________
সকাল এগারোটা।শুক্রবার হওয়ার দরুন এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে স্পর্শী।এ নিয়ে আট বার ফোনে কল আসলেও ইচ্ছাকৃত ভাবে কেটে দিচ্ছে সে।নয় বারের বার কল রিসিভড করে চেচিয়ে বললো-

কি সমস্যা খালামনি?তুমি জানো না এখন আমি ঘুমোচ্ছি।তাও বারবার ফোন দিচ্ছো কেন?তুমি আমার ফোন নাম্বার ও বাড়িতেও দিয়ে দিছো,রাহুল ভাইয়ের কাছে ও দিয়ে দিছো।বলি এর চেয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিলে ভালো হতো না।তোমাদের জালায় কি আমি হোস্টেলেও থাকতে পারবো না নাকি।

ওপাশ থেকে বেশ আদুরে গলায় বিপাশা বললেন-

ওমা,এমন করে না সোনা।আজ তো শুক্রবার,খালামনিকে দেখতে আসো একবার।আর দুলাভাই নাম্বার চেয়েছে দেখে দিয়েছি।উনি তোমার বাবা না বলো।বাবার সাথে কথা বলছো না কেন?

স্পর্শী-মনি তুমি জানো আমি কি জন্য ও বাড়িতে কথা বলি না। তাও বারবার এমন করো কেন?আর তোমার সাধের ছেলে তো আজকাল বাড়িতেই থাকে।এইজন্য আসি না তোমার কাছে।ওকে বাড়ি থেকে কোথাও টুরে পাঠাও দেখবে আমি দুম করে চলে আসবো।

এরইমধ্যে ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে কারো আওয়াজ পেলো স্পর্শী।

এই তোর সাহস কত্ত বড়।আমাকে বাড়ি থেকে বের করতে বলিস।এটা কি তোর জামাই বাড়ি যে সবাই তোর কথায় উঠবে বসবে?নাকি আমি তোর জামাই?

মেজাজ বিগড়ে গেল স্পর্শীর।কাঠকাঠ কন্ঠে বললো-

দেখো রাহুল ভাইয়া,একদম ঢং করবা না।আমার এইসব ঢং একদম ভালো লাগে না। তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো।বিয়েশাদি করে ফেলো,তাহলেই আমি চলে আসবো।

হতাশ হয়ে মায়ের দিকে তাকালো রাহুল।পুনরায় দম নিয়ে বলল-

আমিতো সেই কবে থেকেই বসে আছি।ব্যাস, তুই চলে আয়।তাহলেই কাজি ডেকে ফেলবো।
থেমে দুষ্টুমির সুরে,

এই তুই ও তো বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস।মেয়েদের কোথায় ক্লাস এইটে থাকতে বিয়ে দিয়ে দেয় সেখানে তুই তো এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়িস।তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যা।এ বছরই করে ফেলি বিয়েটা।

স্পর্শীর নিরবতা পেয়ে পুনরায় বললো
আর হ্যা শোন,আজকে আমি বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছি।পিকনিক আছে।আপনি দয়া করে বাড়িতে পদধূলি দিয়ে যান ম্যাডাম।রাখছি

বলে ফোন কেটে বিপাশার হাতে ফোন দিল রাহুল।থমথমে কন্ঠে বললো-

ও আজ এতটা বিগড়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। কলেজের গন্ডি পেরোনোর সাথে সাথেই বলেছিলাম তোমায় বিয়ের কথা।শোনো নি,জাবি’তে পড়তে দিয়েছো।তাও হোস্টেলে একা একা। যা ইচ্ছা কর তোমরা।

বলেই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাহুল।

__________
এই যে মশাই,রাস্তাটা কি আপনার বাপের? নাকি বিয়েতে যৌতুক হিসেবে পেয়েছেন?গাড়ি সাইডে সরান নইলে একদম পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব।

মেয়েলি কন্ঠের এমন হুমকি পেতেই চমকে পিছনে তাকালো পরশ। সামনের সিট থেকে পাভেল চিৎকার করে পরশ কে বলল-

ভাই,এইটা বাবুর আম্মুর স্পেশাল গলার আওয়াজ না।

হনহনিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল পাভেল।সামনে তাকাতেই দেখলো……

চলবে?