#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৫|
সাদিয়া মেহরুজ
মেহতিশা নত মস্তকে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। হাসির শব্দে মাথা তুলে তাকাল ও। শায়লা সারতাজকে খাইয়ে দিচ্ছিল তখন। বড্ড প্রাণবন্ত, স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। কিয়ৎ পূর্বে যেই অস্বাভাবিকতার বিচরণ তার মুখোশ্রী জুড়ে ছিল তা এখন বিলীন। ভদ্রমহিলা বর্তমানে কি সুন্দর মিষ্টি গলায় কথা বলছে, হাসছে। কিন্তু কয়েক প্রহর পূর্বে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো অদ্ভুত রণচণ্ডী ব্যাক্তি। অথচ এখন কতোটাই না স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তিনবারের মাথায় শায়লা মেহতিশাকে পুনরায় বলল,
-” কিছুই তো খাচ্ছো না মেহতিশা। অতটুকু ভাত নিয়ে বসে আছো কেন? দেখি প্লেট দাও তো। ”
বাক্যের সমাপ্তি টেনে শায়লা নিজ হাতে টেনে নিল মেহতিশার প্লেট। পুনরায় দিলো দুই চামচ ভাত সাথে সবজি ও তিন টুকরো মুরগীর মাং স। মেহতিশাকে এই পর্যায়ে বড্ড অসহায় দেখাল। শায়লা তাকে এ নিয়ে তিনবার খাবার দিলো। ভদ্রমহিলা ভুলোমনা! মনে রাখতে পারেন না ক্ষণিকের ঘটনা। মেহতিশা পড়েছে মহাবি প দে! সে অসহায় চোখে তাকাল তার হতে কিছুটা দূরে বসা থাকা সারতাজের পানে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল কি? অস ভ্য ছেলেটা ঠোঁট চেপে হাসছে। কতোবড় খা/রা/প ভাবা যায়? তপ্ত শ্বাস ফেলল মেহতিশা। শাকিব ওপরে যাওয়ার আগে বেশ বিনম্র গলায় তাকে বলে গিয়েছে,
-” সারতাজ হয়তো মায়ের ব্যাপারটা তোমায় খুলে বলেছে মেহতিশা। আমি একটু ওপরে যাচ্ছি। মা’র সাথে কথা বললে তুমি একটু সাবধানে কথা বলো কেমন? উনি মূর্হতের বলা কথা ভুলে যান। তোমাকে ঐ পিছের ঘটনা যা তিনি ভুলে গেছেন সেটা মনে করানো যাবেনা। এতে আম্মুর ব্রেনে চাপ পড়বে। তা নিয়ে সমস্যা হবে ওনার। পিছে যা বলল তা যদি পরে ভুলে যায় সেই কথাটা স্কিপ করে যেও কেমন?”
শাকিবের ব্যাক্ত করা অনুরোধে মেহতিশা ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়েছিল। ভেবেছিল এ আর তেমন কি কঠিন ব্যাপার? কিন্তু সে কি আর জানত নাকি তার জন্য সামনে কি ধরনের বি/প/দ ঘাপটি মে/রে বসে আছে? জানলে কক্ষনোই শাকিবটাকে ওপরে যেতে দিত না। শাকিব সারতাজকে যদিও দেখতে বলেছিল। কিন্তু ঐ বে/য়া/দ/ব ছেলেটা তো তাকে সাহায্য না করে উল্টো তার পরিস্থিতি দেখে হেঁসে ম/র/ছে! মেহতিশা একটুখানি চেষ্টা করেছিল শায়লাকে মনে করানোর যে, তিনি একটু আগেই মেহতিশাকে দু’বার খাবার দিয়েছেন। কিন্তু তার মনে পড়লে তো। হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল মেহতিশা। ভাত নাড়াচাড়া করল কিন্তু মুখে দিলো না। ভাবল সে শাকিবের কথা। ছেলেটা তার মাকে সামলায় কি করে?
খাওয়ার পর্ব শেষ হলো শাকিবের উপস্থিতির পর। মেহতিশা হাত ধুচ্ছিল বেসিনে। শাকিব সারতাজকে কড়া চোখে চেয়ে এগোল মেহতিশার পানে। কন্ঠের স্বর খাদে নামিয়ে আহত স্বরে বলল,
-” তোমাকে ক ষ্ট দিয়ে ফেললাম বোধহয় মেহতিশা, তাই না? সারতাজ এমনটা করবে বুঝতে পারিনি। ও মাকে সামলাতে পারে তাই ভেবেছিলাম ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে নিবে কিন্তু,.. ”
মেহতিশা মাঝে থামাল শাকিবকে, ” ইট’স ওকে ভাইয়া। এই ছোট্ট ব্যাপার নিয়ে আপনার এভাবে বলার দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি। ”
-” এসো তোমাকে তোমার রুম দেখিয়ে দেই। একটু রেস্ট করো। রাতেই তো তোমাদের ট্রেন। ”
মেহতিশাকে ওর রুমে ছেড়ে শাকিব এলো তার রুমে। সারতাজ ওর রুমেই ছিলো। নোটপ্যাড ঘাটছিল। শাকিব গিয়ে তার পিঠে থা/প্প/ড় দিলো। বলল,
-” এই শা/লা তোকে না বললাম মাকে দেখিস। অযথা মেহতিশাকে ক ষ্ট দিলি। ”
সারতাজ আধশোয়া থেকে সটান হলো। ব্যাঙ্গ করে বলল,
-” তাতে তোমার কি? ক ষ্ট হচ্ছে নাকি কোথাও? কাহিনি তো ভালো না ভাই। ”
শাকিব কড়া দৃষ্টিতে তাকাল, ” এই সবটা সময় খালি উল্টাপাল্টা কথা বলস কেন তুই? ভালো কথা মুখ দিয়ে বের হয়না? আমার বউ আছে বউ। বিয়ে ডান আমার। ”
শাকিব সারতাজের পাশ থেকে সরে এলো। কাজ আছে তার। ভেজা চুলগুলো মুছে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
-” আমি বাহিরে যাচ্ছি। রাতে কথা হবে। মেয়েটাকে জ্বালাস না। ”
সারতাজ চেঁচাল, ” এভাবে বলছো যেন ওকে আমি চব্বিশটা ঘন্টা জ্বালিয়ে মা/রি। ”
শাকিব শুনেনি সারতাজের কথা৷ সে ততক্ষণে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। সারতাজ উঠে দাঁড়াল। বসে বসে কি করবে ভেবে না পেয়ে চলল মেহতিশার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটার পানে। মেয়েটাকে একটু রাগিয়ে আসা যাক? তাহলে সময়টাও কে/টে যাবে।
_
-” এই ফুল চোর, এই! ”
কালো গোলাপটা মাত্র ফুটেছে। ফুলটার প্রতি নজর মাত্রই পড়েছিল মেহতিশার অমনিই ছুটে এলো। ও কালো গোলাপের নাম শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখেনি। তাই তো এতোটা উৎসাহ নিয়ে ছুটে আসা। তবে ফুলটা ছুঁয়ে দিতেই পেছন থেকে চেঁচাল এক পুরুষ! মেহতিশা জানে পুরুষটা সারতাজ।
-” আপনি ফুল ছিঁড়ছিলেন কেন? ” একটু কঠিন শোনাল সারতাজের কন্ঠ।
পূর্ণরূপে সটান হলো মেহতিশা। তাকাল সারতাজের পানে। বিরক্তিভাব ইতিমধ্যে তার বদনে ভেসে উঠেছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে ও বলে উঠলো,
-” ফুল ছিঁড়ছি তার প্রমাণ? ”
-” প্রমান আপনার হাত নিজেই। আপনার হাত এমন ভাবে ফুলটা ধরেছিল দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল আপনি ফুলটা ছিঁড়ছেন। ”
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলো মেহতিশার তবে সে নিজেকে সংযত করে নম্র গলায় বলল,
-” এটা আপনার দেখার ভুল। আমি শুধুমাত্র ফুলটা ছুঁয়ে দেখছিলাম। ”
-” দেখার ভুল? আপনি কি ইনডায়রেক্টলি আমায় অন্ধ বললেন? ”
-” অন্ধ কেন বলতে যাব? আমি তো বলেছি দেখার ভুল। মানুষের দেখতে ভুল হতেই পারে। মানুষ মাত্রই তো ভুল! ”
হতাশ সারতাজ! মেয়েটা আজ এতো কোমল কন্ঠে, স্বাভাবিক রূপে কথা বলছে কেন? স্বভাববশত তো তার এখন একটু চড়া গলায় সারতাজকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়া উচিত যা সে সর্বদা করে। কিন্তু আজ মেহতিশাকে বড্ড শান্ত দেখাচ্ছে। শান্ত মানুষের সাথে কি আর তর্ক করা যায়? উঁহু!
বিশুদ্ধ বাতাবরণে চঞ্চল হাওয়াদের অবাধ বিচরণ। দমকা হাওয়া থেমে থেমে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে দৈত্যের মতো গাছগুলোকে। গাছগুলো দুলছে, যেন নৃত্য করছে তারা। শব্দ হচ্ছে, শা শা! পাখিদের তারস্বরে কিচিরমিচিরে মুখরিত নভোমণ্ডল। পশ্চিম আকাশ রক্তিমাভ। যেনো আগুন লেগেছে অম্বরে। সূর্যের দেখা নেই। সে ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে ধরনী হতে। জানুয়ারির শেষ দিক হওয়ায় শীতটায় কমে এসেছে প্রায়। সারতাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেহতিশা পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখায় মত্ত হলো।
-” আপনি কখনো প্রেমে পড়েছেন মেহতিশা? ”
সারতাজ মেহতিশার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অদ্ভুত প্রশ্নটা শ্রবণ মাত্রই মেহতিশা হকচকাল! আড় দৃষ্টে তাকাল পাশে। তার অন্তরালে মরিচা পড়া দুঃখের বাক্সটা একটু নড়বড়ে হলো। মনে পড়লো অতীত। সে অতীত যা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে অথৈ তমসায় ডুবিয়ে মে/রে/ছিল। মেহতিশা মরা গলায় আনমনে শুধাল,
-” প্রেমে পড়িনি তবে একজনের প্রতি ভালোলাগা ছিলো। ”
বি/ষা/ক্ত দমকা হাওয়া যেন ছুঁয়ে দিল সারতাজকে আলত করে। তার মন কেমন করে উঠল। তৎপর সে ধাতস্থ করল নিজেকে। মেহতিশা কে হয় তার? কেও না! তাহলে সে প্রেম করলে তার কি? কিচ্ছুটি না। এসব বলে কয়ে সারতাজ স্বাভাবিক হলো। অলিন্দে পাতা চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল,
-” আপনার মতো ঝগড়াটে মেয়ের কারো প্রতি ভালোলাগা তৈরি হতে পারে? আই কান্ট বিলিভ! ডিটেইলস বলুন তো। ”
নিজেতে নেই মেহতিশা। তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জড়তা, সংকোচ, দ্বিধার দেয়াল সারতাজের সামনে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। মেয়েটা বেখেয়ালি কন্ঠে বলতে লাগল,
-” আমার বাবা – মা দু’জনেই মা রা যান যখন তখন আমি সদ্য এইচএসসি পাশ করেছি। তারা মা রা যাওয়ার পরই আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই। মেহজাকে ফুপির কাছে চট্টগ্রামে রেখে আমি ঢাকায় টিউশনি করিয়ে পড়াশোনা করতাম। তখন মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আমার এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলো। বোকাসোকা টাইপের ছেলেটা। ক্লাসে কারো সাথে মিশতো না। ইন্ট্রোভার্ট সাথে তোতলা টাইপের ছিলো বলে কারো সাথে লজ্জায় মিশতে চাইত না। ওর সাথে কিভাবে যেন আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধুত্বের একটা বছর ছুঁই ছুঁই তখন বুঝলাম তার প্রতি আমার বন্ধুত্ব এক ধাপ এগিয়ে ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেটা আমায় প্রপোজ করল। প্রপোজ এক্সেপ্ট করিনি কারণ নিজের অবস্থানের জন্য। ছেলেটা তবুও ছ্যাচড়ার মতো আমার পেছন পড়ে থাকত। আমি আমাদের মাঝে তখন দূরত্ব সৃষ্টি করলাম। এভাবেই চলল বাকি দিন গুলো। ওর আমাকে প্রতিনিয়ত জ্বালানো, প্রেমের বার্তা বলা। এভাবেই কা/টছিলো। আমি মুখ বুঁজে ছিলাম শুধু পড়াশোনাটা শেষ হওয়ার খাতিরে। ওর প্রতি আমার মায়া হতো। কিন্তু কিছু করার ছিলোনা।
একবছর পার হয়ে যাওয়ার পর একসময় খেয়াল করলাম ও আর ভার্সিটিতে আসছে না, আমাকে জ্বালাচ্ছে না। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন ছিল উচাটন! বড্ড জানতে ইচ্ছে হতো হটাৎ কই গায়েভ হলো ও? পরে ধরে নিয়েছিলাম হয়ত ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। তবে আমার ধারণা ভুল ছিলো। ২১ ফেব্রুয়ারী সেদিন। ভার্সিটিতে ফাংশন ছিলো। প্রায় তিনটা মাস পর আমি সেদিন ওকে দেখেছিলাম।কি যে খারাপ অবস্থা ছিলো ছেলেটার। ও আমার সাথে একান্ত কথা বলতে চাইল আমি দেখা করতে যাই। নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও প্রথম সেদিন আমায় ছুঁয়েছিল। আমার হাত ধরে কাতর গলায় বলেছিল, ‘ তুমি আমার এক না হওয়া প্রিয় মানুষ মেহতিশা। তুমি আমার না হওয়া সুখ। আমার না হওয়া বউ। তোমাকে বড্ড বউ ডাকার ইচ্ছে ছিল তবে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তোমায় আমার ভাগে লিখে রাখেনি। তুমি বোধহয় অন্য কারো জন্য এই পৃথিবীতে এসেছ আমার জন্য না। ‘ ঐটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ কথা। শেষ দেখা। আমার হাতে আচানক চুমু খেয়ে ছুটে চলে গিয়েছিল। কদিন পর জানতে পারি মা রা গেছে ও। থ্যালাসেমিয়া রো গ ছিল। মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল রো গ টা। ”
সারতাজ নির্লিপ্ততা ভাঙল, ” আপনি কি ওকে ভালোবাসতেন? ”
-” জানিনা। কিন্তু ওকে আমি ভুলতে পারিনি, হয়ত পারবোও না। অপরাধবোধ কাজ করে আমার। আমি কি পারতাম না ওর হতে? ”
লম্বা পা ফেলে এগোল সারতাজ। মেহতিশার বরাবর দাঁড়াল সে। বলল,
-” না! আপনি ওর হতে পারেন না। কারণ আপনি অন্যকারো। ”
মেহতিশার ঘোর কা ট ল। সে চটজলদি ওদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করল।
সারতাজকে অন্যরকম লাগছে কি? ছেলেটার দৃষ্টিও আলাদা। কেমন যেন গা কাঁপিয়ে দেয় সে দৃষ্টিপাত। মেহতিশা অবুঝ কিংবা নির্বোধ নয়। পঁচিশটা বছর পার করে এসেছে সে। এই দৃষ্টির অর্থ জানে ও। ভ য় হলো তার! জড়তা নিয়ে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল লহমায়।
চলবে~
#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৬|
সাদিয়া মেহরুজ
তন্ময়! নামটার সাথে জুড়ে আছে একবুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস, হতাশা আর মলিনতা। নিঃসন্দেহে এই নামটার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে মেহতিশার জীবনের সবথেকে বে দ না দায়ক মূর্হত। তন্ময়ের প্রতি তার ভালোলাগা আছে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চিত মেহতিশা। তবে অবিরাম মায়া আছে ছেলেটার প্রতি ওর। এই মায়াটাই বোধহয় আজও পীড়া দেয়, দেয় ভীষণ ভীষণ য ন্ত্র ণা! তন্ময় আলাদা ছিল। নিজের মাঝে আকাশসম মায়া নিয়ে ঘুরত ছেলেটা। তার আচরণ ছিলো মুগ্ধ হওয়ার মতো। এইযে তন্ময় হুট করে মা রা গেল। তারপর কিভাবে যেন একের পর এক বি প দ এসে ঝুটল মেহতিশার কাঁধে। বন্ধ হলো তার পড়াশোনা। মাটি চাপা পড়লো তার স্বপ্ন।
-” মেহতিশা বাড়ি যাবে না? ”
মাথা ঝাঁকাল মেহতিশা। উঠে দাঁড়াল ব্যাগ হাতে। অতীতের পৃষ্ঠা বন্ধ করে রেখে দিল ধূলি জমা মনের কোণে পড়ে থাকা বাক্সটায়। আয়েশার দৃষ্টিপাত স্বাভাবিক নয়। সে চিন্তিত! তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার জন্য চিন্তিত। মেহতিশাকে তার বেশ ভালো লাগে। মেয়েটা কি সুন্দর করে যে কথা বলে! শুধুমাত্র এই চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলা আর বাবা মা বাদে নিজের ছোট্ট জীবনটার খুঁটি ধরে কিভাবে সামনে অকপট ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই দু’টো জিনিস কতোটা দারুণ ভাবে যে পারে তা গহীন মনে চিন্তা না করলে বোঝাই যাবে না।
-” তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত মেহতিশা? কন্ঠে দুশ্চিন্তা ঝাড়ল আয়েশা।
আয়েশার নম্র হাতটা আঁকড়ে ধরে সামনে এগোতে এগোতে কিয়ৎ হাসল মেহতিশা। মাথা নাড়াল। যার অর্থ না! তবে আয়েশার সন্দেহের বরফ পাহাড় এই ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়ায় কিছুতেই গললো না। সে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
-” তোমাকে ইদানীং খুব টেন্স’ড দেখায়। তোমাকে আজকাল দেখে মনে হয় যেন কতো দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছো। কোনো সমস্যা হলে আমায় বলতে পারো। ”
মেহতিশা মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো, ” তেমন কিছুই না আয়েশা। ঐ টাকা পয়সার হিসেব করছিলাম আর কি। এই টাকায় আসলে আজকের যুগে সংসার চালানো কষ্টকর। সবকিছু ঠিকভাবে সামলে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম এতোটা বেশি যা বলার বাইরে। আমার মতো নিম্নবিত্তের খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই অল্প টাকায় জীবন পরিচালনা করা।”
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘন ঘন মাথা নাড়ল। নত মস্তকে সে মেঝেতে তাকিয়ে হাঁটছে। তার স্বাভাবিক মুখোশ্রীতে হুট করে ফুটে উঠল আশঙ্কা!
-” হুম। এটা নিয়ে চিন্তা আমারও হচ্ছে। দেশে তো এখন দুর্ভিক্ষ চলছে তাই দ্রব্যমূল্যের দাম এতোটা বেশি। চিন্তা করো না। দুর্ভিক্ষ কে টে গেলে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শান্ত হবে ইনশাআল্লাহ। ”
-” ইনশাআল্লাহ। ”
তারা দু’জন রাস্তায় নেমে এলো। হেঁটেই যাবে। দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক জীবন চালনা করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। টাকা বাঁচাতে এখন অনেক গণমান্য ব্যাক্তিরাই পথে হেঁটে নিজ গন্তব্যে পৌঁছায়।
-” মেহতিশা একটু দাঁড়ান। ”
দূর থেকে চেঁচাল কেও! মেহতিশা, আয়েশা দু’জনেই ফিরে তাকাল। সারতাজ সাইকেল দ্রুত গতীতে চালিয়ে এদিকেই আসছে।সারতাজকে এই অসময়ে এখানে দেখে মেহতিশা ভীষণ বিরক্ত! অধর যুগল প্রসারিত হয়ে চ’কারান্ত শব্দ বেড়িয়ে এলো তার। অন্যদিকে আয়েশা নির্বাক, বিমূর্ত! উত্তেজনার বশে মেহতিশার ডান হাতটা খা ব লে ধরে সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-” আরেহ ইনি সারতাজ শাহরিয়ার না মেহতিশা?”
মেহতিশা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-” তুমি চেনো এনাকে? ”
-” হু চিনব না কেন?বাংলাদেশের বিখ্যাত, খ্যাতিমান ফটোগ্রাফারদের মধ্যে একজন। কয়েকদিন আগেই তো পুরো বিশ্বের মধ্যে ফটো কনটেন্স প্রতিযোগিতা যখন হলো তখন তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ”
সারতাজের সাথে মেহতিশার দেখা সাক্ষাৎ নেই এক মাস যাবৎ। ঐযে সেদিন চট্টগ্রাম থেকে এলো সকল ঝুট – ঝামেলা শেষে করে তারপর থেকেই এই ব্যাক্তি উধাও। মেহতিশা অবশ্য স্বস্তি পেয়েছিল সারতাজের নিরুদ্দেশ হওয়াতে। তবে অন্তরালে কোথাও না কোথাও সে অসন্তুষ্ট ছিল। সারতাজ কোথায় গেল হুট করে? আগে তো মেহজার সাথে দেখা করার চক্করে সপ্তাহে একবার প্রায়ই আসতো। শাহরিয়ার ভিলাতেও ছিল না ও। সাবিনা খালার থেকে জানা গেছে সারতাজ সবকিছু তার ভাই দু’টোর নামে করে দিয়ে চলে গিয়েছে শাহরিয়ার ভিলা ছেড়ে। আজ এতোদিন পর সারতাজের দর্শন আর মাঝে উধাও হওয়ার কারণটা মেহতিশা বুঝল। সারতাজ তার সাথে দেখা করবেই বা কি করে? সে তো গিয়েছিল নিউইয়র্ক।
-” জলদি সাইকেলের পিছনে উঠে বসুন মেহতিশা। ”
মেহতিশা যারপরনাই কপাল কুচকাল! সুক্ষ্ম ভাজ ফেলল ললাট জুড়ে। বলে উঠলো,
-” কেন? ”
-” প্রয়োজন আছে বলেই বলছি। উঠে বসুন এখন। আপনাকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে যেতে হবে। ”
-” কি কাজ তা নির্দিষ্ট করে না বললে আমি যাব না কিছুতেই। ”
সারতাজ ভয়াবহ বিরক্ত হলো। অতিষ্ঠ, বিতৃষ্ণা ভাব তার চেহারায় দেয়া দিল। ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘসতে ঘসতে ভাবল, মেয়েটা এতো প্রশ্ন করে কেন? তার ওপর কি বিশ্বাস নেই? সে কি আর ওকে মেরে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছে নাকি আশ্চর্য!
-” এখন কি মাস চলছে? মার্চ মাস! আজ কত তারিখ মনে আছে তো? মনে না থাকলে ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আজ ১৭ তারিখ আর পরশু শুনানির চূড়ান্ত দিন। আপনাকে র্যাব – ০৭ এর অফিসে যেতে হবে জরুরি প্রয়োজনে। ”
তারিখটা মনে করে চোখ মুদে নিল মেহতিশা। সে কি দিনকে দিন ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছে না? এইযে শাকিব আজ সকালেও তাকে ফোন দিয়ে তলব করেছিল র্যাব অফিসে। আর ও কি উত্তর দিয়েছিল? পাঁচটা বাজে পৌঁছে যাবে অথচ এখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। এতোটা বেখেয়াল তো ছিলনা মেহতিশা। হচ্ছেটা কি তবে?
আয়েশা নির্লিপ্ত। নত মস্তকে সে। দু’জনের কথাবার্তা মৌন রূপে কেবল শুনে যাচ্ছিল। তবে ক্ষণে ক্ষণে মৌন থাকার ধৈর্যটা ভে ঙে গুঁড়িয়ে আসতে চাইছে কৌতূহলে। তার নির্লিপ্ততা চুরমার হলো ভে ঙে! প্রশ্ন করল,
-” র্যাব অফিসে তোমার কি কাজ মেহতিশা? ”
-” তোমাকে আমি কাল বলবো সব। আজ যেতে হবে। সময় নেই। ”
নির্বাক আয়েশাকে হাত দিয়ে বিদায় জানানো শেষে মেহতিশা চড়ে বসল সাইকেলে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সে চেপে ধরল সাইকেলের সিটের একাংশ। সারতাজ মিষ্টি হেঁসে আয়েশাকে ” বায় ” বলে টান দিল সাইকেল। পড়ন্ত সায়াহ্নের আধো আধো রশ্মিতে নির্বাক আয়েশা মিলিয়ে গেল লহমায়। দৃষ্টি সরাল মেহতিশা। দেহে প্রাণ থাকতে সে কখনোই এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটার সাইকেলে উঠত না। তবে এখন যে হাত শূন্য! শরীর দূর্বল। হেঁটে যেতে সায় দিচ্ছে না মস্তিষ্ক। কখনো নিজের স্বার্থে পৃথিবীর সবথেকে অপছন্দনীয় কাজ গুলোও করতে হয় আমাদের।
সাইকেল চলছে ধীর গতীতে। মৃদুমন্দ হাওয়ার তোড়ে মেহতিশার চুল গুলো উড়ছে তখন শূন্য। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার মেহতিশাকে দেখল সারতাজ। পরক্ষণেই মন দিল সামনে। খোলা চুল, বন্ধ নেত্র যুগল সাথে অধর কোণে মৃদু হাসি! এই তিনটে সাধারণ জিনিস তার বুকে কেমন কম্পন ধরিয়ে দিল। নিউইয়র্ক থাকাকালীন এই মেয়েটা তাকে বেশ জ্বালিয়েছে! য ন্ত্র ণা দিয়েছে! সারতাজ জানে, তার সাথে এক অঘটন ঘটে গেছে। সে অঘটন তার তিল তিল করে গড়া শক্তপোক্ত মনটাকে ভেঙে চুড়ে খান খান করে ফেলেছে। তাকে বানিয়ে দিয়েছে অবিন্যস্ত। সারতাজের ঠোঁট দু’টো কাঁপছে। ও কাঁপা ঠোঁটে নিম্ন স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে,
-” আমার বি ষ ন্ন শহরে আপনাকে স্বাগতম বি ষ ন্ন কন্যা। ”
_
-” তোমার জন্য আমি আর্মির চাকরি ছেড়ে র্যাবে এসেছি প্রান্তিকা। আর কি চাও তুমি? র্যাবের চাকরি ছাড়লে আমার মায়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি ১৯ বছর বয়সে আর্মিতে এসেছি। ইন্টার পাশ করা ছেলে আমি। এখন র্যাবের চাকরি ছাড়লে আমি ঠিক কোথায় চাকরি পাবো বলতে পারো? ”
রূঢ় গলা! নিস্তব্ধ কামড়াটা আচানক আছড়ে পড়া হুংকারে কেঁপে উঠল যেন। কেঁপে উঠল প্রান্তিকাও। শাকিবের লাল লাল চোখ দু’টোতে চেয়ে তার বুকে ভীতির কম্পন উঠল। শাকিবকে স্বাভাবিক লাগছে না। অবশ্য স্বাভাবিক লাগারই – বা কথা কি? উঁহু ! প্রান্তিকা মিনমিন করে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করল শাকিবের নিকট।
-” আমি এখন কি করব বলো তো? বাবা বেঁকে বসেছেন ডিফেন্সে জব করা কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। তোমাকে বাবা বলেছে চাকরি খুঁজে দিবে তো। ”
পুনরায় গর্জে উঠল শাকিব, ” চাকরি খুঁজে দেবে? কিসের চাকরি দেবে জানো? পিয়নের! আমাকে হেনস্তা করার একটা উপায়ও এই লোক ছাড়ে না। তোমার বাবাকে এদিক থেকে তুমি না চিনলেও আমি খুন ভালো করেই তাকে চিনি। ”
-” তো এখন কি করতে চাচ্ছো তুমি? ”
শাকিব চুপ রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে দিল নি ষ্ঠু র কিছু কথা,
-” যেভাবে তিন শব্দের মাধ্যমে আমরা নতুন জীবন শুরু করেছিলাম ঠিক সেভাবেই তিন শব্দ বলার মাধ্যমে নাহয় আমাদের পথচলা শেষ হোক! আমি কিছুতেই চাকরি ছাড়ব না প্রান্তিকা। একবার সেক্রিফাইস করেছি আর সম্ভব না। তোমার বাবা যে তোমাকে আমার হতে দেবে না তা খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছি আমি। ”
প্রান্তিকা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! সে টলমলে চোখে বিমূর্ত হয়ে চেয়ে রইল কেবল শাকিবের পানে।
চলবে~
| রি-চেইক দিইনি। রেসপন্স করবেন সকলে। |