শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-২৭+২৮

0
5190

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ২৭

অগ্নি অনেকটা সময় আমার গলায় মুখ লুকিয়ে আছে । আমি চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম ,

– “আমি বাড়িতে যাবো । ”

আমার কথায় অগ্নি মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালেন । আমি সাথে সাথে জানালার দিকে ফিরে তাকাই । অগ্নি আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ঠিক হয়ে বসে । আমার চুল গুলো কানের নিচে গুছিয়ে দিয়ে । সামনের দিকে ফিরে গাড়ি স্টার্ড দেয় । আমি তখনো বাহিরে তাকিয়ে । হঠাৎ আমার হাতের উপর অগ্নি হাত রাখে । শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় । আমিও আর ছাড়ানোর চেষ্টা করি না ।আর কেনই বা ছাড়ানোর চেষ্টা করবো ? এই স্পর্শের জন্য যে আমি উতলা । এই স্পর্শ ই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর স্পর্শ । জীবন যেহেতু নিজের থেকে যেচে সুযোগ দিচ্ছে আমি কেন হাত ছাড়া করবো ? আমার যে উনার স্পর্শের উনার ভালোবাসার লোভ পেয়েছে !
বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে রাত আড়াইটা । অগ্নি গাড়ির দরজা ধরে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকিয়ে দাড়িয়ে আছে । আমি ছোট কাঁদো কাঁদো দ্বিধান্বিত চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছি । মনে সংকোচবোধ কাজ করছে । এই ড্রেসে বাড়িতে ডুকবো ? যদি আবির ভাইয়া বা মা দেখে দেখে ফেলে ? কি ভাববে ?
মাথায় হাজার প্রশ্ন আলাপন করছে ।অগ্নি আগের মত ভ্রু কুঁচকিয়ে প্রশ্ন করলো ,

– “কি হলো নামবে না? ”

আমি আমতা আমতা করে বললাম,

– “আমাকে শেফার বাড়িতে দিয়ে আসেন প্লিজ । আমি কাল সকালে বাড়িতে ফিরবো । পাক্কা ! ”

উনি আমার কথায় চোয়াল শক্ত করে নেয় । নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন ,

– “তা কেন ? মেহেরবানি করে বলবেন কি? ”

আমি কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দেই ,

– “আমি এই ড্রেস পরে বাড়িতে যাবো না । যদি ভাইয়া আর মা দেখে ? আমাকে কি ভাববে? ”

অগ্নি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয়,

– “হুর এতো রাতে কেউ জেগে নেই । সবাই ঘুমে আছে । কেউ দেখবে না । ”

আমি কিছু একটা ভেবে ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে উত্তর দেই ,

– “যদি জেগে যায় । তো ?
না না বাবা আমি ভিতরে যাবোনা । একদম যাবো না । ”

আমি সামনের দিকে তাকিয়ে নখ কামড়াচ্ছি । আর ভেবে যাচ্ছি কি করে বাড়িতে ডুকা যায় । এমন সময়ই আচমকা অগ্নি আমাকে নিজের কোলে তুলে নেয় । আমাকে নিয়ে সামনের দিকে পা হাঁটতে হাঁটতে বললেন ,

– “এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ধের কি আছে ? বলেছি তো সবাই ঘুমাচ্ছে ।আজ এমন ড্রেস পড়েছো ঠিক আছে । এর পর যেন না দেখি । আর যদি এই ড্রেসে শুধু আমার সামনে আসো তাহলে ঠিক আছে। আমি তোমাকে সব ভাবে দেখতে পারি সেই রাইট আমার আছে ! ”

আমি উনার কথায় হা করে আছি । উনি সব ভাবে বলতে কি বুঝালেন ?
আমি এখনো বাকশক্তি হারিয়ে বসে আছি । কি বলবো ? উনার কথায় উত্তর দেওয়ার মত ভাষা আমার নেই । এমন এমন কথা বলে লজ্জায় ফেলে যে কিছু বলার মত থাকেই না !

___________________________

আমি ড্রেস চেঞ্জ করে সোফায় বিছানা পেতে শুতে যাবো এমন সময়ই অগ্নি আমার হাত টেনে নিজের দিকে ঘুরায় । আমি পিছনে ফিরে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তে উনার দিকে তাকাই । উনি গম্ভির গলায় বললেন,

– “যাও বিছানায় ঘুমাও । ”

আমি উনার থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম ,

– “আমি এখনেই ঠিক আছি ”

উনি আমার দিকে রাগী দৃষ্টি তে কিছুক্ষণ তাকিয়ে টেবিলের উপর থেকে পানির জগটা নিয়ে সব পানি সোফার উপর ঢেলে দেয় ।মুখে বাঁকা হাসি টেনে বললেন ,

– “এবার ঘুমাও ”

বলেই বিছানায় হেলান দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে । আমি ছোট ছোট চোখ করে সবটা দেখছি । উনার এমন কান্ডে প্রচন্ড রাগ হলো । আমি উনার দিকে প্রচন্ড রেগে তেড়ে যাই । চিৎকার করে বলি,

– “আপনি এটা কি করলেন ? এই নিশি রাতে আপনি কি শুরু করেছেন ?
আমাকে নিয়ে যদি আপনার এতই সমস্যা থাকে । তাহলে কেন আনতে গিয়েছেন ? আমি তো বেশ ভালোই ছিলাম ।
আমি এখন কোথায় ঘুমাবো ? ফ্লোরে ? ”

উনি আমার হাত টান দেয় । আমি উনার বুকের উপর পড়ি । উনি আমার দিকে আদুরে চোখে তাকাচ্ছে । আর আমি উনার দিকে ভস্ম করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি । এই মুহূর্তে উনার চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে । আমি উনার বুকের উপর থেকে উঠতে গেলে উনি আমার কমোড়ে এক হাত রাখে । অন্যহাতে আলতো করে আমার কানের নিচে চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– “আমি কি একবার ও বলেছি আমার তোমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা ! আর ফ্লোরে ঘুমাবে কেন ? আমি তো চাই তুমি আমার সাথে বেডে ঘুমাও । কিন্তু তুমিই তো জিদ ধরে আছো । তাই তো এমনটা করতে হলো ! ”

আমি ঝাঁঝালো গলায় বললাম ,

– “আপনি একটা ইতর ! একটা খাটাশ ! নিজের কথা মানানোর জন্য আপনি সব ধরনের ইতরামি করতে পারেন ।জঘন্য লোক একটা ”

উনি শয়তানির হাসি দিয়ে আমার থুতনি তে হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ,

– “তোমার সব নামের সাথে এই নামটাগুলো ও গ্রহণ করলাম । তোমার আইডিয়া নেই আমি তোমার জন্য কতটা ইতর ,খাটাশ আর জঘন্য হতে পারি !
চুপ চাপ এখানে শুয়ে পড়ো না হয় আমি আমার ঔসব অবতার নিবো । তা কি ভালো হবে সুন্দরি ? তুমিই বলো? ”

আমি আর কোনো উত্তর দিলাম না । এই লোক সব পারবে । সব । আমার রাগে কান্না আসছে । প্রচুর কান্না আসছে । এই লোক এভাবে আমাকে জ্বালায় কেন ?
কেন ? ভাল্লাগেনা একদম ভাল্লাগেনা । আমি অগ্নির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দু পা বিছানায় তুলে পুরো কম্বল নিজের শরীরে জড়িয়ে নেই। একটুখানি ফাঁক ও অবশিষ্ট রাখিনা । কম্বলের ভিতর থেকে চিৎকার করে বলি ,

– “আমি থাকবো না এই বাড়িতে । একদম থাকবো না । কালই মামার কাছে চলে যাবো । ”

কিছুক্ষণ অগ্নির ঝাঁজালো আওয়াজ পেলাম ,

– “যাওয়ার জন্য পা তো বাড়াও ! পা ভেঙে বিছানায় বসিয়ে দিবো । ”

আমি কোনো কথা বললাম না চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ঘুমানোর অপ্রাণ চেষ্টা চালালাম । কিছুসময়ের মাঝেই আমি সফল হলাম ।

ঘুমের মাঝে আঁচ করতে পারলাম কেউ আমার খুব কাছে । কখনো কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে আবার কখনো গাল । কারো বরফ শীতল হাত আমার গলা ছুঁইছে । আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে কি ? মারলে মারুর তাতে কি ? জীবনে তো এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই যার জন্য আমাকে বাঁচতে হবে । কিন্তু এই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকালে । নিশ্চিত মাথা ব্যথায় পাগল হয়ে যাবো । তাই এই মুহূর্তে চোখ বন্ধ থাকাই শ্রেয় ।
আবাশ পেলাম কেউ আমার গলায় ঠান্ডা কিছু পড়িয়ে দিচ্ছে । কিন্তু তা কি ! চোখ মেলে দেখবো কি একবার ? না থাক এই মুহূর্তে ঘুম ভাঙলে বড্ড লস হয়ে যাবে । আমি পাশ ফিরে অন্যদিকে ঘুরে ঘুমালাম ।

_________________________

সকালে রৌদ্রের মিষ্টি আলো আমার মুখের উপর পড়ছে । খুব বিরক্ত লাগছে । আমি পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যাবার চেষ্টা করি । কিন্তু আমার প্রচেষ্টা বেশিদূর আগায় না । এর পরই কানে খটখট আওয়াজ আসে । আমি চরম বিরক্তির সাথে কম্বলের ভিতর থেকে মুখ বের করে চোখ কচলাতে কচলাতে সামনে তাকাই । অগ্নি আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে । মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে মনে হচ্ছে । একদম ঝকঝকে চকচকে স্নিগ্ধ লাগছে ।
আমি হাই তুলে উঠে বসি । অগ্নি আয়নায় আমাকে দেখে আমার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললেন ,

– “শুভ সকাল সুন্দরী ! ”

উনার হাসিতে আমার চোখ ঝলঝল করে উঠে খুশিতে । সকাল সকাল এতো সুন্দর মর্নিং উইশ ! আর না মন ভালো হবে ? হায় ! এই লোক এতো সুন্দর কেন ? হোয়াই ???
কিছু মনে পড়তেই নিজের মুখের ভাবভঙ্গী গম্ভির করে ফেললাম ।মনের অনুভূতি গুলো মনের ভিতরেই সিন্ধুক বন্ধী করলাম । গম্ভির কন্ঠে বললাম ,

– “গুড মর্নিং ”

– “ঘুম হয়েছে ?”

আমি ভেংচি কেটে বললাম ,

– “না তো এখনো ঘুমিয়ে আছি ”

অগ্নি আমার কথায় কোনো তেক্কার করে না । সামনে মুচকি হেসে সামনে তাকায় । আমি চুল গুলো হাত খোপা করতে করতে সামনে আয়নার দিকে তাকাতেই বড়সড় একটা ঝটকা খাই । আমার গলায় চেইন আর তার মাঝে পেন্ডেন । এটা কোনো সামান্য পেন্ডেন না । চিটাগাং এ আমার পছন্দ করা সেই পেন্ডেন । এটা কি করে আসলো ? অগ্নি দিয়েছে কি ? তবে কি অগ্নি সেদিন আমার পছন্দ লক্ষ করেছিলো ! আমি সাথে অগ্নির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি ,

– “এটা আপনি দিয়েছেন ! তাই না? ”

অগ্নি আমার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললেন ,

– “না তো । একদম না ! ”

– “তাহলে আমার গলায় কি করে আসলো ? ”

– “কি জানি ? হয়তো কোনো রাক্ষসরাজ বা কোনো দৈত্য দিয়েছে । আজ কাল তো তোমার আবার ভূত প্রেতের সাথে ভালো সম্পর্ক । তাদেরই কেউ গিফট করেছে । ”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় । আমি উনার যাওয়ার দিকে কুশন ছুড়ে মারি । বদ ,অসভ্য লোক একটা । উনি দিয়েছে তা স্বীকার করলে কি হয় ? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় ?
এতো ভালো মুডটাই নষ্ট করে দিলো !
এসব বিরবির করে বলে মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখি । অগ্নি কুশন হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আমার দিকে ঝুঁকে চোখ টিপে শয়তানী হাসি দিয়ে বললেন ,

– “কুশন ছুড়ে মারলে তো ব্যথা পাবো না সুন্দরী !
হ্যা ,যদি এখানে কামড়ে দেও ঠিক ব্যথা পাবো । ”

কথাটা উনি উনার ওষ্ঠের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন । আমি উনার কথায় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি । কতবড় অসভ্য লোক । লাজলজ্জা সব বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে কি ? এখনো হা করে আছি !

চলবে…❤️❤️❤️

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ২৮

লাইব্রেরী তে বসে আছি সামনে শেফা রেগে বসে । শেফার কটকট অগ্নি দৃষ্টি স্পষ্ট বলছে ।যে কোনো মুহূর্তে সে আমাকে খুন করে ফালতে পারে । আমি সবটা বুঝেও না বুঝার ভান করে আছি । শেফা টেবিলে বারি দিয়ে বললেন ,

– “মানে তুই নিজেকে কি ভাবিস ? বলতো ? ”

আমি আমতাআমতা উত্তর দেই ,

– “কি আর ভাববো ,আর পাঁচটা মানুষের মত সাধারণ মানুষ । ”

– “তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস? বুঝতে পারছিস না আমি কি বুঝাতে চাইছি ?”

আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম ,

– “না তো ! একদম বুঝতে পারছি না । ”

শেফার চওড়া উত্তর ,

– “হুর !! ডোন্ট ট্রায় টু বি স্মার্ট ,তোকে স্যুট করে না !
আমি তোকে হারে হারে চিনি । তুই এমন কি করে করতে পারিস ? আমি কি তোর কিছু হই না ? অগ্নি ভইয়া তোর বর । তুই এই কথা আমার থেকে লুকালি কি করে? ”

আমি বইয়ের দিকে মুখ দিয়ে বলি,

– “এতে বলার মত কি আছে ? উনি আমাকে চুক্তির বিয়ে করেছে । যার মেয়াদ একবছর । মেয়াদ শেষ হলে সম্পর্ক শেষ । আর তাছাড়া আমাদের মাঝে আর আট দশটা স্বাভাবিক হাসবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্ক নেই । অগ্নি এখনো তার প্রথম ভালোবাসা কে ভালোবাসে । ”

শেফা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,

– “কাল রাতে তুই কি উনার অবস্থা দেখিস নি ? তোকে সামান্য কয়েক ঘন্টা না দেখে কেমন পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলো । উনার চোখে ভয় কি তুই দেখিস নি ? এর পরও কি তোর মনে হয় যে অগ্নি ভাইয়া তোকে ভালোবাসে না ? ”

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলি ,

– “ঐটা উনার ভালোবাসা না উনার মৌহ ছিলো ।অগ্নি আমার মৌহ তে পরেছে প্রেমেতে নয় ।
প্রিয়জন আর প্রয়োজনের মাঝে অনেক তফাৎ । আমি উনার শুধুই প্রয়োজন ,প্রিয়জন নই । উনার মনের ঘরে এখনো উনার প্রথম ভালোবাসা বসত করে । ”

শেফা কিছু বলতে নিলে আমি থামিয়ে দেই । শেফাও আর কথা বাড়ায় না ।

শেফা আর আমি খুব মন দিয়ে সামনে এক্সামের প্রস্তুতি নিচ্ছি । শেফা ফিন্যান্সে বেশ অভিজ্ঞ । তার থেকে কয়েকটা অঙ্ক বুঝে নিচ্ছি । এমন সময়ই কেউ বিচ্ছিরি ভাবে আমার চুল টানে । পিছনে তাকিয়ে দেখি রবিন দাড়িয়ে । মুখে খুব বাজে হাসি । এবার উনি ফাইনাল ইয়ারে । আমাকে খুব বিরক্ত করে । বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ভাষা ইউজ করে । ভার্সিটি তে ভর্তি হবার পর থেকে উনার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি । এমনটা শুধু আমার না আরো অনেক মেয়েদের সাথেই করে ।
উনার কথায় কোনো উত্তর দেই না । নিজের সব রাগ চেপে ধরে মাতা নিচের দিকে দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগি । রবিন আমার কোনো জবাব না পেয়ে । আমার সামনা সামনি বসে । আমি তখনো নিরব । হুট করে আমার সামনের থেকে আমার বই টেনে নিয়ে নিচে ফেলে দেয় । আমি এবার রেগে উত্তর দেই ,

– “কি চাই আপনার ? এমন অসভ্যতামী করছেন কেন ? ”

উনি আমার কথায় বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলে ,

– “রাগলে যা লাগে না ! একদম আইটেম বোম । মনে হচ্ছে এখনি ফেটে যাবে । ”

কথাগুলো বাজে দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে । মুখে ভাবভঙ্গিমা দেখে পুরো গাঁ ঘিনঘিন করে উঠে । উনার বাজে নজর আমার পুরো শরীরের দিকে ঘুরঘুর করছে । আমি উড়না নিয়ে নিজের শরীর ভালো ভাবে ঢেকে নেই । চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ঘিনঘিন গলায় বলি,

– “ছিঃ কি চাহনি ।মেয়েদের সামান্যতম হলেও সম্মান দিতে শিখুন । বাড়িতে কি মা বোন নেই ? ”

– “আমি বললেই মা বোনের কথা তাই না ? আর অগ্নির সাথে যখনতখন রাতবেরাতে ঘুরে বেড়াস ? তখন ? তখন কোথায় যায় তোর এই আদর্শ? এক রাতের রেট কত ? কত দেয় অগ্নি তোকে? দেখছি তো আজকাল অগ্নিকে খুব ভালো সার্ভিস দিচ্ছিস!
তো মান্থলি প্রেমেন্ট করে ? নাকি এভরি ডে ? ”

অগ্নির সাথে উনার পূর্ব শত্রুতা আছে । অগ্নির বিরোধী দল । রবিনের কথায় আমার শরীরের লোমলোম জ্বলে যাচ্ছে । মাথা থেকে রাগে আগুন বের হচ্ছে । আমি উনার কাছে যেয়ে নিজের শরীরের সব জোড় দিয়ে ঠাস করে এক থাপ্পড় মারি । এক থাপ্পড়ে আমার রাগ ক্ষান্ত হচ্ছে না ।এখনো রাগে ফুসফাস করছি । চিৎকার করে বলি,

– “ছোট বেলা যদি তোর মা তোকে এভাবে থাপ্পড়টা দিতো না?
তাহলে আজ এসব অসভ্যতা করতি না । তোর পারিবারিক শিক্ষার অভাব । ”

রবিন রাগে ফুসতে লাগে । আমার কথা শেষ করে আমি যেতে নেই । এমন সময়ই পিছন থেকে আমার উড়না টেনে নেয় রবিন । আমি লজ্জায় নিজের দুহাতে শরীর ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । রবিন বিচ্ছিরি ভাবে ইঙ্গিত করে বলে ,

– “তোদের মত মেয়েদের চেনা আছে । গোপনে টাকার জন্য সব ছেলেদের কাছেই যাস আর প্রকাশ্য সবার সামনে ন্যাকামি করিস ।শুধু কি অগ্নি কে মজা দিলেই হবে ? মাঝেমধ্যে আমাদের কাছেও আসিস । টাকা দিয়ে লালে লাল করে দিবো । ”

আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি । শরীর বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে গেছে । শেফা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগে । পুরো লাইব্রেরীর এতো গুলো মানুষের সামনে রবিন আমার উড়না টেনে নিয়েছে অথচ সবাই চুপ । কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করছে না । সবাই দর্শক হয়ে সবটা দেখছে । কেই কোনো রকম প্রতিবাদ জানাচ্ছে না ।
সমাজের এমন চিত্র দেখে মনে হচ্ছে কেন নারী হয়ে জন্ম নিয়েছি ? নারী হয়ে জন্মানোই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপ । এই সমাজে নারীর কোনো মূল্য নেই । নারী তাদের কাছে খেলার বস্তু । মাংসের ধলা মাত্র ।
রবিন আমার উড়না নিজের গলায় পেঁচিয়ে নেয় । সবার সামনে আমাকে শাসিয়ে নিজের চ্যালাদের নিয়ে চলে যায় । আমি মাথা নিচু করে কান্না করছি । জীবনে কোনো দিন আমি এতোটা অসহায়ত্ব বোধ করিনি । এতোটা অপমান বোধ করিনি । আমার বুক চিড়ে কান্না আসছে । এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে ।
শেফা আমাকে চেয়ারে বসায় । তাড়াতাড়ি করে নিজের ব্যাগ থেকে স্কার্ফ বের করে আমার শরীরে জড়িয়ে দেয় । আমার আশে পাশের কোনো কিছুর কোনো খেয়াল নেই । আমি একাধারে কান্না করে যাচ্ছি ।
মাথা নিচু করে নিজের চোখে পানি জড়াচ্ছি । শেফা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করতে করতে বাহিরে চলে যায় ।

কিছুসময় পর অগ্নি কোথা থেকে যেন ছুটে আসে । কিছুক্ষণ আমাকে দেখে থমকিয়ে যায় । এরপর আস্তে আস্তে একপা একপা করে এসে আমার সামনে ফ্লোরে হাটু গেরে বসে । অগ্নি তখনো বড়বড় শ্বাস নিচ্ছিলো । মনে হচ্ছে পুরোটা পথ ছুটে এসেছে । আমি একবারের জন্য অগ্নির দিকে তাকাচ্ছি না । মাথা নিচু করে আছি । কিন্তু অগ্নি গভীর করে আমার দিকে তাকিয়ে । অগ্নির চোখে মুখে অস্থিরতা । চেহারাই বলেছে আমার এই অবস্থা অগ্নিকে কতটা দিশেহারা করে দিয়েছে ।অগ্নি আমার হাতে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ,

– “হুর কি হয়েছে ? কে কি করেছে আমাকে বলো !
কি হয়েছে তোমার এমন অবস্থা কেন? ”

আমি কোনো জবাব দিলাম না । মাথা নিচু করে পাথর হয়ে বসে নিজের চোখের জল ফেলছি । অগ্নি আমার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে । আবার জিগ্যেস করেন ,

– “হুর আমার ভয় হচ্ছে ! কি হয়েছে বলো । হুররররররর! ”

শেষের ডাকটা চিৎকার করে বললেন । আমি ঠাস করে সবার সামনে উনার গালে এক চড় দেই । এরপর অন্যগালে আর একটা । অগ্নি চুপ ! থম লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি অগ্নির পাঞ্জাবীর দুই সাইডের কলার ধরে নিজের কাছে টেনে আনি ।আমার ভিতরের সব কষ্ট যন্ত্রনা রাগ ক্ষোভ সব চোখের জলের রুপ নেয় । আমার বুকের ভিতরের হাহারার গুলো ভয়ংকর রুপ ধারণ করে । আমি চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলি,

– “করে দিয়েছেন আমার জীবন নরক । এবার খুশি ? ধন্যবাদ আমাকে রাস্তার পতিতা বানানোর জন্য । সবার সামনে আমাকে ছোট করার জন্য । আমার মান সম্মান আত্মমর্যাদা সব কিছু ধোলায় মিশিয়ে দিয়েছেন । আমার বেঁচে থাকার সব কারণ শেষ করে দিয়েছেন । আজ যা যা হয়েছে সব আপনার জন্য । সবার কাছে আমি আপনার রেষ্ট্রি রক্ষিতা । তাই তো আমার একরাতের রেট জিগ্যেস করছে !
সবার সামনে আমার গাঁয়ের উড়না টেনে নিয়ে গেছে ।
আপনি আমাকে শেষ করে দিয়েছেন অগ্নি । আমাকে জীবন্ত লাশ করে দিয়েছেন । আপনি খুব সুন্দর প্রতিশোধ নিয়েছেন আমার থেকে । আমাকে নিস্ব করে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন । ”

আমি মাটিতে অগ্নির পায়ের সামনে বসে চিৎকার করে কান্না করতে লাগি । অগ্নি আমার কথা শুনে থরথর করে কাঁপছে । চোখ লাল বর্ন ধারন করেছে । কপালের রগগুলো ফুলে আছে । হাত শক্ত করে মুঠি বদ্ধ করে নেয় । চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্য বললেন,

– “এ করেছে এসব ? ”

সবাই চুপ । অগ্নি কোনো উত্তর না পেয়ে সজোরে টেবিলে লাথি দেয় । টেবিল দূরে ছিটকে পড়ে । অগ্নি দ্বিগুণ রেগে চিৎকারে বলেন ,

– “কি তামাশা হচ্ছে ? আমি তামাশা করছি ? কেউ কথা বলছে না কেন ? আমি জিগ্যেস করেছি কে করেছে এসব ? ”

অগ্নি প্রত্যেকটা প্রচন্ড রেগে বলছে । অগ্নির ধমকে দেয়াল গুলোও কেঁপে উঠছে । কেউ কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছে না । ভয়ে থর থর করে কাঁপছে । শেফা ভয়ে ভয়ে সামনে এসে অগ্নিকে সব বলে অগ্নি সব শুনে আরো বেশ রেগে যায় । আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগে । আমি চাইলেও ছাড়াতে পারবোনা । ছাড়ানোর চেষ্টা ও করছি না ।মুখে কিছু না বললেও অগ্নির এই ভয়ংকর লাল চোখ আমাকে ঠিক শাসিয়ে দিচ্ছে।অগ্নিকে আমি এর আগেও অনেক বার রেগে যেতে দেখেছি । কিন্তু এতোটা ভয়ংকর রূপ এই প্রথম দেখলাম ।আজ অগ্নির মাথায় খুন উঠে আছে ।
যেতে যেতে কাউকে ফোন করে কিছু আনতে বলে । ফোনে কথা বলার সময় উনার শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছিলো । প্রত্যেকটা কথায় ভয়ংকর রাগী গর্জন ছিলো ।

ভার্সিটির আমগাছ তলায় রবিন আর তার চ্যালারা আড্ডা দিচ্ছিলো । অগ্নি রবিনের গলায় আমার পেঁচানো উড়নাটা নিজের হাতে পেঁচিয়ে রবিনকে টেনে নিচে ফেলে । মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারে । হাতের মোটা রড দিয়ে এলোমেলো ভাবে রবিনকে মারতে লাগে ।প্রত্যেকটা মার জয়েন্টে জয়েন্টে দিচ্ছে ।অগ্নির এই রাগের সামনে কেউ এক পা ও ভয়ে বাড়াচ্ছে না । রবিন আশেপাশে সাহায্য চাইছে কিন্তু কেউ আসছে না । রবিন ছুটে পালাতে চাইলে অগ্নি পিছন থেকে ছুটে ছুটে মারতে লাগে । কেউ অগ্নিকে থামাতে পারছে না ।যে যাচ্ছে সবাইকে ঝাড়ি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে । এই মুহূর্তে অগ্নির ক্রোধের কেউ সম্মখীন হতে চাইছেনা ।
রবিন রক্তাক্ত শরীর নিয়েই পালাতে চাইছে কিন্তু অগ্নি সেই সুযোগ দিচ্ছে না । এক সময় রড ফেলে দিয়ে লাথি দিতে দিতে বলে ,

– “বাই**** তোর এতো কারেন্ট ? তোর সব কারেন্ট আজ বের করবো । এমন অবস্থা করবো নিজেকে পুরুষ বলে দাবী করতে পারবি না ।
কুত্তা** ,শুয়া** জানোয়ার,তোর সাহস কি করে হয় হুরের শরীরে হাত দেওয়া ! ওর উড়না টেনে আনার ? বা**** এত বড় কলিজা আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস !
তোর বুক চিড়ে কলিজা বের করে খাবো । ”

আবার এলোপাথাড়ি লাথি দিতে লাগলো । মাঠের আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা সবাই ভয়ে চুপসে আছে ।অগ্নির বন্ধুরা কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না । অগ্নি রবিনকে মারতে মারতে আমার পায়ের সামনে ফেলে ।
রেগে চিৎকার করে বললেন,

– “পা ধরে ক্ষমা চা । ”

রবিন রক্তাক্ত কাঁপা কাঁপা হাত বাড়াতেই অগ্নির আমার ধমক ,

– “কুইক !!! ”

রবিন আমার পা ছুঁতেই অগ্নি আবার রবিনকে টেনে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ,

– “থাপ্পড় দেও !”

আমি চুপ করে দাড়িয়ে আছি । অগ্নি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,

– “আমি বলেছি থাপ্পড় দিতে । ”

আমি সজোরে রবিনকে কয়েক্টা থাপ্পড় দিলাম । অগ্নি রবিন কে ছেড়ে দেয় । রবিন মাটিতে লুটে পরে । অগ্নি আমার হাত টেনে নিজের কাছে দাড় করিয়ে চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্যে বললেন ,

– “হুর ,আতেফ খাঁন অগ্নির স্ত্রী । ওর দিকে কেউ বাজে নজরে তাকালে চোখ উঠিয়ে ফেলবো । এমন অবস্থা করবো লাশও কেউ চিনতে পারবে না । ”

রবিনের হাতে পাড়া দিয়ে বলল,

– “বাস্টার্ড ! এরপর হুরের দিকে চোখ তুলে তাকালে এমন অবস্থা করবো যে তোর বাড়ির লোক তোকে দাফন করার জন্য খুঁজে পাবে না । ”

ভার্সিটির সবাই এখনো থম মেরে দাড়িয়ে আছে ।
আমার শরীরে ভালো করে স্কার্ফ জড়িয়ে নিজের সাথে করে নিয়ে যায় । আমি অগ্নির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ।

চলবে….❤️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন 😊😊😊 ।