শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
4185

#শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ৩৭

কিছুক্ষণ পূর্বেই মায়ের জ্ঞান ফিরেছে । মায়ের কেবিনে সবাই । মা অপরাধ ভঙ্গী তে সেটে হেলান দিয়ে আছে । অগ্নি মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শব্দহীন ভাবে চোখের জল ফেলছে । মা অগ্নির মাথায় হাত রেখে অগ্নিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিন্তু অগ্নি কোন ভাবেই থামছে না । বাচ্চাদের মত কান্না করে যাচ্ছে ।মাকে আকড়ে ধরেই এতোটা বছর বেঁচে এসেছে। আজ যখন জেনে মায়ের খুব তাড়াতাড়ি তার মা তাকে ছেড়ে চলে যাবে অগ্নির যেন পুরো দুনিয়ায় অন্ধকার নেমে এসেছে । বাচ্চা দের মত কান্না করে নিজের মাকে নিজের কাছে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে । অগ্নির এমন অবস্থা দেখে বার বার ভেঙে পড়ছি ।অগ্নি কে কি করে সামলাবো? কি সান্ত্বনা দিবো ?

অগ্নি মায়ের হাত ধরে কান্না করতে করতে বলে ,

– “মা তুমি কেন এতোবড় কথা লুকালে ? কেন তোমার অসুস্থতার কথা আমাদের জানাও নি ? ”

মা মলিন হেসে বললো ,

– “আগে জানালে কি হতো? কোনো কিছু কি পরিবর্তন হতো ? শুধু শুধু তোমরা সবাই চিন্তা করতে ভেঙে পড়তে । ”

– “মা তুমি এমন ভাবে বলছো যেন কিছুই হয়নি । আর এতোটা মাস তুমি একাই সব কষ্ট সহ্য করেছো নিজেই সব সামাল দিয়েছো সব চাপ টেনশন নিয়েছো। আমাদের একটা জানাও নি ।আর আমিও অপদার্থ ছেলের মত কিছুই বুঝিনি । নিজের মার কষ্ট গুলো একবার বুঝিনি । ”

বলেই অগ্নি আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে । খুব করে কাঁদছে অগ্নি । মা অগ্নির মাথায় হাত রেখে কান্না জড়ানো গলায় বললেন ,

– “কে বলেছে আমার ছেলে অপদার্থ ? আমার ছেলে লাখে এক । যার মত কেউ কখনো হতে পারবেনা । খুব দায়িত্ববান । এইযে আমার পুরো পরিবার আমার সামনে । সবাই হাসি খুশি একসাথে আছে এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে? এখন আমার মৃত্যু হলেও কোনো আফসোস নেই । আমার সবচেয়ে বড় শান্তি কি দেয় জানো ? আমার জীবনের সব ঋন আমি শোধ করেছি । তোমার জন্য যোগ্য বউ এনেছি যে সারাজীবন তোমার খেয়াল রাখবে ,সামলাবে ,ভালোবাসবে সঠিক রাস্তা দেখাবে । অগ্নি তোমার জন্য হুরের চেয়ে বেটার লাইফ পার্টনার কেউ হতে পারতো না । আমি জানি তুমি রেগে ছিলে আমার উপর কিন্তু আমার এই ডিসিশন তোমার কথা চিন্তা করে নেওয়া । আমি তোমার জন্য ভরসার হাত খুঁজছিলাম আর একমাত্র হুরই তোমার যোগ্য । ”

অগ্নি মায়ের পায়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে ,

– “মা স্যরি ! আমাকে মাফ করে দেও । আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি ভুল বুঝেছি । রুড বিহেভ করেছি । কিন্তু তুমিই সঠিক ছিলে মা । তোমার ডিসিশন ঠিক ছিলো । তুমি আমাকে আমার হারানো জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছো আর আমি তোমাকেই ভুল বুঝছি । ক্ষমা করে দেও মা । আমাকে ক্ষমা করে দেও । ”

– “বাবা রে মায়েরা কি সন্তানের উপর রেগে থাকে? আমি জানতাম তুমি একদিন আমাকে ঠিক বুঝবে । ”

মা হাতে ইশারা আমাকে নিজের দিকে ডাকেন আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে মায়ের দিকে যাই । মায়ের পাশে বসি । মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

– “মা তুই যথেষ্ট ধৈর্যশীল একটা মেয়ে । আজকালকের মেয়েদের থেকে একদম আলাদা । আমি জানি আমার কাছে সময় খুব কম । হয় তো এখনি ,,, তুই আমার ভরসা । আমার পাগল ছেলেটাকে একমাত্র তুই ই সামলাতে পারবি । একটু রাগী একটু পাগলামি করে । কিন্তু মন থেকে খুব ভালো । তোকে খুব ভালোবাসে মন প্রাণ উজাড় করে তোকে চায় । আমি জানি সারাজীবন তোকে আগলে রাখবে । আমার ছেলেটার কাছে তুই সব । আমার ছেলের ঢাল হয়ে সব সময় থাকবি । তুই ই অগ্নির শক্তি ।সব সময় আমার ছেলের পাশে থাকিস মা । ”

আমি নিজের কান্না আটকাতে পাড়লাম না । শব্দ করে কেঁদে দেই । মা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন ,

– “একদম কাঁদবি না । তুই ভেঙে পড়লে সবাইকে কে সামলাবে । এখন তো তোর অনেক দায়িত্ব মা ।”

মা হিয়া আপুকে কাছে ডাকে। আপু মায়ের পাশে বসে । মা হিয়া আপুকে বললেন ,

– “আমি আবির আর অগ্নিকে কখনো দু চোখে দেখিনি । আমি আবিরকে জন্ম না দিলেও আবির আমার বড় ছেলে । তার তুমি আমার বড় বউমা । আমার আরেক মেয়ে । আমার নাতী- নাতনী দেখার সৌভাগ্য আমার বোধহয় হবে না । কিন্তু তাদের বলো তার প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা । নিজের আর আমার ছেলের খেয়াল রাখবে আর সন্তানের কাছে একজন সৎ মা হবে । এটাই নারী আসল আদর্শ ।এই সংসার এখন তোমাদের দুবোনের । সব সময় জুড়ে রেখো । ”

হিয়া আপু মুখ চেপে কান্না করতে লাগলেন । আবির ভাইয়া মায়ের হাত ধরে জোরে শব্দ করে কান্না করছে । মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,

– “বাবা তুই না বুঝদার ? তুই এমন অবুঝের মত আচরণ করলে হবে । তোকে যে এখন সব সামাল দিতে হবে । হিয়ার খুব খেয়াল রাখবি । হিয়া কখনো অসম্মান করবেনা । তাহলে আমার আত্না অনেক কষ্ট পাবে।”

আমি মায়ের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছি ।টপটপ করে আমার চোখ থেকে পানি ঝোড়ছে । মায়ের দিকে অপলক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছি । আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ । নিজের পরিবারের জন্য নিজেকে শেষ গেলো সারাজীবন । নিজের মৃত স্বামীর স্মৃতি নিয়ে এতোটা বছর পাড় করেছে কখনো ভেঙে পড়েনি সারাজীবন শক্ত হয়ে বটবৃক্ষের মত সবাইকে ছায়া দিয়ে গেছে । নিজে একাই সব বিপদ কাঁধে দিয়েছে । একজন সফল বিজনেস ওম্যান । একজন শ্রেষ্ঠ মা । যতবার দেখি গর্বে বুক ভরে যায় । আজ জীবনের শেষ মুহূর্তে এসেও সবাইকে সামলাচ্ছে । সবাইকে নিজেদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে । জীবনের প্রত্যেকটা হিসাব মিলাচ্ছে । এতো সাহস আর এতো ধৈর্য আমি কখনো কাউকে দেখিনি । আমার আইকন । যার থেকে জীবনের পথ চলা শিখা যায় ।

রাত দশটা বাজে । আমি আর অগ্নি হসপিটালে মায়ের সাথে । আবির ভাইয়া আর হিয়া আপুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি । আপু প্রেগন্যান্ট সারাদিন এখানে ছিলো । সামনে মাসেই আপুর ডেলিভারি । এখন এতো তোড়জোড় করা ঠিক না । প্রোপার রেষ্টের প্রয়োজন । অগ্নিকে এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়াতে পারিনি । অগ্নি মায়ের হাতে মাথা ঠেকিয়ে নত হয়ে আছে ।
মা ঘুমাচ্ছে । আমি অপলক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে সাহসী মানুষটা একদম নেতিয়ে গেছে ।আমি অগ্নির কাঁধে হাত রাখতেই অগ্নি মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে । শান্ত স্বরে বলি,

– “একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন । সারাদিন কিছু মুখে নেন নি । ”

– “আমার ভালো লাগছে না ”

– “একটু কিছু মুখে দিন । না খেয়ে সারারাত জাগলে অসুস্থ হয়ে যাবেন । ”

অগ্নি না করতে চাইলো । কিন্তু আমি একপ্রকার জোড় করে পাঠাই । অগ্নিব দরজার কাছে যেতেই ।
মা শব্দ করে জেগে উঠে ।কেমন যেন ছটফট করছে । অগ্নি আর আমি মাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । মায়ের চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে । বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে । চোখ উল্টিয়ে যাচ্ছে । আমি কান্না করতে করতে চিৎকার করে ডক্টর কে ডাকি । মা ততক্ষনে চোখ উল্টে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে । নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে । কোনো সাড়াশব্দ করছে না। ডক্টর হাতের পালস চেক করে আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে বললেন ,

– “স্যরি সি ইজ নো মোর ”

এই কথাটাই আমার পুরো দুনিয়া এলোমেলো করে দিলো । মাথা ঝিমঝিম করছে । শরীর ভর ছেড়ে দিচ্ছে । পাশের দেয়াল ধরে দাড়াতে যাই কিন্তু পারিনা । হুট করে ফ্লোরে লুটিয়ে পরি ।তার পর আর কিছু মনে নেই ।

চলবে …❤️❤️❤️

শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ৩৮

আদো আদো চোখ খুলি । মাথা প্রচন্ড রকম ব্যথা করছে । শরীর কেমন যেন শক্তিহীন মনে হচ্ছে । আমি হাত দিয়ে মাথা চেপে উঠে বসি । একহাতে ক্যানোলা লাগানো । পুরোরুম অন্ধকার হয়ে আছে । পর্দা গুলো ছড়ানো । পর্দার ফাঁকে ফাঁকে আলো আসছে । বাহিরে অনেক মানুষ আনাগোনা শুনা যাচ্ছে । কান্নার শব্দ আসছে । আমি হেলান দিয়ে ভালো করে বসে পাশে তাকিয়ে দেখি নিশিত বসে মুখ চেপে কান্না করছে।নিশিতের কান্নার কারণ খুঁজতে গিয়ে মাথার টনক নড়ে ।আমি কান্না কাঁপা কাঁপা স্বরে বলি,

– “নি…নিশিত মা কই”

নিশিত মুখে কাঁপড় চেপে ধরে ফুফিয়ে কান্না করতে করতে বলে ,

– “ভাবী ফুপি….ফুপি …

আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ে । আমি নিশিতের কথা শেষ করার অপেক্ষা করিনা । হাতের ক্যানোলা টান দিয়ে খুলে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে পরি । আটকানোর জন্য নিশিত পিছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকে । আমি সেদিকে কোনো ধ্যান দেই না । এই মুহূর্তে আমার মাকে দেখাটা জরুরী । আমি সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখি পুরো বাড়ি ভরা লোকজন । মায়ের বডিটা ড্রইং রুমে মাঝে রাখা আবির ভাইয়া আপু সবাই কান্না করছে।অগ্নি পাথর হয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছে । চোখ মুখ পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে । এক ফোটা জল বের হচ্ছেনা যেন পাথর হয়ে গেছে । আমি মায়ের সামনে হাটু গেড়ে থপ করে বসে পড়ি । মা কি সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে । আজ চেহারায় কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই । কোনো দায়িত্ব নেই । সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত । মুখটা উজ্জ্বল সূর্যের মত ঝকমক করছে।আর কেউ মা বলে ডাকতে পারবো না ।চিরকালের জন্য আজ সব দায়িত্ব থেকে কর্তব্য থেকে মুক্তি হয়ে গেল । আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে বলি,

– “মা গো কেন ছেড়ে চলে গেলে? কেন? এখন আমি কাকে মা বলে ডাকবো ? আমার যে এখনো মা ডেকে স্বাদ মিটেনি । কেন আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে । এখন আমি কি ভাবে বাচঁবো? কি ভাবে থাকবো ? আমার সবচেয়ে বড় শক্তি যে তুমি।আমার সব সাহস তোমার থেকে পাই । এখন কে বলবে হুর সব ঠিক হয়ে যাবে । কে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে । তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে ? কেনননন ? ”

চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম । ভিতর থেকে শুধু চিৎকার করে কান্না আসছে । আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করছি । আজ আমি আমার ঢাল হারিয়েছি । আমার অনুপ্রেরণা আমার মনোবল সব হারিয়েছি । আমি মাকে শেষ বারের মত জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করছি । হ্ঠাৎ ই মাথাটা আমার ঝিমঝিম করছে । আশেপাশের সবাই রক্ত রক্ত বলে চিৎকার করছে । আমি ঝাপসা ঝাপসা চোখে আমার হাতের দিকে তাকাই । ক্যানোলা লাগানো জায়গায় গলগল করে রক্ত পড়ছে । আমার হাত ভিজে গেছে ।আমি হাতের দিকে তাকিয়েই নিজের জ্ঞান হারাই ।

জ্ঞান ফিরে রাতে । চারদিক অন্ধকারে তলিয়ে আছে । মায়ের দাফনকাজ শেষ হয়েছে । ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি অগ্নি আমার পাশে বসে আছে। আমার দিকে অগ্নির পাথর দৃষ্টি । চোখ দুটো যেন থেমে আছে । একদম স্থির চাহনি । কোনো ভাব নেই । ভাষাহীন চোখ । আমি উঠে বসতে নিলে অগ্নি আমার হাত ধরে উঠে বসায় । পিঠের পিছনে বালিশ ঠেকিয়ে বসিয়ে দেয় । শীতল স্বরে বললেন ,

– “খুব খারাপ লাগছে ? ”

– “উহু ”

– “তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসি ”

– “উহু খুদা নেই ”

– “সারাদিন সেন্সলেস ছিলে। অল্প কিছু খেয়ে নেও । মেডিসিন নিতে হবে ! ”

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অগ্নি খাবার আনতে চলে যায় । কিছুক্ষণ পরই খাবারের প্লেট নিয়ে আসে । আমার সামনে বসে । আমি অগ্নির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করি ,

– “সবাই ডিনার করেছে ? ”

– “হুম করেছে ”

-“আপনি করেছেন? ”

অগ্নি কোনো উত্তর দেয় না । তার মানে অগ্নি কিছু মুখে তুলেনি । হাত ধুয়ে অগ্নি থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে নেই । অগ্নির মুখের সামনে খাবারের লোকমা তুলতেই অগ্নি শান্ত স্বরে বললো,

– “আমি খেয়েছি ”

– “মিথ্যা বলছেন কেন ।জানি তো আমি সেই কাল থেকে কিছু মুখে তুলেননি । চোখ মুখ সব শুকিয়ে আছে । ”

– “হুর আমার খিদে নেই ”

– “আপনি না খেলে আমিও খাবো না ”

অগ্নি আমার সাথে না পেরে বাধ্য হয় খেতে । পুরোটা সময় অগ্নির চোখ ছলছল করছিলো ।
অগ্নি একবারের জন্যও আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না । অগ্নি কি আমার থেকে নিজের কষ্ট লুকাতে চাইছে ? আমার থেকে ? অগ্নি কি জানে না অগ্নির হুর অগ্নিকে খুব ভালো করে চিনে । অগ্নি চাইলেও আমার থেকে নিজের কষ্ট যন্ত্রণা লুকাতে পারবে না ।অগ্নি যতই পাথর হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন । আমি তো জানি অগ্নির এই পাথর আভরণের পিছনে নরম হৃদয় আছে । খাওয়া দাওয়া শেষ করে অগ্নি আমাকে মেডিসিন খায়িয়ে দেয় । আমি অগ্নির কাছে যেয়ে উনার কাঁধে মাথা রেখে । আড়চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলি ,

– “কি ভাবছেন আপনি আমার থেকে নিজের কষ্ট যন্ত্রণা লুকাতে পারবেন ? কেন নিজেকে এমন পাথরের মত গড়ে তুলছেন । মায়ের মৃত্যু তে এক ফোটা জল আপনার চোখ থেকে বের হয়নি । কেন নিজের যন্ত্রণা গুলো বুকের মধ্যে এমন জমাট বাঁধছেন । কষ্টগুলো বুকের মধ্যে গেঁথে রাখছেন ? কষ্ট গুলোকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিন । না হয় দিনেদিনে কষ্ট গুলো বাড়বে ।ছুড়ি আঘাত করবে । ”

আমি আর বলতে পারলাম না । তার আগেই অগ্নি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করছে । অগ্নি কান্না করতে করতে বললো ,

– ” আমার কাছের মানুষ গুলো কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায় । আমি কি খুব খারাপ? কেন সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায় ? প্রথমে বাবা আর এখন মা । সবাই কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায় ? এখন মাকে ছাড়া আমি কি ভাবে থাকবো । কিভাবে?

অগ্নি ছোট বাচ্চাদের মত কান্না করছে।
আমি অগ্নিকে থামালাম না । কাঁদুক যত ইচ্ছে কাঁদুক । এতে মন হাল্কা হবে । কষ্ট গুলো চোখের পানির সাথে বেরিয়ে আসবে । অগ্নি এক সময় কান্না করতে করতে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় । আমি অগ্নির চুলে বিলি কেটে রাত পাড় করি। আজ দুদিন পর অগ্নি ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে ।

শেষ রাতের দিকে আমার চোখ লেগে যায় । আর ভোর সকালে ঘুম ভাঙে । অগ্নি তখনো গভীর ঘুমে মগ্ন ।কিছুসময় অগ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরি।ফ্রেশ হয়ে নামায পরে নিচে যাই । চিটাগাং থেকে সবাই এসেছে । আশেপাশের রিলেটিভরা এসেছে ।সকালের নাস্তার কাজে চম্পা কে সাহায্য করতে হবে একা হাতে সব সামলাতে পারবে না। তার উপর নানুর ডায়াবেটিস । নানুর ইন্সুলিন দিতে হবে । নিজের চোখের সামনে সন্তানের লাশ দেখার মত বড় যন্ত্রনা আর হয় না । সহ্য করা যায় না । না জানি নানুর কি অবস্থা । কাল থেকে একবার ও উনার সাথে দেখা করা হয়নি । আমি এসব ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরে পা বাড়াই । রান্নাঘরে ডুকতেই দেখি নিশিত আগের থেকে আছে । চম্পাকে দেখিয়ে দিচ্ছে ।নিশিত আমাকে দেখে প্রশ্ন করে ,

– “ভাবী তুমি এই অবস্থায় এতো সকাল সকাল উঠতে গেলে কেন ? তোমার প্রোপার রেস্টের প্রয়োজন ! ”

– “রেস্ট নিতে ভালো লাগছে না নিশিত ।”

– “তার পরও ভাবী ”

– ” বাড়ির সবার মনের অবস্থা ভালোনা । আপুও প্রেগন্যান্ট । আমি যদি রেস্ট করি কেমন দেখায় । ডোন্ট ওয়ারী আমি পুরোপুরি সুস্থ । ”

নিশিত আর কিছু বললো না। আমি নিশিত চম্পা নাস্তা হাতে হাতে নাস্তা বানানো শেষ করি । কিন্তু মাছের কাছে যেতেই শরীর গুলিয়ে আসে । তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে চলে যাই । বুমি আসছে খুব ।যদিও পেটে পানি ছাড়া কিছু নেই বলে ভিতর থেকে কিছু আসছে না । নিশিত আমার পিছন পিছন ছুটে আসে । আমি নাকে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসি ।

চলবে …..❤️

শত_ ডানার_ প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট : ৩৯

সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছি । এখনো ঘুম থেকে কেউ জাগে নি । নিশিত আমার দিকে লেমন জুস এগিয়ে দেয় । আমি পুরোটা শেষ করি । লেমন জুস খাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে । গা গুলানো ভাবটা কমছে । চোখ বন্ধ করে আছি । বমির কারণে এই শীতেও কেমন জানো অস্থির লাগছে । গাঁ থেকে ঘাম ছুটছে । সোফায় গাঁ এলিয়ে ফ্যানের নিচে চোখ বন্ধ করে আছি । নিশিতের ডাকে চোখ খুলে আস্তে করে উঠে বসি । নিশিত গলা ঝেড়ে বললো,

– “ভাবী একটা কথা বলি ? ”

– “হুম ,অবশ্যই! এতে পার্মিশনের কি আছে ? ”

– “ভাবী ,আই থিংক ইউ আর প্রেগন্যান্ট ! কাল থেকে এভাবে বারবার সেন্সলেস হওয়া বমি করা সব দেখে আমার মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট । চেকআপ করে দেখ । ”

আমি নিশিতের কথায় কিছুক্ষণ থম মেরে বসে আছি । তাও কি সম্ভব ? লাস্ট টাইম ইরেগুলার পিরিয়ডের জন্য ডক্টর আন্টির কাছে চেকআপ করেছিলাম, আন্টি বলেছিলেন আমার হেলথ কন্ডিশন পুরোপুরি স্বাভাবিক না । কিছু ত্রুটি আছে ।ভবিষ্যৎ এ প্রব্লেম দেখা দিতে পারে । আমি সরাসরি জানতে চাইলে আন্টি জানায় যে ভবিষ্যৎ এ কনসিভ করার সময় প্রব্লেম দেখা দিতে পারে । অনেক সময় বেবি না হবার সম্ভাবনা থাকে । কিন্তু যদি ঠিক সময় চিকিৎসা করে মেডিসিন নেওয়া হয় তাহলে কোনো সমস্যা হবে না । আমি আন্টির কথা তেমন ভাবে গুরুত্ব দেইনি । মেডিসিন ও ঠিক মত নেওয়া হয়নি । আমি তখন ডিপ্রেশনে ছিলাম । এই ব্যাপারে খুব খামখেয়ালি করেছি । এরপর এইসব ব্যাপারে আর ভাবিনি । কিন্তু আজ নিশিত কথায় গলা শুকিয়ে আছে । সত্যি কি এমন কিছু ?
মা হওয়া পরম ভাগ্যের ব্যাপার । পৃথিবী কোন মেয়ে চায় না মা হতে ? এই সুখের চেয়ে বড় সুখ দুনিয়াতে নেই । কিন্তু নিজের হেলথ কন্ডিশনের কথা বিবেচনা করে নিশিতের কথাটা আমলে নিতে পারছি না ।
আমি ছোট একটা শ্বাস দিয়ে নিশিত কে বলি ,

– “নিশিত তা কি করে পসিবল ? ডক্টর বলেছে আমার হেলথ কন্ডিশন পুরোপুরি ঠিক না ।কনসিভ করার সময় প্রব্লেম হতে পারে । আর মেডিসিন ও টাইম টু টাইম নেই নি । তাহলে কি করে সম্ভব ? ”

– “এইতো তুমিই বললে মেডিসিন টাইম টু টাইম নেও নি । কিন্তু নিয়েছিলে তো ? এমনও হতে পারে যে মেডিসিনে রিকভার হয়েছে । ”

– “এমনো তো হতে পারে যে উইকনেস আর গ্যাস্ট্রিকের জন্য এমন হচ্ছে । ”

– “ভাবী আমি মেডিকেলে পড়ছি তোমার চলাফেরা সবকিছু মিলিয়েই বলছি । চেকআপ করাতে প্রব্লেম কোথায় । ”

– “অকে বাবা ,আমি চেকআপ করবো কেমন? জানো নিশিত সত্যি বলতে এখন কিছুতে হুট করে বিশ্বাস করতে ,আশা বাঁধতে খুব ভয় হয় । যদি তা মনের না হয় তখন নিজেকে সামলাবো কি করে ? জীবনে এতো ধাক্কা খেয়েছি যে বিশ্বাস করতে ভয় করে । ”

– “ভাবী তুমি ভয় পেওনা । আমার মনে হচ্ছে ভালো কিছু হবে । জীবনে অনেক সহ্য করেছো এবার তোমার সাথে সব ভালো হবে দেখ । ”

আমি নিশিতের কথায় চোখ নামিয়ে মলিন হাসি ।নিশিতের কথা কি সত্যি হবে ?

____________________________

পৃথিবীতে সময় সবচেয়ে বড় ঔষধি । এর চেয়ে বড় ঔষধ আর নেই । সময় মনের জখম ,শরীরের জখম সব ভুলিয়ে দেয় । মানুষ কে সব ব্যথা ভুলিয়ে দেয় । মায়ের মৃত্যুর আজ একমাস পাঁচ দিন । ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়েছে সব । অগ্নি নিজের দায়িত্ব গুলো কাঁধে নিয়েছে । অফিস জয়েন করেছে । যদিও অন্তি আগের থেকেই দায়িত্ববান । কিন্তু এখন পুরোপুরিভাবে সংসার জীবনে প্রবেশ করেছে । অফিসের কাজের প্রতি খুব সিরিয়াস হয়েছে । আবির ভাইয়ার সাথে সবকিছু দেখাশোনা করছে ।বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে । হিয়া আপু ছেলে সন্তানের মা হয়েছে । আমি আর অগ্নি ভাইয়ার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছি ‘আদিল’ । আদিল সবার চোখের মনি । আপু আদিল কে নিয়ে মামীর বাসায় আছে । এসময় আপুর মামীর কাছে থাকা প্রয়োজন ।মা নেই আপু একা সামলাতে পারবে না । আর আমি বাচ্চা সামলানোর ব্যাপারে একদম ই অদক্ষ । প্রতিদিন অগ্নি অফিস থেকে ফেরলে আমরা দুজন বাবুকে দেখতে যাই । কোনো একদিন মিস হলে সে রাতে আর ঘুম হয় না । এদিকে আমিও নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার দেখছি । পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গেছি । একা হাতে সবটা সামলাচ্ছি । মাঝে মাঝে ভেঙে পরি । কিন্তু যতবার ভেঙে পরি মায়ের হাসি উজ্জ্বল মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে । আমি আবার উঠে দাড়াই । মা আমার প্রেরণা সবচেয়ে বড় শক্তি । যদিও মায়ের মত সবটা পেরে উঠতে পারিনা । কিন্তু সব দিক সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই ।

কিচেনের সবকিছু গুছিয়ে রুমে এসে দেখি অগ্নি বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে । অফিসের কাজ করছে । চেহারায় টেনশন ক্লান্তির ছাপ ।আমি ওয়াশরুমে চলে যাই ড্রেস চেঞ্জ করতে ।আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে অগ্নি ল্যাপটপ বন্ধ করে সাইডে রেখে দেয় । আমি আয়নার সামনে চুল বিনুনি করতে বসি । ততক্ষনে অগ্নি আমার পিছনে এসে দাড়ায় । প্রথমে আমার সেদিকে ধ্যান না গেলেও পরবর্তিতে নজরে পরে । অগ্নির ক্লান্তি ভরা চেহারায় মলিন হাসি । আমি চেয়ার ছেড়ে অগ্নির দিকে পা বাড়াই । অগ্নির দু কাঁধে নিজের দু হাত জুলিয়ে মুচকি হেসে অগ্নির দিকে তাকাই । অগ্নি আমার দিকে আদুরে চোখে তাকিয়ে আছে । ডানহাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে আমার গালে স্লাইড করতে করতে বলতেন ,

– “তুমি আমার উপর বিরক্ত হও না ?”

– “তা কেন ? ”

– “এইযে আমি তোমাকে সময় দিতে পারছিনা ,তোমার খেয়াল রাখতে পারছিনা ,তোমার সাথে মিনিট পাঁচেক বসে আলাপ করতে পারিনা । ”

– “বিরক্ত হবো কেন ? জানি তো আপনি ইদানীং কতটা ব্যস্ত । কাজের চাপ অনেক । এইযে আপনার কপালের ভাজ গুলো বলে দিচ্ছে কতটা ক্লান্তি আর ব্যস্ততার মাঝে আপনার দিন কেটেছে ।”

– “এতোটা কেন বুঝ আমাকে ? ”

– “আমি আপনাকে না বুঝলে কে বুঝবে ? ”

অগ্নি আমাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায় । আমি মুচকি হেসে বুকে মাথা ঠেকাই ।

– “আমাকে বিশ্বাস করো ? ”

– ” অনেক বেশি ”

অগ্নি আমাকে নিজের কোলে তুলে নেয় ।বারান্দার চেয়ারে বসে ।আমি তখনো অগ্নির কোলে । মাথা ঠেকিয়ে বসে আছি । অগ্নি আমার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলে,

– “যদি আমি তোমার থেকে কিছু লুকাই কখনো তা তোমার সামনে এসে যায় । তখনো কি আমাকে বিশ্বাস করবে ? ”

– “তাহলে ছেঁড়ে চলে যাবো । কেন আপনি কি এমন কিছু করেছেন ? ”

হুট করে গম্ভির মুখ করে অগ্নিকে প্রশ্ন করি । অগ্নির চেহারা সাথে সাথে রক্তশূন্য হয়ে যায় । আমি অগ্নির এই ফ্যাকাসে চেহারা দেখে ফিক করে হেসে দেই । অগ্নি আমার হাসি দেখে ছোট্ট একটা নিশ্বাস নেয় । আমি উঁচু হয়ে অগ্নির কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে আমার বুকে মাথা রাখি । অগ্নির আঙুলে আঁকিঝুঁকি করতে করতে বলি ,

– “কখনো এমন পরিস্থির সম্মখীন হলে বিশ্বাস করবো কিনা ! তা ডিপেন্ড করে বিষয় টা কি তার উপর ।
অগ্নি আমি আপনাকে অনেক বিশ্বাস করি । অনেক বেশি । আর আমি জানি আপনি কখনো এমন কিছু করবেন না যাতে আমার বিশ্বাস ভঙ্গ হয় । ”

অগ্নি আমার মাথা চুমু খেয়ে নিজের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । আস্তে আস্তে আমার চোখ বুজে আসে আজ অনেক দিন পর নিজের পরম শান্তির স্থানে মাথা রেখেছি । দুনিয়াতে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ।

চলবে…..❤️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন