শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-২১+২২

0
5606

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ২১

চরম বিরক্তি নিয়ে শেফার দিকে তাকিয়ে আছি । শেফা আমার সামনে মুখ ছোট করে দাড়িয়ে আছে ।চিন্তিত গলায় বললাম,

– “তুই এমন কি করে করতে পারিস ? আমাকে না জিগ্যেস করে তুই কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য আমার নাম দিয়ে দিলি ? হাউ ক্যান ইউ ডু দ্যাট ? ”

শেফা আমতা আমতা করে বলল,

– “স্কুল কলেজে সবসময় কালচারাল প্রোগ্রমে পার্টিসিপেট করতি । তুই ঢাকায় ছিলিনা তাই আমিই নাম দিয়েছি । তাতে কি এমন হয়েছে বলতো ! ”

– “শেফা স্কুল কলেজের ব্যাপার আলাদা । তখনকার আর এখনকার পরিস্থির মাঝে আসমান জমিন তফাত । তাছাড়া আমার গান গাওয়া থেকে মন উঠে গেছে । তুই তো সবটা জানিস ! ”

– “স্যরি ইয়ার ! বাট একটা ব্যাপার নিয়ে আর কত দিন নিজেকে এভাবে লুকিয়ে রাখবি ? দোষ ঐ লোকের ছিলো তোর না । আর কতদিন নিজেকে এভাবে সবকিছু থেকে দূরে রাখবি ? ”

– “যাই হোক আমি পারবো না । যতবার গান গাইতে যাই ঐ লোকের প্রত্যেকটা কথা আমার কানে বাজে উনার মিথ্যা স্বপ্ন চোখে ভাসে বারবার মনে করিয়ে দেয় আমি কত বড় বোকা ছিলাম ।আমি পারবো না গাইতে । এখনি আমার নাম তালিকা থেকে কাটবো । ”

শেফাকে আর কিছুবলার সুযোগ না দিয়ে নাম কাটাতে চলে যাই । সেখানে যেতেই আমার চোখ কপালে উঠে যায় । নিহা রিহার্সাল রুমে । আর সবাই অডিশন তার কাছেই দিচ্ছে । নিশ্চিত কোনো ঝামেলা করবে । আমার ভাবতে দেরী কিন্তু শয়তানের ডাক পড়তে দেরী না । নিহা আমাকে ডাকছে । ইচ্ছা না থাকার পরও যেতে হলো । এই মুহূর্তে কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চাইছিনা । আমি চুপাচাপ দাড়িয়ে আছি । নিহা তার হাতের পেপারস গুলো চেক করে ভেঙাত গলায় বলল,

– “ওহ বেহেনজি ? তুমি গান গাইবে ? গান পারো নাকি এখানে ছেলে দেখতে এসেছো ? ”

আমার ভয়ংকর রকম রাগ হচ্ছে । কিন্তু নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে খুব স্বাভাবিক গলায় বললাম ,

– “আমি আমার নাম কাটাতে এসেছি । তালিকা থেকে আমার নামটা কেটে দিন প্লিজ । ”

নিহা আমার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,

– “কেন ভয় পাচ্ছো বুঝি ? অবশ্য তোমারদের মত ছোট লোকদের কাছে তো একটা ট্যালেন্টই আছে নিজের শরীর প্রদর্শন করে ছেলে ফাসানো । যেমন করে অগ্নি কে ফাসিয়েছো । কি ভেবেছিলে মানুষ অন্ধ ? তাদের চোখে কিছু পরে না ? অগ্নির সাথে গাড়ি দিয়ে চলাচল করা ,এক সাথে ফাংশন এটেন্ড করা এসব কেউ দেখে না ? যাই বলো বেহেনজি মানতে হবে ছেলে ফাসানোর ভালো ট্যালেন্ট আছে । না হয় অগ্নির মত ছেলেকে কি করে পটাতে পারতে? ”

এতো সময় নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও এখন আর পারলাম না । মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বললাম ,

– “কেন আপনার কি আফসোস হচ্ছে ? আপনি পটাতে পারেননি বলে ।আপনার উপর মাঝে মাঝে খুব দয়া হয় এতো কিছু করেও আপনি অগ্নির মন জয় করতে পারেননি । আপনার দিকে তাকায় না পর্যন্ত । ছিঃ কি লজ্জা ! ”

– “ইউ ইডিয়েট ! ”

বলেই আমার উপর হাত তুলতে চাইলো । আমি হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে তার হাত মোচড় দিয়ে ধরে বলি ,

– “আপনার হাতটা একটু বেশি নড়ে । নিজের হাত ঠিক ভাবে রাখতে শিখেন । না হয় হাত ভেঙে দিতে আমি ভাববো না । ”

বলেই নিহার হাত ছেড়ে দিলাম । নিহা টেবিলের উপরে পরে । এমন সময়ই অগ্নি রিহার্সাল রুমে প্রবেশ করে । নিহার এই অবস্থা দেখে সবার দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বললেন ,

– “এখানে কি হচ্ছে ? ”

সবাই চুপ । অগ্নি আমার চিৎকার করে ধমক দিয়ে বললেন ,

– “আমি জিগ্যেস করেছি এখানে কি হয়েছে ? ”

নিহা ন্যাকা কান্না করতে করতে বলল ,

– “দেখ অগ্নি এই মেয়ে কি অসভ্য । সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করছে । আমাকে শুধু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে । ‘আউচ’ হাত খুব ব্যথা করছে । ”

আমি নিহার কথা শুনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায় । আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিহা বলল ,

– “আমি শুধু অডিশনের জন্য লাইনে দাঁড়াতে বলেছিলাম । তাই রেগে এসব করলো । সে নাকি রুলস মানবে না । আবার বলে ,আমি কে জানো ? আমি অগ্নির খুব কাছের ! আমার জন্য কোনো রুলস নেই । ”

অগ্নি আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে শান্ত স্বরে বললেন,

– “আজ কাল সিনিয়রদের সম্মান করা বোধহয় ভুলে গেছেন ? কখনো অপমান করছেন ,কখনো মারছেন !
ভার্সিটি তে এসে এসব শিক্ষা পাচ্ছেন ? ”

আমি কিছু বললাম না । আমি জানি উনি সকালের কথা গুলোকে ইঙ্গিত করছে । উনাকে অপমান করায় এখনো রেগে আছে ।
উনি আমার দিকে খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টি তে তাকিয়ে । আমি চুপ । আমি জানি আমি কিছু বললেও উনি এই মুহূর্তে শুনবে না । অগ্নি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ,

– “তুমি কালচারাল প্রোগ্রামে পার্টিসিপেট করবে না । ”

– “আমি পার্টিসিপেট করবো ”

– “আমি না বলেছি তো তুমি করবে না ”

আমি উনার কথায় উনার দিকে ছোট ছোট সন্দিহান চোখে তাকাই । উনি এতো কিছু রেখে আমার পার্টিসিপেট করার পিছনে কেন লেগেছে ? কি চায় উনি ? তা জানার জন্য আগুনে একটু ঘি ঢেলে দেই । বললাম,

– “কেন আমি করবো না অবশ্যই করবো । আপনার কোনো সমস্যা ? ”

উনি রেগে বললেন ,

– “হ্যা আমার সমস্যা আছে ।স্টেজে এতো গুলো মানুষ হা করে তাকিয়ে থাকবে সবার সামনে ড্যাং ড্যাং করে গান গাইবে তা হবে না ।তুমি গান গাইবে না মানে না । ”

– “আমি গান গাইবো একশো বার গাইবো । এতো ক্ষন ভেবেছিলাম গাইবো না কিন্তু এখন যেহেতু আপনার সমস্যা হচ্ছে তো আমি গান গাইবো ই গাইবো । ”

উনি রেগে বাঁকা হেসে বললেন ,

– “আমি অডিশন নিচ্ছি আমি সিলেক্ট না করলে তুমি কি করে পার্টিসিপেট করবে ! ”

আমি কৃত্রিম হেসে বললাম,

– “তাই বুঝি? আমি আদ্রিতা ম্যামের কাছে কমপ্লেইন করবো যে আপনি ইচ্ছে করে আমাকে সিলেক্ট করেননি । ”

উনি আর কোনো কথা বললেন না । রেগে নাক ফুলিয়ে চলে যায় । আর আমার অডিশন ও নেন না ।আমি জানতাম উনাকে মায়ের কথা বললে উনি আর কথা বাড়াবেন না। আমার ট্রিক কাজে লেগেছে । আমি এখন থেকে তাই করবো যা উনার অপছন্দ । ছেলেরা দেখবে বলে উনি আমাকে গান গাইতে না করছে তাই না ? আমি এখন তাই করবো । উনার কথায় আমি কেন চলবো ? কিসের এতো অধিকারবোধ ? যেই সম্পর্কই উনি মানে না সেই সম্পর্ক নিয়ে উনার এতো কেন মাথা ব্যথা ?

রিহার্সালের ঘটনার পর তিন চারদিন চলে যায় । আমার আর অগ্নি মাঝে এর পর আর কোনো কথা হয় না। একি বাড়িতে একি ছাদের নিচে দুজন অপরিচীতদের মত থাকি । না কোনো কথা না কোনো নৈকট্য । দুজনের মাঝে শুধুই পিনপতন নীরবতা কাজ করে ।আমি বরাবরের মতই অগ্নিকে ইগনোর করি । দুজনের খুব কম চোখাচোখি হয় ।
উনি ঘুম থেকে উঠার আগেই ভার্সিটি তে চলে যাই । আর ফিরার সময় রিহার্সাল শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি । রিহার্সালের সময় ও লুকিয়ে চলে আসি । কোনো ভাবেই এই লোকের মুখোমুখি আমি হতে চাই না ।

___________________________

আজ রিহার্সাল শেষ হতে অনেক দেরী হয়ে গেছে । শেফাও অপেক্ষা করতে না পেরে চলে গেছে । আমি ভার্সিটির গেটে আসতেই দেখি উৎস ভাইয়া দাড়িয়ে আছে । আমাকে দেখেই আমার দিকে এগিয়ে আসে । এক গাল হাসি নিয়ে । আমিও সৌজন্য মূলক হাসি দিলাম । উৎস ভাইয়া আমার সামনে এসে বললেন,

– “কেমন আছো হুর পরী ? ”

আমি মুচকি হেসে বললাম ,

– “আবার নতুন নাম ! ”

উনি নিচের দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বললেন ,

– “এখন তুমি মানুষটাই এমন যে তোমার প্রতি রুপ নতুন নতুন নামের সন্ধান দেয় । ”

আমি মুচকি হাসলাম । উৎস ভাইয়া আবার বললেন ,

– “বললে না ,কেমন আছো? ”

– “জি ভাইয়া ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন? ”

– “হুম ভালো। তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো । যদি তোমার সমস্যা না হয় তাহলে কোথাও বসি ! ”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হ্যা বোধক মাথা নাড়ালাম ।উনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট কিছু । উনার সাথে ভার্সিটির পাশে রেড রোজ ক্যাফে তে বসি ।উনি কফি অর্ডার করলেন । দুজনের মাঝে নীরবতা কাজ করছে । নীরবতা ভেঙে উৎস ভাইয়া বললেন,

– “হুর আমার জীবনে তোমার কতটা ইম্পরট্যান্টস তুমি হয়তো জানোনা । আমার জীবনের প্রথম প্রেম ছিলে তুমি আর হয়তো শেষও । ”

উৎস ভাইয়ার কথায় আমি কিছুটা নোড়ে বসি । সংকোচিত স্বরে বললাম ,

– “কিন্তু ভাইয়া এখন এসব কথা…..মানে আরকি …

আমাকে থামিয়ে উৎস ভাইয়া বললেন ,

– “আমি এখন এসব কেন বলছি তাই ভাবছো তো ? এসবের দরকার আছে হুর । আমি এখন যা বলবো তার জন্য এসব কথার প্রয়োজন আছে হুর । তোমার সবটা জানার অধিকার আছে । আমি তোমার এই অবস্থা মেনে নিতে পারছিনা ”

উৎস ভাইয়ার কথায় আমার মনে ভয় চেপে ধরে । উৎস ভাইয়া কি আমার আর অগ্নির ব্যাপারে সবটা জেনে গেছেন? যদি মামাকে জানিয়ে দেয় ? না না আমাকে যে করেই হোক সবটা সামলিয়ে নিতে হবে । উৎস ভাইয়াকে বুঝাতে হবে ।

চলবে…❤️

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ২২

উৎস ভাইয়ার কথা শুনে আমি এখনো থম মেরে বসে আছি । উনি কি বলতে চাইছে ? আমার ভাবনায় কড়া নেড়ে উৎস ভাইয়া বললেন,

– “হুর আমি এখন যেটা বলবো জানিনা তুমি কি ভাবে নিবে । পজিটিভলি নাকি নেগেটিভলি । কিন্তু সত্য তো সত্যই । আই লাভ ইউ হুর । ”

আমি উৎস ভাইয়ার কথা চমকিয়ে যাই কি বলছেন উনি ? উনি কি পাগল হয়ে গেছে নাকি ? আমি রেগে বললাম ,

– “ভাইয়া আপনি এসব কি বলছেন? আমি বিবাহিত । আপনি আমাকে এসব কি করে বলতে পারেন । আপনি …”

উৎস ভাইয়া আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে। মুচকি হেসে নিজেই বললেন,

– “আমি জানতাম তুমি এমন কিছু বলবে । কিন্তু সত্য এটাই হুর । কিন্তু আমাকে আমার কাল্পনিক সত্য নিয়ে থাকলে চলবে না। তেঁতো বাস্তবতা ও মেনে নিতে হবে যে তুমি বিবাহিত । আর অগ্নি তোমার স্বামী । তোমার উপর শুধুই অগ্নির অধিকার । ”

এতটুকু বলেই উৎস ভাইয়া এক তিক্ত শ্বাস ফেলে । তারপর আবার বললেন ,

– “আমি জানি কোথাও আমাকে নিয়ে তোমার আর অগ্নির মাঝে প্রব্লেম চলছে ।স্যরি টু সে ,ইয়াশা ভাবির হলুদের দিন অগ্নি আর তোমার মাঝে কথোপকথন আমি শুনেছি । অগ্নি তোমার উপর রেগে ছিলো আমার সাথে কথা বলেছো বলে । ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম তাই সেদিন হিয়া কে ফোন দেই কথায় কথায় তোমাদের কথা জিগ্যেস করি । জানতে পারি তোমার আর অগ্নির মাঝে ঝামেলা চলছে।আমার অনুমান এই ঝামেলা ইয়াশা ভাবীর হলুদের দিনের সূত্র ধরে। আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের মাঝে কোনো রকম ঝামেলা হোক । অগ্নি নিজের জায়গায় একদম ঠি ক আছে।কোনো পুরুষই তার স্ত্রী কে ঐ লোকের সাথে কথা বলা সয্য করবে না । যে কিনা কোনো একসময় তাকে ভালোবাসতো বা এখনো ভালোবাসে । অগ্নিও তাই করেছে । রিলেটিভ হওয়ার সুবাদে দুজনের মুখোমুখি হতে হবে । আমি আর তুমি মুখোমুখি হলে অগ্নির মনে ইনসিকিওর,সন্দেহ কাজ করবে । তোমাদের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরবে । যা আমি কোনো ভাবেই চাইনা ।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি বিয়ে করবো ! আমি বিবাহিত হলে অন্তত অগ্নির মনে এসব ইনসিকিওরনেস কাজ করবে না । আর পাত্রী অগ্নির কাজিন নিশিত । ”

আমি উৎস ভাইয়ার কথায় বেশ অবাক হচ্ছি । একটা ঠিক কতটা নিসসার্থক ভাবে ভালোবাসলে এমন ডিসিশন নিতে পারে ? কিন্তু তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি নিশিতের কথা শুনে। নিশিত পাত্রী কি করে হতে পারে ? আমি সংকোচিত মনে প্রশ্ন করলাম ,

– “ইয়ে ….. মানে ,ভাইয়া ! নিশিত কি করে পাত্রী ? ”

উৎস ভাইয়া মলিন হেসে উত্তরে বললেন,

– “নিশিতের সাথে একবছর আগে অনয়ের এংগেজমেন্টে পরিচয়। তার পর থেকে মাঝে মাঝে নিশিতের সাথে মেসেঞ্জারে টুকটাক কথা হয় । আস্তে আস্তে লক্ষ করি নিশিত আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে । তাই তার সাথে কথা বন্ধ করে দেই । এবার বিয়েতে প্রোপোজ করে । কোনো উত্তর দেইনি । সত্যি বলতে ফিরিয়ে দিতে পারিনি । নিশিতের চোখে সেই একই না পাবার যন্ত্রণা দেখেছি যা আমার মাঝে আছে । তাই সব ভেবে ডিসিশন নিয়েছি যে নিশিতকে ফিরিয়ে দিবোনা তাকে বিয়ে করবো । কেউ তো অন্তত ভালো থাকুক । কারো একপক্ষীয় প্রেম পূর্নতা পাক । ”

আমি মুচকি হেসে বলি,

– “নিশিত খুব ভালো মেয়ে।আপনাকে খুব ভালোবাসবে । আপনার কেয়ার করবে। যা আপনি সবসময় ডিজার্ভ করেন । দোয়া করি আপনারা খুব সুখি হোন । পুরাতন সব ভুলে নতুন জীবনের সূচনা করুন । ”

উৎস ভাইয়ার চোখ চকচক করছে জলে । বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে বললেন ,

– “নতুন জীবনের সূচনা ? আমি চাইনা পুরাতন সবকিছু ভুলে কোনো নতুন সূচনা করতে । ”

– “কিন্তু নিশিত আপনার কাছে অনেক আশা স্বপ্ন নিয়ে আসবে তাকে কেন অবহেলা করবেন? তার কি দোষ ? আমার ভুলের শাস্তি নিশিত কে দিবেন? ”

– “আমি কারো ভুলে শাস্তি কাউকে দিবো না । আর না তুমি কোনো ভুল করেছো !
যদি কেউ করে থাকে তাহলে তা আমি ।
আমার জীবনের সব হাসি আনন্দ তোমার চেহারায় আটকিয়ে । এই চেহারাটা আমি সারাজীবনের জন্য নিজের আঁখিদুটির মাঝে আটকিয়ে রেখেছি । যা করছি সব আমার হুরপরীর জন্য করছি । অন্তত দূর থেকে তোমার হাসি মাখা মুখখানি তো দেখতে পাবো । নাইবা হলে আমার ,তোমার হাসিটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি । আর রইলো নিশিতের কথা ? নিশিত আমার ভালোবাসা হোক আর না হোক । কিন্তু স্ত্রীর সম্মান আর মর্যাদা অবশ্যই পাবে।তুমি চিন্তা করোনা । নিশিত কে আমি ভালো রাখবো । ”

আমি উনার কথায় সহমত জানিয়ে বললাম ,

– “একটা মেয়ের স্ত্রীর মর্যাদা না পাওয়া কতটা যন্ত্রণা দায়ক তা কেবল একটা মেয়েই জানে । কিন্তু আমি জানি আপনি নিশিতের ঠিক খেয়াল রাখবেন । তাকে তার মর্যাদা দিবেন ।”

উৎস ভাইয়া দু হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে ।উনি কি কান্না করছে? বলে ছেলেরা কান্না করে না । খুব বেশি অসহায় না হয়ে পাড়লে তাদের চোখে জল আসেনা । দুজনের মধ্যে আবারো পিনপতন নীরবতা ।বেশ কিছুসময় পর উৎস ভাইয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন ,

– “আমার একটা কথা রাখবে ? ”

আমি চুপ করে আছি।কি বলবো ? বুঝে উঠতে পারছি না । উৎস ভাইয়া আবার বললেন ,

– “ভয় নেই তেমন কিছু চাইবো না যাতে তোমার দিতে আপত্তি হবে ।
একবারে জন্য তোমার হাতটা ধরতে পারি ? ”

আমি কিছু বললাম না । উৎস ভাইয়া ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে । বক্স থেকে ব্রেসলেট বের করে আমার হাতে পড়িয়ে দেয় । করুন গলায় বললেন ,

– “এটা তোমার জন্য কিনেছিলাম । ভেবেছিলাম যেদিন তুমি আমার হবে তোমাকে নিজ হাতে পড়িয়ে দিবো । কিন্তু তা তো আর হলো না । আর না কোনো দিন সম্ভব । কারণ তুমি অগ্নিকে খুব ভালোবাসো । অগ্নির প্রতি ভালোবাসা তোমার চোখে ভাসে । আর আমার কাছে তোমার খুশির থেকে বড় কিছু নেই । এই ব্রেসলেটটা সবসময় তোমার কাছে রাখবে কি ? এতে আমার এটা ভেবে শান্তি লাগবে যে তুমি আমার না হও আমার কোনো জিনিস তো তোমার কাছে আছে ! ”

উৎস ভাইয়ার কথা শেষ হতেই আমার চোখ যায় দরজার দিকে অগ্নি হাত মুঠো বদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে।শুধু রাগ না একে বলে ভয়ংকর রাগ । সব কিছু ধ্বংস করে দেওয়ার মত রাগ । আমি তাড়াতাড়ি করে উৎস ভাইয়ার থেকে হাত ছাড়িয়ে নেই। অগ্নি রাখে ফুসতে ফুসতে ক্যাফের থেকে বেরিয়ে যায় ।
উনার এ ভাবে চলে যাওয়াটা আমার জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা আমার ঠি ক জানা আছে ।

_____________________________

বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে আসে । আজ খুব দেরী হয়ে গেছে । এমনিতেই রিহার্সাল দেরী তে শেষ হয়েছে তারপর আবার উৎস ভাইয়ার সাথে দেখা । সর্বশেষ ঢাকার জ্যাম । মা আর হিয়া আপুকে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি ।
রুমে ডুকতেই দেখি পুরো রুম অন্ধকার। অগ্নি কি এখনো ফিরেনি ? কিন্তু রুমের এসি তো চলছে ।শীতের আবছা আবাস পড়েছে । এই ঠান্ডার মাঝে এসি ? রুমে লাইট জ্বালাতেই অগ্নিকে খালি গায়ে পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে থাকতে দেখি । শার্ট টা নিচে পড়ে আছে।আমি শার্টটা তুলে রাখি । অগ্নি আমার দিকে সরু দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে । আমি কাঁধের ব্যাগ ড্রেসিংটেবিলের উপরে রাখতেই অগ্নি গম্ভির স্বরে বললেন ,

– “রিহার্সালের পর কোথায় ছিলে ? ”

আমি শীতল স্বরে বলি ,

– “যেখানে উত্তরটা আপনার জানা আছে সেখানে প্রশ্ন করাটা বিলাসিতা । ”

আমি অগ্নির কথার উত্তর দিয়ে চুল হাত খোপা করতে লাগি হ্ঠাৎ অগ্নি পিছন থেকে আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরায় । আচমকা এমন হওয়ার চুল সব মুখের উপর এসে পরে । অগ্নি আমার হাত চেপে ধরে । চিৎকার করে বললেন ,

– “কি ভাবো নিজেকে ? আমি চুপ করে সবটা সয্য করছি বলে সবকিছু মেনে নিবো ? হুর আমার চুপ থাকাটা কে আমার দুর্বলতা ভেবে ভুল করো না । আমি এখনো সেই আগের অগ্নিই আছি ।
কেন ঐ উৎসের সাথে ক্যাফেতে দেখা করতে গিয়েছিলে ? বলো কেন ? ”

আমি কিছু বললাম না। অগ্নির ক্রুদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছি । এই চোখে রাগ ছাড়াও আরো অন্যকিছু আছে । কিন্তু তা কি ? জেলাসি? অভিমান নাকি ভয় ?
যাই থাকুক না কেন আমি এবার আর দুর্বল হবো না আর এই চোখের মায়ায় নিজেকে জড়াবো না । আমি অগ্নি থেকে টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেই । অগ্নি আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আমাকে আবার নিজের দু হাত দিয়ে নিজের বাহুতে আটকায় । আমি ছাড়াতে পারছিনা । অগ্নি নিজের এক হাতে আমার ব্রেসলেট পড়া হাত চেপে ধরে বললেন ,

– “এই ব্রেসলেট ঐ উৎস দিয়েছে তাই না ? এই হাতটাই চেপে ধরেছিলো না ? ”

এতোটুকু বলেই আমাকে ওয়াশরুমের দিকে টেনে নিয়ে যায়।উনার এমন কাজে আমি হতভম্ব হয়ে আছি । কি করতে চাইছে এই লোক ? আমাকে এভাবে টানছে কেন ?
বেসিনে পানি ছেড়ে উনি আমার হাত পানির নিচে রেখে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দিচ্ছিলেন । উনি হাত ধুতে ধুতে বললেন ,

– “এই হাত ঔ উৎস ধরেছিলো । আমি এই হাতে তার স্পর্শের কোনো চিহ্নই রাখবো না সব ধুঁয়ে ফেলবো । ”

আমি আমার হাত ছাড়াতে চাইলে উনি আরো শক্ত করে তা চেপে ধরে । আমি বারবার উনাকে আমার হাত ছাড়তে বলছি কিন্তু উনি আমার কোনো কথা কানেই নেয় না ।পাগলের মত বিহেভ করছে । বেশ কিছুক্ষণ পর আমাকে আবার টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসে। আমি নিজের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও উনার সাথে পেরে উঠতে পারছি না। আমি চিৎকার করে বললাম ,

– “আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আপনি এমন কেন করছেন ? ”

উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আমার চেয়ে দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে বললেন ,

– “হ্যা আমি পাগল হয়ে গেছি । তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছো । আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছো । তোমার ইগ্নোর আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।তোমার অন্যকারো কাছে যাওয়া আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে ।মানতে পারছিনা তোমাকে অন্যকারো সাথে । ”

উনি কিছুক্ষণ থেমে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছিলেন । আমার হাতের ব্রেসলেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটানে তা ছিড়ে নিচে ফেলে দেয় । আবার হাতে অনেকটা কেটে যায় আমি ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠি । কিন্তু অগ্নির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই । অগ্নি রেগে বললেন ,

– “অন্যকারো কোনো জিনিস তোমার কাছে থাকতে পারবে না । তোমার উপর কেবল আমার অধিকার ।
কেন গিয়েছিলে ঐ উৎসের সাথে দেখা করতে? বলো কেন ? ”

আমি এতো সময় চুপ করে নিজের হাত চেপে ধরে ছিলাম । অগ্নির উপর আমার রাগ আর হাতের ব্যথার যন্ত্রণা সবকিছু একত্রে মিশ্রিত হয়ে অগ্নিগিরির জ্বলন্ত লাভা রুপ ধারন করে । আমি উনার বুকে আমার দুহাতে সজোরে আঘাত করে দূরে সরিয়ে দেই । চিৎকার করে বললাম ,

– “কিসের অধিকার দেখান ? বলেন কিসের অধিকার? আমি আপনার কে হই ? বউ ? নাকি জাস্ট একবছরের রেস্ট্রি করা রক্ষিতা ?
আমার উপর আপনার কোনো প্রকার আধিকার নেই বিয়েটা শুধু একটা চুক্তি । একবছর পর চুক্তি শেষে আপনি আপনার রাস্তায় আর আমি আমার । আর শুনতে চেয়েছিলেন না আমি কেন উৎস ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ? তো শুনুন একবছর পর আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে নতুন কাউকে তো ধরতে হবে তাই না ? তাই আমি উৎস ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম । একবছর পর তার কাছে ফিরে যাবো তা বলতে । শুনেছেন উত্তর ? মনে শান্তি লেগেছে ? এর পর আমার থেকে কোনো কৈফিয়ত চাইবেন না। ভুলে যাবেন না আমি আপনার একবছরে রক্ষিতা । আর রক্ষিতাদের থেকে কৈফিয়ত চাইতে নেই ! ”

আমার কথা শেষ হতেই অগ্নি সজোরে আমার গালে চড় বসিয়ে দেয় । আমি অশ্রভরা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি । উনি কাবার্ড থেকে কন্ট্রাক্ট পেপারস বের করে তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। আমার কাছে এসে শক্ত করে আমার গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ,

– “নিজেকে আর একবার রক্ষিতা বলবি তো তোকে খুন করে ফেলবো । খুব শখ আমার থেকে মুক্তি পাবার তাই না? এই যে কন্ট্রাক্ট পেপারস পুড়িয়ে দিয়েছি । আমার থেকে মুক্তি পাওয়া আমার প্রাণ থাকতে সম্ভব না । শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত নিজের কাছে রাখবো ।আমার বউয়ের পরিচয় নিয়েই সারাজীবন থাকতে হবে । দুনিয়া এদিকওদিক হয়ে গেলেও আমি তোকে ছাড়ছিনা হুর । তুই আমার মানে আমারই । তোর উপর সব অধিকার শুধুই এই অগ্নির । ”

কথা শেষ করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে চলে যায় । আমি থম মেরে দাড়িয়ে আছি । শরীর মন দুটোই আজ বড্ড ক্লান্ত । আমি পারছিনা বারবার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে । উনি কেন এমন করে ? আমাকে তার বউ মানে না !
ভালোবাসে না ! তাহলে এসব কেন?
আমি মাটিতে ধপ করে বসে পরি । চোখ গুলো পোড়া কন্ট্রাক্ট পেপারসের দিকে । চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝোড়ছে । মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ আমি ক্লান্ত । পারছি না আর নিজের সাথে পেরে উঠতে ।
আজ অগ্নি ফিরলে তাকে শক্ত করে প্রশ্ন করবো সে কি চায় ? তাকে যে কোনো এক কূল বেছে নিতে হবে ।

চলবে ……❤️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন 😊😊😊।