#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_30
#Writer_NOVA
— এতো ভালোবাসিস! তাহলে বলে দিলি না কেন?
আমার কথা শুনে ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। তারপর ডায়েরিটা ওর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে আমার সামনে এসে বললো,
—ঢংগী ঢং কম কর। এমন একটা ভাব নিতেছিস যেন তোর নাম লেখা ছিলো। আমাকে কনফিউশানে ফেলার ধান্দায় আছো? তা হচ্ছে না।
ওর কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। ধূর, বাঁদরটায় আমার চালাকি ধরে ফেলছে। কোথায় ওকে কনফিউশানে ফেলার জন্য আমি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যাতে ও চিন্তায় পরে যায় যে ওর ডায়েরিতে আমি আমার নাম দেখেছি। তা আর হলো কোথায়? আমার শয়তানি বুদ্ধিতে এক বালতি পানি ঢেলে সব বরবাদ করে দিলো। আমি দুই হাত কোমড়ে রেখে ওর সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললাম,
— হ্যাঁ রে ভাইয়া এসব কবের থেকে?
— কোন সব?
— এই যে তুই নূর আপিকে এতো এতো ভালোবাসিস।
তায়াং ভাইয়া আমার মুখ আটকে এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
— এই চুপ। কেউ শুনে ফেলবে। জানিস না দেয়ালেরও কান আছে।
আমি ওর হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে কঠিন গলায় বললাম,
— তলে তলে টেম্পু না ধূর ট্রেন হবে। তলে তলে ট্রেন চালিয়েছিস আর আমাকে কিছু বললিও না। এত খারাপ কেন রে তুই? আমি আমার সব কথা তোকে বলি। আর তুই এতবড় বিষয়টা আমার কাছ থেকে লুকালি। তোর সাথে কথা নেই আমার। আমি এখুনি গিয়ে সবাইকে সব বলে দিবো।
তায়াং ভাইয়া একবার দরজার ওপর পাশে উঁকি দিয়ে আমার সামনে এসে আমার হাত দুটি ওর দুই হাতের মুঠে নিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,
—দেখ বোন আমি যে নূর কে ভালোবাসি তা কাউকে বলিস না প্লিজ। তোর হাত দুটি ধরি আমি। ও কি পাঁজি তাতো তুই জানিস। ওকে আমার ভয় করে। মাঝে মাস রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে।
ওর কথা শুনে আমার পেট ফেটে হাসি আসছে। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ভাইয়া বাঘ থাকলেও নূর আপির সামনে বেশিরভাগ সময় ওকে বিড়াল রূপেই দেখা যায়। আসলেই ও নূর আপিকে ভয় পায় নাকি ভয় পাওয়ার ভান করে তা আমি জানি না। বহু আগে আমার একবার তায়াং ভাইয়ার মতিগতি ভালো ঠেকেনি। নূর আপির সামনে যেই তায়াং-কে দেখা যায় সেই তায়াং-এর সাথে বাস্তবের একফোঁটাও মিল নেই। তাই আমি সন্দেহ করেছিলাম। তদন্তেও নেমেছিলাম। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রামাণের ভিত্তিতে আমাকে পিছিয়ে যেতে হয়। ভাইয়া এখনো আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। একটু আগের রাগী তায়াং-এর সাথে এখনকার তায়াং আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
— হাত ছাড়। এতো করে যখন অনুরোধ করছিস তাহলে কিছু বলবো না। তবে তোকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
— কি প্রশ্ন?
— তুই যে নূর আপিকে ভালোবাসিস তা কি আপি জানে? একদম সত্যি বলবি।
— আমার কয়েকটা বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না। এমন কি আম্মু-আব্বুও ওর বিষয়ে জানে না।
— নূর আপিকে তাহলে বলিস না কেন যে তুই ওকে ভালোবাসিস?
— আমার ভয় করে। ও যদি আমায় ভুল বুঝে। তবে ওর হাব-ভাবে মনে হয় ও বুঝতে পেরেছে আমি ওকে পছন্দ করি।
— মেয়েরা আগের থেকে এসব টের পেয়ে যায়। তা কবের থেকে ভালোবাসিস?
ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে খাটের ওপর বসলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— সেই ছোটবেলা থেকে।
— কি! ওরে বাটপার, সেই ছোটবেলা থেকে পছন্দ করিস তা আমাকে, আপিকে, কাউকে বলিস নি। দাঁড়া তুই আজকে।
আমি এগিয়ে গিয়ে ওর চুলগুলো মুঠ করে ধরে ইচ্ছে মতো টানলাম৷ ইচ্ছে করছে ওকে আলুভর্তা করি। সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে অথচ আমাকে একটুও বলেনি। আমি ওর চুল ছেড়ে ঠোট উল্টে,দুই হাত গুঁজে ওর পাশে দাড়ালাম।তায়াং ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,
— চুলগুলো আরেকটু টেনে দে। ভালোই লাগছিলো।
বেহায়াটা বলে কি? আমি ব্যাথা পাওয়ার জন্য চুল টেনেছি। আর তার নাকি ভালো লাগছিলো। রেগে বললাম,
— এখুনি আমি নূর আপিকে সব বলে দিবো।
রুম থেকে বের হতে নিলেই তায়াং ভাইয়া হাত ধরে আটকে ফেললো। মিষ্টি কন্ঠে বললো,
— এমন করিস না বোন। আমি আগে ব্যবসাটা শুরু করি। তারপর সবাইকে সব বলে দিস।
— আচ্ছা কিছু বলবো না। এর জন্য তোকে বেশি না পাচশত টাকা দিতে হবে৷ দে টাকা দে।
আমি ডান হাত ওর দিকে বারিয়ে দিলাম। ভাইয়া হাত মুচড়ে ধরে বললো,
— দূর্বলতার সুযোগ নেওয়া হচ্ছে? কিসের টাকা দিবো তোকে?
— আমার মুখ বন্ধ করার জন্য।
—তুই ঘুষ নিবি আমার থেকে?
— একটুও না। আমি এত কষ্ট করে তোর গোপনীয় কথাগুলো আমার পেটে জমা রাখবো। সেগুলোর জন্য একটা পারিশ্রমিক আছে না। সেটাই নিবো। তোর ঐ কথাগুলো আমার পেটে খোঁচাবে, মুখ ফসকে বের হতে চাইবে। সেগুলো আটকে রাখার জন্য এই টাকা। বেশি তিড়িংবিড়িং করবি এখুনি বলে দিবো। আরেকটা কথা বললে আরো পাঁচশত টাকা বাড়বে।
— ব্লাকমেইল করছিস। সমস্যা নেই করতে থাক। এই দিন, দিন না পাগলী। আমারও দিন আসবে। তুই রওনকের থেকেও টাকা মেরেছিস। তুই এই জীবনে ভালো হবি না।
— এই খবর তোর কানেও এসেছে। যাকগে তাতে আমার কি? ঐ রওনক বেটা বেশি বাড়ছিলো তাই ওকে ছেঁটে কমিয়ে দিয়েছি। তুইও যদি বাড়িস তাহলে টাকার অঙ্কও বাড়বে।
—ভালো হয়ে যা নোভা, ভালো হয়ে যা। ভালো হতে টাকা লাগে না।
—অবশ্যই ভালো হতে টাকা লাগে। এই যে তুই এখন টাকা দিবি তাহলে আমি ভালো হয়ে যাবো। কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু তুই টাকা না দিলে আমি খারাপ হয়ে সবাইকে সব কিছু বলে দিবো।
ভাইয়া আমার দিকে একটা খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে আমার দুই হাত ছেড়ে ওর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো।সেখান থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।আমি ছো মেরে সেটাকে নিয়ে মুখ টিপে হাসলাম। তারপর তায়াং ভাইয়াকে হাত নাড়িয়ে বায় বলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলাম। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া আমার দিকে রাগী ফেস করে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— যদি এসব কথা কোনভাবে লিক হয় তাহলে সবার আগে আমি তোকে ধরবো।
আমি মুখ ভেংচে বললাম,
— নোভা কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। তাই আমার দিক থেকে নিশ্চিন্তে থাক। তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু ব্লাকমেইল করবো। তার জন্য প্রস্তুত থাকিস।
কথাগুলো বলে এক মিনিটও দাড়ালাম না। দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত কপালে শনি আছে। নামাজটা কাযা হয়ে গেলো কিনা কে জানে। দ্রুত রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢোকার আগে টাকাটা লুকিয়ে ফেললাম। নয়তো এটা হাইজেক হতে পারে।
💖💖💖
পরেরদিন……
দুপুরের প্রখর রোদে কলেজ থেকে ফিরে সোফায় চিৎপটাং হয়ে পরে আছি। ওড়না,জুতা,ব্যাগ একেকটা একেক দেশে পরে আছে।দুদিন কলেজে না যাওয়ায় আজও যেতে চাইনি। কিন্তু তায়াং ভাইয়ার এক রামধমক খেয়ে দুই বোন সুন্দর করে রেডি হয়ে কলেজের দিকে দৌড়িয়েছি। আগামীকাল মহালয়ার বন্ধ। সামনেই দূর্গা পুজো। পুজোর বন্ধে গ্রামে যাবো। ছুটি কাটাতে নয় চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে। আম্মু সকালে কল করেছিলো। আজ সকাল ৯টায় ভাইয়া ফ্লাইট থেকে নেমেছে। সপ্তাহ ঘুরতেই বিয়ে। বাসায় কাজের হুলস্থুল পরে গেছে। কতদিন পর গ্রামে যাবো।ভাইয়ার বিয়েতে কি মজা হবে! সেগুলো ভাবতে গেলেই চোখের ঘুম হারাম। হলুদে কি পরবে, বিয়েতে কিরকম মেকআপ নিবো, বৌভাতে কোন সাজটা ভালো হবে সেসব নিয়ে আমি ও তন্বী খুব এক্সাইটেড। আজ বাসার যাওয়ার সময় বড় চাচ্চু বাসায় এসে খালামণি,মামীকে পরিবারবর্গ দাওয়াত করে গেছে। আমরা কলেজে ছিলাম বলে কিছুই জানি না। উনি বেশি সময় থাকেনি। নয়তো তার সাথে দেখা হতো।
মামী ও খালামণি কিচেনে রান্না করছে। আজ বাসায় ভালো-মন্দ রান্না হচ্ছে। পোলাও,মাংসের ঘ্রাণে সারা ফ্ল্যাট মৌ মৌ করছে। এখন ইলিশ মাছ ভাজছে। তার ঘ্রাণ নাকে বারি খেতেই পেটের ভেতর ইঁদুরে ডুগডুগি বাজানো শুরু করলো। তায়াং ভাইয়া আজ সারাদিন বাসায়। নিশ্চয়ই এখন নামাজ পরতে গেছে। নূর আপির সামনে নিজেকে একটু ভালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে তো। কিচেন থেকে মামী এসে আমাকে বললো,
— মামী যাও গোসল করে নেও। শরীর ভালো লাগবে। কি রোদ উঠছে আজকে। আমি একটু ছাদে তানভীরের জামা-কাপড় মেলতে গিয়েছিলাম। রোদে দাঁড়ায় থাকতে পারি না। মাথা ঘূর্ণি দিচ্ছিলো। লেবুর শরবত বানায় দিবো? খাইবা?
— না মামী লাগবে না। রোদে আজকে তার প্রকোপ দেখাচ্ছে। একটা রিকশাও পাইনি। হেঁটে আসতে আসতে কাহিল হয়ে গেছি। এখন যে উঠে রুমে যাবো সেই শক্তি পাচ্ছি না। শরীর পুরো দূর্বল হয়ে গেছে। তন্বী গোসলে ঢুকছে। ও বের হলে তারপর যাবে।
— আচ্ছা তাইলে তনিমা বের হওয়ার পর সাথে সাথে গোসলে চলে যেয়ো। বেশি দেরী কইরো না। গোসল করলে শরীরটা ভালো লাগবে।
— হুম তন্বী বের হলেই ঢুকবো। কিন্তু এই মাইয়ার বের হতে দেরী আছে। ও ওয়াশরুমে ঢুকলে বের হতে চায় না। আল্লাহ জানে কি করে!
মামী মুচকি হেসে দুষ্টুমী করে বললো,
— ঠান্ডা পানি পেয়ে বোধহয় ঘুমায় যায়।
— তাই হবে মামী৷ নয়তো এত সময় লাগে? এত সময় থাকতে তো নিজের কাছেও বিরক্ত লাগে। দুই ঘন্টা এরে দরজা ঠুকঠুক করে তারপর বের করতে হয়। রান্না কি শেষ?
— হ্যাঁ সব প্রায় শেষ। এখন শুধু পোলাও আর মাছ ভাজা হলে সব শেষ হয়ে যাবে।
হঠাৎ আমার খেয়াল হলো এনাজ তো আজকে আসবে। যেদিন এ বাসায় ভালো কিছু রান্না হয় সেদিন খালামণি, তায়াং ভাইয়া কল করে এনাজকে নিয়ে আসে। খালামণি প্রায় সময় বলে এনাজকে এখানে এসে খাবার খেতে। কিন্তু তার নাকি লজ্জা করে। আমি মামীকে জিজ্ঞেস করলাম,
— মামী!
— হুম বলো।
— তায়াং ভাইয়ার কোন বন্ধু আসছে?
খালামণি খুন্তি হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— এনাজের কথা জিজ্ঞেস করছিস?
— হ্যাঁ। তাকে আসতে বলো নাই?
— আমি তো সেই সকালে কল করে বলে দিছি। কিন্তু আসতে চাইছিলো না। আমি বলছি আজকে তুই না আসলে তোর সাথে আমার কোন কথা নেই। তায়াংও ওর সাথে রাগারাগি করছে। কেন ও আসবে না তার জন্য। আমাদের দুজনের বকা খেয়ে তারপর রাজী হইছে। বলছে নামাজ পরে আসবো।
মামী খালামণিকে জিজ্ঞেস করলো,
— কার কথা বলো তানভীরের মা?
খালামণি মামীকে বললো,
— ঐ যে তায়াং-এর বন্ধু।ছেলেটা একা থাকে কি খায় না খায় কিছু জানি না। মাঝে মাঝে এই বাসায় এসে খেতে বললেও লজ্জা পায়। বলে মানুষ কি বলবে? দেখ তো ছেলের কথা। মানুষের কথায় আমাদের কিছু আসে-যায়? খাওয়া,ঘুমের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যায়। দেখভালেরও একটা মানুষ নেই। ওর ছোট ভাই পড়াশোনার সুবাদে হোস্টেলে থাকে। বাসায় ও একা একটা ছেলে। ইচ্ছে হলে খায়, না হলে নাই। কত করে বলি এবার একটা বিয়ে কর। কিংবা আমরা মেয়ে দেখি। বলে চাকরী পেলেই বিয়ে করে ফেলবে। তার আগে নয়। ছেলেটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় আমার। বাবা-মা ছাড়া এতিম ছেলে। ছোট ভাইকে নিয়ে তার বেঁচে থাকা। তবে অন্যসব ছেলের থেকে অন্যরকম। এতদিনে অন্য ছেলেরা থাকলে বাজে সঙ্গে খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু এনাজ এসব থেকে বহু দূরে। এনাজ ভালো বলেই তায়াং-কে ওর সাথে সবসময় মিশতে দেই। ওমন সোনার টুকরো ছেলের সংস্পর্শে আমার ছেলে কখনো খারাপ হবে না। এতটুকু চোখ বন্ধ করে বলতে পারি।
খালামণির কথাগুলো শুনে এনাজের জন্য আরেক ধাপ ভালো লাগা বেরে গেলো।আমি উৎসুক চোখে খালামণিকে প্রশ্ন করি,
— খালামণি এনাম ভাইয়া কিসে পড়ে?
— এবার বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে। পড়াশোনার অনেক চাপ। বাসার থেকে আসতো-যেতে সমস্যা বলে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে।
— ওহ এই জন্য তাকে দেখি না।
— এনাম বেশি একটা আসে না। পড়াশোনা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। শুনছি পরীক্ষা দেওয়ার পর ওকে হাই স্টাডির জন্য বিদেশে পাঠাবে এনাজ। তার জন্য এনাজ নিজের চাকরী খুঁজছে।তোর সাথে কথা বলতে বলতে আমার মাছ না পুড়ে যায়। আমি গেলাম। ভাবী গিয়ে গোসল করে নামাজ পরে ফেলেন।
খালামণি কিচেনের দিকে ছুটলো। মামী রুমে চলে গেলো। আমি সোফার পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মাথার ওপর বনবন করে পাখা ঘুরছে। আর মাথার ভেতর এনাজের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ কোলিং বেল বেজে উঠলো। নিশ্চয়ই তায়াং ভাইয়া চলে এসেছে।আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সামনের মানুষটাকে দেখে মনের অজান্তে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এনজিও সংস্থার পরনে আজ হালকা আকাশি রঙের পাঞ্জাবী ও কালো প্যান্ট। পাঞ্জাবীর গলাটা শার্টের কলারের মতো।চুলগুলো সম্ভবত কাটিয়ে এসেছে। দাড়িতেও হালকা কার্ট দেওয়া। তাকে যে কতটা ভালো লাগছে তা বলার মতো নয়। আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এরকম জামাই সেজে এসেছে কেন? আমাকে ঘায়েল করতে নাকি অন্য কোন কারণে?
— এই যে মিস টিডি পোকা, ভেতরে কি ঢুকতে দিবেন?
—হুম!
আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— তাহলে সরে দাঁড়াও।
তার তুড়ির শব্দে আমার ধ্যান ভাঙলো।আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে বললাম,
— আপনি এমন জামাই সেজে এসেছেন কেন?
— খালা শাশুড়ীর বাসায় এলে তো একটু জামাই সাজ দিয়ে আসতেই হয়। তাছাড়া এখানে তো আমার হবু বউও আছে। তাকে দেখাতে এত সাজ।
— ওহ আচ্ছা।
আনমনে তার কথায় সম্মতি দিয়ে দিলাম। যখন খেয়াল হলো তখন চোখ দুটো রসগোল্লা। কি বললো সে? ততক্ষণে সে আমাকে সাইড কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এই এই আপনি কি বললেন?
উনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত দৃষ্টি নিচের দিকে করে বললো,
— যা বলার তাতে বলেছিই।
— আরেকবার বলুন তো।
— একটুও না। এক কথা দুইবার বলতে ভালো লাগে না।
— আপনাকে বলতে হবে।
— আমি বলবো না।
— না বলতে হবে।
এনাজ আমার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললো,
— তা টিডি পোকা তোমার ওড়না কোথায়?
তার কথায় আমার হুশ ফিরলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি ওড়না নেই। কোলিং বেলের শব্দ শুনে ওড়না না নিয়েই চলে গেছি। আমার এখন ইচ্ছে করছে মাটির নিচে ঢুকে যাই। ইস, সে কি ভাবলো! আর আমি এই অবস্থায় তার সামনে দাড়িয়ে ছিলাম।আল্লাহ উঠায় নাও।এর জন্য পাতলা জর্জেটের ওড়নাগুলো আমার নিতে ইচ্ছে হয় না।আমি আর এখানে নেই।আমি সোফা থেকে ওড়না উঠিয়ে রুমের দিকে দিলাম দৌড়। ছিঃ কি লজ্জা!এই কথা মনে থাকলে এ জীবনে জর্জেটের ওড়না আর নিবো না। এতোটা কেয়ারলেস কি করে হলাম আমি🤧? আপাতত আমি এনজিও সংস্থার মুখোমুখি আর হচ্ছি না।
#চলবে
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_31
#Writer_NOVA
রাতের নির্জন রাস্তায় নিরিবিলি হাঁটতে কার কেমন লাগে তা আমি জানি না। কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে। তাও যদি হয় পছন্দের মানুষগুলোর সাথে তাহলে তো কথাই নেই। আমি,তায়াং ভাইয়া,তন্বী, নূর আপি, এনজিও সংস্থা সবাই মিলে হাঁটতে বের হয়েছি।ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত কোলাহল ছেড়ে নিরিবিলি পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটতে মন্দ লাগছে না। আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই। তবে ঝলমল করছে ছোট ছোট তারকারাজি। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ছোঁয়াও নেই। খালি চোখে রাস্তা চলা যায় এতটুকু উজ্জ্বলতা আছে। খানিক দূরত্বের পরপর সোলার প্যানেলের ল্যাম্প-পোস্টগুলো ততটা উজ্জ্বল আলো না দিলেও রাস্তা চলতে অসুবিধা হচ্ছে না। নূর আপি এসেছে দুই দিন ধরে। কোথাও যাওয়া হয়নি। তাই ভাইয়া সবাইকে নিয়ে বের হয়েছে। দুপুরের খাবারের পর এনাজকে কেউ যেতে দেয়নি। তাই সেও রয়ে গেছে।
এদিকে সাধারণত আসা হয় না। চিপা গলির মতো রাস্তা বলে সাইকেল,বাইক ছাড়া অন্য কোন যানবাহন প্রবেশ করতে পারে না। তন্বী, নূর আপি, তায়াং ভাইয়া আগে চলছে। আমি ও এনাজ কিছুটা পেছনে। এনাজ চুপচাপ আমার পাশাপাশি হাঁটছে। দুপুরের ঘটনার পর লজ্জায় আমি তার সাথে কথাও বলতে পারছি না। মাথা নিচু করে চুপচাপ চলছি। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে এনাজই প্রথম কথা বলে উঠলো,
— টিডি পোকা এত চুপচাপ যে?
আমি পলক ফেলে শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। সে আশেপাশে তাকিয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবী পাল্টে কালো শার্ট পরেছে। সবকিছু এখন কালল। তাকে কালোতো ভালোই লাগছে। আমিও তার সাথে মিলিয়ে ফুল কালো পরেছি।বোরখা, হিজাব, জুতো,সাইড ব্যাগ সবকিছু কালো।এনাজ পকেটে দুই হাত গুঁজে ধীর পায়ে আমার সাথে চলছে। আমি নিচুস্বরে বললাম,
— এমনি।
— তুমি দুপুরের বিষয়টা নিয়ে এখনো টেনশনে আছো?
ইস,আবার দুপুরের কথা উঠালো। আমার ইচ্ছে করছে পিংক কালার বিষ খেয়ে মরে যেতে। ঐ কথা মনে পরলে আমার এখনো লজ্জা করে।থমথমে মুখে বললাম,
— একদম না।
— দেখো যা হয়েছে ভুলে যাও। ঐটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। সেটা নিয়ে আর লজ্জা পেতে হবে না।
— ওকে।
মুখে ওকে বললেও মনে মনে বেশ রাগ হলো। পুরনো ঘা খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিয়ে বলছে ভুলে যেতে। বেটা খাটাশ কোথাকার!
— মনে মনে বকছো নাকি আমায়?
আমি ভুত দেখার মতো চমকে তার দিকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে চুলগুলো পেছন দিকে নেড়ে একগালে হেসে বললো,
— নিশ্চয়ই ভাবছো কি করে বুঝলাম?
আমি বিস্ময় মুখে রেখেই ওপর-নিচ মাথা নাড়ালাম। সে হো হো করে হেসে বললো,
— এবারো আন্দাজে ঢিল মেরেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঠিক জায়গায় লেগেছে। চুপচাপ থেকো না তো তুমি। তোমাকে চুপচাপ একটুও ভালো লাগে না।
— তাই নাকি?
— হুম মিস টিডি পোকা।
— আমি কথা বলে মুডটা নষ্ট করতে চাইছি না। আশেপাশের শান্ত পরিবেশটা চুপ করে ফিল করতে চাইছি। কিন্তু আপনার কারণে তা বোধহয় হবে না।
— কি আর করার বলো? তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমিও বাঁচাল টাইপের হয়ে গেছি।
আমি রাগী লুকে তার দিকে তাকাতেই সে ভয় পাওয়ার ভান করে বললো,
— আমি কিছু ভুল বললাম কি?
— আপনি বাঁচাল কাকে বললেন?
— কেন তোমাকে!
— আমি বাচাল?
— কোন সন্দেহ নেই।
দাঁত কটমট করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
—আপনাকে আমি😬….
— চুমু দিবে নাকি জড়িয়ে ধরবে? দুটোর মধ্যে যেটা ইচ্ছে করতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।
— ছিঃ আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই।
— নেই বলেই তো বলছি।
— আপনি না কত লাজুকলতা তা এখন কি লাজ-শরম সব ভাতের সাথে খেয়ে ফেলছেন নাকি?
— আসলে ফার্স্ট লিপ কিস ছিলো তো। তাই একটু লজ্জা পেয়েছিলাম। তুমি কি না কি ভাবো?
ছেলের কথা শুনে আমার চোখ দুটো বোধহয় বেরিয়ে যাবে। ও আল্লাহ কি বলে এসব? এটাও দেখছি তায়াং ভাইয়ার মতো ঠোঁটকাটা স্বাভাবের। মুখে কিছু আটকায় না। আর এতদিন বোকা হওয়ার ভান করছিলো। তবে তার কথা শুনে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে।আমি কিছুটা রুক্ষ্ম সুরে বললাম,
— তার মানে এর আগোও কাউকে কিস করেছেন?
— হ্যাঁ, করেছি তো। তুমি করোনি?
— ছিঃ ছিঃ আমি ঐ টাইপের মেয়ে না।
— তা আমি জানি। তবুও একটু বাজিয়ে দেখলাম। আসলে তুমি যা ভাবছো তা না। ছোট বেলায় ক্লাশ টু তে থাকতে এক বাচ্চা মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল। সেম ক্লাশের ছিলো। মেয়েটার গাল দুটো গুলুমুলু ছিলো। আমি ওকে একদিন ক্লাশে একা পেয়ে….
তার কথা শেষ হওয়ার আগে আমি চেচিয়ে বললাম,
— মেয়েটাকে একা পেয়ে কি করেছেন আপনি? কোন খারাপ কাজ করেননি তো?
— আরে ধূর। পুরো কথাটা তো শেষ করতে দাও।
— আচ্ছা কন্টিনিউ।
— একদিন ওকে ক্লাশে একা পেয়ে বলেছিলাম আমি ওকে পছন্দ করি। কিন্তু কি হিংসুটে মেয়েরে বাবা। সেই কথা গিয়ে ম্যামকে বলে দিয়েছে। ম্যাম আমায় ক্লাশে ভীষণ বকেছে। সেই রাগে ছুটির পর জোর করে ওর মুখ চেপে গালে টাইট করে একটা চুমু বসিয়ে দিয়েছি। এটা নিয়ে পরে স্কুলে অনেক ঝামেলা হয়েছে। আমার আম্মুকে ডাকিয়ে নিয়ে বিচার বসেছিলো। এর জন্য মারও খেয়েছিলাম। মেয়েটা বিচার দিলেও এরপর থেকে আমার থেকে দূরে দূরে থাকতো। আর আমি সুযোগ পেলে ওর গুলুমুলু গাল জোরে টেনে পালাতাম।
তার এই কাহিনি শুনে আমি হাসতে হাসতে তার বাহুতে ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। বেচারা বেকুবের মতো আমার দিকে তাকালো। আমি তবুও হেসেই যাচ্ছি। যখন খেয়াল হলো তখন হাসি থামিয়ে বললাম,
— সরি। আমার খেয়াল ছিলো না। এই বাজে অভ্যাসটা মাঝে মাঝে চলে আসে। হাসতে হাসতে পাশের জনকে ঠাস করে একটা মেরে দেই। তা এই ছিলো আপনার প্রথম ভালোবাসা?
— না ও আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলো না। ও ছিলো আমার প্রথম ভালো লাগা। ঐ ঘটনার পর ঐ মেয়েকে সামনে পেলে কোন না কোনভাবে গাল টেনে পালাতাম। ওকে দেখলে রাগ উঠতো। ওর গাল জোরে টান দিয়ে লাল করতে পেলেই শান্তি লাগতো। মাঝে মাঝে গালে চিমটিও মারতাম।
— আপনি তো মনে হচ্ছে ভীষণ ফাজিল ছিলেন।
— হ্যাঁ, অনেকটা ভেজা বেড়াল টাইপের। আব্বু-আম্মু মারা যাওয়ার পর যখন জীবন কি বুঝতে শিখলাম,বাস্তবতার মুখোমুখি হতে লাগলাম। তখন সব শয়তানি ছেড়ে ভালো ছেলে হয়ে গেলাম। আমার মাথায় সবসময় এটাই থাকতো যে আমি বিপথে গেলে আমার ভাইয়ের সুন্দর ভবিষ্যতটা নষ্ট হয়ে যাবে।
তার কথায় একরাশ বিষন্নতা খুঁজে পেলাম। বড় ভাই-বোনদের বোধহয় এমনি হতে হয়। নিজের সবকিছু ছেড়ে ছোটদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হয়। আমি এই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনার প্রথম ভালোবাসার কথাতো বললেন না।
— ওহ হ্যাঁ। মেয়েটির সাথে পরিচয় হয় ক্লাশ নাইনে। অন্য স্কুল থেকে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়। প্রথম দেখায় তাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু খুব চুপচাপ স্বভাবের। সবার সাথে ততটা মিশতো না। না অহংকারের জন্য নয়। ও আসলে সবার সাথে খুব সহজে মিশতে পারতো না। তার সাথে প্রথমে টুকটাক কথা হতো৷ তাও সব পড়ার বিষয়ে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। তারপর প্রেম। ও আমার প্রতি দূর্বল ছিলো। তাই আমি প্রপোজ করতেই ও রাজী হয়ে যায়। মাস খানিক চুটিয়ে প্রেম করে ক্লাশ টেনে উঠলাম। ও যথেষ্ট সুন্দরী ছিলো। প্রায় ওর জন্য সমন্ধ আসতো।হঠাৎ একদিন স্কুলে গিয়ে জানতে পারি সামনের সপ্তাহে ওর বিয়ে।ছেলে বাবার ব্যবসায় বসেছে। এত ভালো ছেলে পেয়ে ওর বাবা দেরী করেনি।এক সপ্তাহের মধ্যেই ওর বিয়ে পাকা করে ফেলে। বিশ্বাস করো তখন আমার মাথায় মনে হচ্ছিলো আকাশ ভেঙে পরেছে। সেদিন প্রথম আমি দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনে খেয়েছিলাম। সারারাত কান্না করেছি। কিশোর মনটা মানতেই পারছিলো না যে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের দুই দিন আগে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। সেদিন প্রথম ও শেষবারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিলো। বলেছিলো তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে।
💖💖💖
এতটুকু বলে থামলো এনাজ। ওর কণ্ঠ পুরো কাঁদো কাঁদো। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। তবুও বললাম,
— তারপর?
— কিশোর বয়স হলেও মাথায় তখনও আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে ছিলো। ওকে কঠিন গলায় বলেছিলাম বাসায় ফিরে যেতে। আর বিয়েটা করে নিতে। আমি চাইলে বাল্য বিবাহের দায়ে বিয়েটা ভেঙে দিতে পারতাম। থানায় আমার একটা ইনফর্ম যথেষ্ট ছিলো বিয়ে ভাঙতে। কিন্তু মনটা সায় দেয়নি। কারণ এক গরীব বাবার মেয়ে বিদায় করতে কত দেনা করতে হয়, কতকিছু খোয়াতে হয় তা গ্রামে থাকতে নিজের চোখে দেখেছিলাম। আমাদের গ্রামের রাশেদ চাচার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিলো যৌতুকের টাকা জোগাড় করতে না পারায়। তিনি সেই শোকে গলায় দড়ি দিয়েছিলো। কিন্তু তার স্ত্রী দেখে ফেলায় সে যাত্রায় মরতে পারেনি। আমার ভালোবাসার মানুষটা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে গিয়েছিল। দুই দিন পর ওর বিয়ে হয়ে যায়। আজ থেকে ১৩ বছরের আগের কথা। ওর বড় মেয়ের বয়স ১১ বছর হয়ে গেছে। আর আমি এখনো বিয়ে না করা ২৯ বছরের ছেলে।বছর দুই আগে খবর নিয়ে জেনেছিলাম দুটো মেয়ে আছে। আরেকটা নাকি পেটে। এতদিনে নিশ্চয়ই পেটেরটাও এক দেড় বছরের হয়ে গেছে।
এনাজ কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকালো।তার চোখ ছলছল করছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আমি সাইড ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে টিস্যু নিয়ে চোখের কোণায় জমে থাকা পানিগুলো মুছে নিলো।আসলে পৃথিবীটা বিশাল বড়। কত কত কাহিনি নিত্যদিন পৃথিবীর বুকে ঘটে যায়। তার কয়টা আমরা জানি। এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—তারপর বহু বছর কাউকে আর ভালো লাগেনি। কিন্তু তারপর যেদিন আমি আমার ২য় ভালোবাসার মানুষটাকে দেখলাম তখন না চাইতেও নতুন করে আবার ভালোবাসায় জড়িয়ে গেলাম।
— দুজনের কাহিনি বললেন। কিন্তু একজনেরও নাম বললেন না। এটা কি ঠিক হলো?
— ক্লাশ টু-এর ঐ গুলুমুলু বাচ্চা মেয়েটার নাম মনে নেই। তবে প্রথম ভালোবাসার মানুষের নামটা মনে আছে। তাকে কখনো ভুলতে পারবো না। কারণ সে আমার প্রথম ভালোবাসা। তার নাম কি আমি ভুলতে পারি।
— তার নাম কি ছিলো?
— ফাহমিদা।
— ওহ আচ্ছা। তা ২য় ভালোবাসার মানুষটার কাহিনি বলবেন না?
— অন্য একদিন।
— তাহলে নামটা বলুন।
— সেটাও সময়মতো বলে দিবো। খুব শীঘ্রই তাকে প্রপোজ করবো। তখন তোমাকেও সাথে নিবো। তুমি নিজ চোখে দেখে নিয়ো।
তার কথায় ভীষণ হতাশ হলাম। বিষন্নতায় গ্রাস করলো আমায়। প্রথম ভালোবাসার কথা শুনে যতটা না খারাপ লাগছে তার বেশি খারাপ লাগছে ২য় জনের কথা ভেবে। সত্যি মেয়েটা ভীষণ লাকি। নয়তো তাকে কি এনাজ ভালোবাসতো। আমার কপাল খারাপ। আমার লাইফে ভালোবাসা বলতে কোন বস্তু ছিলো না। আর বোধহয় আসবেও না। একজন তো ধোকা দিলো,আরেকজনকে ভালোবাসতে নিয়েই জানতে পারলাম সে অন্য কারো। আমি চোখের পানিটা আড়াল করে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এনাজ আমার পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হলো তোমার?
— কিছু না। ভালো লাগছে না। ভাইয়াদের কাছে যাবো।
সবাই মিলে বেশ কিছু সময় রাস্তার দিকে ঘুরলাম। তারপর ফুচকার স্টল থেকে একসাথে সবাই হৈ-হল্লা করে ফুচকা খেলাম। তবে আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে সারাটা সময় ছিলাম। এনাজের সাথে একটা কথাও বললাম না। ওকে একটু এড়িয়ে চললাম। দুইবার আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও আমি কোন উত্তর দেইনি। ফুচকা খেয়ে বাইরে চলে এলাম। সবাই একসাথে হাঁটছি। তায়াং ভাইয়া আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— কি রে তোর কি হয়েছে?
নূর আপিও একি প্রশ্ন করলো,
— নোভি তোর কি হয়েছে?
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললাম,
— কিছু না।
তন্বী আমার হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
— তাহলে এতো চুপচাপ কেন তুমি নোভাপু? নিশ্চয়ই তোমার কিছু হয়েছে। বলো না?
— এমনি ভালো লাগছে না।
তায়াং ভাইয়া এনাজকে জিজ্ঞেস করলো,
— তোর সাথে কিছু হয়েছে এনাজ? তুই কি কিছু বলেছিস?
এনাজ একবার আমার দিকে তাকিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— আমার সাথে ওর কিছুই হয়নি। আমরা তো একসাথে কথা বলছিলাম।হঠাৎ করে ওর জানি কি হলো। আমিও বুঝতে পারলাম না।
সবাই জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে, কি হয়েছে। আনার একটাই উত্তর কিছু না। সবাই জিজ্ঞেস করতে করতে হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করাই বন্ধ করে দিলো। সবাই হাঁটছে। আমি কিছুটা পেছনে পরে গেছি। হিল জুতার ফিতাটা কিছু সময় পরপর খুলে যাচ্ছে। যার জন্য হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। সেটাকে উবু হয়ে লাগাতে গিয়ে বারবার পেছনে পরে যাচ্ছি। আজ যে বোরখাটা পড়েছি সেটা আমার থেকে এক সাইজ লম্বা। ভেবেছিলাম কেটে-ছেটে, সেলাই করে এক সাইজ ছোট করবো। কিন্তু তাতে নিচের ডিজাইন নষ্ট হয়ে যাবে।স্লিপার জুতো পরলে বোরখা মাটিতে হিচড়ায়। তাই এর সাথে আমি সবসময় হিল নয়তো উঁচু গোড়ালির জুতা পরি। কিন্তু এরকম বিপদে আগে কখনো পরিনি। ভীষণ বিরক্ত লাগছে। একবার চিন্তা করলাম জুতো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটবো। আরেকবার ভাবি থাক দরকার নেই। কিছু সময় পর পর সবাই একসাথে রাস্তায় আমার জন্য দাঁড়িয়ে রইছে। তাদের দাঁড় করে রাখতেও আমার ভালো লাগছে না। আরেকবার জুতার ফিতাটা লাগিয়ে একটু হাঁটতেই আবার খুলে গেলো। ফিতে না লাগালে হাটা যায় না। জুতো খুলে চলে আসে।ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম এটাই শেষ। আর লাগাবো না। এরপর যদি খুলে যায় তাহলে জুতা খুলে এখানেই ছুড়ে ফেলে দিবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ।উবু হয়ে আবার জুতোর ফিতা ঠিক করে লাগতে নিলাম। তখুনি এনাজ সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— জুতায় কি সমস্যা?
—😶
— কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন? তখন থেকে দেখছি আমাকে এভয়েড করছো ঘটনা কি?
— কিছু হয়নি। আপনি যান আমি আসছি।
— আমি তো দেখতে পাচ্ছি কিছু হয়েছে।
আমি কথা না বলে জুতার ফিতাটা আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। উনি এগিয়ে এসে হুট করে আমায় কোলে তুলে নিলো। আমি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকালাম। সে কোন কথা না বলে সামনে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। আমি চেচিয়ে বললাম,
— আরে করছেন কি নামান? কেউ দেখলে খারাপ বলবে। প্লিজ নামান।
—আরেকটা কথা বলবে ধপাস করে নিচে ফেলে দিবো। তোমার বারবার জুতোর ফিতা লাগানোর জন্য এতবার দাঁড়িয়ে থাকার থেকে তোমাকে এভাবে নেওয়াই বেটার।
ফেলে দেওয়ার কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভাইয়াদের সামনে যেতেই দেখলাম সবাই আমাকে এভাবে দেখে মিটমিট করে হাসছে। আমি এনাজকে আরেকবার কোলের থেকে নামাতে বলতেই সে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। যা দেখে আমি পুরো চুপ হয়ে গেলাম। সত্যি যদি ফেলে দেয় তাহলে আমার কোমড় শেষ।
#চলবে।