শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-২৯+৩০

0
4604

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ২৯

আজকের এই মারামারির ঘটনা পুরো ভার্সিটি তে ছড়িয়ে গেছে । এখন পুরো ভার্সিটি জানে হামিয়া হুর আতেফ খাঁন অগ্নির স্ত্রী ।
আমার মনে শুধু একটা প্রশ্ন জাগছে । অগ্নি এমন টা কেন করলো ? কেন অগ্নির নামের সাথে আমার নামটাও জড়িয়ে নিলো ? বাসায় এসে সারাদিন নিজেকে ঘর বন্ধী করে রাখি । খাওয়া দাওয়া ঘুম সব ত্যাগ করেছি । বারবার রবিনের সেই নোংরা কথা গুলো মাথায় ঘুরঘুর করছে । চোখ বন্ধ করতেই ,উড়না টেনে নেওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে । লজ্জা অপমানবোধ গলা চেপে ধরছে । যা শ্বাস নেওয়া দুষ্কর করে দিচ্ছে । চোখ দিয়ে অনবরত চোখের পানি ঝড়ে যাচ্ছে । এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে জালিল হওয়ার অপমানবোধ আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।ভিতর থেকে বারবার বলছে ,’হুর তুই অপবিত্র ! রবিনের নোংরা দৃষ্টি , স্পর্শ তোকে অপবিত্র করে দিয়েছে । ‘
এসব মনে করতেই বুক চিড়ে হু হু করে কান্না চলে আসে ।
ভার্সিটি থেকে এসেছি সেই দুপুরে । এখন সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত । আমার কোনো হুশ জ্ঞান নেই। অগ্নি আমাকে বাসায় রুম পর্যন্ত পৌছিয়ে। কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পরে । এখনো ফিরেনি । পুরোটা সময় রেগে আগুন ছিলো ।
রাত পর্যন্ত কয়েকবার আপু আর মা এসেছিলেন ।ডেকে গেছে ।কিন্তু আমি কোনো প্রকার উত্তর দেইনি !
আজ কোনো কিছুই ভালো লাগছে না । সবকিছু বিষাক্ত লাগছে ।

কেউ রুমের দরজা খুলে । ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আলোর লম্বা দাগ পরে। আমি রুমের এক কোনায় হাত পা ঘুচিয়ে কান্না করছি ।কেউ একজন আমার সামনে এসে বসে । আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি ছিটকে দূরে সরে যাই । কিন্তু সামনের মানুষটা আমাকে জোর করে নিজের বুকে টেনে নেয় ।এ বুক আমার অচেনা নয় । খুব পরিচীত । হ্যা আমি অগ্নির বুকে আছি ।
অগ্নি নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন ,
– “হুসসসস ,একদম কান্না করবেনা । এভাবে কান্না করছো কেন ? কিছু হয়নি । আমি আছি তো ! ”

আমি বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে করতে উত্তর দেই ,

– “আমি অপবিত্র হয়ে গেছি অগ্নি ! রবিনের স্পর্শ আমাকে অপবিত্র করে দিয়েছে । ”

– “উহু হুর একদম না ,কারো অপবিত্র স্পর্শ আমার হুরকে অপবিত্র করতে পারবেনা । ”

আমি ভাবলিশহীন চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলি,

– “আমি তো অপবিত্রই অগ্নি । সবার সামনে আমার উড়না টেনে খুলেছে আমাকে অপমান করেছে । পতিতা বলেছে । এর চেয়ে অপমানের আর কি হতে পারে ?
এর চেয়ে তো আমার মৃত্যু ভালো ছিল ।
আজ যা যা হয়েছে সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী ! ”

অগ্নি বিষ্ময়কর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ,

– “এতে আমার কি দোষ? আমি কি করেছি? ”

– “সব আপনারই দোষ ! আপনি সব করেছেন । আজ আমার সাথে যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী । আপনি এসব কিছু করেছেন ।ডিরেক্টলি হোক বা ইনডিরেক্টলি আমার সাথে আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্য আপনি দায়ী । কেবল মাত্র আপনার জন্যই আমার জীবন আজ এমন ছেলেখেলা হয়ে গেছে ।সব কিছু এমন উলট পালট করে দিয়েছে । আমাকে শেষ করে দিয়েছেন । আমার মান সম্মান মন সব নষ্ট করে দিয়েছেন । আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো আপনাকে ভালোবাসা । আপনাকে বিয়ে করা । আপনার কথা শুনিনি বলে আমার থেকে এভাবে প্রতিশোধ নিলেন ? আমার জীবন শেষ করে দিলেন? আ…আমার …..”

আর বলতে পারলাম না ভিতরে সব ভেঙে কান্না আসছে । আমিও আর নিজেকে আটকালাম না । আমি চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম । আমি ফ্লোরে পড়ে চিৎকার করে কান্না করছি । এতো দিনের সব চাপা কষ্ট যন্ত্রণা সব বুক ফাটা চিৎকারের বেরিয়ে আসে । আমি ফ্লোরে গড়িয়ে কান্না করছি । অগ্নি আমার দিকে পাথর চোখে তাকিয়ে আছে । অগ্নি চোখ থেকে পানি ঝড়ছে । আমার সব যন্ত্রণা যেন উনি অনুভব করছে । আমার প্রত্যেকটা কষ্টে অগ্নির চোখে জল । এই অনুভূতি কিসের জন্য ? আমার জন্য ?

অগ্নি এক পা আমার দিকে এগিয়ে আসে ,আমাকে সামলানোর জন্য । কিন্তু আজ আমার অগ্নিকে খুব অসয্য লাগছে । একদম বিষের ন্যায় বিষাক্ত । আমি মাটিতে শুয়েই চিৎকার করে বলি,

– “আমাকে একদম স্পর্শ করবেন না । একদম না । আপনার স্পর্শ আমার কাছে বিষের মত লাগে । মনে হয় কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে ।
আমার আপনার এই হুটহাট দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই । ইদানীং আপনার এই হুটহাট দয়া খুব অসয্য লাগে খুব অসয্য । যতবার আপনি আমার কাছে আসেন ততবারই বিষাক্ত অনুভূতি জেগে উঠে । ”

অগ্নি আমার কাছে এসে আমাকে মাটি থেকে তুলে নিজের কোলে টেনে বসায় । অগ্নি থেকে ছাড়া পাবার জন্য আমি আমার সর্বস্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয় না । অগ্নি পিছন থেকে আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে শব্দহীন ভাবে নিজের চোখের জল ঝরাচ্ছে । অগ্নির ঘনঘন গরম নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়ছে । পিঠ ভিজে যাচ্ছে । অগ্নি কোনো কথা বলছে না একাধারে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে ।
আমি চিৎকার করে বলি ,

– “ছাড়ুন আমাকে ! ”

অগ্নি আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে মাথা নাড়িয়ে “না বোধক “উত্তর দিলেন । আমি ক্রুদ্ধ গলায় বলি ,

– “আমাকে ছাড়ুন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । অসয্য লাগছে খুব । ”

উনি ভেজালো গলায় উত্তর দেয় ,

– “না আমি ছাড়বো না । তোমাকে আমার প্রতিটা নিশ্বাসে প্রয়োজন । খুব করে প্রয়োজন । ”

– “হুম আমি তো শুধু আপনার প্রয়োজন হয়েই রয়ে গেলাম । কখনো প্রিয়জন হয়েছি ? না কখনো হবো ! ”

অগ্নি পিছনে আগের মত মুখ ডুবিয়ে বিষ্মিত গলায় উত্তর দিলেন ,

– “তুমি কি আমার চোখের ভাষা বুঝো না হুর ? তোমার কি মনে হয় তুমি আমার শুধুই প্রয়োজন ? প্রিয়জন নয় কি ?
যদি তাই না হতে তাহলে আমি কেন সবার সামনে তোমাকে নিজের বলে দাবী করেছি ? কেন পুরো ভার্সিটির সামনে বলেছি তুমি আমার স্ত্রী ? ”

– “এগুলো বলে আপনি কি আমার উপর খুব দয়া করেছেন ?
আপনি কি ভাবছেন এসব বলে আপনি খুব মহৎ কোনো কাজ করেছেন ? আমি বলেছিলাম আপনাকে এসব বলতে ? ”

– “হুর তুমি এভাবে কথা পেঁচাচ্ছো কেন ? নেগেটিভলি নিচ্ছ কেন ? আমি মটেও এসব মিনিং করিনি । আমি জাস্ট বলেছি আমার নিজের কাজের জন্য গিল্টি ফিল হচ্ছিলো আমি এমন টা আরো আগে করলে কেউ তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতো না ।”

– “আমি কথা পেঁচাচ্ছি ? আমি? আপনি
ডাবল মিনিং কথা বলছেন । এতেও আমার দোষ ?
আর আপনি যুক্তিবাদী লোক । আমি শুধু আপনার যুক্তিতে আপনাকে বুঝাচ্ছি ।
আর আপনার গিল্টি ফিল করার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি সারাজীবন আপনার জীবনে থাকবো না । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে চলে যাবো । অনেক দূর । ”

আমার কথায় হয়তো অগ্নি রেগে গেছে । বড় বড় রাগী শ্বাস ফেলছে । আমার হুট করে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে । আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে । ঝাঁঝালো গলায় বললো ,

– “এই মেয়ে কি চাও তুমি ? কি চাও?
আমি শান্ত ভাবে বোঝাচ্ছি কথা কানে যাচ্ছে না ? তুমি কি ভেবেছো তুমি যেতে চাইলেই আমি নাচতে নাচতে তোমাকে যেতে দিবো ? হুম ?
না একদম না । তুমি আমার বিয়ে করা বউ তোমার উপর আমার অধিকার আছে । আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই অধিকার থাকবে ।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন আমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । তুমি পূর্নরূপে আমার স্ত্রী । ”

– “ওও বুঝতে পেরেছি । আপনি আমার উপর দয়া করছেন তাই না ?
সেই রাতে আমার কাছে আসায় আপনার গিল্টি ফিল হচ্ছে । তাই তো ?
আমার চাইনা আপনার দয়া । ছোট থেকে এই পর্যন্ত সবার দয়ায় বড় হয়েছি আমি আর কোনো রকম দয়া চাই না । সেই রাত আমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেছি । আপনি মুছে ফেলুন । ”

অগ্নি আমার বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন ,

– “স্মৃতি থেকে সেই রাত মুছে ফেলেছো মানে ? কি মুছেছো ? পেরেছো মুছতে? আমি তো পারবো না ! কোনো দিন মুছতে চাই । চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে সেই রাত ভেসে উঠে । তোমার করা পাগলামোর কথা মনে পড়লে এখনো পুরো শরীরে শিহরণ জাগে। তোমার সেই এলোমেলো চুল ,মাতাল চাহনির কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা ধুকধুক করে । তোমার সেই উষ্ণ নিশ্বাস আমি এখনো অনুভব করি।সেই অনুভূতির কথা মনে করে এখনো গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠে ।
আর বলছো সেই রাত ভুলে যেতে ? আমি তো ভুলতে চাই না । সেই রাত আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর রাত । যা সারাজীবনের জন্য মনে দাগ কেটে গেছে । তুমি পারবে কি সেই রাত ভুল তে ? ”

আমি অগ্নির কথায় কোনো জবাব দিলাম না । চুপ করে থাকলাম । কি জবাব দিবো । সেই রাত তো আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না । সেই রাত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত । যতই অগ্নির সাথে রেগে বলি আমি সেই রাত ভুলে গেছি ।কিন্তু সত্যি তো এটাই যে আমি পারবো না ভুলতে অগ্নির সেই স্পর্শ ,সেই আদুরে চোখের চাহনি । ভয়ংকর আদর । অগ্নির প্রত্যেকটা স্পর্শ আমার আত্মার সাথে মিশে গেছে । আমি চাইলেও কোন দিন তা ভুলতে পারবো না ।

অগ্নির কোনো প্রশ্নের আমার কাছে কোনো উত্তর নেই । আর কিছুক্ষন উনার সাথে থাকলে আমি আবার অগ্নির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বো ।কোনো সাড়াশব্দ না করে আমি সামনের দিকে পা বাড়াই । দু কদম পা বাড়াতেই পিছন থেকে অগ্নি আমার হাত টেনে ধরে । আমি পিছন দিকে ফিরে দেখি অগ্নি হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে । আমি গম্ভির কন্ঠে বললাম,

– “অগ্নি আমার হাতটা ছাড়ুন ,আমার বিষণ অসয্য লাগছে । ”

অগ্নি মাথা নিচু করেই শীতল গলায় বললেন ,

– “লাভ ইউ সুন্দরী ! আই লাভ ইউ!! ”

উনার কথাটা কানের মাঝে সজোরে বারি খায় । কানের পর্দা এখনো থমথম করে বাজছে । অগ্নি ভুল বলছে ? নাকি আমি ভুল শুনছি ? যা বলছে তা কি আদৌ সম্ভব ?
আমার পুরো শরীরে শীতল হাওয়া বইছে । আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । বড় বড় চোখ করে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছি । অগ্নি আমার দিকে মাথা তুলে তাকায় । চোখ গুলো টলটল করছে। এই চোখে মিথ্যার কোনো ছাড়া নেই । সত্যতা ছলছল করে প্রকাশ পাচ্ছে । কিন্তু এই সত্যকে গ্রহণ করার মত সাহস শক্তি আমার মাঝে নেই । মনে একরাশ অভিমান ইগো ভড় করে ।সেদিন উনার করা সেই খারাপ ব্যবহার মনে পড়ে যায় । সেদিন অগ্নি আমাকে অস্বীকার করেছিলো ।নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো । আজ অগ্নির কাছে আসাটা মন থেকে স্বীকার করতে পারছি না ।
আমি অগ্নি থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলি ,

– “আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন । আপনার এসব কথা আমাকে ম্যান্টলি টর্চার করছে।আমি আপনার কাছাকাছি থাকলে আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব আরো বাড়বে ।রিফ্রেশমেন্টের জন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন । আমি কিছুদিনের জন্য আপনার থেকে মুক্তি চাই ।পুরোপুরিভাবে ! ”

উনি আমার জবাবে থম মেরে আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে । হয়তো আমার থেকে এমন কিছু আশা করেনি ।উনার চোখে তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে । আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেই । এই চোখের মায়ায় আমি পড়তে চাইনা । এই মুহূর্তে তো একদমই না !

আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি । গভীর রাত । চারদিকে নিস্তব্ধতা । কোনো শব্দের আনাগোনা নেই । আকাশে বৃত্তের ন্যায় বিরাট চাঁদ । চাঁদকে ঘিরে মিটমিট তারা জ্বলছে । চাঁদের চাঁদনীতে পুরো শহর আলোকিত । আমি আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । মনে আজ গভীর করে বিষন্নতায় ডেকে আছে ।
বার বার মনে একই প্রশ্ন জাগছে । অগ্নি আমার প্রস্তাবে রাজি হবে কি ? যেতে দিবে তার থেকে দূরে ?
হ্ঠাৎ ই কারো পায়ের শব্দ কানে আসে । নিশ্চিত অগ্নি ! অগ্নি ছাড়া অন্যকেউ হতেই পারে না ।
আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি অগ্নি দাড়িয়ে । হাতে খাবারের প্লেট । চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে । কান্না করেছে কি ? কিন্তু কেন ?
অগ্নি আমার হাত টেনে বারান্দার চেয়ারে বসায় । আর অগ্নি আমার সামনা সামনি বসে আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে । আমি চোখ নামিয়ে ফেলি । অগ্নি মুখের সামনে খাবার ধরতেই আমি আমতা আমতা করে বলি,

– “আমি খাবোনা । খিদে নেই ! ”

– “সারাদিন কিছু মুখে দেওনি । জিদ না করে খেয়ে নেও । ”

আমি মুখ ঘুরিয়ে নেই।অগ্নি বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন ,

– “বাড়িতে যেতে চাও না ? ”

আমি মাথা হ্যা বোধক নাড়াই । অগ্নি সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন ,

– “তাহলে আমার সব কথা মানতে হবে ! আমি যা বলবো তা করতে হবে । ”

– “কি করতে হবে ? ”

আমি ছোট মুখ করে প্রশ্ন করি । অগ্নি আমার মুখের সামনে খাবার তুলে উত্তর দেয় ,

– “আপাদতো খাবারটা শেষ করো । ”

আমি বাঁকা চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে তুলি । খাবার চাবাতে চাবাতে বলি ,

– “আমাকে সত্যি সত্যি যেতে দিবেন ? ”

অগ্নি মাথা নিচু করে মলিন গলায় উত্তর দেয় ,

– “অন্যায় যেহেতু আমি করেছি মুষল তো আমাকেই দিতে হবে । ”

আমি অগ্নির উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছি । এই চোখে তীব্রতর কষ্ট যন্ত্রণা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।

চলবে…..❤️

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ৩০

চাঁদের চাঁদনী বড় কাচের দেয়াল ভেদ করে পুরো ঘর আলোকিত করছে । আমি বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি । চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই । চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে রেখেছি । সোজাসুজি ভাবে বললে ঘুমের ভাণ করে আছি । অগ্নি আমার পাশেই বসে । মূলত অগ্নি পাশে আছে বলেই এমনটা করা । আমি চোখ বন্ধ রেখেই বলতে পারছি অগ্নি আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে ।
নাকে সিগারেটের তীক্ষ্ণ গন্ধ আসছে । আমি পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখি অগ্নি পাশের চেয়ারে বসে আছে । পা জোড়া সেন্টার টেবিলের উপর উঠানো । হাতের সিগারেটটা জলজল করে জ্বলছে । চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে । আর দৃষ্টিটাও আমার দিকে । সবটা বুঝতে আমার খুব একটা কষ্ট হলো না । কারন চাঁদের উজ্জ্বল আলো আমাদের দুজনকেই ঘিরে আছে । অগ্নির মাতাল চাহনিটাও আমার চোখ এড়ায় না ।এই চোখে কি আছে ? রাগ? নেশা ? প্রেম? না তীক্ষ্ণত্ব কোনো চাওয়া ?
আমি সেদিকে আর তাকালাম না আমার চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে নেই । গাঁয়ের কম্বলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরি । বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় । আচমকা টের পাই অগ্নি আমার দিকে এগিয়ে আসছে । ভয়ে আমি বালিশের কোনা খামচে ধরি । কপালটাও সামান্য কুঁচকে যায়। আচ্ছা অগ্নি আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? আমাকে মারবে কি ?
যদি অগ্নি সজ্ঞানে অগ্নি কখনো এমনটা করবে না । কিন্তু এখনতো নেশারঝোঁকে আছে । যদি এমন কিছু করে দেয় এমনি তেই আমার উপর যা রেগে আছে ।
মনে ভয় খচখচ করছে । মনে মনে নিজের মনকে বুঝ দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছি ।
হ্ঠাৎ ই অগ্নির বরফ শীতল হাত আমার গালে স্পর্শ পাই । আমার দু গালে অগ্নির দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আঁকিঝুঁকি করছে । প্রত্যেকটা স্পর্শ খুব আদুরে । হঠাৎই অগ্নি কপালে খুব আলতো চুমু খেলেন । আমি কেঁপে উঠি । আমার পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে । এই কনকনে শীতের মাঝেও গাল গরম হয়ে গেছে । কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।হার্ট খুব স্পীডে চলাচল করছে । উনার স্পর্শ গুলো এমন কেন? তড়িদগতি সম্পন্ন !
অগ্নি আমার ঘাড়ে চুলের মাঝেই নিজের মুখ ডুবায় । আমি তখনো চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছি । উনার শরীর থেকে তীব্র মদের গন্ধ আসছে ।মদের গন্ধ আমার খুব অসহ্য লাগে । আমি কোনো রকম নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখছি ।অগ্নি আমার ঘাড়ে বেশ কয়েকবার নিজের শীতল খশখশ করা ঠোঁটের স্পর্শ দেয় । আমি আমার কাঁপাকাঁপা হাত পা নিয়ে কোনো রকম চোখ বন্ধ করে আছি । অগ্নি আমার কানের লতিতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়িয়ে আলতো স্বরে বলে ,

– “আমি জানি তুমি এখনো জেগে সুন্দরী ! নিজেকে এভাবে কষ্ট না দিয়ে চোখ খুলো । ”

আমি উনার কথায় সাথে সাথে চোখ খুলে আড়চোখে অগ্নির দিকে তাকাই । অগ্নি তখনো আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে আছে । আমি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলি ,

– “আমার কাছে কেন এসেছেন । ”

অগ্নির মাতাল স্বর ,

– “অনেকক্ষণ তো চেষ্টা করলাম তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখার। কিন্তু পারলাম কই ? তুমিই তো কাছে টেনে আনলে ! ”

– “আমি কি করে কাছে টেনে আনলাম ? আমি কি আপনাকে ডেকেছি ? না আপনার হাত টেনে এনেছি ? ”

উনি হাল্কা শব্দ করে হেসে উত্তরে বললেন,

– “ডাকার জন্য কি এই দুটো উপায় ই ? আর অন্য কোনো উপায় নেই ? ”

আমি হ্যবলার মত অগ্নির কথায় থম মেরে আছি । অগ্নি আমার ঘাড় থেকে মুখ তুলে আমার দিকে ঝুঁকে ভারী গলায় উত্তর দেয় ,

– “ডাকার জন্য আরো কত উপায় আছে ! এই যে তুমি এলোমেলো চুলে বাঁকিয়ে আমার সামনে এমন আবেদনময়ী ভঙিতে শুয়ে আছো । মুখের উপর চাঁদের নুর পড়ছে । তোমার চাঁদেরকণা মুখটায় এক মোহনীয় মায়ায় ভরে আছে ।
তা কি আমাকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয় ? আমার বুকে আগুন জ্বালানো ,কন্ট্রোলেস করার জন্য যথেষ্ট নয় কি ? ”

আমি অগ্নির থেকে চোখ সড়িয়ে নেই । অন্যদিকে তাকিয়ে বলি,

– “আপনি এখন সজ্ঞানে নেই । নেশার ঘোরে আছেন । ”

অগ্নি আমার মুখ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে অস্থির কন্ঠে বললেন ,

– “একদম ঠিক বলেছো । আমি সত্যি নিজের মধ্যে নেই । আমি নেশায় পড়েছি! কিন্তু তা মদের না তোমার নেশায় পড়েছি । বুকে ঝড় উঠেছে । ভয়ংকর ঝড় । এই ঝড় শুধু তুমিই থামাতে পারো ! ”

আমি অগ্নির দিকে ভীতু দৃষ্টি তে তাকাই । কি বলতে চাইছে অগ্নি ?
অগ্নি হয়তো আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব বুঝতে পেরেছে । এক টুকরো হেসে বললেন,

– “ভয় নেই সুন্দরী আমি এমন কিছু চাইবো না যা আমাদের দূরত্বের কারন হবে !
কিন্তু যা চাইবো তা আমাকে দিতেই হবে । তুমি দিতে বাধ্য !
আমার আজ রাতের জন্য তোমাকে চাই । ”

অগ্নির কথায় আমি বড়বড় চোখ করে তাকাই । অগ্নি বললেন ,

– “এই না না তুমি যা ভাবছো তা নয় । আমি আজ সারারাত তোমাকে নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখতে চাই মন জুড়িয়ে তোমাকে দেখতে চাই । কাল বাড়ি যাবে জানিনা আবার তুমি কবে ফিরবে । কবে আবার এতোটা কাছ থেকে তোমাকে দেখবো !
তাই আজ সারারাত তোমাকে দেখে পাড় করতে চাই ।”

আমি অগ্নির চোখে এই মুহূর্তে পাগলামো দেখছি । এই অগ্নি অন্য এক অগ্নি । এক অগোছালো অস্থির অগ্নি । যার চোখে তীব্র চাওয়া আকাঙ্ক্ষা !
আমি অগ্নির চোখের মায়া এড়াতে পারিনা । অগ্নিকে কিছুটা জায়গা খালি করে দিয়ে পাশেই শুয়ে পড়ি । অগ্নিও দেরী না করে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে । আমাকে টেনে বুকে নিয়ে নেয় । অগ্নির মুখে এই মুহূর্তে বিশ্বজয়ের হাসি !

____________________________

সকালে ঘুম ভাঙতেই অগ্নি কে পাশে দেখতে পাই না । নিচেও নেই ।
আপু আজ বাড়িতে যাচ্ছে ।প্রেগন্যান্সিতে মন একদম বাচ্চাদের মত হয়ে যায় । মায়ের কাছে থাকতে ভালো লাগে ।তাই আপু কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যাচ্ছে । আমিও ঝোপ বুঝে কোপ মারি। আপুর সাথে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলি । মা ও নিষেধ করেন না । আর অগ্নিও সকাল থেকে লাপাত্তা । আমি সকালের নাস্তা শেষে রুমে এসে প্যাকিং করছি । এমন সময়ই অগ্নির আগমন ঘটে ।কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে আর প্যাকিং করা ব্যাগের দিকে রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে । পাশে থাকা ফুলদানি টা মাটিতে আছাড় মেরে ওয়াশরুমে চলে যায় । আমি অগ্নির কান্ডে হা করব তাকিয়ে আছি । এমন হুটহাট রেগে যাওয়ার কারণ আমার মাথায় খেলছেনা।আমি তো কাল রাতেই বলেছিলাম আমি আজ বাড়িতে যাবো । তাহলে এমন রিয়েক্টের কারণ কি ? আর রেগে গেলে কি ঘরের জিনিস ভাঙা আবশ্যক ? এই লোকের এই একটা জিনিস আমার প্রচন্ড বিরক্ত হই । রেগে গেলে হয়তো নিজের ক্ষতি করবে ,না হয় ঘরের জিনিস ভাংচুর করবে !
আমি উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ছাড়ি । আমি যখন রেডি হচ্ছিলাম অগ্নি পুরোটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন । কোনো সাড়াশব্দ ছাড়া । চোখ দুটো রক্তলাল ছিলো ।আমার সাথে টু শব্দ পর্যন্ত করে না । ভাইয়া অগ্নিকে আমাদের মামা বাড়ীতে পৌছিয়ে দেওয়ার কথা বললে । অগ্নি রেগে উত্তর দেয় । উনি আমাদের দিয়ে আসতে পারবে না । উনার সময় নেই । বলেই রাগে ফুসতে ফুসতে উপরে চলে যায় । উনার ব্যবহারে আপু আর ভাইয়া বেশ অবাক হয় । ভাইয়া আমাদের বাড়িতে পৌছিয়ে দেয় ।
বাড়ি তে সবার সাথে দেখা করি ।
মামা মামি আমাদের দেখে খুব খুশি হয়ে যায় ।সবাই একসাথে দুপুরে লাঞ্চ করি ।
লাঞ্চ শেষ করে দুপুরের পর বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেই। এতো দিন পর নিজের নিজের ঘর নিজের বিছানায় শুয়ে বেশ শান্তি লাগছে । কেমন যেন মুক্ত মুক্ত লাগছে । কিছুক্ষনের মাঝেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই । মাগরিবের আযানে ঘুম ভাঙে । নামায পড়ে কফির মগটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠে ।ফোনের সাথে সাথে মনের ঘন্টিটা ও বেজে উঠে । অগ্নি ফোন করেছে কি ? উৎসাহ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নেই । ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি শেফার নাম ভাসছে । মনটা ছোট হয়ে যায় । শেফার সাথে কথা বলে জানতে পারি । রবিনকে ভার্সিটি থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে । আর অগ্নিকে এক সাপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড । খোলা চোখে অগ্নি যদিও কোনো দোষ করে নি । কিন্তু মারামারি আর ভার্সিটির রুলস ব্রেক করার কারনে এমনটা করেছেন । যদি অগ্নিকে কিছু না বলা হয় তাহলে অন্যান্য স্টুডেন্ট তা খারাপ নজরে নিবে । আর তাছাড়া অগ্নি ভার্সিটির রাজনীতিতে জড়িত যদি এমনটা না করে তবে সবাই ভাববে ক্ষমতার জোরে এসব করেছেন ।পরবর্তীতে ভার্সিটি তে বাজে পরিবেশ সৃষ্টি করবেন । অগ্নি নিজের থেকেই মাথা পেতে পানিশমেন্ট নিয়েছেন ।
সেদিন অগ্নি আর ফোন দেয় না । সারারাত কেটে যায় কোনো খোঁজ নেয় না ।

_________________________________

আজ দুদিন হয়ে গেছে । অগ্নির কোনো খোঁজ নেয় নি । এই দুদিনে রাগ অভিমান আরো মাথায় চড়ে বসেছে । এই তার ভালোবাসা ? এই ?
দুদিনে না ফোন করেছে ,না কোনো খোঁজ নিয়েছে !
অসভ্য লোক একটা । কাছে থাকলেই যত ভালোবাসা কেয়ার হ্যান ত্যান !
এই দুদিনে মা কম হলেও শতবার ফোন করেছে । আর শেফা তো সারাদিনই ফোনের উপর ফোন কি করছি ? খেয়েছি নাকি এটা ওটা জিগ্যেস করছে । যেন আমার প্রেমিক বা স্বামী । শেফার এমন হুটহাট টাকা খরচ করে ফোন দেওয়া আর সারাদিন কথা বলা । আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে ! মেয়েটার কি হলো ? মেয়েটার জেন্ডার- টেন্ডার চেঞ্জ করেছে কি ?
ইয়াক ! যাতা ভেবে যাচ্ছি । আই হেইট মাই মাইন্ড ।
কাল আইসক্রিম খেয়ে গলা বসে গিয়েছিলো । মামা মামী আপু কত খেয়াল রেখেছে । শেফা আর মা তো কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে খবর নিয়েছে ।
সবাই আমার কতো খেয়াল রাখে । আর এক উনি যার আমার থাকা না থাকায় কোনো কিছু আসে যায়না । মনে একরাশ অভিমান বুকে জমাট বাঁধে !
সকাল দশটার দিকে শেফা ফোন দেয় ।বিকালে বের হতে চাইছে । বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে । আজ বিকালে ছেলের সাথে দেখা করবে । আমি প্রথমে না করে দেই । কিন্তু পরে শেফার রিকোয়েস্টে আর না করতে পারি না । যাওয়ার জন্য রাজি হই । বাড়িতে বন্ধী থাকতে থাকতে হাপিয়ে গিয়েছি । বাহিরে বের হলে মন কিছুটা হাল্কা হবে ।
আর অগ্নির ভূত ও ঘাড় থেকে নামবে !

চলবে…..❤️