লাবণ্যর সংসার পর্ব-০৬

0
576

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_6
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

—“ এমন দিন দেখার জন্যই কি আমি তোকে খাইয়ে পরিয়ে বড়ো করেছিলাম? কি এমন করেছি আমি যে এই মেয়েটার কাছে আমায় ক্ষমা চাইতে হবে? ”

শিউলি বেগম কান্নারত অবস্থায় কথাগুলো বলে মাটিতে বসে কপাল চাপড়াতে থাকে।

—“ তুমি তো শুধু একটা ক্ষমাই চাইবে আম্মু । তার জন্য এতো নাটক কেনো করছো? আর এই মেয়ে তুমি কাকে বলছো? ও তোমার বৌমা, আমার স্ত্রী ও কে ওর যোগ্য সম্মানটুকু তো দাও। ”

—“ এবার অন্তত নিজেকে শুধরে নাও বেগম। ওদের ঠিক মতো সুখে এবার সংসার করতে দাও। ওদের দুজনের মধ্যে আর কোনও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করিয়ো না। হাত জোড় করে বিনীত হচ্ছি। ”

আতীক সাহেব , নিবিড়ের অনেক জোরাজুরিতে শিউলি বেগম লাবণ্যর কাছে মাথা নত করে ক্ষমা চেয়ে নেন। লাবণ্য হাসিমুখে শিউলি বেগমের হাতটা ধরে নেয়।

—“ মা আপনি আমার কাছে এভাবে ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ। মা আমি চাই আপনি আমার সাথে মেয়ের মতো আচরণ করুন। আমি বলছি তো আপনি আমাকে একটু আপন করে নিন। আমি আমার বিরুদ্ধে আর কোনও অভিযোগ আপনার মনে সৃষ্টি করতে দেবো না। আপনি শুধু কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে মানিয়ে নিন মা। ”

লাবণ্যর কথাশুনে শিউলি বেগম নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। শিউলি বেগমের পা ছুঁয়ে লাবণ্য সালাম করে। শিউলি বেগম সবভুলে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে।

—“ দেখলে তো লাবণ্য মেয়ে হিসিবে কতোটা ভালো। আজ তোমরা মা ছেলে হিসাবে যা করেছো তাতে লাবণ্য চাইলেই অনেক কিছু করতে পারতো। ও কিন্তু সব ভুলে আবার এইখানে ফিরে এসেছে। ”

—“ এইখানে না বলো লাবণ্যর সংসারে। ওর নিজের সংসারে ও ফিরে এসেছে। ”

শিউলি বেগমের হঠাৎ এমন কথায় আতীক সাহেব সত্যিই অবাক হন। আতীক সাহেব নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে উঠে।

—“ আমি স্বপ্ন দেখছি না তো বেগম? তুমি সত্যিই এমন কথা বলছো? ”

শিউলি বেগম হাসিমুখে লাবণ্যর হাত ধরে নিবিড়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। দুজনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে।

—“ আমার ছেলের খুশিতেই আমি খুশি। আমার ছেলে যা চায় তাই হবে। আমার ছেলের খুশির কথাই আমি ভাবি। তাই আমার ছেলে যখন লাবণ্যকে নিয়ে সারাজীবন থাকতে চায়। এখানে আমার আর কোনও আপত্তি নেই। ”

—“ লাভ ইউ আম্মু , লাভ ইউ ফরএভার। ”

নিবিড়ের কথায় লাবণ্য ছাড়া প্রত্যেকেই হেসে উঠে।লাবণ্যর মনের ভিতর থেকে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সব ভালোর মধ্যেও কোথাও যেনো একটা ফাঁক রয়েই গেছে। কোথাও একটা চাপা কষ্ট ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠছে। হয়তো বাবা – মা কে চিরজীবনের মতো ত্যাগ করে আসার কষ্ট টা লাবণ্যকে শান্তি দিচ্ছে না।

এখন থেকে হেসে হোক, কষ্ট করে হোক এই মানুষ গুলোকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে। এখন এটাই যে ওর শেষ আশ্রয়। মা তো স্পষ্ট বলেই দিয়েছে মেয়েরা পরগাছা। কিন্তু শাশুড়ী মা হাসিমুখে বলেছে এটা ওর সংসার । নাম দিয়েছে “লাবণ্যর সংসার’ , এই কথাতে অনেকটা ভরষা পেয়েছ লাবণ্য। যা হয়তো ওর বেঁচে থাকার আলো।

—“ লাবণ্য কি ভাবছো? ”

নিবিড়ের ডাকে হুঁশ ফেরে লাবণ্যর। চোখের পানি মুছে নিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকায়।

—“ রুমে চলো ফ্রেশ হয় নাও। ”

লাবণ্য নিবিড়ের সাথে রুমে চলে আসে। নিবিড় দরজা বন্ধ করে দেয়। লাবণ্যর হাতটা ধরে নিয়ে ও কে বিছানায় বসিয়ে দেয়। নিজেও ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে। লাবণ্য পা তুলে নিতে চাইলে নিবিড় শক্ত করে ধরে নেয়।

—“ তুমি আমায় ক্ষমা করেছো তো লাবণ্যময়ী? আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এখনো স্বামীর দায়িত্ব পালন করিনি। তোমার হাত ধরে বসে একটা দুটো ভালোমন্দ কথাও বলিনি।কিন্তু আজকের পর থেকে তুমি স্ত্রীর সমস্ত অধিকার পাবে। ”

নিবিড় লাবণ্যর কপালে গভীর ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,,,

—“ আজকের সন্ধ্যায় স্পেশাল একটা গিফট আছে তোমার জন্য , রেডী থেকো। ”

নিবিড় হুড়মুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে শাওয়ার নিতে চলে যায়।

লাবণ্য এখনো নিজেকে বোঝাতে পারছে না। সত্যিই সে তার মা – বাবার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে এসেছে! সত্যিই কি মায়ের কোলে শুতে পারবে না। মায়ের হাতে ভাত খেতে পারবে না। সব শেষ হয়ে গেলো এক নিমেষে!

—“ কি রে চুলটাও এখনো ঠিক করে মুছতে পারিসনা? ”

লাবণ্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে তোয়ালে দিয়ে মুছছিলো। কারুর গলার আওয়াজ পেতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখে। ওর শাশুড়ি মা প্লেট হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য ‌শিউলি বেগমকে দেখে উনার কাছে এগিয়ে আসে।

—“ আসলে মা , আমি মুছছিলাম , ,,”

লাবণ্য ভাঙ্গা গলায় কথাগুলো বলে নিজের চুলটা মুছতে চেষ্টা করে। এমনিতেই কথা সত্যি যে লাবণ্য নিজের কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুল ভালো করে মুছতে পারে না। এতোদিন মা, ভাবী এরাই যত্ন নিতো। আর এখন তো!

শিউলি বেগম এগিয়ে এসে লাবণ্যর হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে নেন।

—“ হয়েছে আমি বুঝে গেছি। আয় তো আমি তোর চুলটা মুছিয়ে দিচ্ছি। ”

শিউলি বেগমের কথায় লাবণ্যর চক্ষু বড়ো হয়ে যায়। ও কি ঠিক শুনছে!

—“ তুই কি আমাকে মাফ করতে পেরেছিস মা? আমি যা কাজ করেছি তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমি বুঝতে পারিনি আমার ছেলের সুখ তোর কাছেই। আজ থেকে তুই আমার মেয়ে, তোর এই মা টাকে ক্ষমা করিস। ”

শিউলি বেগমের চোখের কোণে পানি। নিজের মার কষ্ট ভুলতে লাবণ্য শিউলি বেগমকে জড়িয়ে ধরে।

—“ মা আপনি আমার কাছে বারংবার ক্ষমা চেয়ে আর লজ্জা দিবেন না। আপনি যে আমাকে মেয়ের স্থান দিচ্ছেন এটাই অনেক। ”

—“ আমি তোকে সেদিন খেতে দিইনি তাই না রে? আয় আজ আমি নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিই। মুখটা তো একদম শুকনো হয়ে আছে। নিশ্চয়ই এখনো পর্যন্ত পেটে কিছু পড়ে নি! ”

লাবণ্যর দুই নয়ন পানিতে ভরে উঠে। সত্যিই তো যে খাওয়ার কথা ভুলে আছে একদিন না খেয়ে। অন্যসময় হলে হয়তো বাড়ি মাথায় করে ফেলতো! আর খাবেই বা কি, খেয়েছে তো স্বামীর লাথি, আর বাপ-মা-ভাইয়ের মুখ ঝামটা , এতেই পেটটা ভরে আছে ওর।

শিউলি বেগম ভাত মাখিয়ে এক লোকমা লাবণ্যর গালে তুলে দেন। লাবণ্য কান্না করতে গিয়েও কাঁদেনা। এক মা কে ছেড়ে আর এক মা কে যদি আপন করতে পারে তা তে ক্ষতি কি!

শিউলি বেগম পরম স্নেহে লাবণ্যকে খাইয়ে দিচ্ছে। লাবণ্য বাধ্য মেয়ের মতো পরম তৃপ্তির সাথে খেয়ে চলেছে। আসলেই কি ও স্বপ্ন দেখছে! যা ঘুম ভাঙলেই ভেঙ্গে যাবে! খাওয়ার মাঝে দরজায় নকের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় দুজনেই। একজন সার্ভেন্ট এসে লাবণ্যর হাতে এসে একটা প্যাকেট দিয়ে যায়। আর মুখে বলে যায় নিবিড় স্যার পাঠিয়েছেন।

শিউলি বেগম ব্যপারটা বুঝেই যান। ছেলে সত্যিই এই মেয়েকেই ভালো বেসেছে। তাই তিনি লাবণ্যকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই খাইয়ে দিয়ে চলে যান।

অফিসে আসার সাথে সাথেই সমস্ত স্টাফ উঠে নিবিড়কে দেখে গুড নুন জানায়। নিবিড় নিজের চেম্বারে চলে যায়। তার মধ্যে সবাই কম বেশী আলোচনা করতে থাকে, তাদের বস সকালেই চলে আসে তাহলে আজ এতো দুপুর বেলায় ঢুকলো কেনো? কেউ বলছে নতুন বিয়ে হয়েছে তো দেখ! কিছুক্ষণের জন্য সবাই হেসে উঠে। ম্যানজারের ধমকে সবাই চুপ করে যায়।

নিবিড় নিজের চেম্বারে ঢুকতেই দেখে ওর চেয়ারে কেউ বসে আছে। নিবিড়ের বুঝতে বাকি থাকে না , তাই কিছু না বলেই অন্য চেয়ার টেনে বসে ফাইল নিয়ে দেখতে লাগলো। অপর পাশের মানুষটা টের পেয়ে ওর মুখোমুখি ঘুরে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো।

—“ আমি যে এখানে আছি একজন কি তার টের পেয়েছে? ”

—“ ইয়েস ম্যাম টের পেয়েছি! আর তাই জন্যই তো পাশের চেয়ারে বসেছি। ”

নিবিড় মৃদু হেসে মেঘলাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো। মেঘলা উঠে এসে নিবিড়ের সামনে থাকা টেবিলের ওপর উপর উঠে বসলো। নিবিড়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এক টানে ওর হাতে থাকা ফাইলটা কেড়ে নিয়ে পাশে রেখে দিলো। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে মেঘলার দিকে তাকাতেই মেঘলা বললো,,

—“ তুমি আজকে অফিসে আসতে এতো লেইট করলে কেনো? জানো আমি পাক্কা তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা এখানে তোমার জন্য ওয়েট করেছি! তুমি দশটার সময় অফিসে চলে আসো তাই জন্য আমি নয়টার সময় এসে বসে আছি এখানে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে। কিন্তু তুমিই তো আমায় সারপ্রাইজ দিয়ে দিলে! ”

মেঘলা কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ করে গাল ফুলিয়ে রইলো। নিবিড় সশব্দে হেসে উঠে মেঘলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

—“ আমি সত্যিই সারপ্রাইজড্ হয়েছি! এবার বল তুই ভার্সিটি না গিয়ে এখানে কি করছিস? ”

—“ আমার জ্বর হয়েছে না। আমি কি করে ভার্সিটি যাই বলো তো! ”

—“ কেনো? যেমন ভাবে এখানে এলি!”

—“ আমি তোমাকে মিস করছিলাম তো! তাই জন্য এসেছি তোমার কাছে। তুমি তো তোমার বউ কে আনতে গিয়েছিলে তাই না? ”

নিবিড় সামান্য ভ্রুযুগল কুঁকড়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘলা কিঞ্চিত হেসে বলে,,

—“ শুধু আনতে নয় ,
তার রাগ ভাঙ্গাতে গিয়েছিলে। ”

—“ তোকে বললো কে? ”

—“ কেউ বলেনি শুনেছি মামু কল দিয়েছিলো মমকে। তোমাদের মধ্যে না কি কিছু বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে! কিছু একটা করেছো যার জন্য তোমার বউ তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এনিওয়েজ আমার ওর মধ্যে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমার শুধু তোমার প্রতি ইন্টারেস্ট। ”

মেঘলা নিবিড়ের কপাল থেকে হাত বুলিয়ে এনে চিবুকে ঠেকায়। নিবিড় হাতটা ধরে সরে আসে। অনেক ফাজলামো করেছিস বাড়ি যা। নিবিড় পুনরায় ফাইল হাতে তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। মেঘলা নিবিড়ের এক কাঁধে হাত রাখে।

—“ তোমাকে না কতোবার বলেছি ভাইয়া এই ফাইল দেখা, এতো কাজের প্রেশার তুমি একা কেনো নাও! আমায় এর দায়িত্ব কবে দিবে তুমি? ”

—“ সময় আসুক অবশ্যই দায়িত্ব নিবি। ”

সবুজ রঙের শাড়ি পড়ে হাত দুটো কালো চুড়িতে রাঙিয়ে নেয়। চুল এলো করে সুন্দর পরিপাটি হয়ে সেজে নেয়। কপালে ছোট্ট করে একটা লাল টিপ পড়ে নেয়।

দুপুরে প্যাকেটে নিবিড় এই শাড়ি আর চুড়ি পাঠিয়েছে। তার মধ্যে একটা চিরকুটে লেখা ছিলো, “ পরণে সবুজ শাড়ি আর হাত ভর্তি কালো চুড়ি তে আজ সন্ধ্যায় আমি দেখতে চাই আমার লাবণ্যময়ীকে। ”
লাবণ্যর ঠোঁটের কোণে হাসিদের আগমন হয়। তবে কি সত্যিই সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। লাবণ্যও কি সত্যি সত্যিই আর চার – পাঁচটা মেয়ের মতো স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে পারবে!!

রং বেরং এর লাইটে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে লাবণ্যর। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি করেই লাবণ্য এই রিসোর্টে আসে। মূলত নিবিড় এখানেই ওর জন্য কিছু একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছে।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক হতে চললো নিবিড়ের এখনো কোনও পাত্তা নেই। নিবিড়কে যে কল দিবে তারও কোনও উপায় নেই , কারণ নিবিড়ের নাম্বারটাই তো ওর কাছে নেই!!

চলবে….

(লেখার মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন 🙏)