শানুর সংসার পর্ব-০৯

0
266

#শানুর_সংসার (৯)

‘পরীক্ষার আগে এই শেষ ডেলিভারি, মা। এরপর কিন্তু আর যেতে পারব না। ‘

শানু নাজুক স্বরে ছেলেকে মিনতি করে। রাজুর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। একের পর এক ডেলিভারির চাপে শানু কাজ করে কুলোতে পারে না। ছেলে মেয়ে অবশ্য এতে বেজায় খুশী। মা সংসার ছাড়াও একটা কাজ করছে। রাজু এতদিন বিনাবাক্য ব্যয়ে মায়ের কাজ করে দিতো। শানুর খাবার তালিকায় ঝাল পিঠা যুক্ত হওয়ায় বিকেলের নাস্তার কাটতি বেড়েছে। রাজুকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে শানু। আসিফ যদিও স্ত্রী এবং ছেলের এই গোপন বিষয়টি জানে না। আলেয়া আক্তারের হাতে পায়ে ধরে চুপ করিয়ে কথা নিয়েছে শানু। পড়াশোনার ক্ষতি হবে না, দাদুকে বুঝিয়ে রাজু মাকে সাহায্য করে। ছেলেকে নাড়ু আর সন্দেশের বাটি ভর্তি ব্যাগ সাজিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দেয় শানু। ঝাল পিঠার ব্যাগ আলাদা। চিকেন ও বিফ দুটোর ক্রেতা ভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার করেছে। শানু বুদ্ধি করে সন্দেশের সাথে কয়েক পিস করে ঝাল পিঠা ফ্রি দেয়। ঘ্রাণে অর্ধভোজন হলেও আগে, দর্শনধারী, পরে গুনবিচারী। তেমনি, যারা একবার পিঠা খায়, তারা আবার অর্ডার করে।

‘বাবা এত রাত করে ফেরে কেনো, মা’।
‘জানি না, আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করে না। ‘ রাজু কাঁধে ব্যাগ তুলতে তুলতে প্রশ্ন করলে শানু স্বাভাবিক স্বরে উত্তর করে।

‘আসি মা। একটা ডেলিভারি কোম্পানির সাথে কথা বলি। তোমার কাজ বন্ধ করার দরকার নেই।’
‘বলে দেখ। তোর বাবা জানলে সমস্যা হবে। কোম্পানির লোক আসলে দরজায় অপেক্ষা করবে। তার মুখোমুখি পরবেই’।

রাজু জুতোর ফিতে বাঁধে। একবার অনার্স শেষ করতে পারলে সে যে করে হোক সরকারী চাকরীর জন্য চেষ্টা করবে। বাবার খুব পয়সা দেয়ার দেমাগ। সন্তান পালনে পয়সার চেয়ে স্নেহ ও মায়া প্রয়োজন। স্নেহ নিন্মগামী, সন্তান ভুল করলেও বাবা – মা ক্ষমা করে। বাবা হয়ে আসিফের অভিধানে ক্ষমা শব্দটি অনুপস্থিত। রাজু চলে গেলে শানু ফেসবুক খুলে বসে। রেহানা ভাবী সিলেট ঘুরতে গিয়ে মালিনী ছড়া টি স্টেটের ভেতর নীলকন্ঠী ময়ূর আঁকা শাড়ি পরে ছবি তুলেছে। শানু ছবিটা দেখে। তার খুব ইচ্ছে হয়, এমন একখানা শাড়ি পরে চুল উড়িয়ে খোলা গাড়িতে করে ঘুরতে। ভেবেই হেসে ফেলে শানু। আসিফ তার এই বিচিত্র ইচ্ছে জানতে পারলে কি বলে বসে, কে জানে! রেহানা ভাবীর এলবাম দেখতে থাকে শানু৷ রেহানা ভাবী বুকোগ্রাফি করেছে। বেশ লাগে দেখতে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে রেহানা ভাবীর হাতে লেখক ‘বন্যা হোসেন ‘ এর ‘যখন থামবে কোলাহল’ বই এর ছবি। কি যে সুন্দর হয়েছে ছবিটা, শানু মুগ্ধতা নিয়ে দেখে। আজকাল, পুরনো লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বই পড়ছে শানু৷ ‘ঢাবাকা’ বইটা পড়তে গিয়ে শানুর সে কি লজ্জা। পাতায় পাতায় ছবি, শানু এক চোখ বুজে অন্য চোখে ছবি দেখে গল্প পড়েছে। প্রথমবার যেমন তেমন হলেও দ্বিতীয়বারে পড়তে মন্দ লাগেনি৷ শানু ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বই লুকিয়ে রাখে। আসিফ দেখলে বলবে, ‘যে মা এখনো নভেল পড়ে তার মেয়ের মাথা খারাপ হবে না তো, আর কার হবে।’ শানুর সব কিছুতে আসিফের বিরক্তি। রাজুকে ফোন দিতে গিয়ে থামে শানু। থাক, ছেলে মাত্র বেরোল। এখনি কোথায় আছে জানবার দরকার নেই।

বাবু জানিয়েছে, মিশু নাকি স্কুলে খুব অমনোযোগী হয়ে গেছে। শানু এখন মেয়ের সাথে শোয়। আসিফের নির্দেশ, মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে। শানু জানে, মিশুকে পাহারা দেবার দরকার নেই। শানু মুখ ধুয়ে সান্সক্রিম মাখে। কচি কলাপাতা রঙের ওপর হালকা হলদে বাটিকের লেস বসানো সালোয়ার কামিজ পরে নেয়। কপালে কুমকুমের টিপ। এই টিপের খোঁজ শানু পেয়েছে বান্ধবীদের গ্রুপে। পুরনো দিনের কিছু অনুসঙ্গ গায়ে জাড়াতে ভালো লাগে। শানু এতদিন নিজের জন্যে কিচ্ছু ভাবেনি। এখন অল্প বিস্তর চিন্তা করে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসায় শানু সুযোগ পায় নিজের জন্যে ভাবার। পকেট ঝেড়ে আসিফের টাকা নিতে শানুর এখন খারাপ লাগে। রোজীকে তার স্বামী মাসিক হাত খরচ দেয়। সেই টাকার যেমন কোন হিসেব রোজী দেয় না, আবার রোজীর আরো টাকা লাগলে স্বামী ও না করে না। শানুর জীবন অমন সহজ নয়। আসিফের কাছে ইদানিং খরচ থেকে ক’পয়সা বেশী চাইলেও কৈফিয়ত দেয়া লাগে। শানুকে উল্টো বলে দেয় যেন এখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে নেয়।

পুরনো প্রেমিকের সাথে দেখা হবার জন্য শানুর ভেতরে কোন উত্তেজনা নেই। শানু নির্লিপ্ত ভাবে চোখে কাজল ঘষে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। চুল অভ্যাস বশত খোঁপা করতে গিয়ে খুলে রাখে। অনেক দিন পর আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে যায় শানু। তাকে কেমন তরুণী লাগছে। আয়নার অপর পাশের নারীটি মেয়ে থেকে মা হতে গিয়ে পুরোদস্তুর মহিলা হয়ে উঠবার কথা। কদিনের কাজের চাপে শানুর ওজন কমেছে কেজি পাঁচেক। হয়তো, সে জন্যে অমন কমবয়স্ক লাগে। বের হবার আগে শানু শাশুড়ীর কাছে বিদায় নিতে যায়। আলেয়া আক্তার ঘুমিয়ে আছেন। তার মাথার কাছে একটি নতুন মডেলের স্মার্টফোন, কাশিফ পাঠিয়েছে। শানুর হাতের ফোনের বয়স প্রায় ছয় বছর। একটানা চালালে তালুতে গরম লাগে। আলেয়া আক্তার পা গুটিয়ে শুয়ে আছেন। শানু তার গায়ে কাঁথা টেনে এসি বন্ধ করে। এই ঘরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র লেগেছে এক মাস, কাশিফের উপহার। শানুর মনে পরে, আগামীকাল শুক্রবার। ওদের আসার দিন। বাজার করা হয়নি৷ বাবুর সাথে দেখা করে, বাজার করে ফিরতে হবে৷ শানু চলে গেলে আলেয়া আক্তার মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখ ভেজা। একটু আগে তিনি কেঁদেছেন। ছেলের বউয়ের কাছে চোখের পানি লুকোবেন বলে ঘুমের ভান ধরে ছিলেন। আলেয়া আক্তার আবার কাঁদতে শুরু করেন। যে আসন্ন ঝড় ঘণিয়ে উঠছে জোরশোরে তাকে কেমন করে ঠেকাবেন ভাবতে তার ভয় লাগে। এত ভয় তিনি নিজেকে নিয়েও কখনো পাননি৷

নারীর আগে পুরুষ পৌছে অপেক্ষা করার নিয়ম চিরায়ত। আজ তার ব্যতিক্রম হলো। শানু বাবুর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, পুরুষেরা তাকে বেশ মনোযোগ দিচ্ছে। শানু ওড়না জড়িয়ে বসে। অন্য পুরুষের চোখে পরতে সে সাজেনি। এখন সাজ নিজের জন্যে। একটু ভালো দেখাতে এ ধরন ধারন করা। শানুর মনে পরে, আসিফের প্যান্ট ধুতে দেয়া থামিয়ে দেবার পর রুমের চেয়ারে প্যান্টের স্তুপ জমেছে। শানু ঠিক করে ফিরে গিয়ে সে সব কেঁচে দেবে। একটা এসএমএসের জন্যে এতদিনের সংসারে বুড়ো স্বামীকে সন্দেহ করা ঠিক না। আসিফ তো বুড়োই, রাজু কদিন বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবে। যার ছেলে এত বড় তাকে কচি খোকা ভেবে শানু ভুল করেছে। একটা কোলড্রিংক্স নিয়ে শানু স্ট্র লাগিয়ে নেয়। প্রথমে একটু ঠান্ডা স্ট্রয়ে টেনে ওপরে তুলে সামনে রাখা প্লেটে ফেলে। এটা তাকে শিখিয়েছে, রেহানা ভাবী। একে বলে, স্ট্র পরিষ্কার করে নেয়া। একটু একটু করে ঠান্ডা খায় শানু। রেস্তোরাটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। তাই ঘুরে দেখতে গিয়ে শানুর বুকের ভেতর ছোট খাটো একটা দোকানের স্বপ্ন মাথা চাড়া দেয়। সেখানে একপাশে হাতে তৈরী কুশির কাজ থাকলো, অন্যপাশে রইলো মিষ্টির সম্ভার। ক্যাশের পেছনে শানু বসবে চোখে চশমা এঁটে। মুখ গম্ভীর করে দাম বলবে, কিনতে আসা ক্রেতাদের। বুড়ো আর কচিকাঁচাদের বিনামূল্যে খাওয়াবে শানু। ওরা খুব আপন, রেশারেশিহীন মানুষের দলে পরে যারা শানু তাদের ভালোবাসে। ভাবতে গিয়ে শানু হাসে, এই ভাবনা জানলেও আসিফ ছেলেমেয়েকে বলবে, ‘শেষে গিয়ে দোকানদারের বাচ্চা হয়েছে তোদের মা। ছোটলোকদের সাথে উঠবস না করলে পেটের ভাত হজম হচ্ছিলো না। ‘

বাবু এসে বসে শানুর প্রশংসা করে। শানুর কেন যেন শুনতে ভালো লাগে। পুরনো প্রেমিক তার সাথে ফ্লার্ট করে না। বাবু তাকে জানায়, মেয়েদের বয়স বাড়লে তাতে যোগ হয় মমতা, মাতৃত্ব ও দায়িত্ব নামের মায়াবী চাদর। যা গায়ে জড়িয়ে মেয়েরা একের পর এক দুঃখ পাতা ছিড়ে সুখ নামের পাখি বানায়। সংসারে সবার হাতে সেই সুখ পাখি তুলে দিয়ে মেয়েরা গৃহবৃক্ষে একলা পরে রয়। তবু, তাদের মুখে কখনো রাগ বা কষ্ট দেখা যায় না। যা থাকে, তা বুকের ভেতর নীরব অথচ প্রকট অভিমানে গড়া শোকের পাহাড়। এ শোক নিজ স্বত্বাকে হারিয়ে ফেলে ক্রমশ অপরের প্রতিটি জীবন যাপন করার শোক। যা আশপাশের কেউ কোনদিন বোঝে না। এমনকি নারী হয়ে নারীরাও তাদের স্বজাতির দুঃখ বোঝার ক্ষমতা রাখে না। শানু কেবল বাবুর কথা শুনে যায়। এত সুন্দর করে কোন পুরুষ নারীকে নিয়ে ভাবতে পারে তার বিশ্বাস হয় না। বাবুর দাঁড়ি গোঁফের আড়ালে থাকা মুখে কথা বলার সময় শানুর প্রতি সম্মান দেখা যায়। শানু বুঝতে পারে বেশ, বাবু তার শরীর নয় মন দেখতে পাচ্ছে। যা স্বামী হয়ে আসিফ কোনদিন স্পর্শ করা দূর দেখার চেষ্টা করেনি। শানু বাবুকে লুকিয়ে চোখের পানি গিয়ে ধরা পরে যায়।

‘হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে শানু। ‘
‘এখন তাহলে হো হো করে হাসবো!’

শানু এবার বাবুর সামনেই ভেজা চোখ হাতে ডলে মোছে। বাবু রুমাল এগিয়ে দেয়।

‘রুমাল দিলে ঝগড়া হয়’।
‘চিঠি দিলে বন্ধু হয়’
‘তাই ফুল নিয়ে এসেছি। ‘

শানু চমকে দাঁড়িয়ে যায়। বাবু শানুকে হাত নেড়ে বসতে বলে, ওয়েটারকে আরেকটা ঠান্ডা দিতে বলে।

‘আরে বাবা, কানে কানে কথা, চোখে চোখে দেখা হওয়ার সময় কি আছে শানু? তুমি বিবাহিতা, আমি ডিভোর্সী। যদিও আমরা দুজনে আগুন এবং তেল। সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে আমাদের দেখা হওয়া কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য না। তবে, আমি সীমারেখা মানি শানু। ‘

‘জানি, আমি বুঝতে পারি সেটা। তোমার কাছে আমি নিরাপদ’।

শানু মাথা নামিয়ে চোখ মেঝেতে রেখে আস্তে আস্তে কথাটা বলে। বাবু চশমার ফাঁক গলে আসা কান্না এড়াতে ঘুরন্ত পাখায় চোখ আবদ্ধ করে। অভিভাবকেরা মেয়েদের মন কখনো পড়তে পারে না। তারা চায় একটি বয়সে গিয়ে মেয়ের দায়িত্ব পুরুষ নামের প্রাণীটির হাতে তুলে দিয়ে সারাজীবনের জন্য নিশ্চিত হতে। অথচ, মেয়েকে বোঝা না ভেবে মানুষ ভাবলে মেয়েটি হয়ত তার যোগ্য কাউকে বেছে নিয়ে সংসারে জড়াতে পারত।

বাবু শানুর সামনে হলুদ গোলাপের তোড়া রাখলে শানু গোলাপ নেড়ে দেখে রেখে দেয়। শানুর হলুদ গোলাপ ভালো লাগতো। হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের প্রতিক। বাবু কি তবে আবার শানুর বন্ধু হতে চায়? শানুর মনে কথা যেন বুঝে নিয়ে বাবু উত্তর দেয়,

‘তুমি যা ভাবো, বন্ধু অথবা শুভাকাঙ্খী।’
‘এত বছর পর বন্ধু হতে চাওয়া বেশী হয়ে যায়।’
‘প্রেমিক ছিলাম ও কথা ভুলে যেতে পারো। আমার কোন দাবী নেই শানু। ‘

শানুর কোল্ডড্রিংক্স খাওয়া শেষ। বিল দিতে গেলে বাবু বাধা দেয়।

‘আমার সাথে দেখা করতে এসে বিল তুমি দেবে। এটা কি ভদ্রলোকচিত ব্যবহারের সীমায় পরবে?’
‘আমি এসেছি মিশুর মা হয়ে। আমার মেয়ের জন্যে যদি জাহান্নামে যেতে হয়, আমি সেখানে যাবো। মেয়ের জীবন আমার মতো হতে দেব না’।

শানুর চোখে চিকচিক জেদ খেলে যায়। সন্তান বড় কষ্টের ধন, যত্নের ফসল। মিশুর বয়স পার হতে হতে শানুকে জীবন জোয়াল কাঁধে তুলতে হয়েছে। বাবু শানুর এই প্রতিজ্ঞাকে শ্রদ্ধা করে।

‘মিশু ক্লাসে মন মরা হয়ে থাকছে। ডাকলে রেসপন্স করে কম। ক্লাসওয়ার্ক ও যেমন তেমন। ‘
‘ও তো এমন ছিলো না। লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ মিশুর’।
‘না, আমার ক্লাসে যে কয়েকজন মেয়ে মেধাবী, মিশুকে আমি প্রথমে রাখবো। ভয় পায় মেয়েটা, কিসের জন্য এই ভয় তৈরী হয়েছে শানু। তোমাকে তাই ডাকলাম। ‘
‘আমি ওর সাথে কথা বলে দেখব।’
‘মিশুকে বুঝতে দিও না, তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে। আরেকটা কথা, তোমাকে জিজ্ঞেস করব কিনা।
‘বলো, কি জানতে চাও’।
‘তোমাদের সংসার জীবনের কোন সমস্যা, আই মিন হাজবেন্ড ওয়াইফ রিলেশন কেমন। না, প্লিজ রাগ করো না। বাচ্চাদের ওপর এসবের প্রভাব পরে।’

শানু কি বলবে ভেবে পায় না। আসিফের মুখে লাগাম নেই, আচরনে ভব্যতা নেই। শানু এতদিন জানত এই আচরণ গুলো সাধারণ পুরুষের স্বাভাবিক ব্যবহারের ভেতর পরে। ফিরে পাওয়া বান্ধবীদের গল্পের দুনিয়া তাকে গোপনে অনেক কিছু জানিয়েছে। স্বামীরাও কেয়ারিং হয়। স্ত্রীদের মন খুশী করার চেষ্টা করে। তাদের মাসিকের দিনগুলোতে যত্ন নেয়। যারা তাও পারে না, তারা নিদেনপক্ষে স্ত্রীকে সম্মান দেয়। শানুর নিরবতা বাবুকে আরো প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখে।

মিশুকে কোচিং থেকে রিকশায় তুলে নিয়ে শানু বাড়ির পথ ধরে। পথে মা- মেয়েতে গল্প করে। শানু লক্ষ্য করে মিশু চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতো চটপটি -ফুচকা খাবার বায়না ধরছে না। রাস্তায় এটা ওটা নিয়ে মাকে প্রশ্ন জুড়তেও যেনো মিশুর অনীহা। শানু নিজেকে ধমকে দেয় মনে মনে। এটা অনীহা নয়, অনিচ্ছা। মিশু গুটিয়ে গেছে। মেয়ের এই মনের দুয়ার ভেঙে তাকে জাগিয়ে তুলতে হলে মাকে এগোতে হবে।

‘এই মিশু, গোলা খাবি?’ ঐ যে বিক্রি করছে। মামা, থামো। আমরা গোলা খাবো।’
‘না, মা। বাসায় চলো। কালকে অংক পরীক্ষা আছে।’
‘রাখ তোর অংক পরীক্ষা। অমন পরীক্ষা সারাজীবন আসবে। আজকের গোলা খাওয়ার ইচ্ছা আসবে না। চল।’

মিশুর হাতে ধরে শানু দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে তার মনে হয়, সে কিশোরী বেলায় ফিরে গেছে। সালোয়ারকামিজ পরে রোজীর হাত ধরে বৃষ্টির দিনে আইসক্রিম ওয়ালার পেছনে ছুটছে। আইসক্রিম ওয়ালা ঘন্টা বাজিয়ে ডাকছে, ‘এই আইসক্রিম, এই আইসক্রিম। তিন টাকায় একটা, পাঁচ টাকায় দুইটা। ‘

শানুকে অবাক করে দিয়ে ভর জৈষ্ঠ্যে আকাশ ভেঙে হঠাৎ বৃষ্টি নামে। মিশু খিলখিলিয়ে হাসে। শানু মাঝ রাস্তায় মেয়ের হাতধরে গোল হয়ে ঘুরে। পথচারীরা তাকে পাগল ঠাউরে নেয়। গাড়িদের জটলা বাঁধতে গিয়ে ও বাঁধে না। ট্রাফিক পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে শানু আর মিশুকে রাস্তা ছেড়ে যেতে বলে। শানু বৃষ্টির দ্বিগুন তালে হাসির ফোয়ারা তুলে ফুটপাতে গিয়ে ওঠে। বৃষ্টি তাদের ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিয়েছে। শানুর সেদিকে খেয়াল নেই। ঝমঝমিয়ে নেমে আসা অবিরত ধারায় ভিজতে ভিজতে শানু গোলা আইসক্রিম খায়। মিশু মায়ের হাত শক্ত করে ধরে থাকে। তার ভীষণ ভালো লাগছে।

ডেলিভারি ব্যাগ নামিয়ে রাজু অনুষ্ঠানের গেটে টাকার জন্য অপেক্ষা করছে। এ বাড়ির ভাব আলাদা। মানুষের শ্রেণী বিভাজন স্পষ্ট। আমন্ত্রিতরা ভগবান, আপ্যায়নে নিয়জিত লোকেরা দাস। মাথা নামিয়ে মুখে মাস্ক এঁটে তারা সেবা করছে। বেয়ারারা হাতে গ্লাভস পরে ঘুরে ফিরে সবাইকে পানীয় সাধছে। রাজুর ইচ্ছে হয় ঢক করে এক গ্লাস পানি খেতে। লজ্জায় বলতে পারে না। তাকে ভিক্ষুক ভেবে গলা ধাক্কা দিয়ে বসলে এদের কিছু হবে না। রাজু কেনো এসেছে তা জেনে নেহাত দুঃখ প্রকাশ করবে। যা যাবে সেটা রাজুর সম্মান। তবে, এই শ্রেণীর কাছে সম্মান তাদের নিজস্ব সম্পদ। কম পয়সার লোকেদের সেটা থাকতে নেই। একটু এগিয়ে এক ভদ্রলোককে ডেকে রাজু জানতে চায়, বাড়ির মালিক কোথায় আছেন’। তিনি আঙুল তুলে সিড়ি গোড়ায় নির্দেশ করলে রাজু ভিড় ঠেলে এগোয়। ওদিকে একটি পুরুষ ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে হাসছে। কাছে এগোতেই পুরুষটির বাহুলগ্না হয়ে সুন্দরী তরুণী নারী রাজুকে পাশ কাটায়। অবাক বিস্ময়ে রাজু দেখে তার বাবা আসিফের গালে সকলের সামনে চুমু খায় নারীটি। আয়া শ্রেণীর মহিলার হাতে শিশুটিকে তুলে দিয়ে তারা ফাঁকা জায়গায় এগোয়। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, হালকা মিউজিকের তালে পায়ে পা মিলিয়ে নেচে চলা আসিফ মহিলাটির সফেদ কোমড় আঁকড়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নাচে। যদিও সেটা নাচ হয় না। তরুণী শব্দ তুলে আরেকপ্রস্থ হাসলে অপ্রস্তুত আসিফকে তার জন্যে মোটেও লজ্জিত বা বিব্রত হতে দেখা যায় না। চকচকে বাতির নিচে ক্রমশ মাটিতে মিইয়ে যাওয়া রাজুর পকেটে কেউ পেমেন্ট গুঁজে তাকে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বললে ডেলিভারি বয় রাজু মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। চারপাশের উজ্জল আলোকসজ্জায়, গরম কাবাবের সুগন্ধে, নারী ও পুরুষের উদ্দাম আনন্দের ভীড়ে একটি তরুণের চোখ বেয়ে পরতে থাকা কান্নাজল মাড়িয়ে যায় হুল্লোড়ে ছুটে চলা আনন্দমুখর মানুষ।

গেটের কাছে পৌছে রাজু আবার ফিরে তাকায়। একজন সুখী মানুষ এই আসিফের জীবনে যেন পৃথিবীর অন্য কোথাও তার জন্যে অপেক্ষারত একটি ঘর্মাক্ত ক্লান্ত নারী শানু, একটি মেঘজল চোখের মেয়ে মিশু, এবং একটি তরুণ তুর্কী যুবক রাজুর কোন অস্তিত্ব নেই। রাজুর চোখের সামনে তাদের ছবিগুলো ইরেজারে মুছে গিয়ে আঠারো বছরের পরিচিত পিতাকে নারীটির বারবার চুমো খাওয়ার সাথে কোলের শিশুটি আধো বুলিতে ‘পাপা’ ডাক ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(চলবে)