শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৯

0
601

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রিসা ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।তার দেখাদেখি নিহাদও দাঁড়িয়ে পড়লো।

” মিস্টার নিহাদ এটা হচ্ছে কেজি ডি সেকশন।আপনি কি এর আগে বাচ্চাদের পড়িয়েছেন?”

” না আগে বড় বাচ্চাদের পড়িয়েছি তবে তা বেশ আগে।কিন্তু কোনদিন ছোট বাচ্চাদের পড়াইনি।”

” আপনি পড়বেন তো এদের সামলাতে?এই সেকশন কিন্তু ৭৫+ ছেলেমেয়ে আছে।” একটু চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো প্রিসা।

” চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবো।একটা দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন তাতো পালন করতেই হবে।আমি এবং এবার যাই ভিতরে,নয়তো ক্লাসে সময় শেষ হয়ে যাবে।”

প্রিসা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলে নিহাদ ক্লাসের ভিতরে চলে গেলো।প্রিসা দরজার কাছ থেকে সরে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।অপরিচিত মুখ দেখে বাচ্চারা সবাই শান্ত হয়ে গেলো।নিহাদ খুবই শান্ত এবং মুখে হাসি বজায় রেখে নিজের পরিচয় দিলো।তারপর তাদের পড়ার সাথে সম্পর্কিত একটা মজার গল্প বলতে লাগলো।বাচ্চারা চুপচাপ আগ্রহ নিয়ে নিহাদের বলা গল্প শুনছে।বোঝায় যাচ্ছে নিহাদের কথা বলার ধরণ তাদের আর্কষিত করছে।প্রিসা একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে টির্চাস রুমে চলে গেলে।এই পি’রিয়’ডে তার কোন ক্লাস নেই।
____________________________________________

হাতে কাজ শেষ হওয়া কয়েকটা ফাইল নিয়ে পালক পা বাড়ালো রাদের কেবিনের দিকে।দরজায় হাত দেবে তার আগেই পাশ থেকে কেউ হেন্ডেলে হাত রাখলো।পালক ঘাড় ঘুরিয়ে নোরাকে দেখতে পেলো।নোরা নামের মেয়েটাও তার সাথেই অফিসে জয়েন করেছে।তবে বাকিদের থেকে নোরা একটু বেশিই ভাব নিয়ে চলাফেরা করে।সবসময় সবার সাথে গম্ভীরভাবে কথা বলে।সবসময় একটা ভাব নিয়ে অফিসে চলাফেরা করে যেন এটা তার অফিস।অন্যদের থেকে সাহায্য লাগলে সে নম্রভাবে কথা বলে না উল্টো হু’কু’ম দিয়ে থাকে।

পালক দু’কদম পিছে গেলো।নোরা বাঁকা চোখে পালকের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে ঠকঠক করে জুতায় শব্দ করে ভিতরে চলে গেলো।জুতোর শব্দ শুনে পালক কিছুটা বিরক্ত হলো কারণ হাঁটার সময় জুতোয় শব্দ করা তার মোটেও পছন্দ নয়।তাদের বাবা তাদের বলতেন জুতায় শব্দ করে হাঁটা একধরনের বাজে অভ্যাস।আস্তে করে দরজাটা খুলে পালক ভিতরে ঢুকে পড়লো।

ভেতরে কারো আসার শব্দ শুনে নোরা এবং রাদ দু’জনেই সেদিকে তাকালো।পালককে দেখে যে নোরা বিরক্ত হয়েছে সেটা তার মুখেই বোঝা যাচ্ছে।রাদ পালকের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আবারো ফাইলটা পড়তে লাগলো।

ফাইল চেক করে রাদ নোরাকে নতুন একটা ফাইল দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিলো।চলে আসার সময় সে পালকের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো শব্দ করে বেরিয়ে গেলো।

” আরে পালকসাহেবা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?বসুন,বসুন।”

” কিন্তু আপনি তো নোরাকে বসতে বলেননি।তাহলে আমি কেন?সমস্যা নেই আমি ঠিক আছি।” ইতস্তত হয়ে বললো পালক।

” আরে ওনার কথা ছাড়ুন।আপনি বসুন।উনি আর আপনি মোটেও একি নন।এবার তাড়াতাড়ি বসুন তো।”

পালক আর কথা না বাড়িয়ে রাদে সামনে থাকা একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

” তাজ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি এর ফাইলটার কি কাজ শেষ হয়েছে?তিনদিন পর কিন্তু ফাইনাল মিটিং।আর এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য।ডিলটা কিন্তু হাত থেকে বেরিয়ে গেলে আমাদের লস হতে পারে অনেক।”

” আমি সব ঠিকভাবে দেখে নিয়েছি স্যার।এবার আরেকবার দেখে নিন।আমার থেকে আপনি ভালো বুঝতে পারবেন।”

” আচ্ছা আমি আরেকবার দেখে নেবো।আপনি বরং এই ফাইলটা নিয়ে যান।এটার লাস্ট ডেট কালকে।অফিসেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

” আচ্ছা স্যার।আমি এবার আসি।আমি ছুটির আগেই আপনাকে জমা দিয়ে যাবো।”

” ধীরেসুস্থে কাজ করবেন পালকসাহেবা।আপনার চোখের নীচে তো দেখছি কালো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।এতো কিসের টেনশন?অতিরিক্ত টেনশনে নেবেন না।আস্তে ধীরে সময় নিয়ে কাজ করুন।কোন সমস্যা হলে আমার কাছে চলে আসবেন।”

পালক হালকা হেসে রাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে নিজের ডেস্কে চলে এলো।

অন্যদিকে,

” কাজ হয়েছে?”

” জ্বী স্যার।আমি কয়েকটা ফাইল পেইনড্রাইভ এ কপি করে নিয়েছি।বাসায় গিয়ে আপনাকে সেন্ড করে দেবো।”

” গুড।এরকম আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য নিতে থাকো।তবে খবরদার একদম তাড়াহুড়ো করবে না।একসাথে সব নেবে না।তাহলে সন্দেহ হয়ে যাবে।”

” ওকে স্যার।”

ফোন কেটে দিয়ে ব্যক্তিটি একবার আশেপাশে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে নিজের ডেস্কে এসে বসে পড়লো।

বাচ্চাদের টিফিন ছুটি দেওয়া হয়েছে।সবাই এদিক-ওদিক ছোটছুটি করছে।সব টিচাররা টির্চাস রুমে বসে খাবার খাচ্ছে আর গল্প করছে।খেতে খেতে না চাইতেও প্রিসার চোখ পড়ে যায় সামনের টেবিলে যেখানে স্কুলের ৮/৯ জন স্যারেরা বসে কথা বলছেন আর খাবার খাচ্ছেন।প্রিসা নিহাদকে দেখছে।হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে।প্রিসা ভাবছে কি সুন্দর প্রথম দিনই সবার সাথে মিশে গিয়েছে।কোন দাম্ভিকতা নেই,শান্তভাবে সবার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলছে।প্রিসার কি হলো সে নিজেও জানেনা।না চাইতেও তার মন অয়নের সাথে নিহাদের তুলনা করে বসলো।দু’জনেই একদম বিপরীত মেরুর।অয়নের প্রত্যেকটা কথায় মিশে থাকে অহংকারবোধ,সে খোলামেলা ভালোভাবে কারো সাথে কখনই কথা বলে না।অন্যদিকে নিহাদ তার থেকে একদম বিপরীত।আচমকা প্রিসা নিজের ভাবনায় ইতি টানলো।এধরণের ভাবনা দেখে প্রিসা খানিকটা বিব্রত হলো।তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে খাবারো মনোযোগ দিলো।অন্য স্যারদের সাথে কথা বলতে বলতে নিহাদ একপলক প্রিসার দিকে তাকালো।তখন অন্য টিচারদের সাথে কথায় ব্যস্থ থাকায় প্রিসা তা খেয়াল করেনি।

লাঞ্চ টাইমে অফিসের প্রায় সবাই ক্যান্টিনে চলে যায়।কেউ সেখান থেকে খাবার কিনে খেয়ে থাকে আবার কেউ বাড়িতে থেকেই নিয়ে এসে ক্যান্টিনে বসে খায়।তবে পালক নিজের ডেস্কেই লাঞ্চ করে থাকে কারণ এখনো পর্যন্ত অন্যকারো সাথে তার খুব একটা সখ্যতা গড়ে উঠেনি।তবে আজকের ঘটনা কিছুটা ব্যতিক্রম হলো।লাঞ্চ টাইম শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট পর ইয়াসিন এসে পালককে বলে গিয়েছে যেন তার লাঞ্চ নিয়ে সে রাদের কেবিন যায়।ইয়াসিনের কথা শুনে পালক কিছুটা অবাক হলো তবে ব্যপার কি বুঝতে না পেরে কৌতুহল নিয়ে সে এলো রাদের কেবিনে।

” স্যার ডেকেছিলেন?”

” অবশ্যই।বসুন,বসুন।”

বসতে বসতে পালক জিজ্ঞেস করলো, ” কোন সমস্যা স্যার?কোন কাজ বাকি আছে কি?থাকলে বলুন আমি এখুনি করে দিচ্ছি।”

” না না কোন কাজ নেই।আসলে অন্যদিন আমি আমার মুলার সাথে লাঞ্চ করি কিন্তু আজ তার কিছু জরুরি কাজ আছে তাই সে চলে গিয়েছে।সবসময় একা খেতে ভালো লাগেনা আর অফিসে তো আমি মুলার পর আপনাকেই বেশি বিশ্বাস করি।তাই ভেবেছি আজকে না হয় আপনার সাথে লাঞ্চ করি।আপনি কি আসার সাথে আজকের লাঞ্চ করবেন?”

পালক না করতে চাইলো তবে রাদ অনেক আশা নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছে তাই পালক আর বারণ করতে পারেনি,রাজি হয়ে গেলো।পালক রাজি হওয়াতে রাদ যে বেশ খুশি হয়েছে তা তার চেহারা দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে।

” কি হলো স্যার আপনি না খেয়ে বসে আছেন কেন?”

” কি খাবো?খাবারই তো এখনো এলো না।” ঠোঁট উল্টে বললো রাদ।

” আপনি কি বাড়ি থেকে খাবার আনেন না?”

” না,বাড়িতে খাবার বানিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই।তাই আমি ক্যান্টিন থেকে খাবার খেয়ে থাকি আর মাঝে মাঝে মুলা তার বাড়ি থেকে আন্টির রান্না নিয়ে আসে।কিন্তু এখন তো কোন রাস্তা খোলা নেই তাই যাওয়ার সময় মুলা পিয়ন আঙ্কেলকে বলে দেবে বলেছিলো কিন্তু এখনো তো এলো না।”

পালক কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলো কিছু একটা।তারপর বললো, ” আপনার কেবিনে কি প্লেট আর চামচ আছে?”

” হ্যাঁ আছে কিন্তু কেন?”

” কোথায় আছে সেগুলো?”

রাদ আঙ্গুল দিয়ে রুমের একটা কোণায় থাকা স্ফেল দেখিয়ে দিলো।পালক চেয়ার থেকে উঠে একটা প্লেট,গ্লাস এবং চামচ নিয়ে সেগুলো পাশে থাকা বেসিনে ধুয়ে আবার টেবিলের কাছে ফিরে এলো।তারপর নিজের টিফিন বক্স থেকে কিছুটা ভাত,ভাজি এবং মাছটা প্লেটে নিয়ে রাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

” এগুলো কি করছেন আপনি?”

” এগুলো আমার মায়ের রান্না।খেয়ে বলুন তো আমার মায়ের রান্না কেমন।”

” কিন্তু এগুলো তো আপনার খাবার।”

” হ্যাঁ জানি।কথায় আছে শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং।তাই আমি আজকে আমার খাবার আপনার সাথে শেয়ার করছি।এবার তাড়াতাড়ি খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে।”

হাত ধোঁয়ার জন্য রাদকে একটা বাটি এনে দিলো পালক।এক লোকমা খাবার খেয়েই রাদের মনটা তৃপ্তিতে ভরে গেলো।পালক কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে রাদ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে খাবারে মনোযোগ দেয়।রাদকে এতো তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখে পালকের অধরে হাসি ফুটলো।

চলবে………