শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৪

0
587

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৪
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” কি প্রিসারাণী ছেলেদের ছুঁতে বড়ই ভালো লাগে তাই না?দেখলাম তো কাল রাস্তায় একটা ছেলেকে তোমার নরম নরম হাত দিয়ে মে’রে’ছো।কেউ তো এগিয়ে এলো না,তুমিই এলে।আসলেই কি মে’রে’ছো নাকি মা’রার বাহানায় একটু তার শরীর ছুঁয়েছো?কই আমার সাথে রিলেশন থাকার সময় তো হাতটাও ধরতে দাওনি।নাকি একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”

সাত সকালে এধরণের একটা জ’ঘন্য মেসেজ দেখে প্রিসার মাথা প্রচন্ড গর’ম হয়ে গেলো।প্রিসার বুঝতে বাকি নেই এটা অয়ন পাঠিয়েছে।

” নির্ল’জ্জ,বে’হা’য়া ছেলে।আমার ভাবতেও অবাক লাগে এটা আমার মেজো মামার ছেলে।যেখানে মেজো মামা এতো ভালো সেখানে তার ছেলে এতোটা নিচু মান’সিক’তার অধিকারী ভাবতেও অবাক লাগে।মানুষ কতটা নির্ল’জ্জ হলে নম্বর ব্লক করার পরেও নতুন নম্বর থেকে মেসেজ করতে পারে।এতো কথা বলি তাও নির্ল’জ্জের মতো গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে।ভালোই হয়েছে এই ফা’ল’তু ছেলেটা আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে,না হলে আমাকে শেষ করে দিতো।ওর কপাল ভালো ও আমার মামার ছেলে না হলে মে’রে গাল লাল করে দিতাম।যত্তসব ফা’লতু ছেলে।”

অয়নের এই নম্বরটাও ব্লক করে দিলো প্রিসা।

গোসল করে রান্না ঘরের দিকে যেতেই প্রিসা শুনতে পেলো হাড়িপাতিলের শব্দ।এইসময় তো কেউ রান্নাঘরে থাকে না।তাই সে উৎসুক হয়ে পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে।গিয়ে দেখলো পালক কিছু রান্না করছে।

” বোনু তুই এখন রান্নাঘরে কি করছিস?আজকের নাস্তা কি তুই বানাবি?”

” বানিয়ে ফেলেছি আপু।এখন পায়েস রান্না করছি।”

” হঠাৎ পায়েস কেন?”

” বলবো বলবো।তুই যা মাকে নিয়ে আয়।”

প্রিসা কথা না বাড়িয়ে মায়ের রুমে চলে গেলো।

প্রিসা এবং অনিলা শেখ এসে দেখলেন পালক সকালের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে।একদম সাধারণ নাস্তা।রুটি,ভাজি এবং আজ একটা বিশেষ আইটেম পালকের হাতের পায়েস।টেবিলে পায়েসের বাটি দেখে অনিলা শেখ প্রথমেই প্রশ্ন করলে, ” পায়েস কে রান্না করেছে?আর এতো সকালে পায়েস কেন?”

” আমি বানিয়েছি মা।”

” কিন্তু কেন?শুধু শুধু কেন বাড়তি খরচ করতে গেলি পালক?এখন জিনিসের যে বাড়তি দাম,অতিরিক্ত খরচ কেন করিস বলতো?এমনিতেও হাজার টাকার খরচ তারউপর এখন মাসের শেষের দিক।আমাদের আয় রোজগার কি খুব বেশি?যা আয় হয় তা এদিক ওদিক খরচে চলে যায়,হাতে টাকা থাকে খু্ব অল্প।তাহলে কেন বাড়তি খরচ করে পায়েস বানালি?” কিছুটা রাগ নিয়েই বললেন অনিলা শেখ। ” আর প্রিসা তুই ওকে আটকাতো পারলি না?তোদের দু’বোনকে কত করে বলি বাড়তি খরচ করিস না।আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের বাড়তি খরচ মানায় না।কিন্তু তোরা তো আমার কথা শুনিস না।”

” মা আমি তো জানতাম না।রুম থেকে বেরিয়ে দেখি বোনু রান্না করছে।”

” মা তুমি আপুকে বকোনা।আপু এসবের কিছু জানে না।বসো তোমরা।আগে পায়েসটা খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।”

অনিলা শেখ আরো কিছু বলবেন কিন্তু পালক তাকে বসিয়ে একচামচ পায়েস তার মুখের সামনে ধরলো।তিনিও আর কোন কথা না বলে পায়েসটা খেয়ে নিলেন।প্রিসাও নিজের বাটি থেকে এক চামচ খেলো।

” কেমন হয়েছে?”

দু’জনেই মাথা নাড়িয়ে বললো ভালো হয়েছে।পালক আরেক চামচ পায়েস তার মায়ের মুখের সামনে ধরলো।এবারো তিনি সেটা খেয়ে নিলেন।

” মা আমি জানি আমাদের মতো ফ্যামিলিতে বাড়তি খরচ মানায় না।সবসময় হিসেব করে চলতে হয় ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে হয়।কিন্তু মা তাই বলে কি বিশেষ দিনে একটু আনন্দ করবো না?বড় করে না হোক ছোট করে হলেও আমরা আমাদের বিশেষ দিন আয়োজন করতে পারি তাই না?অন্যদিন দুটো আইটেম খেলে বিশেষ দিনটা নাহয় তিনটে আইটেম খেলাম।তাই আমি নিজের হাতে আজ তোমাদের জন্য পায়েস বানিয়েছি।সামান্য পায়েস দিয়েই না হলে আমরা বিশেষ দিনটা উদযাপন করলাম।”

” বোনু তুই বারবার বিশেষ দিন বলছিস কেন?”

” হ্যাঁ।আর আজ হুট করেই বা পায়েস বানাতে গেলি কেন?”

আরেক চামচ পায়েস মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পালক বললো, ” কারণ আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে মা।আর বেতনও ভালো আপু।এখন তোর কষ্টটা আরেকটু কমবে আপু।এখন থেকে পরিবারে আমি আরেকটু বেশি খরচ দিতে পারবো।”

মেয়ের কথা শুনে অনিলা শেখ থমকে গেলেন।মুখের খাবারটা গলা দিয়ে পুরোপুরি নামলো না।এই কথাটা শুনে প্রিসা লাফ দিয়ে উঠে পালককে জরিয়ে ধরলো।

” সত্যি বোনু?”

” হ্যাঁ আপু একদম সত্যি।এখন আমিও তোকে সংসারের খরচে সাহায্য করতে পারবো।”

বোনের চাকরি হয়েছে শুনে প্রিসা ভিষণ খুশি।এই জন্য নয় যে তার এখন সংসারে খরচ কম দিতে হবে বরং এই জন্য যে তার বোনের একটা ভালো গতি হয়েছে।

” মা তুমি খুশি হওনি?” পালক প্রশ্ন করলো।

অনিলা শেখ চেয়ার থেকে উঠে দুই মেয়ের মাথায় মমতাভরা হাত রাখলেন।

” আমি খুব খুশি।এটা ভেবে খুশি লাগছে যে আমার দু’টো ছোট পুতুল কত বড় হয়ে গিয়েছে।নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে জেনেছে,সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে।আজ যদি তোদের বাবা থাকতো তাহলে তিনিও অনেক খুশি হতেন।তিনি প্রতিদিন বলতেন,অনিলা আমার রাজকন্যা দু’টো যখন বড় হবে,বড় বড় চাকরি করবে তখন আমার এতো পরিশ্রম স্বার্থ হবে।আমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস মানুষটা এতো ভালো সময়ে আমাদের সাথে নেই।” স্বামীর কথা বলতে বলতে অনিলা শেখ কান্না করে দিলেন।পালক এবং প্রিসা মাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।তাদেরও চোখ পানিতে পরিপূর্ণ।

” মা তুমি কান্না করো না।বাবা আমাদের সাথেই আছে।বাবা আমাদের মনে সবসময় বেঁচে থাকবে।” পালক বললো।

” হ্যাঁ মা।বাবা সবসময় দূর থেকে আমাদের দেখছে।বাবা আমাদের সবসময় আগলে রাখছে।কেঁদোনা তুমি।তাহলে বাবা কষ্ট পাবে।” কান্না জরিত কন্ঠে প্রিসা বললো।
.
.

ঘরের সবকাজ শেষ করে প্রিসা প্রতিদিনের মতো স্কুলে চলে এসেছে।কালকে রাস্তায় হওয়া ঘটনাটা স্কুলের সবাই জেনে গিয়েছে।কেউ প্রশংসা করছে,তো কেউ পেছনে সমালোচনা এবং হাসাহাসি করছে।তবে এসবের কোনটাতেই প্রিসা মনোযোগ দিলো না।প্রশংসার পাওয়ার জন্য প্রিসা এসব করেনি আর ভালো কাজের সমালোচনা শুনতে নেই।অন্যদিকে সেই লোকটা আজ প্রিসার পিছু নিয়ে তার স্কুল পর্যন্ত চলে এসেছে।স্কুলের বাইরে সে তার শান্তি নগরের রাজকন্যার জন্য অপেক্ষা করছে।
.
.

পালকের এক স্টুডেন্ট নাকি বিকেলে বেড়াতে যাবে যার জন্য পালক তাকে সকালে পড়িয়ে এসেছে।যার কারণে আজ বিকেলে পালক ফ্রী আছে।পুরোমাসের এরকম দিন হাতেগোনা ১/২ দিন পেয়ে থাকে পালক।প্রিসা এখন বাড়িতে নেই,সেও তার স্কুলের বাচ্চাদের পড়াতে গিয়েছে।তাই পালক ঠিক করেছে বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসবে।হয়তো আরো ১/২ মাস পর সে এরকম একটা দিন পেলো।

পালকদের বাসা থেকে অনুমানিক ১৫ মিনিটের দূরত্বে একটা পার্ক আছে।যখন সে কলেজে ছিলো তখন প্রায় এখানে আসা হতো।কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর সব শখ আহ্লাদ তার কমে গিয়েছে।এরপর হাতেগোনা পাঁচ কি ছয় বার এখানে এসেছে।পার্কে এসে পালকের পুরোন স্মৃতির মনে পড়ে গেলো।সে,তার বাবা,তার বোন কতবার যে এখানে এসেছে।বড় হলেও তাদের বাবা সবসময় দুজনের হাত ধরে রাখতো।পালক মাঝেমাঝে বলেই বসতো,

” বাবা আমরা কি ছোট বাচ্ছা?এভাবে হাত ধরে রাখো কেন?হাতটা ছেড়ে দাও না।”

পালকের কথায় তার বাবা হেসে উওর দিতে,

” বাবা-মায়ের কাছে তার সন্তানরা সবসময় ছোটই থাকে মামণি।তারা বুড়ো হয়ে গেলেও তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছে নবজাতক শিশুর মতোই নিষ্পাপ থাকে।”

” কিন্তু বাবা তুমি সবসময় আমাদের হাত ধরে রাখো কেন?কোথাও গেলে একটুও হাত ছাড়ো না।আমার বন্ধুরা আমাকে ছোট বাবু বলে ক্ষ্যাপায়।” মুখ ফুলিয়ে বললো প্রিসা।এবারো তাদের বাবা হাসি মুখেই বললেন, ” কারণ আমার ভয় হয় আমার রাজকন্যা দুটো যদি হারিয়ে যায়।তারা তো এখনো ছোট,হারিয়ে গেলে তো বাসাও ফিরতে পারবে না।তাই তাদের ছোট ছোট হাত দুটো আমি ধরে রাখি।যেন তারা কখনো হারিয়ে না যায়।”

অতীতে বাবার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো মনে র
পড়লে প্রিসার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।ঝাঁপসা চোখে নিজের হাতের দিকে তাকালো।তার বাবা এই হাতটাই ধরে রাখতো যেন তারা হারিয়ে না যায়।আর আজ যত্ন করে হাতটা ধরার মতো মানুষটা নেই।মেয়েরা হারিয়ে যাবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকতেন তিনি অথচ সময়ের ব্যবধানে আজ তাঁর দুই মেয়েই নিজে নিজে চলতে শিখে গিয়েছে,নিজেরা সংসারের দায়িত্ব নিতে শিখে গিয়েছে।

” বাবা প্লিজ একবার ফিরে এসো।একবার তোমার ছোট রাজকন্যার হাতটা ধরো।আমার যে তোমার হাতটা ধরতে বড়ই ইচ্ছে করছে।বাবা একটি বার ফিরে এসো।” ক্লান্ত স্বরে মনে মনে বললো পালক।

চলবে…….