রৌদ্র মেঘের আলাপণ পর্ব – ১২ও১৩

0
406

#রৌদ্র মেঘের আলাপণ
#পর্ব-১২+১৩
#WriterঃMousumi Akter

–বাড়িতে একজন মহিলা শাড়ি নিয়ে এসছিলো।আমি নিবো না তবুও মা জোর করে কিনে দিলো।বললো আমাকে নাকি ভীষণ সুন্দর মানাবে পরলে।বাট আমি দুইটা শাড়ি নিয়েছি। একটা তৃধার জন্যক আর একটা আমার জন্য।কথা গুলো বলার সময় মেঘের ঠোঁটের কোণে ছিলো মিষ্টি হাসি।

রৌদ্র বেশ অবাক হলো তৃধার জন্য শাড়ি শুনে।রৌদ্রের চোখে মুখে অবাক হওয়ার মতো ভান দেখে মেঘ বললো,

“–কি ব্যাপার আপনাকে এত বিস্মিত লাগছে কেনো?”

“–তৃধা কি শাড়ি পরবে কখনো?”

“–হুম অবশ্যই পরবে।তৃধার সাথে আমি যখন গল্প করি তৃধা তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।আর আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে।জানেন আজ ও হেসেছে আমার গল্প শুনে।প্রায় প্রায় চোখের পানি মুছে হাসে।”

“–তৃধা হেসেছে?আশ্চর্যজনক চাওনি রৌদ্রের চোখে মুখে।”

“–হ্যাঁ হেসেছে, এই প্রথমবার ওর মুখে আমি হাসি দেখলাম অন্যরকম হাসি।এর আগে হেসেছে কোনো রকম মুচকি হাসি।আজ খুব জোরে হেসেছে।তৃধা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।আমার খুব ভালো লাগছে ব্যাপার টা। জানেন আমি রোজ প্রার্থনা করি তৃধা যেনো সুস্থ হয়ে যায়।”

রৌদ্র মেঘের দিকে এক পলকে তাকিয়ে ভাবছে মেয়েটা কত নিঃস্বার্থ ভাবে সবার কথা ভাবে।মনে কোনো দোষ ত্রুটি নেই।এতটা সহজ সরল কেনো এই মেয়েটা।রৌদ্রকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ বললো,কি দেখছেন।

“–সত্যি মেঘ এই ত্রিশ দিনে তুমি তৃধার জন্য যা করলে।যে ভাবে সময় দিচ্ছো তৃধার পিছনে আমি ভাবতেও পারিনি তুমি তৃধার সাথে এই ভাবে মিশতে পারবে।তৃধার গোসল করানো,খাওয়ানো,ওর পাশে ঘুমোনো।এমন কি ওর সাথে সারাদিন গল্প করে করে অনেক টা সুস্হ করে তুলেছো।তোমার সাজেস্ট করা ডাক্তার দেখিয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে তৃধার।শুনেছি মেয়েরা ননদ সহ্য করতে পারে না।তোমাকে দেখে আমার সব ধারণা পালটে গিয়েছে মেঘ।কেউ কি বলবে তৃধা তোমার ননদ, যে কেউ ভাববে তোমার মায়ের পেটের বোন।”

“–মানে আপনি বলতে চাইছেন মা আমার মা না।তৃধা আমার বোন না।”

“–সরি কান ধরলাম মেঘবালিকা আমি আসলে ভুল বলে ফেলেছি।এই দেখো কান ধরেছি।রৌদ্র সত্যি কান ধরলো বাচ্চাদের মতো।”

মেঘ ফিক করে হেসে দিলো।বললো,

“–এইবারের মতো মাফ করলাম আর কখনো মাফ করবো না বুঝেছেন।
তবে,ডাক্তার ম্যাডাম টা সত্যি অনেক ভালো।আমি কি করেছি বলুন।ওই ডাক্তার ম্যাডাম কে দেখেছি আমাদের বাসার পাশের এক ভীষণ অসুস্থ রুগিকে তাই সুস্থ করে তুলেছিলো।একটা মানসিক রুগিকে সুস্থ করে তুলেছিলো।আমি তো শুধু উনার ঠিকানা দিয়েছি।”

“–ধন্যবাদ দিলে তোমাকে ছোট করা হবে মেঘ।তুমি না এলে অনেক কিছুই বদলে যেতো না।”

“–থাক আমার প্রশংসা করতে হবে না।তৃধার হাতের ওই অক্ষর টার ব্যাপারের কি কিছুই বলবেন না।”

“–তৃধা তখন সুস্থ। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম হাতে এটা কি?তৃধা বলেছিলো ভাইয়া তোমার নামের অক্ষর।”

“–আমার মনে হয় তৃধা আপনাকে ভয়ে মিথ্যা বলেছে।আমার মনে হচ্ছে ওই ছেলের নামের অক্ষর। ”

“–হয়তোবা মেঘ। বাট আমি কি বোন কে জোর করে শুনতে পারি।”

“–তাও ঠিক তবে ধীরে ধীরে সব জানা যাবে। ”

“–ইয়ে মেঘ আজ আমার খালাতো ভাই রাজন আসবে।আমার সম বয়সী। আমার বন্ধু আর ভাই এক ই।তৃধাকে পছন্দ করতো রাজন।ভীষণ পছন্দ করতো।আমরা যখন তৃধাকে রাজনের কথা বললাম তৃধা না করে দিলো।কেননা তৃধার অন্য কাউকে পছন্দ ছিলো সেকথা জানালো।রাজন কে ফিরিয়ে দিলো তৃধা।সেদিন রাজন খুব কষ্ট পেয়ে বেরিয়ে গেছিলো এ বাড়ি থেকে।দু’বছরে রাজন আর আসে নি এ বাড়িতে।আমি বিয়ে করেছি শুনে আমার বউ দেখতে আসছে সে।”

“মেঘ হেসে বললো, তাই নাকি তাহলে তো খুব ভালো কথা।আচ্ছা আমার মনে হয় তৃধার বিয়ে দিলে তৃধা আরো সুস্থ হতো।রাজন কে বললে হয় না। ”

“এখন কোন মুখে বলি বলোতো।আমি এটা বলতে পারবো না।”

“আমার উপর ছেড়ে দিন আমি বলবো রাজন কে।”
——————————————————–

ধরনীতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।সূর্য বিলীন হয়ে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।মেঘ সারা ঘরের লাইট অন করে তৃধার ঘরে গেলো।তৃধার পাশে বসে তৃধার কপালে হাত দিয়ে বললো,খুব শিঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে তৃধা তুমি।তৃধা মেঘের একটা হাত ধরলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।তৃধা ইদানিং কথা বলতে চেষ্টা করে মেঘ সেট স্পষ্ট বুঝতে পারে।সন্ধ্যার পরেই রাজন এলো বাড়িতে।সবার সাথে গল্প করছে রাজন নিচে দাঁড়িয়ে।মেঘ নিজের ঘরে কাপড় ভাজ করছিলো।এমন সময় রাজন দরজায় টোকা দিয়ে বললো,

“আসবো।”

মেঘ দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো খয়েরী ফ্রেমের চশমা পরা কালো সুট পরা ফর্সা লম্বা, ঠোঁটের উপর তিল একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

মেঘ অপরিচিত ছেলেটিকে বললো,

“নাম কি আপনার?চিনলাম নাতো।”

“রাজন ভাবি।”

রাজন।চোখে মুখে অবাক হওয়ার ভাব মেঘের।

“হুম কেনো ভাবি?এভাবে চমকে গেলেন কেনো নাম শুনে।”

“ভেতরে আসুন ভাইয়া।আমি আগে দেখিনি তো তাই চিনতে পারিনি।”

এক তোড়া ফুল এগিয়ে দিলো মেঘের হাতে আর বললো,

“বিবাহিত জীবনের শুভেচ্ছা ভাবি।”

“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

মেঘ দেখলো রাজনের হাতে আর একটা ফুলের তোড়া।

মেঘ বললো,

“ওটা কার জন্য। ”

রাজন এর চোখে মুখে বেশ লজ্জা। রাজন বললো,

“তৃধার জন্য ভাবি।”

“আপনি কি তৃধাকে পছন্দ করতেন।”

“জ্বী ভাবি।”

“কত আগে থেকে। ”

“বলতে পারেন ছোট বেলা থেকেই।”

“এখনো পছন্দ করেন।”

“যে ভাল লাগা মনের মাঝে গেঁথে যায় সেটা কি কখনো ভোলা যায়।দীর্ঘকালের ভাল লাগা কখনো কমবে না ভাবি।”

“বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো তৃধাকে।”

“১০০% ছিলো।বাট তৃধা আমাকে রিজেক্ট করেছিলো।কতগুলো রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার ভাবি।ভালবাসা এত পোড়ায় কেনো বলতে পারেন ভাবি।”

“এখন বিয়ে করতে পারবেন তৃধা কে?”

রাজন চুপ আছে।

“কি হলো চুপ আছেন কেনো? ”

রাজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে।

“কি ভাবছেন তৃধাকে অন্যকেউ স্পর্শ করেছে তাই ও অপবিত্র হয়ে গিয়েছে।এটাই ভাবছেন তাইনা?ভালবাসা কি কে কাকে স্পর্শ করেছে এটা ভেবে হয়। আমাকে দেখুন।আমি বিবাহিত ছিলাম কিন্তু।অন্য কারো স্পর্শ আমার শরীরেও আছে কিন্তু।আপনার ভাই কিন্তু কখনো এটা ভাবে নি কেউ আমাকে স্পর্শ করেছিলো আমি অপবিত্র হয়ে গিয়েছি।সে আমাকে ভালবাসতো আমার শরীর নয়।সত্যিকারের ভালবাসা মন ছুতে চায়।শরীর নয়।”

রাজন এবার হেসে উত্তর দিলো,

“ভাইকে ভালবাসেন আপনি?”

মেঘ চুপ আছে।মেঘ কে চুপ দেখে রাজন বললো,

“আপনি এখন চুপ কেনো?”

মেঘ বললো,

“আগে আমি প্রশ্ন করেছি রাজন ভাইয়া?আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

“আপনার সব প্রশ্নের উত্তর তো আপনি দিয়েই দিলেন।”

“কিভাবে?”

“রৌদ্র যদি আপনাকে কেউ স্পর্শ করেছে এটা না ভাবে আমি কেনো ভাববো।পৃথিবীতে কিছু ছেলে আছে ভাবি যারা এক নারীতে সন্তুষ্ট।এক নারীকে ভালবেসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।আমি রৌদ্র আমরা সেই জাতীয় ছেলের মাঝে পড়ি যারা শুধুই ভালবাসতে জানি।কিন্তু প্রিয়জনের ভালবাসা পাওয়ার ভাগ্য নেই।আমরা এমন এক হতভাগা যাদের ভাগ্য লেখা ছিলো ভালবাসার অবহেলা।তৃধাকে আমি ভালবাসি ভাবি।তৃধার এক্সিডেন্ট এর পরে আমি আর কখনো আসিনি এখানে।কেনো জানেন,তৃধাকে এত খারাপ ভাবে দেখে হজম করার ক্ষমতা আমার নেই।সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমি ভালবাসি তৃধাকে।আমার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়েছেন।এবার আপনি বলুন।”

“কি বলবো আমি।”

“আর কত ভাবি।জীবন কিন্তু কেটে যাচ্ছে,সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।জীবনের সময় কিন্তু খুব অল্প।এই অল্প সময়ের প্রতিটা সেকেন্ড ভালবেসে কাটান না।রৌদ্র ভালবাসে আপনাকে ভাবি।আগে অনেক গালি দিতাম আপনাকে।মেয়েটা এমন বেয়াদব কেনো?যে আমার ভাইটার ভালবাসা বোঝে না।এত ভালবাসার পরেও কেউ কিভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।খুব রাগ হতো আপনার প্রতি।রৌদ্র ভেতরে ভেতরে ভীষণ তৃষ্ণার্ত আপনার একটু ভালবাসা পাবার জন্য।একবার রৌদ্রকে ভালবেসে দেখুন ভাবি।আজ চোখের সামনে আছে তাই বুঝছেন না।কাল যদি ও মারা যায় তাহলে ভালবাসি বলার সুযোগ টা পাবেন না।”

মরার কথা টা শুনে বুকের মাঝে ভীষণ জোরে বাড়ি মেরে উঠলো মেঘের।মেঘ এটা ভাবতেই পারেনা যে রৌদ্র থাকবে না।মেঘ খুব জোরেই বলে উঠলো,

“রাজন ভাইয়া প্লিজ।এমন কথা বলবেন না।উনার কিচ্ছু হবে না।”

রাজন বললো,

যাকে এত কেয়ার করেন কেনো মুখ ফুটে বলছেন না যে ভালবাসেন।বলে দিন না ভাবি।আর চলুন তৃধার ঘরে যায়। মেঘ বললো,আপনি যান না ভাইয়া।কথা বলার চেষ্টা করুণ। অনেক সময় কারো নিখুঁত ভালবাসা মানুষ কে মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনে।

রাজন তৃধার ঘরে প্রবেশ করলো।তৃধার খাটের পাশে গিয়ে বসলো।প্রাণের থেকে প্রিয় মানুষ টার এমন করূণ পরিনতি কারো পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।তৃধার হাত দু হাতের মুঠোয় ধরে কঁদছে রাজন।এমন কেনো হলো তৃধা।তুমি আমার না হতে তবুও কষ্ট ছিলো না। কেনো সব কিছু এভাবে বদলে গেলো।তোমার সাথে আমার জীবন থেকেও হারিয়ে গিয়েছে সব হাসি আনন্দ। তোমার এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না।প্লিজ আগের মতো হয়ে যাও তৃধা।এই জীবনে কি তোমার মুখে আর আমার নাম শুনতে পাবো না।তৃধার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।রাজনের দিকে তাকিয়ে অঝরে চোখের পানি ফেলছে।ভেতরের মানসিক অসুখ তৃধাকে গ্রাস করায় কারো কথায় খুব একটা রেসপন্স করে না তৃধা।

কেটে গেছে আরো সাতটা দিন……….

রাতে ডায়নিং এ বসে খাবার খাচ্ছে সবাই।এমন সময় তৃধা উঠে এলো।তৃধা এসে মা বলে ডাক দিলো।সেলিনা বেগম ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।নিজের মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে।এক টানা দুই বছর ঘরের বাইরে আসে নি নিজ থেকে।রাজন খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে তৃধাকে।বেশ স্বাভাবিক লাগছে তৃধাকে।আনোয়ার হোসেন ও উঠে গেলো মেয়ের কাছে।তৃধার দাদু ও উঠে গেলো।রৌদ্রর মুখে আনন্দের হাসি।মেঘের মুখে ও হাসি।আনন্দে আত্মহারা এই পরিবার টি।সবাই তৃধাকে নিয়ে ব্যাস্ত।রৌদ্র বোন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।সবার কাঁন্না দেখে তৃধা বললো কেউ কেঁদো না প্লিজ।আমি আর কাঁদতে চাই না।অনেক কেঁদেছি।তৃধার মুখে এমন কথা শুনে সবাই আরো বেশী অবাক হয়ে গেলো।তৃধা সবার মাঝ থেকে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো মেঘ ভাবি।আজ আমি সবার সাথে খাবার খাবো।মেঘ খুশিতে যেনো আত্মহারা।

–সেলিনা বেগম বললেন,তুমি জানো মা মেঘ তোমার ভাবি হয়।

–হ্যাঁ মা জানি।মেঘ ভাবি খুব ভালো।

–মেঘ তৃধাকে জড়িয়ে ধরে বললো,তৃধা দীর্ঘ দুই বছর পর আজ আমি অনেক খুশি হয়েছি।গত দুই বছরে আমার জীবনে এই প্রথম কোনো ভালো নিউজ তোমার মুখে ভাবি ডাক শোনা।

–গত দুই বছরে আমার জীবনে হাসির মতো কারণ কথা বলার মতো কারণ ছিলো না।কিন্তু তুমি আসার পর আমি অনেক বার হেসেছি।তোমার কথা আর গল্প আমার খুব ভালো লাগে।তুমি আমাকে বুঝিয়েছো কেঁদে নয় ফাইট করে বাঁচতে নয়।তুমি আমাকে শিখিয়েছো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার,তুমি আমাকে শিখিয়েছো কাঁদে বোকারা।কাঁদে দূর্বল রা।আমাকে সাহসী হতে সাহায্য করেছো তুমি।চোখের পানি মুছে ফেলেছি আমি ভাবি।আমিও বাঁচার মতো বাঁচবো।

–রৌদ্র সবার আড়ালে মেঘের হাত চেপে ধরে বললো,অথচ এই কাজ গুলো তোমার ও করা উচিত মিস মেঘবালিকা।

এরই মাঝে কলিং বেলের সাউন্ড হলো।আনোয়ার হোসেন দরজা খুলতেই দেখলেন মেঘের আগের পক্ষের শ্বশুর বাড়ির সবাই।
মেঘ বুঝতে পারলো তাদের আগমণ তার জন্য শুভ হবে না।

চলবে,,,