শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-০৯

0
164

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৯|
সাদিয়া মেহরুজ

নির্জন অরণ্য। অবনীতে মধ্যাহ্নের বিচরণ। শুকনো পাতা ঝরে পড়ে লেপ্টে রয়েছে ভূমি জুড়ে। হীম শীতল সমীরে নৃত্য করছে বৃক্ষের পাতা গুলো। বুনো ফুলের মাদক মাদক সুভাসের রাজত্ব তখন অরণ্য জুড়ে।নাম না জানা পুষ্প আপন চিত্তে ফুটে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে সবুজ কাননে। পক্ষীরাজের অবাধ গুঞ্জন। ভীষণ সাবধানে কদম ফেলে এগোচ্ছে মেহতিশা। সঙ্গে ক্ষণকাল বেমালুম ভুলে নেত্র দিয়ে অহংকারী অরণ্যের সৌন্দর্য পরখ করছে। তার আচানক মনে হলো সে বনমানুষ হলে মন্দ হতো না। এই চমৎকার কাননে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারত কেবল তার সৌন্দর্য দর্শন করে।
পিছন থেকে পায়ের শব্দ প্রখর হচ্ছে। টনক নড়লো মেহতিশার। দ্রুত পা ফেলল। বক্ষঃস্থল শীতল করা দুশ্চিন্তা আবারও ভর করলো। অনিক তার পিছু নিয়েছে নিজের লোকবল নিয়ে। মেহতিশাই সঠিক ছিল। তার ফুপির নিরুদ্দেশ হওয়ার পিছনে হাত ছিলো অনিকের। সে এক ঢিলে দুই পাখি মা র তে চেয়েছিল। ফুপিকে আঁটকে রেখে অনিক তার পুষে রাখা ক্ষোভও মেটাতে পারবে আবার ফুপি নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে অনন্তপক্ষে ফুপির জন্য না হলেও ইলার জন্য মেহতিশা ছুটে আসতো এখানে তা অনিক জানত! তাই তো কৌশলে এসব করেছে। মেহতিশার অকস্মাৎ মনে হলো, সে বড্ড বোকা! অনিকের চাল আন্দাজ করতে পেরেও নিজেকে বিপদে ফেলতে কেন এখানে এলো? পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকালো সে। কেমন স্বার্থপরের মতো চিন্তা করছে! মেহজার মতো তো তার আরেক বোন ইলা। ওর কি দোষ? মেয়েটা তো নির্দোষ! ইলার বিপদে পাশে না দাঁড়ালে মেয়েটা তো আ ত্ন হ ত্যা করে বসত। অনেক দূর্বল এবং অল্পতেই ভেঙে পড়া মেয়ে ইলা।

দূর হতে দূরান্তে কেবল গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেহতিশা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে যে। অনিক আর তার লোকবলের হাতে ছিল অ স্ত্র। এই জিনিসটার জন্যই অনিকের সামনে দাঁড়ানো হয়নি তার। সে একা একটা মেয়ে আর তারা ছয়জন তাগড়া যুবক। এদের সাথে পেড়ে ওঠা সহজ না। যেখানে আত্মরক্ষার মতো কিছুই নেই তার। বেলা বাড়ছে। সাথে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। গলা শুকিয়ে কাঠ তার! পিছে তাকিয়ে দেখল অনেকদূর এসে পড়েছে। একটা শুকনো ভেঙে পড়া গাছের ওপর বসলো সে। তৃষ্ণা পেয়েছে প্রবল! সহসা শব্দ হলো কোথাও। উঠে দাঁড়াল মেহতিশা। সামনে সারিবদ্ধ গাছপালা থেকে বেড়িয়ে এলো হুট করে সারতাজ! মেহতিশা বিস্মিত গলায় চেঁচাল,

-‘ আপনি? ‘

গা ঝাড়ছিল সারতাজ আপনমনে। মাথা তুলে তার সামনে বিষ্ময়ভূষে দাঁড়ানো মেয়েটিকে সে দেখলো না। মেহতিশা এগোল। দাঁড়াল সারতাজের সম্মুখে। অতঃপর পুনরায় বিষ্ময় ঝাড়ল সে,

-‘ কি ব্যাপার? কথা বলছেন না যে। আপনি এখানে কি করছেন? ‘

মাথা তুলল সারতাজ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল মেহতিশার মুখোশ্রীতে। বলে উঠলো,

-‘ এইযে গাছগুলো দেখছেন না?এদের সাথে নাচতে এসেছি আমি। বুঝেছেন? ‘

বিষ্ময় কাটিয়ে শব্দ করে হাসল মেহতিশা। তারপর হটাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। গাম্ভীর্যতা অটুট রেখে শুধাল,

-‘ ফাজলামো করেন? ‘

-‘ না তো! প্রেমালাপ করছি। ‘

-‘ কি হয়েছে আপনার বলুন তো। ‘

-‘ কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আপনাকে। ম্যারাথনে রেসের অংশগ্রহণ করেছেন তেমন করে দৌড়াচ্ছেন, তখন পিছু ডাকলাম আপনাকে শুনলেন না কেন? ‘

-‘ বাই এনি চান্স আপনি কি আমার পিছু পিছু এই জঙ্গলে এসেছেন? ‘

-‘ হোয়াট ননসেন্স! আমার আর কাজ নেই নাকি? জঙ্গলেই আসছিলাম আমি। ‘

-‘ কি করতে? ‘

প্রতিত্তোর করল না সারতাজ। তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা গলা থেকে সরিয়ে হাতে নিলো। পা টিপে টিপে এগোল সম্মুখে। কিছুদূরে এক হরিণ ঘাস খাচ্ছে নিবিড় মনোযোগে। হরিণটা খাচ্ছে বললে ভুল হবে সে মুখে করে ঘাস ছিঁড়ে তার বাচ্চাটার মুখে দিচ্ছে। সারতাজ মূলত সেই মূর্হতটার ছবি তোলার উদ্দেশ্যেই এগোচ্ছে। মেহতিশা তা দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দুলালো। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘ ঐযে শুরু হলো ফটোগ্রাফারের ফটোগ্রাফি। ‘

পুনরায় ভাঙা গাছটার ওপর বসলো মেহতিশা। দৃষ্টি আশপাশে বুলাল। আশ্চর্যজনক হলেও তার এখন ভীতির পরিমাণটা আগের থেকে কমেছে। কেন যেন সারতাজ আসায় তার সাহস ফিরে এসেছে। ভয় লাগছে না। আতঙ্ক কাবু করছে না অন্তঃকরণকে!

জুইঁয়ের লা শ পুলিশ নিয়ে গিয়েছে। মৃ ত্যু র পূর্বে জুইঁয়ের সাথে সাক্ষাৎ করাতে সারতাজকে ফেঁসে যেতে হয়েছিল আইনি জটিলতায়। তবে জুইঁ যেন সবকিছু গুছিয়েই গিয়েছিল। কক্ষে সিসি ক্যামেরা থাকায় এবং যাবতীয় সকল তথ্য ঠিকমতো প্রদান করার পর ঘন্টাখানেক আগে থানা থেকে মুক্ত হয়েছে সে। জে লে নেওয়া না হলেও জেরার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। সকল ঝামেলা শেষে অরণ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মন বিষন্ন ঠেকলে তার সময় কাটে কাননে ঘুরে বেড়িয়ে।

-‘ আপনি এখানে কি করছেন মেহতিশা? আপনার তো এখানে থাকার কথা নয় এ-সময়। জঙ্গল তো আমার আস্তানা। পেশার খাতিরে বছরের বেশির ভাগ সময় এখানেই পড়ে থাকি। ‘

মেহতিশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-‘ এভাবে বলছেন যেন জঙ্গল আপনি নিজের নামে কিনে নিয়েছেন। ‘

-‘ দুই লাইন বেশি বোঝেন কেন সবসময়? অদ্ভুত মেয়ে! ‘

ইতস্তত বোধ করছে মেহতিশা। ভাবছে অনিকের বিষয়টা সারতাজকে বলা আদও ঠিক হবে কিনা। তবে সারতাজকে না বলেও তো উপায় নেই। সে তার ফোন ফেলে এসেছে। উল্টোপাল্টা বোকার মতো ছুটতে ছুটতে অরণ্যে এসে পড়েছে। নিজের বোকামির জন্য রাগ হলো তার। কেনো জঙ্গলেই আসতে হলো তার? পুলিশ স্টেশন কিংবা শহরের দিকে ছুটলেই তো হতো!

-‘ শুনুন? ‘

সারতাজ ক্যামেরা রাখল। চাহনি ফেলল মেহতিশার পানে। মেয়েটাকে একটু অন্যরকম লাগছে না? শক্ত, কঠিনমনা মেহতিশা কেমন যেন নুইয়ে আছে। পা ফেলে এগোল সে। বসল মেহতিশার থেকে কিয়ৎ দূরে। নরম কন্ঠে সে শুধালো,

-‘ বলুন শুনছি। এনি প্রবলেম? ‘

-‘ অনিক…অনিক আমার পিছু নিয়েছে। ‘

সারতাজ ভ্রু’দ্বয় কুঁচকাল! প্রশ্ন করলো,

-‘ এই অনিকটা আবার কে? ‘

-‘ আমার স্বামী। আপনাকে বলেছিলাম…,’

-‘ ওহ হ্যা! তা উনি কেন আপনার পিছু নিয়েছে? ‘

সম্পূর্ণ বিষয়টা খুলে বলল মেহতিশা। সারতাজ মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনল। পরিশেষে কেমন ঠাট্টার সুরে বলল,

-‘ আপনার হ্যাজবেন্ড বেশ চালাক মানুষ দেখছি। ‘

-‘ ও আমার হ্যাজবেন্ড না। তালাক দিয়েছি ওকে। ‘
শক্ত গলায় শুধাল মেহতিশা।

-‘ কিন্তু একটু আগেই তো আপনি তাকে ‘ স্বামী ‘ বলে সম্মোধন করলেন। ‘

-‘ ঐটাতো আপনাকে মনে করানোর জন্য বলেছি আশ্চর্য! ‘

-‘ আচ্ছা, আচ্ছা। ‘

সারতাজ মনে মনে হাসল! মেহতিশাকে রাগাতে পারলে তার এমন পৈ শা চি ক আনন্দ হয় কেন? কে জানে!

-‘ এখন আমার কি করার আছে? ‘

মেহতিশা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটাকে এটাও বলে দিতে হবে? সে গলা ঝেড়ে মিনমিন করে বলল,

-‘ আমাকে একটু সাহায্য করুন। শুধুমাত্র জঙ্গল থেকে বের হতে সাহায্য করলেই হবে। কিংবা আপনার কাছে যদি ফোন থাকে তাহলে প্লিজ একটু কাছের কোনো পুলিশ স্টেশনে ফোন করুন। ‘

-‘ এটা বাংলাদেশ মেয়ে! এখানে শহর বাদে গ্রামে গেলেই যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না সেখানে জঙ্গলে নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশা করছেন কিভাবে? ‘

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল মেহতিশা। সেটাই তো! বোকার মতো কিসব বলছে সে। উঠে দাঁড়াল সারতাজ। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘ চলুন সামনে যাই। জঙ্গলে আমি রাত কাটাতে পারলেও আপনার নিশ্চয়ই সেই অভিজ্ঞতা নেই। সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরী নেই। জঙ্গল থেকে বের হতে হবে। ‘

হাঁটা ধরলো দু’জন! শুকনো পাতায় মড়মড় শব্দ হচ্ছে। সঙ্কোচ নিয়ে মেহতিশা দ্রুত হাঁটা ধরতেই পা মরা গাছের ডালপালার সঙ্গে বেঁধে পড়ে যায় সে। সারতাজ তৎক্ষনাৎ পেছনে তাকায়। মেহতিশাকে ভূমিতে পড়ে থাকতে দেখে বিরক্তি নিয়ে শুধায়,

-‘ বাচ্চা নাকি? দেখে চলতে পারেন না? উঠুন জলদি! ‘

পায়ে কাটা বিঁধেছে মেহতিশার। র ক্ত পড়ছে সেখান থেকে। ব্যাথা চেপে রেখেই সে উঠে দাঁড়াল। সহসা মেহতিশার র ক্তা ক্ত পা দর্শন হলো সারতাজের। বিরক্তিতে অধর যুগল তার ‘ চ ‘ আকৃতির হলো। সে এগোতে নিলেই অদূরে কোথাও গু লি র শব্দ হলো। কারো আ র্ত না দ ছিটকে এলো দু’জনের কানে।

চলবে~