রেড রোজ পর্ব-০৭

0
185

#রেড রোজ (পর্ব ৭)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
১.
রায়ান দুপুরে লাঞ্চ শেষে আয়েশ করে নিজের অফিস রুমে বসে চা খাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে হতে মোবাইলে বাসার সিসি ক্যামেরার অপশনটা চালু করে। সবগুলো রুম একবার করে দেখে, বিশেষ করে বেডরুমটা। নাহ, সব ঠিকঠাক। আজ সাত দিন হয়ে গেছে ও সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে, এখন পর্যন্ত আর সেরকম কিছু ঘটেনি। রায়ানের ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে, সেদিনের সেই অদ্ভুত কান্ডগুলো নিশ্চয়ই ওই পুলিশ অফিসারের কাজ। ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছে। হাহ, এত সহজ না ওকে ভয় দেখানো। একটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে চায়ে শেষ চুমুক দেয়। ছোট্ট একটা অস্বস্তি অবশ্য আছে, সেদিন ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লেখাটা একদম রয়ার হাতের লেখার মতোই। এরা কী রয়ার হাতের লেখা নকল করেছে!

অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সাজানো। যদি রয়ার অশরীরী আত্মা থাকতই তাহলে সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরও তার দেখা পাওয়া যেত। এটুকু ভাবতে একটা স্বস্তি বোধ করে। মাথা ঠান্ডা করে এবার ও অফিসের কাজে ডুব দেয়।

সেদিন রাতে যখন বাসায় ফেরে ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় সিকিউরিটি গার্ড জামশেদকে দেখে বসে বসে কান চুলকাচ্ছে। ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই রায়ান বাঁকা সুরে বলে, ‘কি, পাহারা ঠিকমতো চলছে তো? কোনো ভুত পেত্নী ঢোকে নাই তো?’

সেদিনের পর থেকে এই স্যার প্রতিদিন ওরে এই কথা বলে খোঁচা দেয়। জামশেদ মুখ গোমড়া করে বলে, ‘স্যার, ভূত, পেত্নী লইয়া মশকরা কইরেন না। এরা বাতাসে ঘুরে, সব কথা শুনতে পায়। আল্লাহ না করুক এরা আপনার কোনো ক্ষতি করে।’

রায়ান হাত নেড়ে বলে, ‘কোনো ভুত পেত্নী বলে কিছু নাই। সিসি ক্যামেরার কাছে সব বেটায় জব্দ। তুমি পাহারা দাও ঠিকঠাক করে।’

কথাটা বলে ও লিফটের দিকে এগোয়। নাহ, সিসি ক্যামেরার কথাটা বলা ঠিক হলো না। একটা ছোট্ট অসন্তুষ্টি নিয়ে রায়ান লিফটের ‘ছয়’ বাটন চাপে। ওর ফ্ল্যাটের সামনে এসে থামতেই লিফট থেকে নেমে পড়ে। এখানে প্রতি ফ্লোরে একটা করেই ফ্ল্যাট। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে জামা কাপড় ছাড়ে। সব রুমে বাতি জ্বালানোই ছিল। এখন দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা বাতি জ্বলে। যাতে ভিডিও ফুটেজগুলো পরিস্কার দেখা যায়।

রায়ান হাত মুখ ধুয়ে টিভির সামনে বসে। ন্যাচারাল জিওগ্রাফি চ্যানেলটা চালাতেই দেখে একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। অবাক হয়ে খেয়াল করে ডকুমেন্টারিটা লন্ডনের একটা haunted house এর উপর দেখাচ্ছে। রায়ানের কেমন একটা অস্বস্তি হয়। যদিও জানে এগুলো একটু রঙচঙ মাখিয়ে বাড়িয়েই বলে। তারপরও কেমন যেন লাগে। একবার আড়চোখে বেডরুমের দিকে তাকায়, এখনও ওই রুমটায় যায়নি ও। যাবার দরকারও নেই। আসার সময় ভিডিও ফুটেজ চেক করে এসেছে, কেউ আসেনি, সব ঠিকঠাকই আছে।

রায়ান চ্যানেল চেঞ্জ করে। এখানে একটা মুভি হচ্ছে। খুব জমজমাট একটা একশন মুভি। রায়ান মনোযোগ দিয়ে মুভি দেখতে থাকে। মুভি শেষ হতে হতে রাত বারোটা বেজে যায়। এর মাঝে এক কাপ চা বানিয়েও খেয়েছে। আজ লিয়ার সাথে ডিনার ছিল। মেয়েটা কিছুদিন আগেই ওর অফিসে নতুন জয়েন করেছে, চটপটে, বুদ্ধিদীপ্ত। প্রথম দিনেই রায়ানের ভালো লেগে গেছে। আজ প্রথম ওর সাথে আলাদা করে ডিনার করল। লিয়ারও মনে হচ্ছে ওকে ভালো লেগেছে। কথাটা ভাবতেই একটা সুখ অনুভব করে রায়ান।

রাত সাড়ে বারোটায় ও টিভি অফ করে বেডরুমের দিকে এগোয়। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সরাসরি ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকায়, নাহ, কোনো লেখা নেই। চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ে। তারপর বিছানার উপর ভালো করে খেয়াল করে, নাহ, কোনো গোলমাল নেই। কোথাও কোনো লম্বা চুল পড়ে নেই।

বেড সাইডে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে আসে। লিয়ার সুন্দর শরীরটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রায়ান।

রায়ানের ঘুম ভাঙে ঠিক চল্লিশ মিনিট পর। তলপেটে একটা চাপ অনুভব করে, বাথরুমে যেতে হবে। নাহ, ঘুমানোর আগে এত পানি খাওয়া ঠিক হয়নি। রায়ান উঠে বাথরুমের লাইট জ্বালে। ঘুম ঘুম চোখে কমোডে বসে কাজটা সারতে থাকে। পুরো বাথরুমে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। রায়ান নাক টেনে ঘ্রাণটা নেয়। এই বাথরুমে তো ও অনেক দিন গোসল করে না, তাহলে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ কোথা থেকে আসছে? এটা রয়াই ব্যবহার করত। ওর এই একটা বাতিক ছিল, ওর বাথরুমে অন্য কাউকেই এলাউ করত না। কিন্তু রয়া তো নেই, তাহলে এখানে কে গোসল করল? ফ্লোরটাও ভেজা।

মুহুর্তেই রায়ান সজাগ হয়ে ওঠে, পুরোপুরি চোখ মেলে পাশে শাওয়ার এনক্লোজারের দিকে তাকাতেই ওর চোখের মণি ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায়। শাওয়ার এনক্লোজারের কাচের দেয়ালে লাল লিপিস্টিক দিয়ে ছোট্ট একটা লাইন লিখা –

“Miss u in Grave”

রায়ানের ঘুম ছুটে যায়। লাফ দিয়ে উঠতে যেয়ে কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। সেদিকে ওর এখন আর খেয়াল নেই। কাঁপতে কাঁপতে ও বের হয়ে একছুটে মোবাইলটা হাতে নেয়। দ্রুত সিসি ক্যামেরার বেডরুমের ফুটেজগুলো টেনে টেনে দেখতে থাকে। নাহ, কিচ্ছু নেই, কেউ আজ এই রুমে ঢোকেনি। তাহলে, এই লেখাটা কোথা থেকে আসলো! রায়ানের মনে হচ্ছে বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে। তার মানে রয়া এসেছিল ওর প্রিয় বাথরুমে গোসল করতে!

ভাবনাটা ভাবতেই রায়ানের পুরো শরীর শির শির করে ওঠে। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত পুরো পিঠ বেয়ে নেমে যায়। মাথাটা কেমন এলোমেলো লাগছে। রয়া প্রতিশোধ নিতে এসেছে, ওকে মেরে ফেলবে, মেরে ফেলবে..।

‘মেরে ফেলবে’ কথাটা বার বার ওর মাথায় প্রতিধ্বনি হতে থাকে। একটা সময় ও মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে। রায়ান জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ভাবে, এই ঘরে আজ থাকা যাবে না। রয়া ওকে মেরে ফেলবে। রায়ান হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায়, তারপর এক দৌড়ে বাসার বাইরে এসে পাগলের মতো এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে আসে।

একটা তাজা ঠান্ডা বাতাস নাকে ঝাপটা দেয়। রায়ান বসে পড়ে, হাঁপাতে থাকে। পুরো শরীর এখনও কাঁপছে। একটু ধাতস্থ হতে ও সামনের দিকে তাকাতেই শিউরে ওঠে, রয়া তো এখান থেকেই পড়ে গিয়েছিল। কথাটা মনে হতেই এবার একটা সর্বগ্রাসী ভয় ওকে গ্রাস করে। কেন ও ছাদে এল? এখানেও যে রয়ার আত্মা আছে! কথাটা ভাবতেই রায়ান আর দেরি করে না, ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসে।

এদিকে জামশেদ ঘন্টা খানেক আগে মূল গেটে তালা মেরে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ ও শরীরে একটা ঝাকুনি অনুভব করে। ভয়ে তোতলানো গলায় বলে, ‘এই, কে কে..’

একটা পরিচিত গলার স্বর শোনা যায়, ‘জামশেদ আমি, রায়ান।’

জামশেদ চোখ কচলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে উসকোখুসকো চুলে লাল টকটকে চোখে ছয় তলার রায়ান স্যার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে একটা ভয়ের ছাপ। জামশেদ বুঝতে পারে ব্যাপারটা। ইচ্ছে করেই চিন্তিত গলায় বলে, ‘কী হইছে স্যার? বাসায় চুর ডাকাইত ঢুকছে?’

রায়ান মাথা নেড়ে বলে, ‘জামশেদ, আমি আজ রাতটুকু তোমার এখানেই থাকব। তুমি ঘুমাও, আমি এইখানে একটু বসি।’

জামশেদ মনে মনে হাসে। বেটা এবার ভয় পাইছে৷ সেই পুলিশ অফিসার স্যাররে বিষয়টা জানাইতে হইব।

রায়ান ওর বিছানায় বসে ঝিমোতে থাকে। একটা সময় আর পারে না, জামশেদের পুরনো রঙচটা চাদর বিছানো শক্ত বিছানায় শুয়ে পড়ে। বহুদিন পর আজ ও একটা শান্তির ঘুম দেয়।

২.
রাহাতের চোখে কৌতুক খেলা করছে। ওর সামনে বসে হাফিজ উৎসাহের সাথে হাত নেড়ে চোখমুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে কাল রাতের ঘটনাগুলো বলছে। রায়ানের কাল কী দুর্দশা হয়েছে সেটা বলছে।

এক পর্যায়ে হাফিজ বলে, ‘স্যার, ওই রায়ান শেষ পর্যন্ত নাকি হোটেলে ওঠেছে। আমাদের একজনকে ওই হোটেলে ইতোমধ্যেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছি যাতে চোখ রাখতে পারে। কিন্তু স্যার, একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, সিসি ক্যামেরাও হ্যাক করা সম্ভব!’

রাহাত মাথা নেড়ে বলে, ‘তাই তো দেখলে। আইটির আনোয়ারকে বলতেই ও বলল এটা নাকি খুব সোজা। এই ক্যামেরাগুলো ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক এর সাথে যুক্ত থাকে। এর সুবিধা যেমন আছে যে তুমি অফিসে থেকেও তোমার মোবাইলে বসে ঘরে কি হচ্ছে দেখতে পারো। আবার অসুবিধাও আছে, নেটওয়ার্ক এ থাকার কারণে খুব সহজেই হ্যাক করা যায়। ভিডিওগুলো ম্যানিপুলেশন করা যায়। ইকবাল রোডের যে দোকানটা এই ব্রডব্যান্ডের লাইন দেয় ওকে থানায় এনে সব বুঝিয়ে বলতেই রায়ানের আইপি এড্রেসসহ সব পেয়ে যাই। বাকিটা তো আমাদের আইটি করে দিল। যাক, আমার উদ্দেশ্য সফল।’

হাফিজ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘স্যার, সবই তো হলো। রায়ান না হয় অশরীরী আত্মা বিশ্বাস করে ভয়ও পেল। কিন্তু তাতে আমাদের কেসের কী সুবিধা হবে? আমরা প্রমাণ করব কি করে ওই সেই লোক যে রয়াকে ফোন দিত?’

রাহাত চোখ নাচিয়ে বলে, ‘এটা তো শুরু। রায়ানকে আমি রয়ার মতো মানসিকভাবে ভেঙ্গে ফেলব। এরপর এমন কিছু করব যাতে রায়ান নিজেই সব স্বীকার করে। কিন্তু সেটা কি এখনও ঠিকঠাক জানি না, আমাকে একটু ভাবতে হবে।’

হাফিজ চলে যেতেই রাহাত ভাবতে বসে। এরপর কি? এমন কি করলে রায়ান একদম ভেঙে পড়বে। আনমনে সামনে পড়ে থাকা আজকের খবরের কাগজের দিকে তাকাতেই একটা খবরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে –
‘জামালপুরের ইউএনও এর সিম ক্লোন করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্র’

ধীরে ধীরে রাহাতের চোখেমুখে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ে, পেয়ে গেছে বুদ্ধি। একদম কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। রাহাত আর দেরি না করেই আইটির আনোয়ারকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ওর কৌতুকপূর্ণ গলা শোনা যায়, ‘ভাই, আমারে তো আপনি শেষ পর্যন্ত অপরাধী বানাই ফেলবেন।’

রাহাত হাসে, তারপর রয়ার ফোন নম্বরটা দেয় ওকে।

৩.
রায়ান গত সাতদিন ধরে প্যারানরমাল ঘটনাগুলো নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছে। একটা জিনিস বুঝেছে এসব আত্মা ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু সরাসরি ক্ষতি করে না। ভিকটিম নিজেই ভয় পেয়ে নিজের ক্ষতি করে। এটা ভাবতেই হঠাৎ রয়ার কথা মনে হয়। রয়া যদি ভয় না পেত, ও মারা যেত না। তাহলে কেউ কি ওকে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? সেদিন রাতে সত্যিকারের ভয়ই রায়ান পেয়েছিল। সিসি ক্যামেরাতেও রয়ার আত্মা ধরা পড়েনি। সেটা কি করে সম্ভব ও আজও বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু এভাবে তো হোটেলে লুকিয়ে থাকা যায় না। তাই আজ বাসায় চলে এসেছে। মোটামুটি মনকে এটা বুঝিয়েছে রয়ার আত্মা আছে, ওকে মাঝে মাঝে এমন কিছু লেখা লিখে ভয় দেখাবে। যদিও এটা একদম অবাস্তব মনে হচ্ছে। নাহ, বাসায় মানুষ দরকার। লিয়ার সাথে সম্পর্কটা এগিয়েছে। বিয়েটা দ্রুত সেরে ফেলতে হবে। ততদিন পর্যন্ত নিচের সিকিউরিটি জামশেদকে ও বলেছে, রাতে ওর বাসায় এসে থাকতে। মোটা টাকার লোভ দেখাতে ও রাজি হয়েছে।

রায়ান বাসায় ঢুকেই পুরো ঘর একবার চেক করে। নাহ, আজ কিছুই লেখা নেই বা কোনো ঘ্রাণ নেই। থাকলেও সমস্যা নেই। আজ রাতে জামশেদ তো থাকবেই ওর সাথে।

রাত সাড়ে বারোটার দিকে জামশেদ আসে ওর বাসায়। রায়ান লিভিংয়ে বিছানা পেতে ওকে শুতে বলে। রায়ান মাস্টার বেড বাদ দিয়ে আজ গেস্ট বেডে ঘুমোতে যায়। আজ আর ভয় লাগছে না। ঘুম আসতে আসতে রাত একটা বেজে যায়। ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে রায়ান বলতে পারে না। ঘুমের মাঝে টের পায় ওর ফোন বাজছে। ঘুম জড়ানো চোখে মোবাইলের স্ক্রীণের দিকে তাকাতেই ওর চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। থরথর করে হাত কাঁপছে। স্ক্রীণে রয়ার নাম ভাসছে। রায়ান ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। রায়ান জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে জড়ানো গলায় বলে, ‘কে, কে…’

ওপাশ থেকে কেউ কোনো কথা বলে না, শুধু নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। একটা সময় ফোনটা কেটে যায়। রায়ান ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলতেই থাকে ‘কে, কে?’

যখন বুঝতে পারে ফোনটা কেটে গেছে তখন রায়ান বিমূঢ় দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কল লিস্টে রয়ার নাম ভাসছে। সেই পরিচিত নাম্বার। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! রয়ার মোবাইল চুরি হয়নি তো? পুলিশ মাস খানেক আগেই রয়ার সব জিনিসগুলো ফেরত দিয়েছিল, সাথে মোবাইলটাও। তখন কেউ সিম খুলে রাখেনি তো?

কথাটা মনে হতেই রায়ান খাট থেকে নামে। রুম থেকে বের হতেই দেখে জামশেদ আরাম করে ঘুমোচ্ছে। ও পা টিপে টিপে মাস্টার বেড রুমে যায়। আলমারির লকার খুলতেই অবাক হয়ে দেখে রয়ার ফোনটা জায়গা মতোই আছে। কি মনে হতে ফোনটা হাতে নিয়ে চালু করতে যায়, কিন্তু হয় না। চার্জ নেই। রায়ান চার্জার খুঁজে বের করে মোবাইলটা চার্জে দিয়েই সুইচ অন করে। একটু পরেই মোবাইলটা অন হয়, রয়ার শাড়ি পরা একটা ছবি ভেসে ওঠে। বুকের ভেতর একটা ব্যথা অনুভব করে রায়ান।

রায়ান ভালো করে দেখে, নাহ, সব তো ঠিকই আছে। সিমও আছে এটাতে। তাহলে কে কল দিল রয়ার নাম্বার থেকে? মাথাটা খারাপ হয়ে যায় রায়ানের। একটু পর পর ও চমকে পেছনে তাকাচ্ছিল। সে রাতেও রায়ানের ঘুম হয় না।

৪.
রাহাত জামশেদের কাছে ঠিক খবর পেয়ে যায়, কাল রাতেও রায়ান ঘুমোতে পারেনি। সারাক্ষণ কি যেন বিড়বিড় করতে থাকে। তার মানে রায়ান ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে।

আর বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে না। এবার অন্তিম আঘাত হানতে হবে। রাহাত সেদিন আনোয়ারকে ফোন করে একটা জিনিস জানতে চায়, ‘আনোয়ার, সিম যেমন ক্লোন করা যায়, মানুষের কন্ঠস্বর ক্লোন করা যায় না?’

ওপাশ থেকে আনোয়ার হেসে ফেলে, ‘সেটাও করা যায়। এখন তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যুগ। দেখেন না চ্যাটজিপিটি নামে একটা সফটওয়্যার এসেছে। আপনি কবিতা লিখতে বললে কবিতা লিখে দিচ্ছে, বক্তৃতা চাইলে তাই। যা চাবেন তাই।

ভয়েস ক্লোন ল্যাব আছে, সেখানে আপনি যার ভয়েস নকল করতে চান তার একটা অডিও ফাইল দিলে ওরা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোটামুটি কাছাকাছি ভয়েস নকল করে দেবে। আপনি তখন যা লিখে দেবেন ওরা ঠিক সেটাই ওই নকল ভয়েসে বলবে। এমন কি ইমোশনও। মাইক্রোসফট এর VALL-E নামে একটা অ্যাপ আছে, কানাডার Lyrebird, চাইনিজ Baidu অ্যাপ আছে। কিছুদিন আগে আমরাও এমন একটা অ্যাপ নিয়েছি। আমাকে শুধু যার ভয়েস নকল করতে হবে তার একটা কমপক্ষে এক মিনিটের একটা অডিও ফাইল দেন। বাকি কাজ আমার। কার ভয়েস নকল করতে হবে রাহাত ভাই?’

রাহাত বিস্মিত হয়ে ওর কথা শুনছিল, এও সম্ভব! রাহাত চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘এখানেই তো সমস্যা। একজন মৃত মানুষের ভয়েস।’

ওপাশ থেকে আনোয়ার ছিটকে ওঠে, ‘ভাই কি মশকরা করেন?’

রাহাত সব খুলে বলতেই আনোয়ার হতাশ গলায় বলে, ‘রাহাত ভাই, অডিও ফাইল ছাড়া যে হবে না।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর ফোন রেখে ভাবতে থাকে। রয়ার ফেসবুকে থাকতে পারে। আজকাল তো অনেকেই ফেসবুকে কত কিছু দেয়। রাহাত সাথে সাথে আনোয়ারকে বলে রয়ার ফেসবুকে ঢুকতে, সেখানে নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যাবে।

একটু পরেই আনোয়ারের ফোন আসে, ‘ভাই, পাইছি। কিন্তু সবই গানের ফাইল। কথা বলতেছে এমন ফাইল দরকার। তাহলে একদম কাছাকাছি ভয়েস নকল করা যাবে।’

রাহাত চিন্তিত গলায় বলে, ‘আচ্ছা, আমাকে ভাবতে দাও।’

সেদিন রাতে রাহাত ঘুমোতে যাবার আগে করবী ওকে বলে, ‘এই রাহাত, অমন চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছ কেন। আসো তোমাকে একটা কবিতা শোনাই।’

করবী মাঝে মাঝেই কবিতা আবৃত্তি করে। ওর গলা খুব সুন্দর। করবী আবৃত্তি করতে থাকে –

“আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?”

আবৃত্তি শুনতে শুনতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা রাহাতের মনে হয়। সাজিদ সেদিন বলছিল রয়া ওকে কবিতা আবৃত্তি করে পাঠাত। কবিতা তো অনেকটা কথা বলার মতোই অডিও। রাহাত দুরুদুরু বুকে ভাবে, সাজিদের কাছে অডিও ফাইলটা আছে তো?

(চলবে)