শানুর সংসার পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
439

#শানুর_সংসার(১২)

রান্নাঘরে সিংকের ওপর টাইলস বাধানো জায়গায় গুনে গুনে বারোটা কাপ সাজায় শানু। এবার দশ কাপে চিনি দিতে হবে দেড় চামুচ। বাকি দুই কাপে দুই চামুচ জিরোক্যাল। কিছু জিরোক্যালের ডিব্বায় আলেয়া আক্তার লবঙ্গ রেখেছেন। শানুর আসল ডিব্বা খুঁজে পেতে সময় লাগে দশ মিনিট। চা শুকিয়ে গেছে। পাতিল ধুয়ে আবার নতুন চা বসালো শানু। খালি মুখে চা দেয়া যায় না। শানুর বানানো নাস্তা ডেলিভারিতে দিয়ে শেষ। মোড়ের দোকানে রাজু্কে পাঠানো হয়েছে। গরম আলুপুরি, বড়া আর ঘুঘনি। সাথে চিড়া ভাজা, সেমাই। আলেয়া আক্তার বলে রেখেছেন, কাশিফরা রাতে খেয়ে যাবে। ওদের জন্য বাহির থেকে খাবার আনাবে বলায়, উনি খেপে গেছেন। শানু নাকি এখনি সবাইকে পর করে দিচ্ছে। ঘরে মেহমান খাওয়াবার মতো বাজার নেই শুনে, শানুর হাতে হাজার চারেক টাকা দিলেন তিনি। শানু ঐ টাকা না নিয়ে টেবিলে রেখে এসেছে। শানু নতুন নাস্তার বাটি বের করে। এগুলো সে তুলে রেখে ছিলো রাজুর বিয়েতে ব্যবহারের জন্য। সাদা ফুল তোলা পোর্সেলিনের বাটির চারপাশে সোনালী বর্ডারের চিকন কারুকাজ। বাটির নিচে আবার জরিজরি টানা। শানু বাটি গুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নেয়। সবাই বলে তার কাজ একদম নিখুঁত। শানুর হাতের জাদুতে সব জায়গা চকচক করে। শানু কষ্টের নিঃশ্বাস ছাড়ে। অথচ, এই সুনিপুণা খুঁতহীন মেয়ের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

বসার ঘরে আজ সবাই আসিফ ও শানুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জড়ো হয়েছে৷ শানুর পক্ষে এসেছে তার এক ভাই, ভাইয়ের বউ, তাদের চার ছেলেমেয়ে। কাশিফ এসেছে রুম্পাকে নিয়ে। বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি হাজির আছেন। তাদের মতামত ও প্রয়োজনীয়। আসিফরা এ পাড়ায় অনেকদিন। প্রতিবেশীদরে কথায় অনেক সময় ভুল ঠিক বিচার করা সহজ হয়। শানু রান্নাঘরে পাখা চালায়। ফ্যানের বাতাসে চুলোয় আগুন লাগতে সমস্যা হচ্ছে। বাতাস আড়াল করে দাঁড়ায় শানু। তার শরীরে তীব্র তাপ লাগছে। যার অন্তর ছাই হয়ে গেছে, তার বাহ্যিক আঁচে কি যায় আসে। শানু সরে যায়। এত আগুন সইবার দরকার নেই। যতক্ষন লাগে লাগুক। রাজু ভাজা পোড়া এনে মাকে দেয়। আলেয়া আক্তার নাতির পিছুপিছু এসেছেন।

‘সব বাইরের নাস্তা দিবা? ঘরের কিছু বানাও।’
‘চা দিব আম্মা। চিড়া ভাজা আছে। সেমাই করলাম। ‘
ফলমূল নাই? লিচু দাও না। কাশিফের ছেলেটা লিচু পছন্দ করে।’

অন্য দিন হলে, শানু নিজেই লিচু ছুলে দিত। আজ কেন যেনো মন চাইছে না।
‘মিশু লিচু পছন্দ করে আম্মা। অল্প কয়েকটা আছে। ও রাতে ভাতের পর খাবে, বলে রেখেছে। ‘
‘ওরে আবার এনে দিও৷ চাচার ঘরে ভাতিজা লিচু খাবে। মিশু তো বড়। ‘
‘আমার মেয়ের সাধ অন্যকে দিতে পারব না আম্মা। রাজু, তোর দাদুর কাছ থেকে টাকা নে। লিচু নিয়ে আয়।’

রাজু মা ও দাদীর কথা চুপ করে শুনছিলো। দাদী মিশুর লিচু দিতে বলায় তার মেজাজ চরম খারাপ হয়েছে। মায়ের মতামত শোনার অপেক্ষায় ছিলো। শানু দিতে গেলে রাজু লিচু ডাস্টবিনে ফেলে দিত। মায়ের উত্তর শুনে তার মেজাজ ঠান্ডা হলো।

‘আমি যাবো আর আসব, কি কাজের লোক নাকি। লিচু খায় না বাসায়?’
‘ছোট ভাইরে এমন করে বলতে হয় না, রাজু।’
‘তুমি ওদের বাসায় যাচ্ছো তো, দাদী। যাওয়ার সময় ঝুড়ি ধরে কিনে লিচু নিয়ে যাবা। ‘
‘আমার শরীর ভালো না। পায়ে খুব ব্যাথা। শানু, হট ওয়াটার ব্যাগ দিও আমারে।’

আলেয়া আক্তার দ্রুত পরিস্থিতি বদলে ফেলেন। কাশিফের বাসায় কাজের লোকের ঝামেলা। বুড়া মহিলা যাবে শুনে তারা বেঁকে বসেছে। রুম্পা চাকরী করে সংসার করে। ঘরের অনেক কিছু তাকে এড়িয়ে যেতে হয়। আলেয়া আক্তার গিয়ে থাকা শুরু করলে কাজের লোকদের ফাঁকিবাজি ধরে ফেলবেন। শাশুড়ীর কথা রুম্পা ফেলতেও পারবে না। তাই, কাজের লোকেরা যাই যাই করছে। রুম্পা তাকে ইশারা ইঙ্গিতে সে কথা বুঝাচ্ছিলো। আলেয়া আক্তার জানিয়েছেন, ‘এখন তার যাবার মন নেই। আগে কি হয়,দেখা যাক।’

রাজু মায়ের হাতে হাত লাগিয়ে ট্রে সাজায়। মিশুর ঘরে কাশিফের ছেলে খেলা করছে। ওদের নাস্তা আগে দিয়ে আসে শানু। মিশু বিছানায় চাদর টেনে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। মাকে দেখে বই সরিয়ে রাখলো।

‘ওরা সবাই কখন যাবে মা?’
‘এইতো, ঘন্টা খানেক।’

শানু মিশুর পড়ার টেবিল গোছায়। জীববিজ্ঞানের বইতে লাল মার্কার দিয়ে মিশুর টিচার মার্ক করে দিয়েছে। শানু মেয়ের পড়া ধরতে বসে। মিশু কাচুমাচু মুখে বলে,

‘আমি পড়িনি, মা। বাবা আর তোমাকে নিয়ে টেনশন লাগে।’
‘কিসের টেনশন তোর?’
‘বাবা আমাদের সাথে না থাকলে আমরা কি খাবো। কোথায় থাকবো, কিভাবে চলবে।’
‘কাজ করে খাবি। তোর বয়সী মেয়েরা কাজ করে না?’
‘কোথায় কাজ করব মা। ‘
‘সুপার শপে কাজ করবি। আট ঘন্টা করে ডিউটি। স্কুল থেকে এসে বাসায় গোসল করে খেয়ে কাজে যাবি। ফিরে পড়তে বসবি।’
‘আমাকে সবাই খারাপ মেয়ে বলবে। স্কুলে সবাই হাসাহাসি করবে। ‘

শানু কাশিফের ছেলেকে কলা খাইয়ে দিচ্ছিলো। মিশুর কথা শুনে থেমে সামনে তাকিয়ে থাকলো। বারান্দার গাছে পানি দেয়া হয় না। শানুর মনে থাকে না। আগে কত কিছু খুটিনাটি মনে থাকতো। এখন শুধু দরকারী জিনিষ গুলো ছাড়া বাকি সব বিস্মৃতির খাতায়।

‘শোন মিশু, তুই খালি পেটে থাকলে কেউ তোকে এক মুঠো ভাত ডেকে খেতে দেবে না। সবাই আহা উহু করবে। কিন্তু, যেই তুই শিকল খুলবি। পা বাড়াবি তপ্ত রাস্তায়, লোকে দৌড়ে এসে তোর পায়ে লোহার জুতো পরিয়ে তোর পা একশ কেজি ওজন বানাবে। তোকে নোংরা বলবে। এখন তুই বুঝবি, ক্ষুধায় ধুঁকে মরবি, নাকি ঐ লোকের মুখে লাথি দিয়ে বেঁচে থাকবি।’
‘আমি এত শক্ত শক্ত কথা বুঝি না, মা। আমার খুব ভয় লাগে। স্কুলের রাস্তায় ঐ ছেলেটাকে ভয় লাগে। অপরিচিত মানুষ যখন শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে ভয় লাগে। খুব ভয় লাগে মা, খুব ‘।
‘রাস্তার ঐ ছেলেটাকে একদিন শিক্ষা দিবি। অপরিচিত যারা তোর বুকের দিকে তাকায়, তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবি৷ কেউ তোকে বিব্রত করলে, তাকে ছেড়ে দিবি না মিশু৷ দোষটা তার, তোর নয় তো। ভয় পাবি কেনো। ‘

‘চাচী, চাচা কি তোমাদের অন্য বাসায় রেখে আসবে?’
‘কেনো বাবা?’
‘আব্বু বলেছে, দাদু আমাদের কাছে থাকবে। তোমরা এক বাসায়। চাচা আরেকটা চাচীকে নিয়ে এই বাসায় থাকবে।’

শানু কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে এলো। বসার ঘরে তুমুল আড্ডা চলছে। শানু বা আসিফের কথা কেউ মুখে তুলছে না। রুম্পা হাতের ফোন নিয়ে ব্যস্ত। সে একবার কাশিফের কানে কিছু বলায়, কাশিফ গলা খাঁকারি দিলো।

‘আমাদের একটু তাড়া আছে। রুম্পার মামাতো বোনের বাচ্চা হয়েছে৷ দেখতে যাবো। আমরা যে কাজটায় এসেছি, তা শেষ করি।’
শানুর মামাতো ভাইও উসখুস করে। এই বোনের বিয়ে হবার পর আর তার সাথে যোগাযোগ নেই। আত্মীয় বলতে সেই আছে। তাই তাকে ডেকে আনা। তার কিছু বলার নেই। বাসা থেকে আসার সময় বউ হুশিয়ারী দিয়েছে, সে যেনো চুপ থাকে।

‘চা খেয়ে কথা বলি বাবাজী। গলা শুকায় গেলো।’
‘মুরুব্বি, আপনি কি বলেন। শানু ভাবী ডিভোর্স চায়। এটা কি ঠিক?’

মুরুব্বী দাঁড়িতে হাত বোলান। আসিফ আরেক জায়গায় প্রেম করে বলা হয়েছে। মহিলার পারিবারিক অবস্থা ভালো। আসিফকে টুকটাক সাহায্য করে। এতে আসিফর উপকার হয়। আসিফ স্বীকার করেছে।

‘এখন আসিফ বাবাজীর কি মত? সে কি ঐ মহিলাকে বিয়ে করবে?’

আসিফ বুক ফুলিয়ে বসে ছিলো। আজকে শানুর দম্ভ ভেঙে গুড়িয়ে দেবার সময় এসেছে। গত একটা মাস আসিফ বাড়ি ছাড়া। পাড়ায় এলে ছেলে ছোকরারা তাকে দেখে গান ধরে। দোকানীদের কাছে ইজ্জত নেই। নিজের মা আলেয়া আক্তার ঠিক মত কথা বলেন না৷ ছোট ভাইটা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে কিছু বলার আগে। আর রাজু? বদমায়েশের ধাড় হয়েছে। আসিফ ডেকে প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয় না।

‘আপনারা যদি বলেন, আমি আলাদা সংসার করব। ‘
‘আলাদা সংসার মানে বাবাজী?’
‘তুই আবার বিয়ে করবি, আসিফ? কোথায় থাকবি বিয়ে করে।’

আলেয়া আক্তারের অসহ্য লাগছে। আসিফকে থাপড়াতে পারছেন না। লোকের সামনে তার ইজ্জত যায়।

‘শানুকে আমি ছাড়তে চাই না, আম্মা। মিশু, রাজু ওদের কি হবে।’
‘তুই ঐ মেয়েকে ছেড়ে দে। ‘
‘এটা পারব না, আম্মা। মানসিক ভাবে আমি ওখানে শান্তি পাই। শানু গুছিয়ে সংসার করে। আবার, আপনাকে, বাচ্চাদেরকে ও শান্তিতে রেখেছে। আমার যা দরকার ছিলো, সেটা এক সময়ের পর ও দিতে ব্যর্থ। বলতে পারেন, বাধ্য হয়ে আমি বাইরে অল্টারনেট খুঁজেছি। ‘

রুম্পার কান জ্বলে পুড়ে গেলো। সে কাশিফকে এক নজর দেখে নেয়। এই লোকের রক্তে নোংরামী আছে। আপন বড় ভাই লম্পট হলে, তার স্বামীর হতে কতক্ষণ।

‘এভাবে তো চলে না, ভাইয়া। দুটো সংসার চালানো যায় না।’
‘এই সংসার যেমন চলছে, চলবে। ঐ জায়গা নিয়ে তোদের ভাবা লাগবে না।’
‘সমাজের লোককে কি বলে বুঝ দেবে।’
‘এই যে মুরুব্বিরা আছেন। ওনারা বুঝলেই হবে। আরে, এক বিয়ে রেখে আরেকটা বিয়ে কি করা যায় না? ‘
‘শানু ভাবী মানবে? ভাবী সেপারেশন চাচ্ছে।’
‘ও চাওয়া না চাওয়ার কে। ওর যোগ্যতা কি। ভাত ফুটিয়ে হাড়ি ধুয়ে তুলে রাখা। কতগুলো মন্ডা মিঠাই খুব বানিয়ে কয় টাকা আনলো কি আনলো না। তাকে নিয়ে মাতামাতি। তোদের এত মাথা ব্যাথা কেনো।’

শানু পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে। ওকে দেখে সবাই চুপ করে গেছে। পর্দা গুলো শখ করে কিনে ছিলো শানু। নিউমার্কেটের ভেতরের দোকান থেকে, অনেক দামাদামি করে। ইচ্ছে ছিলো, বাসায় মিলাদ দিয়ে তেহারী রান্না করে সবাইকে দেখাবে। রেহানা ভাবী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে শানু তাকে ভেতরে ডাকে।

‘আপনি এসে বসেন ভাবী। বাইরে কেনো।’
‘আপনারা নাকি বাসা ছেড়ে দিবেন?’
‘কই না তো। কেনো বাসা ছাড়ব?’

রেহানা আসিফের আপাদমস্তক মেপে উত্তর দেয়,
‘ভাই শুনলাম আরেকটা বিয়ে করেছে। আপনারা আর ভাইয়ের সাথে থাকবেন না।’
‘ভুল শুনেছেন ভাবী। ভাই আরেক মহিলার সাথে বিয়ে না করে শুতে যায়। তাই, আমি আপনার ভাইকে ছেড়ে দিচ্ছি।
আপনার ভাই আমাকে ছাড়ছে না।’

আসিফ শানুর স্পর্ধিত কন্ঠস্বর শুনে স্তম্ভিত। এত সাহস সে কোথা থেকে পেয়েছে। একটা টাকার মুরোদ নেই যে মহিলার, সে এত বড় কথা মুখে আনে কেমন করে।

‘শানু, ভিতরে যাও। এখানে তোমাকে কেউ ডাকেনি।’
‘তোমাকে বা কে ডাকলো আসিফ? তুমি এখানে কেনো?’
‘আমি পুরুষ মানুষ। সমস্যা তৈরী হয়েছে, তার সমাধান করব।’
‘সমস্যাটা কে তৈরী করেছে? তুমি। যে সমস্যা তৈরী করলো, সে আবার সমাধান করবে। তা কি সমাধান হলো। তুমি ঐ মহিলার সাথে নিয়ম করে শুবে, আমি তোমার মা আর বাচ্চাদের দেখভাল করবো।’
‘এ ছাড়া অন্য কিছু করা যাবে না। তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারছো না।’

শানু লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। সবার সামনে আসিফ তাকে এভাবে অপমান করতে পারলো! অবশ্য যে পুরুষ ঘরে বউ রেখে আরেক মহিলার সাথে নিয়মিত সহবাস করে থাকে, তার আবার লজ্জা কিসের। শানু হাত তুলে চোখের পানি মুছে। বেশ শব্দ তুলে নাক টেনে নেয় একবার। তারপর হো হো করে হেসে ওঠে।

‘আচ্ছা৷ আমি যদি একই কথা তোমাকে বলি? তোমার সুগারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার ঔষধ চলে। বয়স পঞ্চাশ, তার ওপর তুমি এমন কোন সুঠাম দেহের পুরুষ ও না আসিফ। যদি বলি, তুমি আমাকে স্ত্রীর অধিকার থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত করে অন্য মহিলার সাথে থেকে এসেছো?’

‘নোংরা মহিলা, এত নোংরা। দেখেন আপনারা, এর সাথে সংসার করি।’
‘সংসার তুমি কর নাই, আসিফ। সংসারটা আমি করে গেছি। আপনারা আমাকে বলেন, মুরুব্বীরা। আম্মা, আপনি বলেন, যদি আমি অপর পুরুষের সঙ্গে শুয়ে আসতাম, আপনার ছেলে আমাকে এত দিন এই সংসারে রাখতো? লাথি দিয়ে বের করে দিত না?’

আলেয়া আক্তার কান চাপা দেন। শানু এসব কি কুকথা বলছে। আসিফ দোষ করেছে সত্যি। তাই বলে, আসিফের সাথে তুলনা করবে। তাও, এত গুলো মানুষের সামনে।

রেহানা থেমে থাকতে পারলো না। আসিফের দিকে আঙুল তুললো,
‘আপনি অনেক দিন ভাবীকে কষ্ট দিয়েছেন। আমি সাক্ষী। ভাবীর সাথে এক রুমে ঘুমান না। ভাবীকে নিয়ে বছরের পর বছর কোথাও যান না। ভাবী আপনাকে কি সন্তুষ্ট করবে? আপনি বাসায়ই থাকেন না, আসেন না। তখন কি আর কেউ জানে আপনি আরেক মহিলার রক্ষিতা হয়েছেন?’

‘রক্ষিতা ‘ বলেন না আপা। মহিলারা অভাবে রক্ষিতা হয়। ভাইয়ার কিসের অভাব ছিলো। শানু ভাবীর মত নিবেদিত প্রাণ সংসারী মানুষকে যে লোক ঠকায়, সে নিজে অমানুষ’।

রুম্পা কথা বলে কাশিফের দিকে তাকায়৷ কাশিফ মাথা হেঁট করে আছে। আলেয়া আক্তার রুম্পাকে কিছু বলতে যাবেন, শানু তাকে থামায়।

‘আপনারা এখানে এসেছেন, আমার সংসার নিয় সিদ্ধান্ত নিতে। আমাকে, আমার বাচ্চাদেরকে কি করা হবে তাই নিয়ে মত দিতে। আমার মত কি একবারের জন্য জানতে চাননি। আমার মত হলো, আমি আসিফের সাথে আর সংসার করবো না। ‘
‘তাহলে, তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যাও। এখানে তোমার জায়গা নাই। আমি আম্মা মিলে বাচ্চাদের দেখবো।’
‘আমি না৷ তুমি যাবে আসিফ। এটা আমার সংসার। তিলতিল করে, রক্ত মাংস এক করে গড়ে তোলা ‘শানুর সংসার’ এখান থেকে তুমি চলে যাবে। আম্মা থাকতে চাইলে থাকবেন, না থাকলে তার ছেলের ঘরে যাবেন। আমার বাচ্চারা কোথাও যাবে না। ‘
‘রাজু কোথায়, ওকে ডাকো। মিশু বলুক। ওরা তোমার সাথে থেকে না খেয়ে মরবে কি না। ‘
‘ওদের অভিভাবক আমি। নষ্টামি করার আগে বাপ হয়ে বাচ্চাদের মতামত চেয়ে ছিলে? এখন তাহলে ওদের দরকার নেই। ওরা না খেয়ে থাকবে না। তোমার যদি বিবেক থাকে, ওদের খোরপোষ দিবে। আপনারা চুপ করে আছেন কেনো? এখন, বাপকে বলুন, বাচ্চাদের খোরপোষ দিতে। নাকি আমার সাথে থাকবে বলো সেটা সে দেবে না। আম্মা, কিছু বলতে পারেন না আপনি?
‘আসিফ ওদের খোরপোষ দিবে। তুমি সংসার ভেঙো না শানু। তালাক দিও না। ‘
‘তালাক আমি দেব আম্মা। তিন মাস আপনার ছেলে এ বাসায় আসবে না। সে তার বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে চাইলে বাইরে দেখা করবে। আপনাকে দেখতে চাইলে, আপনি কাশিফের বাসায় যাবেন। এই সংসারে প্রবেশ আসিফের জন্য নিষিদ্ধ আম্মা। আমার সংসারে আমি কোন নোংরা কীট চাই না। ‘

আসিফের গলার স্বর নরম হয়ে আসে। শানু এভাবে সকলের সামনে তার চামড়া টেনে খুলে নেবে, সে কল্পনায় আনেনি। মুরুব্বিরা চুপ করে আছেন। শানু মিথ্যে বলেনি।

রুম্পা উঠে এসে, শানুর কাঁধে হাত রাখে। চাকুরীজীবি বলে তার সুক্ষ একটা অহমিকা ছিলো। আজ শানুর সামনে সব মিথ্যে লাগছে।

‘ভাবী, যদি কখনো কোন দরকার হয় জানিও। তোমাকে সবসময় নরম, কোমল দুর্বল মানুষ ভেবেছি। আসলে, তুমি আমাদের চেয়েও শক্ত। ‘
‘পারলে আমার ব্যবসার কয়টা অর্ডার এনে দিও, রুম্পা। কারো সাথে বিছানায় শুয়ে না, নিজের জানা জ্ঞানটুকু দিয়ে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে চাই। ‘

রেহানা এবার ছুটে এলো। শানুকে সে কত জ্বালিয়েছে। নানান কথায় প্রমাণ করতে চেয়েছে, শানু অবুঝ। আজ শানুকে ধরে তার নাচতে ইচ্ছে করছে।

‘ভাবী, অর্ডার নিয়ে ভাববেন না। আপনার নিয়ত ভালো তো জগত ভালো। খালাম্মা, শানু ভাবীকে আপনার একটা দোকান দেন না। ফেলেই তো রাখছেন। থাকবেন ও ভাবীর ঘাড়ের ওপর। আরো ভেঙে বলবো?’

আলেয়া আক্তার ঘরের ভেতর গিয়ে আবার ফেরত এসেছেন। তার হাতে দুটো টাকার তোড়া।
‘এটা রাখো শানু। আসিফের দেয়া চল্লিশ হাজার টাকা। তুমি এই সংসারে খাটলা তো অনেক। এই টাকায় তোমার হক আছে।’

শানু একবার ভাবে টাকাটা সে নেবে না। নিলে সেই আসিফের পয়সায় ভর দিয়ে পত্তন গড়া লাগে। তারপর সে টাকাটা নেয়। সত্যি এই টাকায় তার হক আছে। তার প্রতিটি ঘামের বিন্দু হিসেব করলে, এই টাকার পরিমান সামান্য। তার বিশ্বাস ভাঙার দাম আদালত নির্ধারণ করলে এর থেকে কয়েক গুন টাকা ধরতে পারে। শানু আইন আদালত করবে না। সে শান্তি চায়৷ নিজের মতো করে বাঁচতে চায়।

—–
মিশু কলেজের গাড়িতে উঠতেই সঙ্গে পড়ুয়া ছেলেটা ওর কামিজ টানলো।

‘এই তুই মেয়ে মানুষ হয়ে কামিজ ঠিক রাখিস না কেনো? বাসে বসিস কামিজ পায়ের ওপর থেকে সরে থাকে। উরু দেখা যায়।’
‘তুই ছেলে মানুষ হয়ে অন্য মেয়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকিস কেনো বেহায়ার মতো? আমি কামিজ টেনে না বসলেও তুই চোখ নামিয়ে বসবি। তুই তো ভালো। আমি খারাপ, তাই তোর আমাকে দেখতে হবে না। তুই সাধুপুরুষ, অন্য মেয়েদের দিকে তাকাবি না, হারা ম জাদা। ‘

ছেলেটা সিটের ভেতর ঢুকে গেলো। অন্য ছেলে মেয়েরা এবার তাকে টিজ করা শুরু করেছে। মিশু বুকের কাছে ব্যাগটা নিয়ে বসে সামনে তাকায়। সমাজ তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। মা না থাকলে এই সাহস তার কোনদিন হতো না। মিশু মাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে মিশু। ভাইয়া হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে ভর্তি কোচিং সেন্টারের টিউশনি করাতে চলে গেছে। ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করে রাতে ঘুম হয় না ভাইয়ের। বাসায় গিয়ে ভাইয়ের মাথা টিপ দেবে মিশু। তার নিজের ও কাজ রয়েছে। মায়ের কাছ থেকে কুশিকাটার কাজ শিখে কলেজে টুকটাক বিক্রি করে। আর মা! মায়ের সেই অখন্ড অবসর যেনো চড়াই পাখির ডানায় ভর করে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে। বাস চলতে শুরু করলে মিশু স্বস্তির হাসি হাসে। কি বোকাই না ছিলো সে।

দোকানের ক্যাশ গুনে ব্যাগে ঢোকায় শানু। বাজারে আলেয়া আক্তারের একটা দোকান সে ভাড়া নিয়েছে। মাসিক ভাড়া যদিও আলেয়া আক্তার নিতে চান না। শানু তাকে তার সাথে থাকতে দিয়েছে৷ তিনি এতেই খুশী। তবু, শানুর দেয়া টাকা তিনি ব্যাংকে জমান। মিশুর বিয়েতে কাজে লাগবে। মিশুকে সে কথা বলায়, মিশুর কি রাগ। মিশু বলেছে, কলেজ শেষ করে সে বিদেশ যাবে। তখন আলেয়া বুড়ির টাকা নিয়ে খরচ করা যাবে। রিক্সায় যেতে যেতে শানু এসব ভাবছিলো, আর হাসছিলো। আজকে রিক্সা চালাচ্ছে সজীব মামা। শানুকে হাসতে দেখে সেও হাসে।

‘আপা, আগের মত আর ঘুরাফিরা করেন না? আপনে আগে শুক্কুরবার শুক্কুরবার কত বেড়াইতে যাইতেন।’
‘সময় পাই না মামা। আপনার বউ বাচ্চা কেমন আছে।’

সজীব মামা সলাজ হাসে। তার আরেকটি কন্যা সন্তান হয়েছে। শানুকে সে কথা বলতে শরম লাগে। শানু শুনেই সজীবের হাতে ক্যাশ থেকে ওঠানো কিছু টাকা দেয়।

‘মেয়ের নামে বীমা করে রাখবেন মামা। মেয়ে মানুষের জানের কোন গ্যারান্টি হয় না। কবে কখন এই টাকা কাজে আসবে বুঝবেন না’।

মামা হেসে ঘাড় কাত করে। শানুকে সে এখন থেকে প্রতিদিন বাড়ি নিয়ে যাবে। শানু ফেসবুক ঢোকে। তার পেজের নাম ‘শানুর সংসার’। ওখানে নিয়ম করে শানু তার জীবনের গল্প লেখে। অজস্র ভুল বানানের গল্প গুলো হাজার হাজার মানুষ পড়ে, হাসে, কাঁদে আবার শানুকে ধমকায়। কেনো শানু স্বামীকে এত সহজে ছেড়ে দিচ্ছে। কত শত মহিলা পুরুষ আইনজীবি শানুর হয়ে লড়তে চায়। শানুকে বড় অংকের ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করে। শানু সব দেখে হাসে। সে জানে এ সব কিছু সাময়িক। মানুষ বড় হুজুগে। আজ যাকে বুকে টেনে নিলো, কাল তাকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। শানুও কোন না কোন সময় তার স্বামীর প্রিয় ছিলো। শেষ পর্যন্ত কি থেকে কি হয়ে গেলো। ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই। বাবুর প্রফাইলে ঢুকে শানু জোরে জোরে হাসে। ছেলেটা নতুন করে প্রেমে পরেছে। তাদেরই ব্যাচমেট এক মেয়ের ওপর। তাকে নিয়ে নিয়ম করে কবিতা লেখে। আর শানুদের ট্যাগ দেয়। বেগানা নারীকে নিয়ে ‘হুজুর ‘ মানুষ কবিতা লেখে বলে গ্রুপের সবার ভেতর চরম হাসাহাসি চলে। শানু বাবুকে বলে রেখেছে, ওদের বিয়েতে শানু বিনামূল্যে মিষ্টান্ন সাপ্লাই দেবে। বাবু শুধু বিয়েটা করে ফেলুক।

বাড়ি ঢোকার সময় শানু হঠাৎ সামনের দোকানের বেঞ্চিতে তাকালো। আসিফ বসে দোকানের গ্লাসে চা খাচ্ছে। আসিফকে দেখে অসুস্থ মনে হলো শানুর। প্রাক্তন স্ত্রীকে দেখে আসিফ এগিয়ে আসে।

‘আম্মার সাথে দেখা করতে এসে ছিলাম। আম্মা সময় দিলেন না। তোমরা সবাই ভালো আছো, শানু?’

আসিফের কন্ঠে মমতা ঝড়ে পরছে। শানু গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। আসিফ তার সাথে সাথে এসেছে। মিশু রাজুর কথা বারবার জানতে চায় আসিফ। সন্তানদের সাথে দেখা হলো না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে। ওদের মুখে ‘বাবা’ ডাক শোনা হয় না অনেক দিন।

‘বসো, ভাত খেয়ে যাও। এখন কোথায় থাকো।’
‘মেসে। চাকরিটা চলে যাবার পর কোথাও ঢুকতে পারছি না। আসলে, এই বয়সে কেউ নতুন করে চাকরী দিতে চায় না। মেহু কিছু না বলে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেলো। আমার পাপের সাজা হচ্ছে শানু। তোমাকে ঠকানোর পাপ। বাচ্চাদের সাথে অবহেলা করার পাপ। ‘

আসিফ সরাসরি ডাইনিং টেবিলে বসে গেলো। এ ঘর একদিন তার ছিলো। ঘরের কর্তা ব্যক্তি হিসেবে দুর্দন্ড প্রতাপের পুরুষ ছিলো আসিফ। আজ এখানে পা রাখতে গেলে শানুর অনুমতি নিতে হয়। যে সরলা নারীটি এক সময় দূয়ার ধরে তার জন্যে প্রতিক্ষায় থাকতো, আজ তার হাতে ঘরের চাবি। আসিফ শানুর নাকের দিকে তাকায়। বিয়ের নাকছাবিটা নেই। ওখানে ভেসে থাকা হীরের নাকফুল ঝলমল করছে।

আসিফের প্লেটে ভাত তুলে দেয় শানু। সামান্য আয়োজন, তাই কত গোগ্রাসে খায় আসিফ। চেয়ে মাছ খায় আরেক টুকরো৷ ডাল খায় লেবু মেখে। আলেয়া আক্তার এক পাশের চেয়ারে এসে বসে ঘণঘণ চোখ মোছেন। শানু আসিফের প্লেটের পাশে আলাদা বাটিতে তার সিগনেচার আইটেম কুঁচো সন্দেশ রেখে নিজের ঘরে যায়। ব্যলকনি থেকে দেখে মিশু রিকশা থেকে নামছে। কলেজ বাস গলির মুখে ছেড়ে যায়। মায়ের দিকে হাত নাড়ে মেয়ে। কলবেল বাজায়, শানু দরজা খুলতে গেলো না। বাবা-মেয়ের দেখা হবার দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করছে না। চাইলে শানু আসিফকে এ বাড়িতে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। তাতে আলেয়া আক্তারের কষ্ট বাড়বে। সন্তানদের পিতা থেকে আলাদা করার অভিপ্রায় তার নেই। ওরা নিজের বিচার দিয়ে ব্যবহার করুক। রাজু পারতপক্ষে পিতার মুখোমুখি হয় না। মিশু আসিফের সাথে দেখা করলেও অল্প কথায় উত্তর করে।

বেশ করে দখিণা বাতাস বইছে। এখন, জোরদার দুই কাপ চা বানিয়ে রেহানা ভাবীর বাসায় গল্প করতে যাবে শানু। আলমিরা থেকে শাড়ি বেছে নিজের ব্যাগ খুলে হিসেব করে বেশ কিছু টাকা আলাদা করে নেয়। আগামী কাল শুক্রবার। শানু বহুদিন নিউমার্কেট যায় না। কাজের চাপে পুরনো শানুকে ভুলে আছে। গোলাপী শাড়িটা গায়ে মেলে শানু। কপালে যে টিপ পরবে, তা লাগিয়ে রাখে কাঁচ আয়নায়, সাথে মেলানো কাঁচচুড়ি। খোলা আকাশ জুড়ে ঝকমকে রোদের মাঝে মেঘদলের পাল তোলা নাচন তার মন আঙিনায় খেলে যায়। শানু তার নিজ সংসারে নিজেকে নিয়ে ভালো থাকার ভাবনায় হাসে। সে হাসি ছুঁয়ে যায় বিস্তর নীল মেঘে ঢাকা এক আকাশ গঙ্গায়।

(সমাপ্ত)