শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৩

0
681

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” আপু তুমি কি কান্না করছো?”

বারান্দার ফ্লোরে বসে আকাশ দেখছিলো প্রিসা।পালকের কথা শুনে সে পেছন ফিরে তাকালো।

” কান্না কেন করবো?আমার কি কিছু হারিয়ে গিয়েছে নাকি?” মুখে হাসি রেখেই বললো প্রিসা।

” আপু তুই কি অয়ন ভাইকে এখনো ভালোবাসিস?তার এরকম আচমকা বিয়ে করে নেওয়ায় কি তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস?” প্রিসার পাশে বসে পালক আবারো বললো, ” তুই কষ্ট কেন পাচ্ছিস আপু?এমন তো না যে সে তোর সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন বিয়ে করেছে।তোদের সম্পর্কের ইতি তো আরো তিন মাস আগেই হয়েছে।তাহলে এখনো কেন তার কথা মনে রেখেছিস?তুই কি জানিস না সে কি বলেছিলো তোকে?”

” জানিস বোনু মায়া জিনিসটা না বড়ই খারাপ।তুই যদি কিছুদিন একটা কলমকে নিজের কাছে খুব যত্ন করে রাখিস,সবসময় সেটাকে ব্যবহার করিস তবে একদিন যদি আচমকা সেটা হারিয়ে যায় তাহলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।কলমটার কথা ভেবে তুই উদাস হয়ে যাবি।সেখানে আমি তো ওকে ভালোবেসেছিলাম,অন্তত খানিকের জন্য হলেও।আর এটা কখনোই মিথ্যা হয়ে যাবে না।কিন্তু তুই চিন্তা করিস না আমি তাকে আগে ভালোবাসতাম এখন নয়।মনে আছে বাবা কি বলতো? ‘ যেটা যাওয়ার সেটা যাবে,হাজার চেষ্টা করেও তুমি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।যেটা চলে গিয়েছে সেটা ভেবে বর্তমানে কষ্ট পাওয়াটা বোকামি।অতীতে কি হারিয়েছো সেটা ভুলে যাও।ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করো না।বর্তমানে তোমার কাছে যেটা আছে সেটা উপভোগ করো।’ তাই তুই চিন্তা করিস না এসব নিয়ে।সে চলে গিয়েছে,চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে ফিরে আসেনি।তাই আমিও চেষ্টা করা ছেড়ে দিয়েছি।আমার জীবনে তার জন্য সকল দরজা বন্ধ।যা ইচ্ছে সে করুক,আমার তাতে কিছু যায় আসে না।ক্ষাণিকের জন্য তার সাথে আমার অন্য একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো ঠিকই তবে এখন শুধু সে আমার মেজো মামার ছেলে।”

বোনের কথা শুনে পালকের স্বস্তি মিললো।প্রিসার কাঁধে নিজের মাথাটা রেখে চোখ বুজলো সে।

” এভাবেই শক্ত থাকিস আপু।ভেঙে যায় না।”

” থাকবো বোনু।আর যাইহোক কারো ক্ষাণিকের মায়ায় জড়িয়ে নিজেকে আর তোদের কষ্ট দেবো না।”
___________________________________________

ওয়েটিং রুমে বসে আছে পালক।তার মতোই আরো অনেকজন অপেক্ষা করছে।সবাই তার মতো ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।৬ মাস হতে চললো পালক অর্নাস শেষ করে বের হয়েছে।তারপর থেকে ভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু একেক জায়গায় একেক ধরণের সমস্যা।উপরন্তু মাথায় মামা-চাচা কারোই হাত নিয়ে বিধায় এতোদিনেও ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি পালক।ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে সকাল ১০ টায়,এখন বাজে সাড়ে ১১ টা।আরো তিন-চারজন এরপর পালককে ভেতরে যাওয়ার জন্য বলার হলো।

” আসতে পারি?”

” আসুন।”

অনুমতি পেয়ে যখন পালক দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তখন সামনে থাকা একজন মানুষকে দেখে সে খানিকটা চমকে গেলো।তিনজন মানুষ বসে আছে তার অপর দিকে,তার মধ্যে একজন হচ্ছে রাদ।পালক প্রথমে খানিকটা চমকে গেলেও পরমুহূর্তে নিজের সামলে নিলো এবং এমন ভাব করলো যে সে কাউকেই চেনে না।একদম অপরিচিতদের মতো তাদের সাথে কথা বললো এবং শান্তভাবে তাদের সকল প্রশ্নের উওর দিলো।রাদও পালকে এখানে আশা করে।তাই সেও চমকে গিয়েছিলো।তবে পালকের মতো সেও কোন ধরণের বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো।অন্যদের সাথে যেরকম ব্যবহার করেছিলো পালকের সাথেও ঠিক সেরকম ব্যবহার করেছে।ইন্টারভিউ শেষে বেরিয়ে আসার সময় পালক একপলক রাদের দিকে তাকালো।অন্য দুজনের মতো রাদও স্বাভাবিকভাবে চেয়ারে বসে আছে।অপরিচিত কেউ দেখলে বুঝতেও পারবে না আসল ঘটনা।
____________________________________________

বাইরে প্রচন্ড পরিমাণের রোদ না হলেও মোটামুটি রোদ আছে।প্রতিদিনের মতোই প্রিসা স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে।মাস্টার্স শেষ করে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি নিয়েছে প্রিসা।মামা-চাচার জোড় না থাকায় বড় কোথায়ও চাকরি হয়নি।

হাঁটতে হাঁটতে প্রিসা হঠাৎ খেয়াল করলো এক জায়গায় কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে।আগ্রহ নিয়ে প্রিসা এগিয়ে গেলো তবে সামনের দৃশ্য থেকে তার মেজাজ বিগড়ে গেলো।কিন্তু হুট করে কিছু করলো না,ঠান্ডা মাথায় আগে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো।কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন দেখলো পরিস্থিতি কেউ সামলাতে পারছেনা তখন সে এগিয়ে এলো।

” কি হচ্ছে এখানে?”

” এখানে কি হচ্ছে সেটা জেনে তোমার কি কাজ সুন্দরী?দেখছো তো কোন ছেলেই এগিয়ে আসছেনা।তাহলে তুমি কেন সাহসীকতা দেখাতে এগিয়ে এলে?”

” আমি জিজ্ঞেস করেছি কি হচ্ছে এখানে?”

” উফ….. সুন্দরী দেখি রে’গে যাচ্ছে।পিচ্চিটা আদর করছি আমরা।তোমারও লাগবে নাকি?লাগলে বলো,আমাদের কাছে জায়গায় আছে ভালো।লাগলে নম্বর নিয়ে যাও,সময় করে ফোন দিও।”

এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না প্রিসা।জোড়ে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে।

” তুই আমার গায়ে হাত তুললি।নিজের সম্মানের কোন ভয় নেই?নাকি ছোঁয়ার জন্য বাহানা খুঁজেছিস?তর সাইছে না বুঝি?” বি’শ্রিভাবে হেসে বললো ছেলেটি।

এতো বাজে কথা শুনে প্রিসা আরো একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো তার গালে।ছেলেটার কোঁকড়ানো চুলগুলো এক হাতে মুটো করে ধরলো সে।

” মেয়ে বলে আমাকে দু’র্ব’ল ভাবিস না।মেয়ে মানেই সে সম্মানের ভয়ে চুপ করে থাকবো,চোখের সামনে অন্যের সম্মানহানি হতে দেখবো তা কখনোই হয়না।আমি তোর ছোট না,তোর থেকে কয়েক বছরের বড় আমি।তাই বড় বোন হিসেবে একটা উপদেশ দিচ্ছি সময় থাকতে ভালো হয়ে যা,নয়তো পরে পস্তাবি।জানিস তো রিভেঞ্জ অফ নেচার বলে একটা কথা আছে।তাই বলছি ঠিক হয়ে যা।নয়তো আজকে মাত্র চুল ধর’লাম কাল চু্ল উঠি’য়ে ফেলবো,সেইসাথে দেখার জন্য চো’খ দুটোও আর থাক’বে না।”

ছেলেটার চুল ছেড়ে দিয়ে একপ্রকার ধা’ক্কা মারলো তাকে।

” এটাকে উঠিয়ে নিয়ে যা।নয়তো যা বলেছি সেটা এখন তোদের সাথে করবো।”

বাকি দুজন ছেলে তাড়াতাড়ি অন্যজনকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো।

” সার্কাস দেখা কি এখনো শেষ হয়নি?আরেকটু সার্কাস দেখবেন?একটা মেয়েকে মাঝরাস্তা একটা ছেলে উ’ত্ত্য’ক্ত করছে।গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া তো সবাই দেখেও না দেখার ভান করে ছিলেন।তখন যদি এভাবে সবাই ছেলেটাকে ঘিরে ধরতেন তাহলে সে এরকমটা করার সাহস পেতো না আর না আমাকে এগিয়ে আসতে হতো।সাকার্স দেখা শেষ হলে দয়া করে এবার সবাই আসুন।”

এক-এক করে সবাই নিজের নিজের কাজে চলে গেলো।মেয়েটি হুট করেই প্রিসাকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দিলো।

” তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আপু।আজকে তুমি না এলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতো।”

” হুস।কান্না বন্ধ করো।নাম কি তোমার?”

” নিরা।”

” মাথা তুলে তাকাও নিরা।কি হলো তাকাও।”

নিরা মেয়েটা মাথা তুলে তাকালে প্রিসা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

” তুমি কেন মাথা নিচু করে থাকবে?তুমি তো কোন দো’ষ করোনি তাহলে তুমি কেন ভ’য় পাবে।শোন নিরা তুমি এখনো ছোট।দুনিয়াটা বড়ই নি’ষ্ঠু’র,বড়ই স্বা’র্থপ’র।গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া নিজের প্রয়োজন না থাকলে কেউ কারো বি’প’দে এগিয়ে আসবে না।ভ’য় পাওয়া ভালো কিন্তু মাঝেমাঝে ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ করা যাবে না।অপরব্যক্তি যদি বুঝতে পারে তুমি তাকে ভয় পাচ্ছো তাহলে সে আরো সাহসী হয়ে উঠবে।নিজেকে নিজেরই বাঁ’চা’তে হবে।আজ আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি,কাল কেউ এগিয়ে নাও আসতে পারে।তাই নিজেকে শক্ত থাকতে হবে।বুঝতে পেরেছো?”

নিরা প্রিসাকে আবারো জরিয়ে ধরলো।

” তুমি আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।তোমার জন্য আজকে আমি বেঁচে গেলাম।”

” এবার কান্না ব’ন্ধ করো পিচ্ছি।বাড়ি যাও,তোমার বাবা-মা চিন্তা করছে।”

কথা বলতে বলতে তারা দু’জন চৌরাস্তার মৌড়ে চলে এলো।এরপর দু’জনে আলাদা আলাদা পথ ধরে চলে গেলো।যাওয়ার আগে নিরা প্রিসার নম্বর নিতে ভুললো না।

অন্যদিকে পুরো ঘটনাটা দূর থেকেই লক্ষ্য করছিলো কেউ।

” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি একদম শান্ত।কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই শান্তি নগরের রাজকন্যা যে অ’গ্নি রুপ ও ধারণ করতে পারে তা আগে জানতাম না।তোমার সম্পর্কে জানার আগ্রহ তো আগে থেকেই ছিলো তবে এখন তা আরো বেড়েছে।এবার তো দেখছি রাতদিন জেগে তোমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে শান্তি নগরের রাজকন্যা।”
.
.
খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করছিলো পালক।ফোনের শব্দ পেয়ে পালক ফোনের কাছে গিয়ে দেখলো অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে।

” হ্যালো কে বলছেন?”

” ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝি?বিরক্ত করলাম নাতে?”

” কিন্তু আপনি কে?আপনাকে তো চিনলাম না।”

” ইশ….আমাকে আপনি ভুলে গেলেন কবুতরের পালক।” অপর পাশের লোকটা হতাশার সুরে বললো।পালক ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে একবার নম্বরটা দেখে নিলো।

” রাদ?”

” ও মা মনে আছে দেখছি।হাইরে আমি কত ভাগ্যবান,একজন দয়ালুব্যক্তি সরি দয়ালু মানবী আমাকে মনে রেখেছে।এতো ভাগ্য আমার।”

” রাদ আপনি কি ঠিক আছে?কিছু বলবেন কি?”

” সরি সরি পালকসাহেবা শুরুতেই এতোটা বিরক্ত করার জন্য এবং এতো রাতে ফোন করে বিরক্ত করার জন্য।কিন্তু কি করবো বলুন।এতোক্ষণ হয়ে গেলো কিন্তু আপনি কোন উওর দিলেন না,তাই আমিই ফোন করলাম।”

” কিসের উওর রাদ?”

” আমি জানতাম আপনি দেখননি।এখুনি আপনার মেইলটা চেক করুন তো।”

রাদের কথা শুনে পালক তার মেইল চেক করলো।সবার উপরের মেইলটা রাদের কোম্পানি থেকে এসেছে।মেইলটা চেক করতেই পালকের মন খুশিতে ভরে গেলো।রাদ এখনো লাইনে আছে।

” এটা কি সত্যি?আমার চাকরিটা কি সত্যিই হয়ে গিয়েছে?”

” জ্বি মিস ঈপ্সিতা পালক।আপনার চাকরিটা কনর্ফাম।আবার এটা ভাববেন না যে আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন বলে আমি চাকরিটা দিয়েছি।এটা ভেবে থাকলে বড়ই ভুল করবেন।আপনি চাকরিটা আপনার যোগ্যতা দিয়ে পেয়েছেন।এই চাকরির ফলাফল শুধু আমি নয় আরো কয়েকজনের মতামতের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে।”

রাদের কথাগুলো পালকের খুব ভালো লাগলো।যাক এতোদিনে কেউ তার যোগ্যতা দেখে তাকে চাকরি দিয়েছে নাকি মামা-চাচা দেখে।

” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ রাদ।আমি আশা করিনি এবারো চাকরিটা আমি পাবো,অন্তত নিজের যোগ্যতায়।”

” শুনুন পালক আমি জানি বর্তমানে যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন।টাকা,পাওয়ার ছাড়া চাকরি পাওয়া মানে তীব্র গরমে বরফ পড়ার মতো।কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন একবার হারিলে চেষ্টা করো শতবার।এই যেমন আপনি নিজের যোগ্যতায় চাকরি না পেলেও হাল ছাড়েননি,দেখুন শেষ পর্যন্ত সঠিক পথেরই জয় হলো।তাই যেই পরিস্থিতি হোক কখনোই সঠিক পথ থেকে সরে আসবেন না আশা করি।যত যাইহোক ঠিক সবসময় ঠিকই হয়।ছ’ল করে কিছুসময়ের জন্য সুখী থাকা যায় তবে একটু কষ্ট হলেও যদি সঠিক রাস্তায় চলেন তাহলে সারাজীবন সুখী হতে পারবেন।”

রাদের কথাগুলো পালক চুপচাপ শুনলো।পালকের মনে হয় রাদ সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে।যেটা তার ভালো লাগে।

চলবে……..