#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
বর্তমানে পালকের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নিহাদ এবং রাদ।
” তুমিই তাহলে রাদ।’
” জ্বি ভাইয়া।বিয়ে বুঝি দেখননি?”
” দেখেছি তবে আজ অন্যরকম লাগছে।জানো প্রিসা প্রায়সময় আমাকে বলতো কবে তুমি নিজের পায়ে হাঁটতে পারবে।তোমাকে নিয়ে ওর খুব টেনশন হতো।”
” আমি জানি প্রিসাপু আমাকে নিয়ে চিন্তা করে।আমার পরিবারের ব্যপারে জানার পর থেকে আপু আরো বেশি চিন্তা করে।আপু পালককে ফোন করলেই আমার কথা জিজ্ঞেস করতো।আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিলো আর দেখাও হয়ে গেলো আজ।”
” উফ….রাদ তুমি আপনি বলাটা বন্ধ করো।তুমি বলো তুমি।তুমি হচ্ছে আমার একমাত্র শালীকার একমাত্র বর।তুমি হচ্ছো আমার শাশুড়ী মায়ের লিটল জামাই বাবা,আপনি বললে পর পর লাগে।আর আমরা পাঁচ-ছয় বছরেরই তো বড়-ছোট।” রাদের কাঁধে হাত রেখে বললো নিহাদ।রাদ বুঝতে পারলো নিহাদকে আসলে সে যেরকমটা ভেবেছে সে আসলে তা নয়।নিহাদও তার মতো হাসিখুশি মানুষ।
” ওকে নিহাদ ভাইজান।আচ্ছা নিহাদ ভাই তোমার আর প্রিসাপুর বিয়েটা লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ ?”
” আমাদেরটা হচ্ছে লাভ এরেঞ্জ ম্যারেজ।মানে মাঝামাঝি।আমার দিক থেকে লাভ ম্যারেজ আর প্রিসার দিক থেকে এরেঞ্জ।আমাদের কাহিনী নরমাল কাপেলদের মতো।তুমি তোমাদেরটা বলো,তোমাদেরটা কি?তোমাদের ব্যপারে তো আমি ভালো মতো জানিনা।তোমার ব্যপারে জানার জন্যই তো তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম।”
” আমাদেরটা হচ্ছে হুট করে ম্যারেজ।” বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রাদ।বেশ অনেকটা সময় তারা দু’জন ছাদে বসে গল্প করলো।
নতুন জামাইরা শশুড় বাড়িতে এসেছে,সেইসাথে রাদের পা ঠিক হয়ে গিয়েছে শুনে পালকদের মামার বাড়িসহ খুব কাছের আত্নীয়রা তাদের বাড়িতে এসে ভিড় করেছে।মেহমানদের জন্য দু’জামাই বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরতি বাজার করে এনেছে।বাজার থেকে ফিরে আসার পর সবাই রাদকে ঘিরে ধরেছে,বারবার তার পায়ের দিকে তাকাচ্ছে।এতো এতো মহিলাদের মাঝে রাদ পড়ে গিয়ে ফ্যাঁসাদে। রাদের অবস্থা দেখে নিহাদ হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে গেলো,মা-মেয়েদের সাহায্য করতে।
দুপুরের খাবার রাদ এবং নিহাদ নিজ হাতে সবাইকে পরিবেশন করলো।অনিলা বেগম বেশ কয়েকবার তাদের বারণ করেছে কিন্তু তারা অনিলা বেগমও বসিয়ে দিলো এবং যত্ন সহকারে সবাইকে পরিবেশন করতে লাগলো।পালক এবং প্রিসা তাদের রান্নাঘর থেকে খাবার এনে দিচ্ছে সেইসাথে মুগ্ধ নয়নে তাদের স্বামীকে দেখছে।দু’জনেই মনে মনে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো তাদের এতো ভালো জীবনসঙ্গী দেওয়া জন্য।
খাবার টেবিলে সেইসময় উপস্থিত ছিলো দীপ্তিও।সে খাবার থেকেও বেশি দেখছে নিহাদ এবং রাদকে।বিশেষ করে নিহাদকে কারণ নিহাদকে অয়নের বন্ধু হিসেবে সে বেশ ভালো করেই চেনে।কিন্তু নিহাদ তার সাথে বিশেষ কোন কথা বললোনা।খাবার পরে দীপ্তি বেশ কয়েকবার নিহাদের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু নিহাদ সেটা বুদ্ধিমত্তার সাথে এড়িয়ে গিয়েছে।
.
.
গ্রীষ্মকাল হওয়ার দরুন বাইরে অত্যাধিক ঘর।ফ্যান ছেড়ে থাকলেও গরমভাব কমছেনা।মাথার উপর মৃদুভাবে ঘুরছে ফ্যান,বিদ’ঘুটে শব্দ করছে সেটা।এতো কম বাতাসে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে মাহাবুব সিনহা।কাল রাতে একটা গোপন জায়গা থেকে ফিরছিলেন সেইসময় কেউ তাকে তুলে নিয়ে এসেছে।
নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেলো জুতোর শব্দ।অন্ধকারে মধ্যে মাহাবুব সিনহা লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলেন।রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
” এই কে রে?কার এতো বুকের পা’টা যে মাহাবুবকে তুলে এনেছে।কিরে অন্ধকারে মধ্যে লুকিয়ে আছিস কেন?তুলে এনেছিস আবার অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আছিস।সাহস কি শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি?”
অপরের পাশের ব্যক্তিটি কিছু বললোনা।কয়েকমিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর মাহাবুব সিনহা কিছু আঁচ করবে তার আগেই লোকটা তার গালে কিছু একটা ছুঁয়ে দিলো।কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই মাহাবুব বুঝতে পারলো তার ডান গালটা জ্ব’ল’ছে।বুঝার পরে মাহাবুব কিছু বলবে তার আগেই বাম গালেও একিভাবে সে জ্বা’লা অনুভব করলো।দু’গাল থেকেই যে র’ক্ত পরছে সেটা মাহাবুবের বুঝতে অসুবিধে হলো না।
” কিরে ভি’তুর বা’চ্চা অন্ধকারে থেকে আ’ঘা’ত করছিস কেন?মুখোমুখি এসে আ’ঘা’ত কর।দেখি তোর বুকে কত সাহস এই মাহাবুবকে সামনাসামনি আ’ঘা’ত করার।”
” কে বলেছে আমি আ’ঘা’ত করছি?মোটেও না,আমরা এটা করেছি যেন গালের দাগটা যখনই দেখবেন তখনই যেন আমাদের কথা মনে পড়ে,আপনার কৃতকর্মের কথা মনে পড়ে।”
” এই কেরে তুই?”
দরজা খোলার শব্দ শোনা গেলো।কয়েক মিনিট পর লোকটি ধীর কন্ঠে বললো,
” ৪ই জানুয়ারি,মধুপুর ব্রিজ।”
কয়েক সেকেন্ড পরিবেশ একদম শান্ত থাকলো।
” রাদ?”
” আমি জানতাম আপনি আমাকে ঠিকই চিনতে পারবেন কিন্তু একটাই আফসোস আপনি অবাক হলেন না।অবশ্য তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।” লাইটটা অন করে মাহাবুব সিনহার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসলো রাদ।
” দেখুন দেখুন আমার পা।সুন্দর না?’
” দেখো রাদ যা হয়েছে তা হয়েছে।এখন এসব ছেড়ে নিজেকে ভালো রাখতে মন দাও।আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে অনেক বড় বড় প্রজেক্ট পাইয়ে দেবো,যেগুলোর মাধ্যমে তুমি অনেক অনেক টাকা কামাতে পারবে।তোমার ভালোর জন্য বলছি ছেড়ে দাও এসব,নয়তো বিপ’দে পড়বে।সুস্থ হয়েছো,ভালোভাবে আরাম-আয়েশ করে জীবনপার করো।এসব ঝামেলাতে জরিয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা।”
” আচ্ছা ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম সব। তার বদলে আপনি আমাকে আমার পরিবারের মানুষ ফিরে দিন।”
” পাগল নাকি তুমি?ম’রা মানুষদের কি করে ফিরিয়ে আনবো?”
” উপস…..তাহলে সরি আঙ্কেল আপনার প্রস্তাবটাও আমি মানতে পারছিনা।”
” রাদ ভেবেচিন্তে কাজ করবে।নিজের বি’প’দ নিজে ডেকে এনো না।”
উঠে দাঁড়ালো রাদ।
” আপনি আমার থেকে বয়সে বড় কিন্তু সরি আঙ্কেল আমি এটা করবো।”
মাহাবুব সিনহা কথা অর্থ বোঝার আগেই রাদ ওনাকে থা’প্প’ড় মেরে বসলো।মাহাবুব সিনহা হতভম্ব হয়ে গেলেন।অবাক হয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।রাদ শান্তিদৃষ্টি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
” মনে আছে সেদিন আমার মণিকে আপনি এভাবেই থাপ্পড় মেরেছিলেন?কত খুশি মনে আমরা আমাদের বাড়ি ফিরছিলাম।আচমকা থমকে গেলো আমাদের হাসি,বাতাস ভারী হয়ে গেলো আ’র্ত’নাদে।আমার মণির না অনেক শখ ছিলো সে সংবাদিক হবে।সবার সাথে লড়ে সে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করেছে,সাংবাদিক হয়েছে।কি দোষ ছিলো তার?কি দোষ ছিলো যে তাকে তার প্রাণটা হা’রা’তে হলো?সে তো শুধু তাকে দেওয়া কাজটাই করছিলো।আমার এখনো মনে আছে সেইদিন তোরা আমার মণিকে চু’ল ধরে আমাদের উলটে যাওয়ার গাড়ি থেকে টে’নে হিঁ’চ’ড়ে বের করেছিলি।মণি কত কাকুতি মিনতি করলো কিন্তু তোরা শুনছিলিনা।আমার মণির মুখে কাঁ’চ ঢু’কে গিয়েছিলো কিন্তু তোরা তা দেখছিসনি।সেই কাঁচ ঢুকে থাকা গালে তোরা অনবরত থা’প্প’ড় মরলি।র’ক্ত আমার মণির গলা বেয়ে পড়ছিলো কিন্তু তোরা পাষাণ কী’টগুলো তা দেখলিনা।আমার মণি পে’টে লা’ত্থি মে’রেছিলো শাকিল হোসেন।তূর্য মিত্র আমার মণির মুখকে জু’তো দিয়ে চে’পে ধরছিলো।তার মুখে কাঁ’চগুলো আরো বেশি করে ঢু’কে যাচ্ছিলো।চিৎকার করছিলো আমার মণি কিন্তু তোরা কেউ শুনছিলাম।কাদের আলী তার নোংরা হাত দিয়ে আমার বোনকে বা’জে ভা’বে ছুঁ’য়ে’ছে।শেষবার যখন তোরা মণির সাথে দেখা করেছিস তূর্য মিত্র তখন মণি বাজে প্রস্তাব দিয়েছে,চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলেছে।সেইরাতে আমি অ’ধ’ম ভাই চোখের সামনে এসব হতে দেখেও কিছু করতে পারলাম না।আমার বাবা-মা অজ্ঞান হয়ে গাড়িতে পড়ে আছে,বোনকে তোরা ক’ষ্ট দিচ্ছিস কিন্তু কেউ এলোনা।উঠতে চেষ্টা করে অনুভব করলাম আমার পা জোড়া নড়ছেনা।বুঝলাম হাঁটার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছি।আস্তে আস্তে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো,ঝাপসা চোখে দেখছিলাম আমার মণিকে তোরা কষ্ট দিচ্ছিলিস।ভেবেছিলাম আমার চোখ আর খুলবে না।কিন্তু আমি চোখ খুলেছি।এতোই অভাগা আমি নিজের পরিবারকে শে’ষবারের মতোই দেখতে পারিনি।তোদের চাইলেই আমি ক’ষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মারতে পারতাম কিন্তু আমি তা করছিনা কেন জানিস?কারণ আমি চায়না তোদের মে’রে নিজের জীবনটা চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে।তোদের আমি অন্যভাবে ক’ষ্ট দিতে চাই,মানসিকভাবে কষ্ট দিতে চাই।তোদের অনেক সম্মান না?মানুষ তোদের কেন ভালো মানুষ করে,তোদের কা’লো টাকার ক্ষু’দ্র একটা অংশ তোরা দান করিস সবার চোখে মহান হওয়ার জন্য।ক্ষমতা ক্ষমতা ক্ষমতা,এই ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য তোরা অনেক অনেক পাপ করেছিস।আমি তোদের এই ক্ষমতাটাই তোদের থেকে কেঁড়ে নেবো।সবার সামনে তোদের ন’রকে’র কী’ট থেকেও বেশি খারাপ বানাবো যেন মানুষ তোদের জু’তো ছুঁ’ড়ে মা’রে।মানসিকভাবে তোদের একেবারে শেষ করে দেবো।যে পেনড্রাইভের খোঁজে তোরা আমার মণিকে মেরেছিস সেই পেনড্রাইভ মণি আমার বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিলো।মণি হয়তো বুঝতে পেরেছিলো তোরা তাকে বাঁ’চ’তে দিবিনা,তাই সে আমার কাছে রেখে গিয়েছে।যাদের সত্যিটা মানুষের সামনে আনার জন্য আমার মণি এতো কিছু করেছে তাদের আমি কি করে ছেড়ে দি।তৈরি থাকানু মাহাবুব সিনহা,কাল সকালে সব জায়গায় শুধু একটাই নাম থাকবে মাহাবুব সিনহা,খুনি,প্রতারক মাহাবুব সিনহা।স্যাম….”
দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো ইয়াসিন।রাদ চোখের ইশারা করতেই ইয়াসিন ওষুধ দিয়ে মাহাবুব সিনহাকে অজ্ঞান করে দিলো।এখন তারা শুধু পুলিশকে ফোন করবে বাকিটা তারাই দেখে নেবে।পুলিশ স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বেই তারা সবপ্রমাণ সোশাল মিডিয়াতে পাবলিশ করে দিলো।যেহেতু মাহাবুব সিনহা পরিচিত একজন মানুষ ছিলেন তাই নিউজটা ভাইরাল হতে বেশি সময় লাগলোনা।রাদ ফোনে এসবই দেখছে।চোখ বয়ে পানি পড়ছে তার।এতোক্ষণে শক্রর সামনে শক্ত থাকলেও সে অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে।ইয়াসিন এসে রাদের কাঁধে হাত রাখলো।
” কান্না করবেন না স্যার,মণি কষ্ট পাবে।খা’রা’প মানুষের সত্যি সামনে আনার জন্য মণি অনেক কষ্ট করেছে,আপনি তা সম্পূর্ণ করেছেন।এখন কান্না করলে মণি যে খুশি হতে পারবেনা।”
” আমি নয় আমরা।তুমি না থাকলে আমি হয়তো অনেক আগেই পৃথিবীর মা’য়া ত্যা’গ করতাম।তোমার মতো একজনকে পেয়ে আমি ধন্য মুলা।অনেক চমৎকার একজন মানুষ তুমি।আমার থেকে বয়সে ছোট হয়েও কি সুন্দর আমাকে আগলে রেখেছো।তুমি না থাকলে আমি একা এই পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁ’চ’তে পারতাম না।হা’রি’য়ে যেওনা তুমি,আবারো আপন মানুষকে হা’রি’য়ে ফেললে আমার জীবনের ই’তি ঘটে যাবে।”
চলবে……..