#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
২০.
“আমার বাচ্চা চাই না।” রুশা খুব সহজ আর স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বলল। কিন্তু ওর এই কথা আদ্রিশ ঠিক হজম করতে পারল না। রুশা ঠান্ডা মাথায় এই ছোট কথা দ্বারা বড় একটা খুন করে ফেলল। আদ্রিশের চোখ মুখে যে খুশির আভা ফুটে উঠেছিল নিমিষেই
তা মুছে গেল। ওর চোখ মুখ শক্ত আকার ধারণ করল।
দু পা এগিয়ে ওর কাছে গিয়ে বলল,
“বাচ্চা চাই না মানে কী?”
“মানেটা খুব সহজ। আমি বাচ্চা চাই না।”
“কেন চাও না হাহ?”
“কেন চাইব? আমি এই বাচ্চা জন্ম দিতে পারব?”
“কেন পারবে না? সমস্যাটা কোথায়?”
“বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য আমি বেঁচে থাকব তো? তোমার শত্রুরা আমাকে বাঁচতে দেবে? বিশেষ করে জারিফ?”
আদ্রিশ সাথে সাথে বলল,
“জারিফকে আমি মেরে ফেলেছি। তুমি এখন সেফ।”
রুশা মৃদু হাসল। আদ্রিশ তাহলে ওকে এতদিন জারিফের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছে।
“জারিফ নাহয় মরে গেছে। তোমার কি শত্রুর অভাব? আমার জীবনের গ্যারান্টি আছে?”
আদ্রিশ রুশার দুহাত ধরে নরম কন্ঠে বলল,
“রুশা, কেউ তোমার ছায়াও ছুতে পারবে না। আমি আমার সমস্ত এফোর্ট লাগিয়ে দেব। তুমি সুস্থ ভাবেই ওকে পৃথিবীতে আনতে পারবে। বাচ্চাটা আমাদের প্রথম সন্তান। ওর আসাটা খুব জরুরি। আমাদের দুজনের জন্যই জরুরি।”
রুশা আদ্রিশের হাত ছাড়িয়ে নিল। আদ্রিশ ওর দিকে চেয়ে আছে। রুশা আদ্রিশের চোখে চোখ রেখে বলল,
“জন্ম দিতে পারলেও সুস্থ একটা জীবন দিতে পারব? কোন পরিচয়ে বাঁঁচবে? কার পরিচয়ে বাঁঁচবে?”
“আমার সন্তান অবশ্যই আমার পরিচয়ে বাঁঁচবে।”
রুশা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তোমার আবার পরিচয় আছে? ওহ হ্যা, আছে তো। একজন মাফিয়া, ক্রিমিনাল, খুনি, সাইকো। খুবই সম্মানের পরিচয়। এই পরিচয়ে বড় হবে?”
আদ্রিশ চিৎকার করে বলল,
“রুশা! একদম বাজে কথা বলবে না। আমি সাইকো নই। আমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। এই শব্দটা তোমার মুখে আরেকবার শুনলে….
” কী করবে? কী করবে তুমি?”
“তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
“তুমি এমনই একজন মানুষ নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে দু’বার ভাববে না। দেখা গেল জন্ম দেওয়ার আগে তুমিই খুন করে ফেললে অথবা জন্ম দেওয়ার পরে।”
আদ্রিশ নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। নিজের সন্তানকে খুন করবে এটা রুশা ভাবলো কী করে?
আদ্রিশ ঠাটিয়ে এক চড় মারল রুশাকে। রুশা ছিটকে খাটের কোনায় পড়ে গেল। রুশা ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“সাথে সাথে প্রমাণ করে দিলে তো? যদি পেটে আঘাত পেতাম? তাহলে কী বাচ্চাটা বাঁচত? তুমি ওর খুনি হতে না?”
রুশার কথা শুনে আদ্রিশের হুশ এলো। রুশা তো ঠিকই বলেছে। বেকায়দায় আঘাত পেলে বাচ্চাটার কী হতো?
রুশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি আমাকে যে পরিমাণ টর্চার করো তাতে আমার জীবনের গ্যারান্টি নেই। একদিন আমিই মরে যাব। সেখানে বাচ্চা কী করে জন্ম দেব? তুমি নিজের উপর কন্ট্রোল করতে পারো না। রাগের বশে আমাকে বারবার আঘাত করবে। আর এই আঘাতে কোনো একদিন আমি বাচ্চাটাকে হারিয়ে ফেলব। আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। আর হ্যা তোমার মতো মানুষের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই। একটা খুনি, ক্রিমিনাল নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। সন্তান, সংসার তাদের জন্য নয়। তাই আমি ওকে পৃথিবীতে আনব না। তোমার মতো মানুষ ওকে মানুষ হওয়ার না অমানুষ হওয়ার শিক্ষা দিবে।”
আদ্রিশ রাগে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু রুশাকে কিছু বলতে পারছে না। আর না আঘাত করতে পারছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই বাচ্চাটা আমার চাই। যেকোনো মূল্যে চাই। ওর সাথে কিছু করলে তোকে আমি ছাড়ব না। মনে রাখিস।”
আদ্রিশ হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুশা ধপ করে বসে পড়ল। বসে বসে কাঁদতে লাগল।
.
আদ্রিশ যথারীতি চেষ্টা করছে রুশাকে মানাতে। রুশার প্রয়োজনের কমতি রাখছে না। নিজে ওর টেক কেয়ার করছে। ও মনে প্রাণে চাইছে বাচ্চাটা আসুক। একটা বাচ্চা ওদের দূরত্ব ঘোচাতে পারে। সম্পর্ক আরো গভীর করবে। রুশা তাহলে সব সময় আদ্রিশের সাথে থাকবে। ওকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারবে না। উলটা পালটা কিছু করার কথাও ভাববে না। বাচ্চার জন্য হয়তো নিজেকে বদলে নিবে। ওদের জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে। হাসিখুশি একটা জীবন হবে।
আদ্রিশ রুশার সামনে ওর মোবাইলটা রাখল। রুশা একবার মোবাইলের দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।
আদ্রিশ ধীরে ধীরে বলল,
“তোমার মোবাইল ফেরত দিলাম। অন করে নিও।”
রুশা কিছু বলল না। মোবাইলটা হাতে নিল না। আদ্রিশকে যথারীতি ইগ্নোর করছে। আদ্রিশ চাইছে না রুশার উপর রাগ করতে। নিজেকে যথেষ্ট ঠান্ডা রাখছে।
দুদিন পর। রুশা ওয়াশরুমে গিয়ে শানকে কল করল। শান কল রিসিভ করে চুপ করে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে আদ্রিশ না রুশা।
“ভাইয়া!”
“পিউ, বোন আমার কেমন আছিস? তুই ঠিক আছিস তো? আমি কত টেনশন করছি তোর জন্য।”
“আমি ঠিক নেই ভাইয়া। অনেক সমস্যায় আছি। কি করব বুঝতে পারছি না।”
“কী হয়েছে? আদ্রিশ কিছু করেছে?”
“না।”
“তাহলে?”
রুশা চুপ করে আছে। শানের টেনশন বাড়ছে। রুশা নতুন করে কি গণ্ডগোল বাঁধাল তাই ভাবছে।
“পিউ! কথা বল। আমার টেনশন হচ্ছে।”
রুশা নিচুস্বরে বলল,
“ভাইয়া, আমি প্রেগন্যান্ট।”
শানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল বোনের কথা শুনে। স্তব্ধ হয়ে আছে। ওর বোন প্রেগন্যান্ট! যে কিনা শত্রু নিধন করতে গেছে সে এখন শত্রুর বংশধর নিজের পেটে বহন করছে?
শান তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“কী বলছিস পিউ?”
“হ্যা ভাইয়া।”
শান গর্জে উঠে চিৎকার করে বলল,
“তুই এইজন্য গিয়েছিস? আদ্রিশের সন্তানের মা? ছিহ! তোকে আমি বারবার সাবধান করেছি। শুনিস নি আমার কথা। ওই খুনিটার সন্তানের মা হয়ে ওই বাড়িতে থাকবি? ওর সাথে সংসার কর, ওর সন্তান লালন পালন কর। আমাকে ভাই বলে পরিচয় দিবি না। আমি মরে গেছি তোর জন্য। এটাই মনে করবি। আমার তোর মতো বোনের দরকার নেই।”
রুশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
“ভাইয়া, এভাবে বলো না। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি কাকে বলব নিজের কষ্টের কথা, সমস্যার কথা?”
রুশা লজ্জায়, অনুতাপে, কষ্টে কাঁদতে লাগল।
শান নিজেকে শান্ত করে বলল,
“তোকে চলে আসতেও বলতে পারছি না। কারণ তুই তোর লক্ষ্যের পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিস, এতদিন এত কষ্ট করেছিস। আমার পরামর্শ বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেল। তারপর নিজের কাজ শেষ করে চলে আয়। আমি সব ম্যানেজ করে নেব।”
রুশার নিজেকে অসহায় লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
“বাচ্চা নষ্ট করে ফেলব? আমার বাচ্চা।”
শান আবারও চিৎকার করে উঠল।
“ভুলে গেছিস তুই সব? ভুলে গেছিস ও আমাদের সাথে কি করেছে? আমাদের পরিবারটা ধ্বংস করে দিয়েছে। সেসব দিন ভুলে গেছিস? কতটা ছটফট করেছি আমরা। কত কেঁদেছি, চিৎকার করে কেঁদেছি, আর্তনাদ করেছি। কত অসহায় ছিলাম। এখনো আমি কিছুই ভুলিনি অথচ তুই সব ভুলে বসে আছিস। তোর ভাইয়ের সাথে, ভাবীর সাথে তার অনাগত সন্তানের সাথে কি করেছে সব ভুলে গেছিস? একটা বাচ্চা আমাদের বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা ছিল। কিন্তু সে এখন তার মায়ের সঙ্গে কবর বাসী হয়ে গেছে। ভাই-ভাবীকে তো বাবা-মায়ের মতো মানতিস, তাদের কথা ভুলে গেলি? কত তপস্যার পরে একটা বাচ্চা দিয়েছিল আল্লাহ সেটাও কেড়ে নিয়েছে ওই আদ্রিশ। মৃত মানুষের মতো বেঁচে আছি। হাসতে ভুলে গেছি পিউ। কতটা অসহায় হয়ে গেছি। তুই সেদিন চিৎকার করে কী বলেছিলি? কী প্রতিজ্ঞা করেছিলি? সব ভুলে গেছিস পিউ? এত তাড়াতাড়ি?”
শান কাঁদছে। রুশাও ওর সাথে কাঁদছে। সেসব দিনের কথা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না রুশা। মেঝেতে বসে পড়ল। ভয়ানক, লোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এতগুলো দিন পাড় করে গেছে।
“না ভাইয়া, কিছুই ভুলিনি। আমি প্রতিশোধ নেব। সবকিছুর প্রতিশোধ নেব। আমি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ করব। আমার ভাই-ভাবী, তাদের অনাগত সন্তানের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেব।”
” ও যেদিন ওর বাচ্চার জন্য ছটফট করবে সেদিন আমি শান্তি পাব। এখন কি করবি তা তুই ভালো জানিস।”
“আদ্রিশ বলেছে যেকোনো মূল্যে ওর বাচ্চা চাই। বাচ্চার কিছু হলে আমাকে ছাড়বে না। আমি কী করব?”
“ওর যন্ত্রণা তাহলে শুরু হয়ে গেছে? তুই এমন কিছু কর যাতে দায়ভার তোর উপর না পড়ে।”
“ঠিক আছে। আমি কিছু ভাবছি।”
রুশা কল কেটে থম মেরে বসে রইল। ওর মাথা কাজ করছে না। গ্যালারি থেকে ভাই ভাবীর একটা পিক বের করল। দুইজনকে এক সাথে কত সুন্দর লাগছে। কত সুখী ছিল ওরা। ওদের কত ভালোবাসা, স্বপ্ন ছিল। বিয়ের পর পর ওর ভাইয়া ওর ভাবীর কাছে বাচ্চা নেওয়ার কথা বলে। বাচ্চা হচ্ছিলো না দেখে ওর ভাবীর মনমরা হয়ে থাকত। মনে মনে অনেক কষ্ট পেত। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করত, কত কি মানত করেছে। রুশাকে কল করেও অনেক কান্নাকাটি করত। ওর ভাই অনেক বুঝাতো কিন্তু তার মনে হতো সে হয়তো কোন দিন মা হতে পারবে না। তারপর তিন বছরের মাথায় আল্লাহ মুখ তুলে তাকায়। সেদিন ওদের বাড়িতে যেন ঈদ উৎসব। রুশাকে ভিডিও কল করে যখন ভাই-ভাবী এক সাথে খবর দিয়েছিল তখন রুশা ওদের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। কত খুশি ছিল তারা। কল কেটে নিজেও কেঁদেছিল খুশিতে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ভাইয়ের বাচ্চার জন্য সুন্দর একটা নাম খুঁজতো।
“ভাইয়া, আমি এত স্বার্থপর কিভাবে হয়ে গেলাম? কী করে সব ভুলে গেলাম? তুমি আমার বাবা, আমার মা ছিলে। তুমি ছোট থেকে আগলে রেখেছো। এতটা ভালোবেসেছো। বিয়ে পর্যন্ত করতে চাওনি। তোমার সাথে কী হয়েছিল কী করে ভুলে গেলাম। আমার ভাবীর সাথে কী হয়েছিল কী করে ভুলে গেলাম? তোমাদের বাচ্চার সাথে যা হয়েছে তা কী করে ভুলে গেলাম? আমাদের সাজানো সংসারের সাথে কী হয়েছিল তাও ভুলে গেলাম? এত স্বার্থপর কিভাবে হতে পারলি পিউ? নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলি? আমি আদ্রিশকে ছাড়ব না। সবকিছুর বরাবর হিসাব নেব। ও আমাদের কাছ থেকে যা যা কেড়ে নিয়েছে তা সব কেড়ে নেব। ওর বাচ্চাকেও কেড়ে নেব। আমি ওকে ছাড়ব না ভাইয়া। আমি ওকে ছাড়ব না ভাবী। প্রতিটি মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব। ভয়ানক প্রতিশোধ।”
রুশা পাগলের মতো আচরণ করছে। চিৎকার করে কাঁদছে। হাত দুটো দিয়ে মেঝেতে আঘাত করছে। হাতে রক্ত জমে গেছে৷
.
.
.
রুশা আদ্রিশের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। আদ্রিশ এতে বেশ খুশি। ওরা দুজন এক সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। বেবির কন্ডিশন নিয়ে কথা বলেছে। কীভাবে চলতে হবে সব পরামর্শ নিয়েছে। বেবির বয়স দুই মাসের অধিক। আর আট মাস পরে বেবিকে ছুতে পারবে। আদ্রিশ সেই সময়টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ওরা দু’জন মিলে বেবির জন্য খেলনা, জামাকাপড় কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছে। আদ্রিশ ওকে কেনাকাটার বাহানায় বাইরে নিয়ে যায় যাতে ওর মন ভালো থাকে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়, রাতে লং ড্রাইভে যায়। ওর মন সব সময় ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করে কারণ ডাক্তার স্ট্রেস ফ্রি থাকতে বলেছে৷
রুশার মাথায় একেক সময় একেক প্লান ঘুরতে থাকে কিন্তু কোন প্লান কাজে দিচ্ছে না। সব প্লান ফ্লপ হয়। আদ্রিশ শাওয়ার নিয়ে এসে রেডি হচ্ছে। জামাকাপড় এটা সেটা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছে। রুশা শুয়ে শুয়ে দেখছে এসব।
“আদ্রিশ তোমাকে না কতদিন বলেছি এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে না? এগুলো আমার পছন্দ না। আর নিচে এসব কি রেখেছো? যদি আমি পড়ে যাই? তোমাকে আর কতবার বলব?”
আদ্রিশ সরি বলে টুল, কাউচ জায়গা মতো রাখল। কার্পেটের উপর থেকে হ্যান্ডার তুলল।
রুশা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। আদ্রিশ শ্যাম্পুর বোতল ফেলে রেখেছে। মেঝেটা পুরো ভেজা। রুশা বেশ বিরক্ত হলো। শ্যাম্পুর বোতলটা তুলে ছিপি লাগাতে গিয়ে থেমে গেল। কিছু একটা ভাবল। তারপর কিছু শ্যাম্পু মেঝেতে ফেলে দিল। পা দিয়ে সেই শ্যাম্পু ছড়াচ্ছে।
আদ্রিশ টাই বাঁধার জন্য টাইটা হাতে নিতেই রুশার চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসে। আদ্রিশের হাত থেকে টাই পড়ে গেল। বুকটা ধুক করে উঠল৷ আদ্রিশ দৌড়ে দরজার সামনে গেল। দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ। রুশার আর্তনাদ কানে আসছে। আদ্রিশ দরজা ভেঙে ফেলে। রুশা মেঝেতে পেটে হাত দিয়ে কাঁদছে। পায়ের কাছে রক্তের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। আদ্রিশ দ্রুত ওকে ধরতেই রুশা জ্ঞান হারালো।
.
হাসপাতালের বেডে রুশা ঘুমিয়ে আছে। আদ্রিশ ওর সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ওর ঘুমন্ত মুখটা যেন বলছে,
“তুমি খুনি। আমার নিষ্পাপ বাচ্চার খুনি।”
আদ্রিশের চোখ ফেটে যেন কান্না হয়ে রক্ত ঝড়ছে। এর আগে শেষ কবে এত কষ্ট পেয়েছে, চোখে পানি এসেছে মনে নেই। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগেই বলেছে ওর মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।
চলবে…..
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
২১.
আজ পনেরো দিন ধরে রুশা ঘর থেকে বের হয় না। আদ্রিশকেও ওর ঘরে এলাও করে না। একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। সেদিন হসপিটালে সব জানার পরে আদ্রিশের কলার ধরে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছে, কেঁদেছে, পাগলামি করেছে। বাড়িতে আসার পর শান্ত হয়ে গেছে। আদ্রিশ অনেক চেষ্টা করেছে রুশার সাথে কথা বলার কিন্তু পারেনি। অপরাধবোধে তেমন জোর করার সাহস পায়নি। আদ্রিশ নিজের ঘরে বসে ড্রিংক করছে। নেশায় বুদ হয়ে গেছে। শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। উঠার শক্তিও নেই। বুকের ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। নিজের হাতে নিজের নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করার অপরাধবোধ হয়তো ওর এ জন্মে শেষ হবে না।
“আমি খুনি। আমি আমার বাচ্চাকে খুন করেছি। রুশা তুমি ঠিক বলতে আমি বাবা হওয়ার যোগ্য নই। তুমি এতবার বলার পরেও আমি কি করে এত কেয়ারলেস হতে পারলাম? কেন তোমার প্রতি, আমার বেবির প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে পারলাম না? কেন আগলে রাখতে পারলাম না? ছোট্ট বাচ্চাটাকে আমি ছুতে পারলাম না। আদর করতে পারলাম না। আমি কি করলাম এটা? আমার এত ক্ষমতা আজ নিষ্ফল। আমি সব শেষ করে দিয়েছি।”
আদ্রিশ কাঁদছে। বাচ্চা হারানোর শোকে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। আজ বুঝতে পারছে সন্তান বাবার জন্য কি। ও ওর বাবার জন্য কি ছিল। মায়ের মৃত্যুর পরে ওর বাবা ওকে খুব যত্ন করেছে, আগলে রেখেছে, কখনো কষ্ট পেতে দেয়নি। কিন্তু ও পারেনি বাবার মতো আদর্শ বাবা হতে।
রুশা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই কয়দিনে চেহারা অনেকটা পালটে গিয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বিষন্নতায় ঘেরা মুখটা দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই ওর জীবনে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
জীবন থেকে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেছে। কতটা অযত্নে কাটছে দিনগুলো। রুশার তখন চোখ পড়ল পেটের দিকে। ডান হাত দিয়ে আলতো করে পেট স্পর্শ করল। পেট স্পর্শ করতেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। পেট থেকে হাত সরিয়ে চোখের পানি মুছে নিজেকে আয়নায় দেখল। নিজের অজান্তেই আলতো হাসল। সে হাসিটা রুশা আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেল। কত সুন্দর, স্নিগ্ধ সে হাসি। কত মুগ্ধতা ছড়ানো। এমন সুন্দর, পবিত্র হাসি কতদিন পরে হাসলো জানা নেই।
রুশা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই ধরণীতে অন্ধকার নেমে আসবে। গাঢ় অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে। রুশা চুলগুলো ছেড়ে দিল। মৃদু বাতাস চুলগুলো ছুয়ে গেল।
“আমি পেরেছি আদ্রিশ। তোমার প্রতি কঠোর হতে পেরেছি। তোমাকে আমি এভাবেই কঠোরতার সাথে শাস্তি দিয়ে যাব। তোমাকে আমি তিলে তিলে মারব যেভাবে আমি তিলে তিলে মরেছি। আমি আমার ভাই, ভাবি আর তাদের বাচ্চার প্রতিশোধ নেব। তুমি তাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছো। নিজের স্বার্থের জন্য নিরাপদ মানুষকে মেরেছো। কি অপরাধ করেছিল ওরা? তুমি এত অমানুষ কেন? এত নিষ্ঠুর একটা মানুষ কি করে হয়? আমিও তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হব। তোমার এমন অবস্থা করব যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে পড়বে।”
.
.
কথা সেজানের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে ব্রিজের ওপর। স্নিগ্ধ বাতাসে ওর পরনের সাদা সেলোয়ার-কামিজ আলতো দুলছে। আজকে চুলে খোঁপা করেছে। মুখে কোনো সাজগোজ নেই। সাজলে সেজান যদি অন্য কিছু ভাবে তাই লজ্জা আর দ্বিধায় সাজতে পারেনি। কথা ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকাল। ঢেউয়ের উত্তাল দেখছে। গাড়ি থামার শব্দে কথা ঘুরে দাঁড়ায়। সেজান চলে এসেছে। সেজান গাড়ি থেকে নামল। ওর গায়ে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্ট ইন করা। সেজান নেমে ধীরে ধীরে কথার সামনে এসে দাঁড়ায়।
কথা জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো। তোমার কি খবর?”
“জি আগের মতোই চলছে।”
সেজান ব্রিজের ওপর বসল। কথার একটু ভয় ভয় লাগছে। এই ব্রিজে গাড়ি চলাচল কম। অনেকেই বিকেল বেলায় এখানে ঘুরতে আসে। প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধুরা কিংবা পরিবার নিয়ে অনেকে ঘুরতে আসে। সেজান আশেপাশে দেখল। তারপর কথার দিকে চেয়ে বলল,
“মনটা খুব খারাপ। কাছের তেমন বন্ধু নেই যার সাথে মনের কথা শেয়ার করব৷ তোমাকে ডেকেছি বলে কি রাগ করেছো?”
“জি না। আমি তেমন ব্যস্ত মানুষ নই। তাই রাগ করার কোনো কারণ নেই। এ সময় আমি ফ্রি থাকি।”
সেজান ব্রিজ থেকে নেমে নিচের দিকে তাকাল। তারপর বলতে লাগল,
“আমি খুব একটা ভালো মানুষ নই। খুব একটা বলতে আমি একদমই ভালো মানুষ নই। এ নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। আদ্রিশ ভাই আমার সব। উনার জন্য আমি সব করতে পারি। জীবনটাও হাজির। উনি আমাকে রাস্তা থেকে তুলে আশ্রয় দিয়েছেন। খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছেন। বাড়ি,গাড়ি সব দিয়েছেন। আমি উনার কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ থাকব৷ ভাই আর ভাবীর জীবনে কি ঘটেছে জানোই তো। তারা দুজনেই ভেঙে পড়েছে। ভাই তো অপরাধবোধে মরে যাচ্ছেন। কাউকে কিছু বলছেন না তবে আমি বুঝতে পারছি তার বুকের ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কত কষ্ট পাচ্ছেন। ভাবীকে খুব ভালোবাসেন। আমি কখনো ভাবতে পারিনি ভাই কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারবে। ভাবীর সাথে তার দূরত্ব দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ভাই এই দূরত্ব মেনে নিতে পারছেন না। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ভাবীকেও এত কষ্টে দেখতে পারছেন না। তুমি একটু ভাবীর সাথে কথা বলবে? একটু বোঝাবে প্লিজ। ভাই তো ইচ্ছে করে কিছু করেন নি। এটা একটা দূর্ঘটনা। দূর্ঘটনায় কারো হাত থাকে না।”
কথা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আপুর অবস্থাটা আপনি আমি কেউ বুঝতে পারব না। কারণ আপু যে সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে সেই অনুভূতিটা তার থেকে আল্লাহ ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। বাবা-মার জন্য সন্তান কি তা জানি না কিন্তু সন্তানের জন্য বাবা-মা কি তা অনাথ হয়ে বুঝি। বাবা-মার জন্য যেখানে আমার এত আকুলতা সেখানে বাবা-মা সন্তানের জন্য কতটা আকুল হতে পারে, ছটফট করতে পারে সেটা কিঞ্চিৎ হলেও বুঝতে পারছি। আপু ট্রমার মধ্যে আছে। একটু সময় লাগবে। তবে আমি কথা বলব। আপুকে বুঝানোর চেষ্টা করব। কারণ আমিও চাই আপু এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক।”
“ওরা ভালো থাকুক। আবারও সন্তানের মুখ দেখুক। সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি মোচন হোক। সুখের একটা পরিবার হোক। এটাই চাই।”
“নিজের জন্য কিছু চাই না আপনার?”
সেজান কথার দিকে তাকাল। কথা কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছে। কথাকে নিরাশ করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সেজান তাই করল। মৃদু হেসে বলল,
“নিজের জন্য কি চাই সেটা অন্য আরেকদিন বলব। আজ নয়। আজ যাওয়া যাক।”
কথা মৃদু হেসে সম্মতি জানাল।
**
রুশা অনেকদিন পরে আজ ঘর থেকে বের হয়েছে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামল। বাড়িটা কেমন নীরব নিস্তব্ধ লাগছে। রুশা কিছুক্ষণ পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘরের দিকে যায়। রুশা উপরে যেতেই আদ্রিশের মুখোমুখি পড়ে। কেউ এই মূহুর্তের জন্য তৈরি ছিল না। রুশা ভাবতে পারেনি আদ্রিশ এই সময় বাড়িতে আছে। দুজনের চোখ আঁটকে গেছে একে অপরের চোখে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। আদ্রিশ রুশার চোখের গভীরতায় হারিয়ে যাচ্ছে। আর রুশা আদ্রিশের ওই ব্যথা ভরা চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। চোখ নামিয়ে নিল। দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চায় সে কিন্তু আদ্রিশ তা হতে দিল না। আঁটকে দিল ওর হাত ধরে।
রুশা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
“রুশা, প্লিজ। আমার কথা শুনো। একটু দয়া করো। আমার সাথে কেন এমন করছো? তুমি তো জানো বাচ্চাটা আমি চেয়েছিলাম। ওকে হারানোর ব্যথা আমারও আছে। আমিও কষ্ট পাচ্ছি। রোজ চোখের পানি ঝড়াচ্ছি। আমাকে আর শাস্তি দিও না।”
রুশা ঝারা মেরে হাত ছাড়িয়ে বলল,
“কতটুকু শাস্তি পেয়েছো তুমি? কতটুকু শাস্তি আমি দিয়েছি তোমাকে? তুমি যা করেছো তাতে তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত। এ তো সামান্য।”
“কি চাও তুমি? কি করলে শান্তি পাবে?”
রুশা হাতজোড় করে বলল,
“আমাকে নিজের মতো একা থাকতে দেও প্লিজ। এটুকু রহম করো আমার উপর।”
“আমি পারছি না। আমি তোমাকে এত কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না। তোমার বাচ্চা চাই তো? রুশা আমাদের আবারও বাচ্চা হবে। আমি তোমাকে আবারও বাচ্চা দেব। আর কোনো ভুল করব না আমি। প্লিজ! আমার উপর ভরসা রাখো।”
রুশা চমকে উঠে আদ্রিশের কথা শুনে। রাগ ফুটিয়ে ওর দিকে তাকায়।
“আজকে বাচ্চার কতদিন হতো জানো? তিন মাস আট দিন। প্রতিটি দিনের হিসাব রাখছি আমি। ভুলতে পারব না। ব্রেনে সেট হয়ে গেছে। তুমি কোন মুখে আবারও বাচ্চার কথা বলো? তোমাকে দেখে, তোমার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমার কাছে আসার একদম চেষ্টা করবে না। যদি চেষ্টা করো তবে আমি আত্মহত্যা করব। তুমি একটা খুনি। ঘৃণা করি তোমাকে। অসহ্য লাগে তোমাকে, তোমার প্রতিটি কথা। আমি আর কোনো বাচ্চার খুনি তোমাকে হতে দেব না।”
রুশার এই মুহুর্তে কাঁদা উচিত কিন্তু কান্না আসছে না। তখন মনে করল সেদিনের কথা যেদিন ওর আপনজনের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিল। চিৎকার করে কেঁদেছিল। ওর কান্নায় পুরো বাড়ি কেঁদেছিল। কেউ চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারেনি। পাগলামি করেছিল প্রচুর। সেদিনের কথা মনে পড়তেই রুশার চোখে পানি চলে এলো। বুকের ভেতরে মৃদু ব্যথা শুরু হয়েছে।
রুশা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল,
“তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা হয় সেদিনের উপর যেদিন আমি তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম।”
রুশা দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদতে লাগল। বিরবির করে বলছে,
“আমি ঘৃণা করি তোমাকে, ভালোবাসি না। একটুও ভালোবাসি না।”
আদ্রিশ স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। জীবনটা বিষাক্ত লাগে। এত বিষাদময় জীবন মেনে নিতে পারছে না। রুশার মুখে ঘৃণা করি শব্দটা শুনে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।
.
কিছুদিন পরের কথা। রুশা আশ্রমে যাচ্ছে কথার সাথে। আদ্রিশই কথাকে বলেছে ওকে যেন আশ্রমে নিয়ে যায় কিছুদিনের জন্য। ঘুরে আসবে মনটা ভালো লাগবে। আদ্রিশ ওর সিকিউরিটির সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করেছে। রুশা আশ্রমে গিয়ে বেশ ভালোই আছে। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাচ্ছে।
রুশা চার দিন ধরে আশ্রমে গিয়েছে। আদ্রিশ আজ ওকে আনতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে কল করে বলেছে যাতে ও রেডি থাকে। আদ্রিশের প্লান ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে। রাতে ডিনার করে বাসায় ফিরবে। তাই আদ্রিশ একাই এসেছে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। নিরিবিলি রাস্তা। রাস্তায় তেমন যানবাহন নেই। হঠাৎ করে ওর সামনে পেছনে
কয়েকটা গাড়ি ওর গাড়ি ঘিরে ধরে। তারপর অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে। আদ্রিশ সাথে রিভলবার আনেনি। অফিস থেকে সোজা এখানে চলে এসেছে। আদ্রিশ আকস্মিক আক্রমণে দিকশূন্য হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝতে পারছে না। গাড়ির গ্লাস ভেঙে ওর উপর পড়ছে। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় কাচ বিঁধে রক্ত ঝড়ছে। তবুও ড্রাইভ করছে। হঠাৎ করে জোরে গাড়ির ব্রেক কষলে একটা গাছের সাথে ওর গাড়ি বারি খায়। আদ্রিশের মাথায় আঘাত লাগে। ধীরে ধীরে ওর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা গোডাউনে ছিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করল। দুহাত, দু’পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সারা শরীর ব্যথা করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছে। আদ্রিশ ভালো করে চোখ মেলে আশেপাশে দেখল। ওকে নড়ে উঠতে দেখে রকি ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
অদ্ভুত হেসে বলল,
“হেই ডুড! আ’ম রকি। কি চিনতে পারলে না? আরে আমি হচ্ছি সেই হুডি পরা মানুষটার এসিস্ট্যান্ট।”
আদ্রিশ ছোটার চেষ্টা করছে। রাগে ফোঁসফোঁস করছে। হাত পা যথাসম্ভব নাড়িয়ে বলল,
“কে সেই হুডি পরা লোক? ওকে আমি এতদিন ধরে খুঁজছি। আজ ফাইনালি তার ডেরায়? আই হোপ মুখোমুখি দেখা হবে।”
“অবশ্যই হবে। একটু অপেক্ষা। আর হ্যা সে পুরুষ নয় নারী। একজন সাহসী, বুদ্ধিমান, লড়াকু নারী।”
আদ্রিশ ওর কথা শুনে চমকে উঠে। একটা মেয়ে এতদিন নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে? আদ্রিশ আর কিছু ভাবতে পারছে না।
রকি ওর সামনে দাঁড়িয়ে রুশাকে কল করল।
“হ্যালো পিউ, তোমার শিকার খাঁচায় বন্দী। তোমার সাথে দেখা করার জন্য ছটফট করছে। সে জানেও না আজ তার শেষ দিন। তোমার হাতে আর ওর মৃত্যু হবে।”
আদ্রিশ ওর দিকে চেয়ে গালাগাল করতে করতে বলল,
“একবার আমাকে ছেড়ে দেখ তোদের কি হাল করি। কোনো মেয়ের কাছে আদ্রিশ হার মানবে না। বড় বড় মাফিয়াকে মেরে পুঁতে দিয়েছি আর এ-তো এক নারী। ”
“শালা, এই নারীর কাছেই হেরে বসে আছিস। ও আসুক তোর এই বড় বড় কথা কোথায় থাকে দেখব।”
আদ্রিশ আর রকির এরকম কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রকি ওকে বেশ মারধর করে মনের রাগ, ক্ষোভ, ডিপ্রেশন মিটিয়ে নেয়। রুশা যাকে ও ভালোবাসে সে ওর সন্তানের মা হয়েছিল বিষয়টা ওকে অনেক কষ্ট দেয়। হাত-পা বাঁধা থাকায় মার খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না আদ্রিশের। আদ্রিশ ভাবতে থাকে কে হতে পারে এই পিউ। ওর শরীর হেলে পড়েছে। ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। নাক, ঠোঁটও ফেটে রক্ত ঝড়ছে। শরীর থেকেও সমান তালে রক্ত পড়ছে। অফিসের সাদা শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। আদ্রিশের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারছে না।
তখনই রকি জোরে জোরে বলল,
“পিউ, এসো পড়েছো তুমি? দেখো ওর কি হাল করেছি।”
আদ্রিশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রুশা( রুশা বলেই সম্বোধন করি) কয়েক হাত দূরে আদ্রিশের বরাবর এসে দাঁড়াল। আদ্রিশ আধো আধো চোখে রুশার দিকে তাকাল। ও চোখগুলো বন্ধ করে আবারও তাকাল। রুশার মুখ কেন দেখতে পাচ্ছে বুঝতে পারছে না। আবারও চোখ বন্ধ করে তাকাল কিন্তু না ও ভুল দেখছে না। এটা রুশাই। জিন্সের সাথে শর্ট টপ্স, গলায় স্কাপ প্যাচানো, চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা, পায়ে হাই হিল। চোখ মুখে আগুন। আদ্রিশের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। স্থির, খুব শান্ত দৃষ্টিতে রুশার দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষন আগে বাঁচার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তা দুমড়ে মুচড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই সুখের ছিল। রুশাকে হারানোর চেয়ে ওর হাতে মৃত্যুই বেশি মধুর।
শান রকির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আদ্রিশের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল।
রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“পিউ, আজকে আমাকে তুই সেরা উপহার দিয়েছিস। গত বছর এই দিনটায় আমরা সব হারিয়েছি আর আজ সব ফেরত পাব। ওয়েল ডান মাই ডেয়ার সিস্টার।”
আদ্রিশ শানকে চিনতে পেরেছে। ওকে আগে থেকেই চিনে। রুশা শানের বোন সেটাও ক্লিয়ার। এতদিন রুশা ওকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে গেছে ভেবে রাগে, ক্ষোভে নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
শান একটা রিভলবার রুশার দিকে ছুড়ে মারে। রুশা সেটা ক্যাচ ধরে।
“শুট হিম পিউ।”
রুশা আদ্রিশের দিকে একবার তাকাল। ও অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। তারপর রিভলবারের দিকে চেয়ে সব প্রস্তুতি নিল শুট করার। রিভলবার আদ্রিশের দিকে তাক করে আছে। হাত কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলে বড় করে একটা শ্বাস নিল। অস্থির অস্থির লাগছে। চোখ খুলে আদ্রিশকে একবার দেখল। ট্রিগারে ওর আঙুল। আরেকটু বাঁকা করলেই কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আদ্রিশের বুক ঝাঁঝরা করে দিতে
পারে।
চলবে….