#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২৮
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” আরে আরে বর ছাড়াই বিয়ে শুরু করে দিয়েছো তোমরা?একটু অপেক্ষাও করতে পারলেনা তোমরা।ইশ….কত অধৈর্য্য তোমরা।”
পেছনে তাকাতেই সবার চোখ অতিমাত্রায় অবাক হওয়ায় কারণে বড় বড় হয়ে গিয়েছে।সবাই থমকে গিয়েছে,অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আছে সামনে।রাদ এবং ইয়াসিন এসেছে।তবে অবাক হওয়ার কারণ তা নয়,রাদ নিজের পা হাঁটছে।পালক কয়েকবার চোখের পলক ফেললো।না সে ঠিকই দেখছে,রাদ নিজের পায়ে হেঁটে তার সামনে দাঁড়িয়েছে।চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে তার।
” রাদসাহেব তুমি!”
” রাদ বাবা তুই আবারো হাঁটতে পারছিস।দেখো তোমরা সবাই আমার রাদ আবারো নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।দেখো,সবাই দেখো।আমার ছোট রাদটা আবারো নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।” নূরজাহান বেগম শব্দ করে কান্না করে দিলেন।রাদ ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন। ” ফুপি কেঁদোনা।আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গিয়েছি না।এখন কান্না করা বন্ধ করো।” রাদ যত্ন করে নূরজাহান বেগমের চোখের জল মুছে দিলেন।ঘাড় গুঁড়িয়ে পেছনে তাকালো রাদ।ছলছল করে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে এখনো রাদের দিকে তাকিয়ে আছে পালক।চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বললো রাদ।
” এখানে কি হচ্ছে ফুপি?আর আয়নার চোখমুখের এই অবস্থা কেন?কিরে আয়না আমি চলে যাওয়ার পর তোকে কি খেতে দেয়নি নাকি?মনে হচ্ছে অনেকদিনের ক্ষুর্ধাত।”
রাদের কথা শুনে আয়না ফুঁপিয়ে উঠলো।
” আদিব আর কতটা সময় আমরা অপেক্ষা করবো?বিয়ের কাজ শুরু করো।”
” হ্যাঁ?ও হ্যাঁ।কাজী সাহেব আপনি শুরু করুন।আজ আমাদের তো দিগুণ খুশি।রাদ নিজের পায়ে হাঁটতে পারছে,সেইসাথে আমার মেয়েটারও আজ বিয়ে।শুরু করুন আপনি।”
” আরে ফুফা দাঁড়াও।আগে বরকে তো একটু তৈরি হওয়ার সুযোগ দাও।তোমরা তো দেখছি অনেক অধৈর্য্য।আচ্ছা যাও তোমাদের সময় আর নষ্ট করবোনা।মুলা দেখি আয়নার পাশে গিয়েছে চটপট করে পড়ো তো।সরি মুলা তোমাকে এই ঘামে ভেজা শার্ট প্যান্ট পড়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে।”
” আদিব এখানে কি হচ্ছে শুনি?একটু পরিষ্কার করে বলো তো।”
” লিমন তুমি একটু শান্ত হও।এই কেউ ওদের একটু শরবত দাও।”
আদিব সাহেব দ্রুত রাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
” এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?আর এসব কি বলছো?দেখো রাদ প্লিজ কোন কিছু করোনা।বিয়েটা হয়ে যেতে দাও তারপর আমি বসে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো।এখন দয়া করে তোমার মুখটা বন্ধ রাখো।আর হ্যাঁ এই ছেলেকেও নিয়ে যাওয়া।”
” আরে ফুফা বরকে নিয়ে গেলে বিয়ে হবে কি করে?মুলা তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো বসো।”
আয়নার পাশে বসা ছেলেটাকে হাসতে হাসতে তুলে দিলো রাদ এবং সেখানে ইয়াসিনকে বসিয়ে দিলো।ইয়াসিন চুপচাপ শুধু সব দেখে যাচ্ছে কিছুই বলছেনা।
” দেখুন আপনারা কি হচ্ছে কি হচ্ছে রেডিও আবার বাজানোর আগে আমি বলে দি আয়না আর ইয়াসিন হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা তাও আবার দু’বছর ধরে তাদের গাড়ি চলছে।তাঁদের ট্রেন বিশ্রামের জন্য যেই একটু থামলো ওমনি বিনা টিকেটে চো’রের মতো আপনার উঠে পড়েছেন।এটা কি ঠিক বলুন?ওদের সেই ট্রেনের টিটি হচ্ছি আমি।এখন আমারো তো একটা দায়িত্ব আছে তাই নয় কি।এখন আপনারা তো বিনা টিকেটে ট্রেনে উঠে পড়েছেন।তাই আমার কাজ আপনাদের তুলে টুপুস করে ট্রেন থেকে ফে’লে দেওয়া।”
রাদ হাসি মুখে বললেও তার কথা শুনে ওনারা বেশ অপমানিত হলেন এবং রেগে গেলেন।
” আদিব তুমি এরকম বা’টপা’রি করবে আগে জানতাম না।আমাদের এতো আদরযত্ন করে ডেকে এনে তুমি এভাবে হাঁটুর বয়সী একজন ছেলেকে দিয়ে আমাদের অপমান করাবে সেটা আমরা ভাবতে পারিনি।চলো সবাই,ওর সাথে তো আমি পরে কথা বলে নেবো।”
ছেলের বাড়ির সবাই চলে গেলো।আদিব সাহেব চেয়েও থামাতে পারলেন না।
” রাদ এসব কি নাটক হচ্ছে?আর এই ছেলে তুমি এখনো ওখানে বসে আছো।লজ্জা করছেনা তোমরা।এই তোমার ক্ষমতা আছে আমার মেয়েকে বউ করে নিয়ে যাওয়ার?যার নিচে কাজ করো তারই মেয়ের সাথে প্রেম করতে লজ্জা করেনি।” চেঁচিয়ে বললেন আদিব সাহেব।ওরা চিৎকার শুনে পালক কেঁপে উঠলো।এতোদিনে কোনদিন আদিব সাহেবকে রাগতে দেখেনি পালক।এখন ওখানে ভয়ানক রকমের হিং’স্র লাগছে।ভয়ে পালকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।তার মনটা আনচান আনচান করছে,মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে।
” আরে ফুফা এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন।কুল কুল,নাও নাও শরবত খাও।আর ইয়াসিন তোমার হয়ে না আমার অফিসে কাজ করে।আর ফুফা তুমি তো আর ওসব হি’ট’লার বাপ না যে মেয়ের ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়ে তাকে জোড় করে নিজের লাভের জন্য বিয়ে দেবে।তাই না?তুমি তো অনেক ভালো,দয়ালু তাই না।এতো রাগ করো নাতো ফুফা।বিয়েটা হয়ে যেতো দাও,না হলে দেখা যাবে পালিয়ে গিয়েছে।তখন তোমার অসম্মান হারাবে।কি বলো ফুপি?কাজী সাহেব আপনি জলদি বিয়ের কাজ শুরু করুন।আমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে।বিরিয়ানির গন্ধ আসছে দেখছি।তাড়াতাড়ি বিয়ে শেষ করুন,আমি বিরিয়ানি খাবো।”
ইয়াসিন অসহায় চোখে রাদের দিকে তাকালো।রাদ ভ্রু-নাচিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিলো।
.
.
বিছানা একহাত লম্বা ঘোমটা টেনে বসে ছিলো আয়না।ইয়াসিন ভয়ে ভয়ে বিছানা মাত্র বসেছিলো কিন্তু আয়নার চিৎকার শুনে ছিটকে দূরে সরে গেলো।একটানাকে ঘোমটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো আয়না।
” খবরদার একদম আমার বিছানা বসবেন না।আমার থেকে একশো পা দূরে থাকবেন।”
” কেন বউ?এখনতো কোন বাঁধা নেই।”
” আপনার বাঁধার কাঁথায় আগুণ।ভিতু জুতো চো’র,কতবার বলেছি বাড়িতে বলে দিন।কিন্তু উনি তো মুরগীর ডিম,নিজে তো বলেনি আর না আমাকে বলতে দিয়েছে।আজ যদি রাদ ভাইকে আমি লুকিয়ে না জানাতাম তাহলে কি হলো জানতেন কিছু?ভাগ্যিস রাদ ভাইকে আমি আগেই সব জানিয়ে দিয়েছি না হলে তো আমি আপনাকে চিরদিনের জন্য হা’রি’য়ে ফেলতাম।” শেষের কথাগুলো বলার সময় আয়নার কন্ঠ কেঁপে উঠলো।ইয়াসিন ধীর পায়ে এগিয়ে আয়নার মাথাটা নিজের বুকে রাখলো।
” একদন কান্না করবেনা ভাঙা আয়না।যেটা হয়নি সেটা ভেবে শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছো কেন?এখন তো আমরা একসাথে আছি আর সারাজীবনের জন্য এক হয়ে গেলাম।এখন ভাঙা আয়না আর জুতো চোরকে মৃ’ত্যু ছাড়া কেউ আলাদা করতে পারবেনা।”
অতিবাহিত হয়ে গেলো কিছু সেকেন্ড।নিশ্চুপ হয়ে রইলো দু’জন।আচমকা আয়না ইয়াসিনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।
” শুনুন জুতো চোর ইয়াসিন এই মিষ্টি মিষ্টি কথায় আমি গলছি না।আপনি আজকে বিছানায় থাকবেন না,মানে না।”
” কিন্তু কেন?” অসহায় ভাবে বললো ইয়াসিন।
” কেন মনে নেই।সেইদিন আমি মুভি দেখছিলাম আর আপনি সেইসময় ফোন করে আ’জা’ইরা কথা বলে আমার মুভি দেখার মুডটা নষ্ট করে দিয়েছিলেন?আমি বলেছিলাম না সেদিন এর শাস্তি আপনাকে দেবো।এটা হচ্ছে সেইদিনের শাস্তি।এখন শুরু হবে আমার শাস্তিময় জীবন।এতোদিন আমাকে যত জ্বালিয়েছেন তার সবকিছুর জন্য আপনার শাস্তি হবে এটা আয়না তার আদালতে দাঁড়িয়ে শেষ সিদ্ধান্ত জানালো।”
.
.
” তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে রাদসাহেব?পুরো একটা মাস তুমি বাইরে ছিলে।আর আজ একমাস পর ফিরে এলে কিন্তু তুমি গিয়েছিলে একরকম ফিরেছেন অন্যরকম!আমাকে কি একটু বুঝিয়ে বলবে?” অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করলো পালক।পালকের অস্থিরতা দেখে রাদ হাসলো তবে কোন উওর দিলোনা।
” কি হলো আমার কথার উওর দিচ্ছোনা কেন?তি এতোদিন কোথায় ছিলে?”
রাদ একদম পালকের সামনে এসে দাঁড়ালো।খানিকটা মাথা উঁচু করে রাদের দিকে তাকালো পালক।পালক ভেবেছিলো রাদ তার থেকে অল্প লম্বা হবে কিন্তু দাঁড়ানোর পর বুঝতে পারলো রাদ তার ধারণা থেকে একটু বেশি লম্বা।
” সিঙ্গাপুর ছিলাম আমি আর ইয়াসিন।ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।তোমাদের সারপ্রাইজ দেবো বলেই কিছু বলিনি।আমার পরিকল্পনা ছিলো অন্যরকম কিন্তু আয়নার ফোন পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।” কথার মাঝে রাদ খেয়াল করলো পালক তার পায়ের দিকে দিয়ে তাকিয়ে আছে।তার মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে রাদ জিজ্ঞেস করলো,
” ওভাবে কি দেখছো?”
” তৃমি সত্যিই হাঁটতে পারছো রাদ?নাকি এটা আমার স্বপ্ন,যেটা ঘুম ভাঙালেই ভেঙে যাবে?”
রাদ পালককে কোলে তুলে নিয়ে কয়েকপা হাঁটলো।তারপর থেমে গিয়েছে বললো, ” এবার বিশ্বাস হলো তো?”
ছলছল চোখে মুখে হাসি রেখে পালক হ্যাঁ বোধ মাথায় নাড়ালো।কোলে থাকা অবস্থায় রাদের গলা জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করে দিলো পালক।
.
.
উওরের আশায় রাদের দিকে তাকিয়ে আছে ইয়াসিন তবে রাদ কিছু বলছেনা।
” স্যার আপনি কি পালককে কিছু বলবেন না?বলে দিন না স্যার।যদি সে অন্যকারো কাছ থেকে ব্যপারটা জানতে পারে তাহলে আরো সমস্যা হবে।” চিন্তিত স্বরে বললো ইয়াসিন।রাদ ঘুরে ইয়াসিনের দিকে বসলো।
” কার থেকে জানতে পারবে?এই ব্যপারটা আমি আর তুমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।আশা করছি তুমি বলবোনা কাউকে।”
” কিন্তু স্যার এসব করার কি দরকার ছিলো?সেদিন প্ল্যান করে মেলায় না গিয়েছে,এই ঘর,গ্রামের লোকজনকে মিথ্যা ইনফরমেশন এতো কিছু না করে সোজা ওনাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন তাহলেই তো হতো।আপনি তো কোন দিকে খারাপ নন,আপনাকে তারা মনে তো নিতে।তাহলে এসবের কি দরকার ছিলো?”
” মুলা তোমার না বাদাম খাওয়া দরকার।এতো কিছু মনে রাখলে তবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই তুমি লক্ষ্য করোনি।”
” কি স্যার?”
” ভেবে দেখো ইয়াসিন,সেদিন আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন।পরিকল্পনা ছিলো আমি অসুস্থ হওয়ায় ভান করবো,আমার সাথে তুমি আর পালক থাকবে।তুমি সাহায্য আনার ভাহানা দিয়ে চলে যাবে এবং গ্রামের মানুষদের ভুল তথ্য দিয়ে আমাদের কাছে পাঠাবে।আমি জানতাম তারা এরকমই কিছু একটা করবে নয়তো বাড়ির লোকেদের ফোন করবে।কিন্তু এসবের মধ্যে একটা জিনিস যেটাতে আমাদের কারো কোন হাত ছিলোনা।”
” কি স্যার?”
” বৃষ্টি।ইয়াসিন বৃষ্টি হচ্ছে প্রকৃতির জিনিস।এখানে আমাদের কোন হাত নেই।দেখো সেদিন আচমকাই বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো,আমাদের আর কষ্ট করতে হয়নি সব নিজে থেকেই হয়ে গিয়েছে।কথায় আছে ভাগ্যে কোন কিছু থাকলে সেটা সে পাবেই।আমার ভাগ্যে পালক ছিলো,তাই এমনি হোক বা ওমনি তাকে আমি নিজের করে পেয়েছি।”
” কিন্তু স্যার বৃষ্টি যদি না আসতো?”
” উফ…মুলা তোমাদের এই এক সমস্যা।যেটা হয়ে গিয়েছে সেটার মধ্যে না আসতো ব্যপারটা কেন আনো বলো তো।”
” কিন্তু স্যার এতো সব না করে সরাসরি বললেই তো কাজ হতো।”
” হতো না মুলা হতোনা।হুট করে না জানিয়ে বিয়ে না করলে আমি পালককে পেতাম না বরং ঝা’মে’লা হতো অনেক।তুমি তো জানোই তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?শোন ইয়াসিন তোমাকে আমি বড়ই বিশ্বাস করি।আমার বিশ্বাস তুমি ভেঙোনা,তাহলে আমি শে’ষ হয়ে যাবো।”
চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো রাদ।মাথানিচু করে বসে রইলো ইয়াসিন।বুক কাঁপছে তার,চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো।
চলবে…….