শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-১৭+১৮

0
143

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৭|
সাদিয়া মেহরুজ

নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। গরম কফির কাপ থেকে বাষ্প উড়ে সমীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নৈঃশব্দের রাজ্য এখন ব্যাস্ততম অফিস কক্ষটা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে বি শ্রীভাবে এসে লাগল। হাত বাড়িয়ে গরম কাপটা হাতে তুলে নিল সারতাজ। স্থির মূর্তির মতো বসে থাকা শাকিবকে দেখতে দেখতে কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল। বিরক্তিতে তার অন্তরাল এখন বি ষি য়ে রয়েছে। শাকিব যদিও তার বড়, গুরুজন হয় তবুও ইচ্ছে করছে এই গর্দভ ছেলেটাকে চটপট কয়েকটা চড় লাগাতে। স্বেচ্ছায় ভুল করা শেষে, সে ভুলের সমাধান না করে এভাবে মূর্তির মতো বসে থাকার কি কোনো মানে হয়?

-” ভাই তোমার যদি স্ট্যাচু সাজার এতোটাই ইচ্ছে থাকে তাহলে বাহিরে গিয়ে এভাবে স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকো। দেখা যেতে পারে মানুষ তোমাকে পাগল, টাগল ভেবে দুই – চারটা টাকা ভিক্ষাও দিয়ে যেতে পারে। এখানে বসে তো লাভ নেই। আমার পকেট এমনিতে খালি। তোমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হিসেবে ভিক্ষা তো আর দিতে পারছি না। ”

শাকিব রুষ্ট দৃষ্টে চাইল। হাতের কাপটা টেবিলে রেখে সারতাজ শাকিবের মুখাবয়ব দেখল। তারপর সে হাসল মৃদু, আড়ালে। গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,

-” এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমার পকেট সত্যিই ফাঁকা ভাই। নাহলে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। তবে যদি তোমার এতোটাই ইচ্ছে থাকে আমার থেকে সাহায্য নেয়ার তাহলে দুই টাকা দিতে পারি। নিবে নাকি? ”
-” তুই কি তোর ফালতু কথাবার্তা বন্ধ করবি নাকি কানের নিচে লাগাব চ ড়? ” শাকিব হুংকার দিয়ে উঠল।

দু’পাশে মাথা নাড়াল সারতাজ। ঠোঁট দিয়ে অদ্ভুত দু’টো শব্দ করল। হতাশ কন্ঠে শুধাল,

-” তোমার এই ঢঙ আমি মানতে পারছিনা ভাই সিরিয়াসলি! মানে নিজে ভুল করলা এখন রাগ ঝাড়ছ আমার ওপর? ”

শাকিব দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ” রাগ ঝাড়ছি না আমি। জাস্ট তোর ফালতু কথার লাগাম টানতে বলেছি। ”

সারতাজ তার নজর এলিয়ে দিল কাঁচের ওপাশে। কিয়ৎ দূরে মেহতিশা বসে চেয়ারে। তার সামনে এক বয়স্ক অফিসার। কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছে মেহতিশাকে। তার উত্তর তোতাপাখির মতো ফটাফট দিয়ে যাচ্ছে সে। আশপাশ কোন দিকে তার ধ্যান নেই। সারতাজ সেদিকে নজর রুখে বলল,

-” দো ষ টা তোমার ভাই তোমার। অনন্তপক্ষে এই মূর্হতে। নারীর মন তুলোর মতো কোমল হয়। তুমি এই কোমল মনে আ ঘা ত দিয়েছে। কি দরকার ছিল প্রান্তিকা আপুকে তালাকের কথা বলার? কষ্টটা এখন কে পাচ্ছে বেশি? তুমিই তো! আপুকে কষ্ট দিয়ে কষ্ট পাচ্ছো, তালাকের কথা বলে কষ্ট পাচ্ছো। অযথা এমন কথা বলো কেন যাতে নিজেকে ক ষ্ট পেতে হয়? রাগ নিয়ন্ত্রণ করো ভাইয়া। তুমি ডিফেন্স এ জব করো। এতো রাগ নিয়ে এই চাকরিতে টিকবে কি করে? ”

শাকিব তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠলো,

-” আমার দো ষ টাই দেখছিস। প্রান্তিকার বাবা? উনি তো দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা না? অতিরিক্ত করছেন উনি। ইচ্ছে করে র‌্যাবে এনে স্পেশাল আপ্যায়ন করি। ”
-” আরেহ ঐ মীর জাফর লোকের কথা বাদ দাও তো। নিজের স্বার্থের জন্য এখন মেয়ের সুখে থাকাটা নষ্ট করার জন্য ম রি য়া হয়ে উঠেছে। মীর জাফর চলে গেছে ঠিকই কিন্তু নিজের বংশধরকে পৃথিবীতে রেখে গিয়েছে। ” হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করল সারতাজ।

শাকিব মাথায় চেপে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। তার অনুশোচনা হচ্ছে। প্রান্তিকার সাথে একটু বেশিই রেগে গিয়েছিল। এতোদিনের ধৈর্যের পাহাড়টা আজ কিভাবে যে ভে ঙে গেল! প্রতেকটা কঠিন মূর্হত সে সামলাতে পারদর্শী ছিল। অথচ আজ? আজ যেন লহমায় সে অন্য এক শাকিবে রূপান্তর হয়েছিল, হয়েছিল অবিন্যস্ত।

_

ফুটপাতে এক আ হ ত বিড়াল আ র্ত না দ করছে। ঝড়ের গতীতে সাইকেল চালালেও সেই আ হ ত বিড়ালের আ র্ত না দ সারতাজের কর্ণগোচর হলো না। ঝট করে ব্রেক মা র ল ও। মেহতিশা তৎক্ষনাৎ মুখ থুবড়ে বাড়ি খেল সারতাজের পিঠে। সাইকেল থেকে নেমে সারতাজ ব্যাস্ত হয়ে উঠল।

-” ব্যা থা পেয়েছেন মেহতিশা? ”

সারতাজের দেহের গড়ন বর্তমানে কিছুটা রোগাটে বলা চলে। হাড্ডি ব্যাতীত কিছুই নেই শরীরে। সেই হাড্ডিসার পিঠে থুবড়ে পড়ে মেহতিশা ভালোই চোট পেয়েছে। ব্যা থা র দরুন অক্ষিগোলকে অশ্রুকণা এসে ভীড় জমিয়েছে। ব্যা থা চেপে রেখে তেতেঁ উঠল মেহতিশা,

-” সাইকেল চালাতে পারেন না তো চালান কেন? কোথাও, কখন, কিভাবে ব্রেক করতে হয় সেটাও জানা নেই। ”

সারতাজ অন্তঃকরণে দুঃখ বোধ করল। তবে বাহিরে সে নিজের ঠাটঁ বজায় রেখে বলল,

-” সাইকেল আমি ভালোই চালাতে পারি। কোথায়, কখন, কিভাবে ব্রেক কষতে হয় তাও জানি আমি। এখানে কিন্তু দো ষ টা আপনার। বুঝে শুনে ধ্যান রেখে শক্ত হয়ে বসা উচিত ছিল। কখন কি হয় সেটা তো আর বলা যায় না। ”

নিরুত্তর, নিশ্চুপ মেহতিশা। ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ মুদে নিল। তার অক্ষিপটে ঝট করে ভেসে উঠল মা বাবার চেহারা। কতোটা বাজে ভাবে থে ত লে গিয়েছিল তাদের দুজনের চেহারা সড়ক দুর্ঘটনায় তা মনে করে শিউরে উঠল একবার, দু’বার।

সারতাজ আ হ ত বিড়াল ছানার কাছে এসেছে। ও হাত বাড়িয়ে কোলে তুলল বিড়ালটাকে। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে মেহতিশাও। বিড়ালটাকে খেয়াল করলে আঁতকে উঠে বলল,

-” ও তো অনেক ব্যা থা পেয়েছে। ”
-” হ্যা। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। ”
-” তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জলদি চলুন। ” তাড়া দিল মেহতিশা।

সারতাজ মাথা তুলল। প্রশ্ন করে বসল,

-” আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে না? আপনাকে আগে বাসায় দিয়ে আসি। ”
-” পাগল নাকি! বাসায় দিতে গেলে বাচ্চাটা বাঁচবে নাকি? জলদি চলুন। ”

প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিড়ালটাকে আনা হলো মেহতিশার বাসায়। সারতাজ রাখতে চাইলেও তা সম্ভব নয় কারণ তার এপার্টমেন্টে ‘ ক্যাট নট এলাউড ‘ সাইনবোর্ডটা একদম তার ফ্লাটের সামনে টানিয় দেয়া। শুধু তার ফ্লাট নয় এপার্টমেন্টের প্রতিটা ফ্লাটের সামনে একই লেখা রয়েছে। বাড়ির মালিকের বিড়াল অত্যান্ত অপছন্দের তাই তিনি এ কাজ করে রেখেছেন।

-” বিড়ালের নাম কি রাখবে আপা? ” মেহজার চঞ্চল গলা।

সারতাজ, মেহতিশা দু’জন ভাবল কিছুক্ষণ। কিয়ৎ পর দু’জন এক সঙ্গে বলে উঠলো, ” নিলি। ”

মেহজা চোখ বড় বড় করে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো,

-” একসাথে বললে কিভাবে? তোমরা কি ওর নাম আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলে? ”

দু’জন মেহজার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল। তাদের দৃষ্টে ঝড়ল অপ্রস্তুত ভাব।

-” নাহ্। কিভাবে যেন কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। আমরা আগে থেকে নাম ঠিক করিনি। ” মেহতিশা জবাব দিল নিম্ন স্বরে।

সারতাজ উঠে দাঁড়াল। হাত ঘড়িতে সময় দেখে অস্থির হয়ে উঠল। দশটার বেশি বাজে। আর সে কিনা এখনো বেকুবের মতো মেহতিশার বাসায় পড়ে আছে! অস্বস্তিতে গাঁট হলো অন্তরাল। তাড়া দিয়ে বলল,

-” মেহতিশা যেতে হবে আমাকে। ”
-” আসুন। গেট বন্ধ এখন। আমি চাবি নিয়ে আসছি। ”

নিচে নেমে এলো দ্রুত সারতাজ। মেহতিশা এলো বাদে চাবি হাতে। তালা খুলে সরে দাঁড়াল। সারতাজ বেড়িয়ে গেল লহমায়। জায়গাটা ছাড়ার পূর্বে ও নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,

-” আপনাকে তো কালই চট্টগ্রাম যেতে হবে। একা যেতে পারবেন? ”
-” কেনো পারব না? এতদিন বুঝি আমার চলাচলের সময় আমার ভূত সঙ্গ দিত যে এখন বলছেন একা যেতে পারব কিনা। ” মেহতিশার কাঠ কাঠ গলা।

সারতাজ হতাশ কন্ঠে বলল, ” আপনার ত্যাড়ামো কখনোই যাবে না? যাইহোক হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।”

কথার ইতি টেনে পিছন ফিরল সারতাজ। অমনি পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখে সে চমকাল, থমকাল! বিষ্ময়ে কথা বলার শক্তি লোপ পেল।

চলবে~

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৮|
সাদিয়া মেহরুজ

ঝড় হচ্ছে। গ্রীষ্মের তান্ডব তোলা ঝড়। ধূলি ঝড়ে চারিপাশ ধূলোয় আচ্ছাদিত। বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেলেও বৃষ্টির দেখা নেই। কালশিটে অন্তরীক্ষ মেঘাচ্ছন্ন। মেঘেদের আড়ালে ঘাপটি মে রে বসে রূপবতী চন্দ্রা। অদূরে এক পশলা স্নিগ্ধ, কোমল বৃষ্টি হাত নাড়িয়ে জানান দিচ্ছে তাদের আগমনী বার্তা। ব্যাস্ত সড়ক ধরে মানুষেরা ছোটাছুটি আরম্ভ করেছে ইতিমধ্যে। এতসব ব্যাস্ত মানুষের মাঝে কেবল স্থির চিত্তে ব্রিজের রেলিং এর ওপর বসে রয়েছে দু’জন মানুষ। সারতাজ আর তার ঠিক পাশে তার আদরের ছোট ভাই শারাফ!

-” পায়ের এই হাল কেন শারাফ? ” কন্ঠনালী কম্পমান সারতাজের।

শারাফ চুপটি করে তাকিয়ে ছিল ঢেউ তোলা পানির দিকে। সারতাজের প্রশ্ন শুনে সে তার পায়ের দিকে তাকাল। তার বাম পা টা নেই! হাঁটু থেকে কে টে ফেলা হয়েছে। জমে যাওয়া কন্ঠে সে আওড়াল,

-” কে টে ফেলেছে ভাই। ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল তাই। ”

সারতাজ শারাফের মুখোমুখি হয়ে বসল। তার চোখ দু’টো কেমন লাল হয়ে আছে! অক্ষি কোটরে জলের উপস্থিতি হয়েছে সেই কখন। কেবল তার অনুমতি না পেয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না। ঠোঁট কাঁপল সারতাজের।আশ্চর্য তো! তার দেহের এহেন কাঁপুনি কেন বন্ধ হচ্ছে না? সে কেন স্বাভাবিক হতে পারছে না? বক্ষ মাঝারে এমন উথাল-পাতাল ঝড় বওয়া কেন থামছেনা?

-” তুই কাইন্ডলি আমাকে সব খুলে বলবি শারাফ? এমন থম মে রে বসে আছিস কেন? আর তুই একা এসেছিস দেশে? শাহিন কোথায়? ও ভালো আছে তো? ”

শারাফ ম রা গলায় শুধাল, ” ও ভালো আছে ভাই। ও আসেনি আমার সাথে। আমার মতো বেইমানের সাথে অবশ্য আসার কথাও না। শাহিনের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ অনেকদিন। যেদিন থেকে আমার সম্পত্তির ওপর লোভ জাগল, তোমার ভালোবাসা ভুলে আমি সম্পত্তির লোভে অন্ধ হয়ে গেলাম সেদিন থেকেই শাহিন আমার সাথে কথা বলেনা, দেখতে আসেনা। আমার যে এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। কোনোরকম জান হাতে বেঁচে গেলাম কিন্তু ইনফেকশন হওয়ার জন্য আমার বাম পা টা একদম শেষ হয়ে গেলো ভাই! আমি পঙ্গু হয়ে গেলাম আজীবনের জন্য। ইথিশা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে ভাই। শাহিনকে ফোন করে এতোবার একটুখানি আসতে বললাম ও এলো না ভাই। লোভে পাপ, পাপে মৃ ত্যু! লোভের জন্য আমার লাইফটা বরবাদ হয়ে গেল ভাই। আমি তোমার ওপর যেই অবিচার, নি ষ্ঠু র তা করেছি প্রকৃতি তা আমায় শুধে আসলে ফিরিয়ে দিলো। আমায় মাফ করো ভাই! আমায় মাফ করে দাও নাহলে আমি বাঁচব না। ”

সড়কে অবাধে ছুটে চলা মানুষের মাঝে কিছু মানুষ থামল আচানক কান্নার শব্দ শুনে। তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ব্রিজের দিকে। দেখল একটা বাম পা হীন ছেলে হাউমাউ করে কাঁদছে আরেকটার ছেলে কাঁধে ঝাপটে ধরে। ঝড় হলেও বাঙালির কৌতূহল দমল না। তারা এগিয়ে এলো। গুনগুনিয়ে কিছু বলল নিজেদের মধ্যে। কেও কিছু প্রশ্ন করতে নিবে অমনি সারতাজকে দেখে তারা সবাই ভীষণ চমকে গেল! শুরু হলো হুড়োহুড়ি। সবাই এক প্রকার ধৈর্য ফেলে চেঁচিয়ে উঠল,

-” আরে সারতাজ শাহরিয়ার! স্যার একটা সেলফি নিব আপনার সাথে স্যার একটু নেমে আসবেন আপনি? ”

সারতাজের নাম শুনে ভীড় ঠেলে ছুটে এলো এল দল উৎসুক তরুণী। সারতাজকে দেখে তারা হা করে বিষ্ময় প্রকাশ করলো। তাদের মধ্য হতে একজন দৌড়ে এসে সারতাজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

-” স্যার। আপনার অনেক বড় ফ্যান আমি। একটা অটোগ্রাফ দিবেন প্লিজ? ”

উত্তেজনা, বিষ্ময়ের প্রকোপে এগিয়ে আসা একদল মানুষ বেমালুম ভুলে বসল তারা আসলে কেন এগিয়ে এসেছিল। তাদের পাশেই যে একটা ছেলে অসহায় আ র্ত না দ করে কাঁদছে ওদিকে তাদের ধ্যান – জ্ঞান বিন্দু পরিমাণ নেই। চলমান পরিস্থিতি দেখে প্রথমবার জনসম্মুখে চটে গেল সারতাজ। খেঁকিয়ে উঠে বলল,

-” এখানে যে একজন কাঁদছে তা কি আপনাদের চোখে পড়েনি? এই ব্যাক্তিটার কি হয়েছে? কেন কাঁদছে তা না জিজ্ঞেস করে আপনারা পড়ে আছেন অটোগ্রাফ, সেলফি নিয়ে? আমাদের মনুষ্যত্ব বোধ কি তবে আজ এতোটাই নিচে নেমে গেল! ”

মৌমাছির ঝাঁকের মতো গুনগুন চলছিল এতক্ষণ জনসম্মুখে। সকলে লহমায় সারতাজের কথা শুনে চুপসে গেল। কয়েকজন লজ্জায় জায়গাটা ছেড়ে গেল চুপিসারে। সারতাজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে দু’টো চট করে দূরে সরল। ইতস্তত ভাব মুখোশ্রীতে ফুটিয়ে তারা চট করে কে টে পড়ল!
সারতাজ আশপাশে আর ধ্যান দিল না। সে শারাফ কে আলগোছে রেলিঙ থেকে নামতে সাহায্য করল। আশেপাশে তাকিয়ে একটা খালি রিকশা ডাক দিল। রিকশায় চড়ে দু’জনে ক্ষণিকের মাঝে স্থানটা ছেড়ে পাড়ি দিলো বহুদূরে। শারাফ পুরো ঘটনায় প্রতিক্রিয়াহীন ছিল, এখনো আছে। কান্না তার থেমে গেছে বেশ আগে। সে এখন কেবল পাথরের ন্যায় বসে রয়েছে। সারতাজ ভাইয়ের দিকে তাকাল। শারাফের মুখাবয়ব দেখে বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো তার তপ্তশ্বাস। ও তো শারাফের ওপর একটুও রাগ করেনি, শারাফের ব্যাবহারে কষ্ট পেলেও তা তো প্রকাশ করেনি। আল্লাহ তায়ালার নিকটও তো কোনো অভিযোগ করেনি। তবুও তার ভাইকে এতো টা কষ্ট পেতে হলো কেন?

_

-” পা নামিয়ে বসো ছেলে! ” প্রান্তিকার বাবা পলাশ হাসান ধমকে উঠলেন। নেত্রে তার তেজী ভাব।

হেলদোল দেখা গেল না শাকিবের মাঝে। সে পূর্বের মতোই পায়ের ওপর পা তুলে ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত। পলাশের উঁচু গলা শুনে ও ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেন পলাশ। শাকিব ফোন কা ট ল। বলল,

-” এতো চেঁচান কেন আঙ্কেল? এ বয়সে এতো জোর গলায় কথা বলা উচিত না। ” পা নামাল শাকিব।

-” নূন্যতম ম্যানার্স শেখায়নি তোমার বাবা – মা? বড়দের সামনে কিভাবে চলাফেরা করতে হয় তা জানো না? ”
-” জানি। গুরুজনদের সম্মান করতে শিখিয়েছে আমার বাবা মা কিন্তু মীর জাফরদের সম্মান করতে শেখায়নি। তাদের শাস্তি দিতে শিখিয়েছে। ” শীতল গলায় জবাব শাকিবের।

পলাশ অতি উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। পুনরায় ধমকে উঠলেন,

-” তোমার সাহস তো কম না। তুমি আমাকে মীর জাফর বলছো? কতবড় বেয়াদব ছেলে! বের হও আমার বাসা থেকে। বের হও বলছি। ”

শাকিব উঠে দাঁড়াল। পলাশের হাত চেপে ধরে তাকে সোফায় বসাল। শীতল গলায় শুধাল,

-” আহা আঙ্কেল! বললাম না? এ বয়সে এভাবে রেগে চেঁচান ভালো না। আপনার স্বাস্থ্যের জন্য এটা ঠিক না। দেখা যাবে হার্ট অ্যাটাক করে নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে যাবেন। আমার আর প্রান্তিকার বাচ্চাকে না দেখিয়ে আমি আপনাকে কিভাবে ম রে যেতে দেই বলুন তো? ”

পলাশ হা করে রইলেন। হয়ত ভাবছেন কতোবড় বেয়াদব ছেলে শাকিব! মুখের ওপর কি উদ্ভট কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে। পলাশের প্রতিক্রিয়া দেখে শাকিব মনে মনে একচোট হাসল। সে দূরে সরে বসল কিছুটা। পকেট থেকে বের করল তার আর প্রান্তিকার বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার। সাদা কাগজে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে ও ভাবল, পলাশ হয়ত এই কাগজটা দেখে এবার সত্যি সত্যিই হার্ট অ্যাটাক করে বসবেন!

চলবে~