শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-১৯+২০

0
254

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৯|
সাদিয়া মেহরুজ

প্রান্তিকা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ তুলে কাঁদছে। পাশে বসা শাকিব নিরুত্তাপ, উদাসীন। সে গাড়ি চালাচ্ছে এক মনে। প্রান্তিকার পানে ধ্যান জ্ঞান দেয়ার সময় তার নেই। একই গলি এই নিয়ে বিশবার চক্কর দিল সে। বিষয়টা খেয়াল করেনি প্রান্তিকা। কান্নার হিড়িক কমে আসতেই ও খেয়াল করল ব্যাপারটা। তখনি কর্কশ গলায় চেঁচাল,

-” কি সমস্যা তোমার? একই জায়গায় বারবার ফিরে আসছ কেন? আজ রাত কি রাস্তাতেই থাকতে চাও নাকি? ”

শাকিব উদাস গলায় জবাব দিল,

-” তো কি করব? তুমিই তো বললে আমার বাসায় যেতে চাও না। তাহলে আর কোথায় বা যাব রাস্তা ছাড়া! ”

প্রান্তিকা তেতেঁ উঠল, ” আমি কখনোই তোমার বাড়ি যাব না শাকিব। তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। কথা দিয়ে কথা রাখোনি। আই হেইট ইউ! ”

রাত বাড়ছে। সড়কে মানুষের চলাচল কমে এসেছে। বিরান স্থানে গাড়ি চাপাল শাকিব। সিটবেল্ট খুলে ঝুঁকল প্রান্তিকার প্রতি। তার দৃষ্টি অন্যরকম। সেই দৃষ্টির অর্থ পড়ে শিউরে উঠল প্রান্তিকা। দূরে সরতে চাইল। তবে তা হতে দিল না শাকিব। প্রান্তিকাকে সন্নিকটে এনে ফিসফিস করে বলল,

-” আমার বয়স কতো হয়েছে জানো প্রান্তিকা? ৩৪। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার কোনো চাহিদা নেই নাকি? শারীরিক, মানষিক দু’টোর চাহিদাই আছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্তপ্রায়। আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া বিয়ের কথাটা তো একদিন না একদিন তোমার বাবাকে জানাতেই হতো। তবে আজ কেন নয়? আই নিড ইউ প্রান্তিকা! আই নিড ইউ। ”

এসি থাকা সত্বেও পুরোদমে ঘামছে প্রান্তিকা। দুই হাত দিয়ে বল প্রয়োগ করে ও শাকিবকে একটু দূরে সরাতে চেষ্টা করল। চেষ্টা বিফলে গেল তার! বলিষ্ঠ দেহের শাকিব তার হালকা ধাক্কায় বিন্দুমাত্র নড়ল না। ঠায়ঁ তার ওপর ঝুঁকে রইল। তপ্তশ্বাস ফেলে ফুঁ দিল চোখে। চোখ মুদে নিল প্রান্তিকা। টের পেলো তার অধর জোড়ায় একজোড়া তপ্ত ঠোঁট আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রান্তিকা কিয়ৎক্ষণের জন্য পিছের কথা বেমালুম ভুলে বসল। ভুলে গেল তার বাবার তিরস্কারের কথা, তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার কথা। আরো ভুলে গেল বাবা তাকে ও বাড়িতে ফিরতে আজীবনের জন্য নিষেধ করে দিয়েছেন!

_

আদালত চত্বরে মনমরা হয়ে বসে মেহতিশা। তার মুখোশ্রী জুড়ে বিষন্নতার প্রলেপ। শূন্যে দৃষ্টি ফেলে ভাবছিল কিছু। তখন হুট করে কোথা থেকে যেন উদয় হলো সারতাজ। মেহতিশার মুখাবয়ব দেখে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিঃশব্দে পাশে বসল ও। বলে উঠলো,

-” অযথা মন খারাপ করছেন মেহতিশা। আপনি কি বাংলাদেশ কে চেনেন না? এ দেশের আইনকানুন সব ভুলে বসে আছেন নাকি? কোন বিচারটা এই দেশে সঠিক ভাবে হয়েছে? কিংবা জলদি হয়েছে? প্রত্যেকটা জটিল থেকে নরমাল কেস এদেশে সলভ হতে লেগে যায় বিশ, ত্রিশ বছর। হতাশ হচ্ছেন কেন আপনি? এটলিষ্ট এটা ভেবে নিজেকে শান্ত করুন অনিক এখন জেলে। ও আর অপকর্ম করতে পারছে না। লাক্সারি লাইফ লিড করতে পারছেনা। জেলে থাকাটা অবশ্যই আনন্দের কিংবা শান্তির নয় তাই না? ”

শুনানির তারিখ পিছিয়েছে পুনরায়। এবার তারিখ পড়েছে প্রায় তিনমাস পর। অনিক যেন দিনকে দিন হাত ফসকে বেড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এই ভাবে তারিখ পেছাতে থাকলে অনিক নিশ্চয়ই তার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাটুকু করবে এবং সফলও হতে পারে। মেহতিশা তপ্ত শ্বাস ফেলল। আকাশে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে কেবল চুপ করে তাকিয়ে রইল। সে সারতাজের কথা শুনে নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। আর তা সম্ভব কি?

-” হ্যালো, মেতিশা..? ”

মেহতিশা চটপট সারতাজের পানে তাকাল। কপালে ভাজঁ ফেলল। ও খানিকটা রাগত গলায় শুধাল,

-” আপনি কেন সবসময় আমার নাম ব্যাঙ্গ করেন? ”

সারতাজ অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করল,

-” মাই গড! কিসব বলছেন? আপনার নাম আমি ব্যাঙ্গ করতে যাবো কেন? আশ্চর্য! ”
-” মিথ্যে বলবেন না সারতাজ। আমার নাম মেহতিশা আপনি বরাবর আমাকে রাগিয়ে দিতে ” মেতিশা ” বলেন। ”
-” এ আর এমন কি? জাস্ট একটা “হ ” ই তো উচ্চারণ করিনি। আপনার এতো বড় নাম। একটা অক্ষর উচ্চারণ না করলে আপনার নাম নিশ্চয়ই শহিদ হয়ে যাবে না। ”

কথা বাড়াল না মেহতিশা। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল। ঢাকা ফিরতে হবে। কর্মস্থলে বেশ ফাঁকি দিচ্ছে সে। এভাবে চললে তার চাকরিটাই না হাওয়া হয়ে যায়। যতই পরিচিত হোক গার্মেন্টস এর মালিক। তার কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য ও নিশ্চয়ই তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবে না!

-” আরে আমার জন্য দাঁড়ান। একসাথে ফিরি? ”

সারতাজ পেছন হতে চেঁচাল। তাতে পদচারণ থামাল না মেহতিশা। হাঁটতে রইল। সারতাজ বুঝল মেয়েটা নিশ্চয়ই রাগ করেছে। করুক! এই রাগের প্রকোপে অনন্ত পূর্বের ঘটনাটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকুক।

ফুটপাতে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কেও সুস্থ দেহে বসে সাহায্য চাইছে তো অসুস্থ দেহ নিয়ে সাহায্য চাইতে এসেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন দৃশ্য অহরহ। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকের চাকরি চলে গেছে। অনেকে হয়েছে পথের ফকির। দরিদ্র মানুষেরা কাজ করতে না পেরে রাস্তায় থালা নিয়ে বসেছে সাহায্য চাইতে। অবশ্য এতেও তেমন লাভ হচ্ছেনা।কারণ দেশের সকলের অবস্থাই করুণ, সকলেই অসহায় এ লহমায়! খাবারের সঙ্কট বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। রিজার্ভের অবস্থা ভালো না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেহতিশা চারপাশ দেখল। বুক ভার হলো তার। সে কতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মন খারাপ করেছিল ভাবতেই লজ্জা পেল। তার দুঃখ তো কিছুই না এই মানুষ গুলোর তুলনায়। তার হাত শূন্য! বেতন যা পায় তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। নয়ত সাহায্যের করার নূন্যতম চেষ্টা ও করত। বেতন এর পরিমাণ আগের থেকে কমে এসেছে অনেকটা তার।

পদচারণ থামাল সারতাজ। মেহতিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-” মেহতিশা আমার জন্যও একটা টিকেট কেটে নিজের কাছে রাখবেন। আমি আসছি। ”
-” আপনার টিকেট আমি কা ট ব কেন? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ” প্রশ্ন ছুড়ল মেহতিশা।
-” আমি আসছি। ”

মেহতিশার হাতে টিকিটের টাকা গুঁজে ওকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দেয় সারতাজ। সড়কে ক্রন্দনরত এক পাঁচ বছরের শিশুর নিকট এগোয় ও।

-” বাবু কাঁদো কেন? কি হয়েছে? ”

বাচ্চাটা দু’হাত দিয়ে তার চোখ মুছল। নাক টেনে অভিযোগ করল,

-” মায় খাইতে দেয়না দুইদিন ধইরা। আমার অনেক ক্ষুদা লাগছে। ”
-” কি খাবে তুমি? আমাকে বলো আমি দিই। ”
-” ভাত খামু। ”

সারতাজ বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাল। পকেট থেকে টাকা বের করে দিল শিশুটির মায়ের কাছে। ইশারায় বলল কিছু যা বুঝল না মেহতিশা। কৃতজ্ঞতায় চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল বাচ্চার মায়ের। তিনি হু হু করে কেঁদে উঠে বাচ্চাটাকে নিজের কাছে টেনে উঠে গেলেন সেখান থেকে। সারতাজ ফিরে এলো। ফেরার পূর্বে সেখানে বসে থাকা সকলের হাতে কিছু টাকা দিয়ে এলো। উপস্থিত সকলের মুখোশ্রীতে আনন্দের দ্যুতি ফুটে উঠল। ফিরে চলল সারতাজ। মেহতিশার নিকট পৌঁছাতেই মেহতিশা তার টিকেট হাতে ধরিয়ে দিল। তারা দু’জন বাসে উঠতে নেবে তৎক্ষনাৎ ফোন এলো সারতাজের। শাকিবের কল।

-” ভাই বলো। ”

অপাশ হতে ব্যাকুল কন্ঠে শাকিব শুধাল,

-” ভাই তুই কি ঢাকায় এসে পড়েছিস? ”
-” না ভাইয়া। মাত্র বাসে উঠলাম। ”
-” বাস থেকে নাম জলদি সারতাজ। মা ভায়োলেন্ট হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। নার্স ফোন দিয়ে জানাল মাত্র। আমি আসছি তবে আমার আসতে একটু লেট হতে পারে। চট্টগ্রাম আসা তো আর মুখের কথা না। তুই মা’কে একটু খোঁজ সারতাজ। জলদি কর! ”

সারতাজ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠল, ” চিন্তা করো না দেখছি। ”

-” কি হয়েছে? ” মেহতিশার চিন্তিত কন্ঠস্বর।

সারতাজ বাসা থেকে নেমে যেতে যেতে জবাব দিল,

-” আমি এখন ঢাকা যেতে পারব না মেহতিশা। আপনি চলে যান। সাবধানে যাবেন। গিয়ে আমাকে একটা কল করবেন। ”

বাস ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মেহতিশা জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল বাহিরে। আবছা আলোয় দেখল সারতাজ ঝড়ের গতিতে ছুটে যাচ্ছে। চিন্তা হলো মেয়েটার! হলোটা কি আসলে? সারতাজটা কিছু তো বলেও গেল না।

_

নিলির সাথে ব্যাস্ত মেহজা। মেয়েটার পরিক্ষা শেষ হতেই সারাক্ষণ নিলিকে নিয়ে পড়ে থাকে। মেহজার সাথে নিলির বেশ ভাবও জমেছে। মেহতিশার বিড়াল তেমন পছন্দ ছিল না। ছোট বেলায় তার বাম হাতে বিড়াল বিশাল এক থা বা মে রে ছিল। তারপর হতে বিড়াল তার কাছে এক আতঙ্কের নাম। তবে নিলির আগমনের ওপর তার আতঙ্ক কে টে গেছে পুরোপুরি।

-” আপু তোমার কল এসেছে। ” ফোন এগিয়ে দিল মেহজা।

মেহতিশা ফোন হাতে নিল। রিসিভ করার পর অপাশ হতে কিছু বলা মাত্রই তার শ্যাম মুখোশ্রী জুড়ে নেমে এলো অমাবস্যা। আতঙ্কে, আ র্ত না দে অধরের হাসি বিলীন হলো। চট করে উঠে দাঁড়াল ও। মেহতিশার উষ্ণ কোল দখল করে শুয়েছিলো নিলি। মেহতিশা চট করে দাঁড়াতেই নিলি পাশে পড়ে গেল। মেহজা দুঃখী গলায় বলল,

-” এভাবে দাঁড়ালে কেন আপা? নিলি তো ব্যা থা পেল। ”

কোনো কথাই শ্রবণ করল না মেহতিশা। কানে ফোন চেপে ধরে পাশের ঘরে এলো কাঁপা পায়ে। কল কেটে দিয়ে ফোন ছুড়ল বিছানায়। টলমলে পায়ে ভূমিতে আঁটসাঁট হয়ে বসে মুখ চেপে কেঁদে উঠল। তার চেহারা জুড়ে শোভা পাচ্ছে অসহায়ত্ব, ভী তি!

চলবে~

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |২০|
সাদিয়া মেহরুজ

জীবন একটি রণক্ষেত্র। এখানে প্রতিটি লহমায়, প্রতিটি পদক্ষেপে যুদ্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। যুদ্ধে আসে নানা প্রতিকূল বাঁধা, নিদারুন ক ষ্ট! ভোগ করতে হয় অনেক যন্ত্রণা। এই জীবন নামক অধ্যায়ে রয়েছে সুখ নামক অতিথি পাখি। শীতকালে এদেশে যেমন অতিথি পাখি দূর দূরান্ত হতে উড়ে আসে এ দেশে কেবল এক নির্দিষ্ট সময়ে তেমনি সুখও একই পথের পথিক। সুখের আগমনী বার্তা শোনা যায় ভীষণ ভীষণ ক ষ্ট পোহানোর পর। তবে এক্ষেত্রে মেহতিশার জীবনে সুখ কোথায়? সবার জীবনেই কি একই নিয়ম বরাদ্দ থাকে কি? উঁহু! মেহতিশা তো সেই ছাব্বিশটা বছর ধরে দুঃখের কাঁটায় বিঁধে বিঁধে বড় হয়েছে। তার জীবনে তো সুখ হাতছানি দেয়নি। এইযে একটুখানি ভালো থাকতে শুরু করল, ক’দিন বা হলো? এক কি দু’দিন! এতো জলদিই কেন এলো বিষন্নতা? এতো জলদি কেন চলে গেল সুখ পাখি?
কান্না থেমে এসেছে মেহতিশার। কামড়ার দরজাটা চাপানো। ওপাশের রুম থেকে মেহজার আদুরে গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। মেহতিশা ফুপিয়ে উঠল! দৃষ্টি দিল মুঠোফোনে। চাকরিটা চলে গেছে। এখন কি হবে তার? কি হবে তার ছোট্ট বোনটার? সে যেই গার্মেন্টসে ডিজাইনারের কাজ করতো ঐ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানের এই টানাপোড়নের সময় সারতাজের বড় মামার আর সম্ভব হয়নি টিকিয়ে রাখা। এই কঠিন সময়ে যেখানে হুড়মুড়িয়ে সব ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই চলছে সেখানে তার আদও কি কোথায় চাকরি হবে কিনা ভেবে পেল না মেহতিশা।

কলিংবেল বাজল। মেহজা নিলিকে বিছানায় রেখে ছুটল দরজা খুলতে। রুম থেকে তখন বেড়িয়েছে মেহতিশাও। সদর দরজা খোলা মাত্রই দর্শন হলো বিধস্ত আয়েশাকে। দিক বেদিক না দেখে আয়েশা ছুটে এসে ঝাপটে ধরল মেহতিশাকে। হু হু করে কেদে দিল লহমায়! ক্রন্দনরত কন্ঠে শুধাল,

-” এখন কি হবে মেহতিশা? চাকরিটা যে চলেই গেল আমাদের। এতো কষ্ট করে পাওয়া চাকরি। মায়ের ঔষধ কেনারও টাকা শেষ। সাদিকের স্কুলের বেতন দেয়া হয়নি চার মাস ধরে। আমি এখন কি করবো বলো তো? ”

নিজেকে শক্ত করল মেহতিশা। ভরসার হাত রাখল আয়েশার মাথায়। সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বলে উঠল,

-” শান্ত হও আয়েশা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই তো করেন। এখানেও হয়ত আমাদের কোনো মঙ্গল লুকিয়ে ছিল তাই তিনি এমনটা করেছেন। এত অল্পতে ভেঙে পড়তে নেই। তুমি ভেঙে পড়লে তোমার ছেলে, তোমার মায়ের কি হবে বলো তো? ”

সান্ত্বনাও কাজ হলো না। আয়েশার কান্নার হিড়িক বেড়েছে। মেহজা নিশ্চুপ! নিলিকে কোলে তুলে ঘরের এক কোনায় গুটিশুটি মে রে দাঁড়িয়ে সে। মেহতিশা মেহজাকে দেখল। অতঃপর ফিসফিসিয়ে উঠল,

-” কেঁদো না আয়েশা। দেখো মেহজা ভয় পাচ্ছে। কান্না থামাও! ”

আয়েশা কান্না থামানোর চেষ্টা করল। হচ্ছে না! তার ছেলে আছে পাঁচ বছরের। অল্প বয়সে বিয়ে তার। তারপর কোল জুড়ে সুখের দ্যুতি নিয়ে সাদিকের আগমন। তবে সুখ যে ক্ষণিকের! তার স্বামী তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে যাওয়ার পর হতে একা হাতেই সাদিক, নিজের মা সহ পুরো সংসারটা শক্ত হাতে সামলেছে আয়েশা। এখন যখন আয়ের উৎসটা নিভে গেল অমনি তাকে ঝাপটে ধরল আ শ ঙ্কা! তার ছেলেটার কি হবে? তার অসুস্থ মায়ের কি হবে? তা ভেবে প্রাণ দ্যুতি তার নিভু নিভু হয়ে আসতে চাচ্ছে।

_

পাথুরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে সারতাজ। নড়চড় নেই। প্রান্তিকা তার পাশে কাঁদছে। অথচ এ সময় যার পাগলাটে আচরণ করার কথা সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, নিশ্চল। শাকিব এক মনে শায়লার শুভ্র কাপড় দ্বারা পেঁচিয়ে রাখা টুকরো দেহ খাঁটিয়ায় তুলছে। তার মুখোশ্রী দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে আদও কি চলছে। কিন্তু সারতাজ জানে এটা ঝড় আসার আগে বহমান শীতল সমীরণ।
শায়লা মা রা গেছে। ট্রেনে কা টা পড়ে। ভায়োলেন্ট হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ছুটতে ছুটতে তিনি চলে আসেন রেললাইনের নিকট। মধ্যদুপুর ছিল তখন। রেললাইনে নেই কোনো মানুষ। বা দিক থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসছে তখন ট্রেন। দিশেহারা শায়েলার পা তখন আচমকা আঁটকে গেল রেললাইনের মাঝে বেফাঁস ভাবে। শায়লা চেঁচাল! চেঁচিয়ে বলতে চাইল কিছু। হুঁশ ফিরেছিল তার মৃ ত্যু র পূর্বে। তবে কেন যেন দেহে বিন্দু পরিমাণ শক্তি পাচ্ছিলেন। ওখানেই গা ছেড়ে দেয়ার পর প্রবল বেগে আসা ট্রেন তার দেহের ওপর দিয়ে তাকে খন্ডিত করে দিয়ে গেলো। র ক্ত ছিটে পড়ল আশেপাশে। মৃগী রোগীর মতোন কাঁপুনি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন শায়লা। এরকম ভায়োলেন্ট শায়লা পূর্বেও হয়েছিল। ডাক্তার কড়া নজরদারিতে রাখতে বলেছিল তাকে। শাকিব তাই বাসায় নার্স দু’জন বাড়িয়ে রেখেছে। বাসার বাইরে গার্ডের সংখ্যাও বাড়িয়ে করেছে দ্বিগুণ। মা’কে তো আর নিজের সাথে তার নেয়া সম্ভব ছিল না। কোয়ার্টারে থাকে ও। সারাক্ষণ কাজে ব্যাস্ত। ফিরে রাত বারোটা কিংবা কোনো কোনো সময় দু’দিন হয়ে গেলেও দেখা মেলেনা তার কক্ষে। শায়লা একা কিভাবে থাকবে তা ভেবে আর নিজের সাথে উনাকে রাখেনি শাকিব। তবে এখন বোধগম্য হচ্ছে তার। কতো বড় ভুলটাই না শাকিব করল!

শাকিব হাঁটুগেড়ে ভূমিতে বসল। দু’হাতে আঁকড়ে ধরল শায়লার ফ্যাকাসে মুখোশ্রী। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে শাকিব আহ্লাদী গলায় বলল,

-” তুমি কখন ঘুম থেকে উঠবে মা? আমার খিদে পেয়েছে তো। খেতে দেবেনা? ”

আশেপাশে ছিল বেশ কয়েকজন র‌্যাব আর পুলিশ। তারা ব্যাতীত উপস্থিত সারতাজ, প্রান্তিকা। বাদ বাকি আর কেওই নেই। শাকিবের এহেন আচরণে ভড়কাল উপস্থিত সকলে কেবল সারতাজ বাদে।

-” মা ওঠো! উঠো জলদি। আমার কিন্তু অপেক্ষা সহ্য করতে পারছিনা আর। তুমি জানো না আমি ক্ষিদে সহ্য করতে পারিনা তবুও কেন উঠছো না তুমি? রাগ করেছ মা? আ’ম সরি! আজ তোমাকে সাথে নিতেই এসেছি তো। চলো উঠো। রেডি হও! ”

র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য শাকিবকে ধরতে এলো কারণ তার পাগলামি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এতে বাঁধা দিল সারতাজ। হাতের ইশারায় তাদের পিছু হটতে বলল। সরে গেল তারা। শাকিব পাগলাম করে যাচ্ছে। আ র্ত না দী সুর তুলে শায়লাকে ডেকে যাচ্ছে। সারতাজ সবাইকে বেরুতে বলল। প্রান্তিকার নিকট এসে তাকে টেনে তুলে বলল,

-” আপু তোমার রেস্ট দরকার। রুমে যাও। আমি ভাইয়াকে দেখছি। ”

প্রান্তিকা পাগলাটে, অন্যরকম শাকিবকে পরখ করতে করতে ভীত গলায় শুধাল,

-” শাকিব অমন করছে কেন? আমার প্রচুর টেনশন হচ্ছে। ”
-” কিচ্ছু হবেনা। আমি দেখছি তো। ”

প্রান্তিকা জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল। বিশাল রুমে এখন শাকিব, সারতাজ বাদে কেও নেই। ধীরস্থ পায়ে এগোল সারতাজ।শাকিবের পিঠে হাত রাখল। শাকিব তৎক্ষনাৎ পিছন ঘুরে পা ঝাপটে ধরল তার।

-” ভাই মা’কে বল না একটু তাকাতে। মা কি বেশি রাগ করে সারতাজ? মা কেন কথা বলেনা? একটু কথা বলতে বলনা। ”

শাকিবকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে ভূমিতে পা ভাজ করে বসল সারতাজ। কোমল দৃষ্টিতে তাকাল শাকিবের পানে। দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,

-” খালামনি আর কখনো চোখ খুলে তোমাকে দেখবে না ভাই। খালামনি আর নেই আমাদের মাঝে। হুঁশে ফিরো! চেয়ে দেখো বাস্তবতা। ”

পাগলামোর প্রকোপটা খানিকটা কমলো কি? হয়ত! শাকিব শায়লার হাত ছুঁয়ে দিল। পরম মমতায় চুমু খেলো। পরক্ষণেই হন্য হয়ে সারতাজের কাছে ছুটে এসে চেঁচিয় উঠল,

-” ভাই, ভাইরে..! আমার আর কেও রইল না ভাই। আমি এতিম হয়ে গেলাম ভাই। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। ইয়া আল্লাহ! আমার জানের বিনিময়ে আমার মা’কে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ। ভাই আমার মা’কে এনে দে না। আমার আর কিচ্ছু চাই না। আল্লাহ এতবড় শাস্তি আমায় কেনো দিলেন? ”

বিলাপ করে কাঁদছে শাকিব। সারতাজের ধ্যান নেই সেদিকে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে শায়লার ফ্যাকাশেটে মুখোশ্রীর পানে। তার শ্বাস রুখে আসছে চাইছে এটা ভাবতেই, এই মায়াময় চেহারাটা নাকি তার আর দেখা হবেনা! কেও আর তাকে তাজ বলে ডাকবে না। কেও আর হাতে তুলে খাইয়ে দেবে না। ঠোঁট দু’টো কাঁপল সারতাজের! অক্ষিকোটরে জলের উপস্থিতি। নিজেকে দমাল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে ফের যন্ত্রের মতো গহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শায়লার মায়াময়ী মুখশ্রীর পানে।

চলবে~