শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৩২+৩৩

0
637

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_32
#Writer_NOVA

দুপুরের খাবার টেবিলে সব গোল করে বসে আছে। আমি চেয়ার টেনে নূর আপির সাথে বসতে নিলেই তায়াং ভাইয়া আমার থেকে চেয়ার কেড়ে নিয়ে নিজে বসে পরলো। আমি রেগে ওর দিকে তাকিয়ে এনাজের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসলাম। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। আমি বিরবির করে ওকে বকে প্লেটটা ঠাস করে আমার সামনে রাখলাম। আজ কলেজ বন্ধ। আগামীকাল নূর আপি, মামী চলে যাবে। তাই সব একসাথে হৈ-হুল্লোড় করে বাসা মাতিয়ে ফেলেছি। ইফাত একবার উঁকি মেরেছিলো। তবে বেশি সুবিধা করতে পারেনি বলে ছুটে পালিয়েছে। মামী, খালামণি আমাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ পায়ের মধ্যে লাথি পরতেই আল্লহ গো বলে চেচিয়ে উঠলাম। সব ব্যস্ত হয়ে গেলো। মামী এগিয়ে এসে বললো,

— কি হলো আবার আমার বড় ভাগ্নির?

খালামণি পানির জগ নিয়ে এগিয়ে এলো। পায়ে পানি ডলতে বলে বললো,
— কিসের সাথে ব্যাথা পেলি? নে পানি ডলে দে।

তায়াং ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— লেদি তো। নিশ্চয়ই চেয়ারের সাথে ব্যাথা পাইছে।

আমি ওর দিকে একটা খাইয়া ফালামু লুক দিলাম। আমার বরাবরি ও বসছে। আর লাথিটা যে ভাইয়া দিয়েছে তাতে আমি ড্যাম সিউর। ওর শক্ত হাড্ডির পায়ে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছি। আজ সারাদিন ধরে শুধু শুধু আমার সাথে লেগে রয়েছে। আমি এনাজের কারণে ওকে কিছু বলতেও পারি না। আবার সইতেও পারি না।এনাজ এগিয়ে এসে আমার পায়ে পানি দিয়ে ডলতে লাগলো। সাথে ইচ্ছে মতো আমাকে বকে ধুয়ে দিলো।

— কোন দিকে ধ্যান থাকে তোমার টিডি পোকা? এখানে খেতে বসছো ঠিকমতো বসে থাকবা। তা না করে এখানেও লাফাতে হবে। আর কোথায় লেগেছে বলো?

— আরে আরে আপনি আমার পা ধরছেন কেন?

— চপ।

তার রামধমকে আমি চুপ হয়ে গেলাম। যদিও আজ প্রথম সে আমার পায়ে হাত দিচ্ছে না। তবুও বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়।সব মিলে আমাকে বকতে লাগলো। নূর আপি দৌড়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এলো। এনাজকে বরফ দিয়ে বললো,

— ভাইয়া বরফ ধরেন।

এনাজ নূর আপির থেকে বরফ নিয়ে পায়ে ডলতে লাগলো। আমার লাগছে সুড়সুড়ি। একে তো সে আমার বড় হয়ে আমার পা ধরেছে। তাতে কিরকম অস্বস্তি লাগছে। আর বরফের ঠান্ডায় পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে। তাই আমি বারবার পা সরিয়ে নিচ্ছিলাম। এনাজ জোরে ধরে বরফ ডলতে ডলতে বললো,

— আরেকবার পা সরালে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।

— এনজিও সংস্থা আপনি আমার পা ছাড়েন। আমার সুড়সুড়ি লাগছে তো আমি কি করবো?

— চুপচাপ বসে থাকো। ব্যাথা পাওয়ার সময় তো মনে থাকে না। এখন এতো সমস্যা কেন?

আমি চুপ হয়ে গেলাম। একে পা ছাড়তে বললেও কোন লাভ হবে না। তন্বী মুখ টিপে হেসে বললো,
— আমি জানি কে করেছে।

আমি মুখ ঝামটা মেরে বললাম,
— চুপ থাক শয়তান ছেমড়ি। তুই আর কথা বলিস না। সবাই আমাকে বকতে আরম্ভ করেছে। অথচ আমাকে যে তায়াং ভাইয়া এতো জোরে লাথি মারলো তার কি হবে? তাকে কিছু বললে না। তোমরা সবাই আমাকে বকার জন্য ছুতো খুঁজো।

তায়াং ভাইয়া অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— আমি তোকে কখন মারলাম? কোন প্রমাণ আছে যে আমি তোকে মেরেছি? প্রমাণ ছাড়া কথা বলিস না।

আমি দুই হাতে মোনাজাত ধরে চেচিয়ে বললাম,
— আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিলাম। তায়াং ভাইয়ারে তুমি শায়েস্তা করো।(তন্বীর দিকে তাকিয়ে) ঐ ছেমড়ি মোনাজাত ধর।

আমার কাহিনি দেখে সবাই মিটমিট করে হাসতে লাগলো। তায়াং ভাইয়া সবে কিছু বলতে মুখ খুলতে নিয়েছিলো। নূর আপির এক ধমকে চুপ হয়ে গেলো।

— তানভীর ভাইয়া আপনি আরেকটা কথা বললে আপনাকে এখানে রাখা হবে না। নিচে বসিয়ে আপনাকে খাবার দেওয়া হবে।

তায়াং ভাইয়া ইনসেন্ট ফেস করে বললো,
— কিনু🥺?

নূর আপি আবার ধমকে বললো,
—আবার কথা বলেন।

তায়াং ভাইয়া ঠোঁটে আঙুল রেখে বাচ্চাদের মতো আধো সুরে বললো,
— আত্তা আমি তুপতাপ🤫।

তায়াং ভাইয়ার কান্ড দেখে আমার হাসি পেলো। তবে না হেসে আমি একটা ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। এনাজ বরফ ডলা শেষ করে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে আমার পাশে বসলো। আমি মনে মনে ফন্দি এঁটে ফেলেছি। আজ তায়াং ভাইয়ার খবর আছে। মামী, খালামণি কিচেন থেকে খাবার নিয়ে এসে সবাইকে সার্ভ করে দিতে লাগলো।

💖💖💖

সবাই চুপচাপ খাচ্ছি। তায়াং ভাইয়া আমাকে জ্বালানো শুরু করেছে। এই মনে করলেন মাছের কাটা ছুড়ে মারে, মাঝে মাঝে পানির ছিটা মারে। কিংবা পা দিয়ে খোঁচা মারে। আজ ওর মধ্যে শয়তানি আত্মা ভর করেছে। প্রতিদিন আমার ওপর ভর করে। আজ আমার ওপর ভর না করে ওর কাছে চলে গেছে। দুষ্টামী করে আবার ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁত কেলাচ্ছে। মামী গোশতের তরকারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তায়াং ভাইয়ার সামনে গিয়ে বললো,

— তানভীর, গরুর গোশতের তরকারি দিবো।

আমি মনে মনে ভাবি এই তো আমার সুযোগ। এই সুযোগ তো হাতছাড় করা যাবে না। ফট করে বলে উঠি,

— মামী ওকে গোশত দিয়েন। ওর এলার্জীর সমস্যা। গরুর গোশত খেলে শরীর অনেক চুলকায়। তবে আপনি চাইলে ওকে মূলা দিয়ে যে শুটকি রান্না করেছেন সেই তরকারি দিন। ভাইয়ার তো মুলা অনেক পছন্দ। ভাইয়ার মুলা তরকারি পেলে আর কিছু লাগে না। এখন যদিও মুলার সিজন নয়। কিন্তু পরশু চড়া দামে যে হাইব্রিড মুলাগুলো খালামণি বাজার থেকে কিনে এনেছিলো সেগুলো ওর জন্য কিনে আনছিলো। ভাইয়া কবের থেকে বলছে আম্মু মুলার তরকারি রান্না করো। তার জন্য তো আজকে রান্না করছে।

ভাইয়া রেগে আমার দিকে তাকালো। আসলে তায়াং ভাইয়া মুলার গন্ধই সহ্য করতে পারে না। মুলা খাওয়াতো দূরে থাক। যেদিন বাসায় মুলার তরকারি রান্না হবে সেদিন ভাইয়া বাসায় খাবে না। তাই খালামণি বাসায় এই সবজিটা আনেই না। খালামণি শুধু তার জন্য আধা কেজি মুলা এনেছিলো।তা দিয়ে তরকারি রান্না করেছে। তাও শুধু তার একার জন্য।তন্বী মিটমিট করে হেসে কিছু বলতে চাইলে আমি ওকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলি। তন্বীও চুপ হয়ে যায়।আমার সাথে সুর মিলিয়ে বলে,

— হ্যাঁ মামী। আমার ভাইয়া মুলার তরকারি অনেক পছন্দ করে। আপনি ভাউয়াকে অন্য কোন তরকারি দিয়েন না। শুধু মুলাই দেন।

মামী তো আমাদের কথা সত্যি ভেবে নিলো। মুলার তরকারির বাটি হাতে নিয়ে বাটির অর্ধেক ভাইয়ার প্লেটে তুলে দিলো। ভাইয়া চোখ বড় বড় করে তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। খালামণি নামাজ পরতে চলে গেছে। সে থাকলে এই শয়তানি করতে পারতাম না। এনাজ ভ্রু কুঁচকে তায়াং ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

— কিরে তায়াং তোর আবার এই তরকারি কবের থেকে এতো ফেভারিট হলো? আমি তো জানতাম না। তুই সত্যি আমাদের তায়াং তো। যে কিনা……. আউচ।

এনাজ পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে আমি আমার বা হাত দিয়ে তার বা হাতে একটা চিমটি মারলাম। সে আউচ বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— চিমটি মারো কেন?

— এদিকে আসেন। কানটা এদিকে বাড়ান। আপনার সাথে আমার কথা আছে।

— কি কথা?

এনাজ কান বাড়িয়ে দিতেই আমি বললাম,
— তায়াং ভাইয়াকে জ্বালাচ্ছি। একদম ওর পক্ষ নিবেন না। তাহলে কিন্তু ঐ পুরো বাটি মুলার তরকারি আপনাকে খাওয়াবো।

— না না। আমার মুলা পছন্দ নয়। আমি আর কিছু বলবো না।

তায়াং ভাইয়া হুংকার মেরে বললো,
— তোরা ফিসফিস করে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিস তাই না? একবার শুধু অপেক্ষা কর শাঁকচুন্নি। তোর খবর আছে।

তায়াং ভাইয়া কাঁদো কাঁদো মুখে প্লেট থেকে এক টুকরো মুলা নিয়ে মুখে দিলো। বেচারার বোধহয় ভেতর থেকে সবকিছু গুলিয়ে আসছে। একবার মুখ বাঁকিয়ে এক হাতে মুখ আটকে রাখলো। এখন বেচারা পারছে না উঠে যেতে। কোনরকম সেটাকে গিলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— হাতি ফাঁদে পরলে চামচিকাও লাথি মারে।

নূর আপি মিটমিট হেসে তাকে বললো,
— তানভীর ভাইয়া আপনার না এতো পছন্দ। তাহলে খাচ্ছেন না কেন?

আমি তায়াং ভাইয়াকে এক চোখ মেরে নূর আপিকে বললাম,
— এত কম দেখে ভাইয়া বোধহয় খেতে চাইছে না। মামী ওকে পুরো বাটির তরকারি দেন। নয়তো ভাইয়া আজ ভাত খাবে না।

মামী তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— তানভীর আরো তরকারি লাগবে।

তায়াং ভাইয়া মাথা উঁচু করে কাঁদো কাঁদো মুখে প্লেটের ভাত নাড়তে-চাড়তে বললো,
—না মামী😵।

আমি শয়তানি হাসি দিয়ে চেচিয়ে বললাম,
— আরে ভাইয়া লজ্জা পাস কে? আমরা আমরাই তো। আহারে ভাই আমার। বেচারা এত দিন পর প্রিয় খাবার দেখে খুশিতে বোধহয় চোখে পানি চলে আসছে। খুশিতে খেতেই পারছে না।ভাইয়া তুই দেখিয়ে দে তুই সব তরকারি শেষ করে দিবি। তায়াং ভাইয়া কাউকে ভয় পায় নাকি।

এনাজ বললো,
— হ্যাঁ, তায়াং দেখিয়ে দে। তুইও পারিস।

তায়াং ভাইয়া মাথা উঠিয়ে কটমট করে এনাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
— শালা,তুইও ওদের মতো শুরু করছিস।

এনাজ দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো। আমরা সবাই মিটমিট করে হাসছি। মামী ডাল আনতে কিচেনের দিকে চলে গেল। তায়াং ভাইয়া আমাদেরকে হাসতে দেখে আরো রেগে গেলো। অল্প একটু ভাতের সাথে মুলার তরকারি মেখে মুখে দিতেই ওয়াক ওয়াক করে মুখে হাত দিয়ে বেসিনের দিকে ছুটলো। একদম ঠিক হয়েছে। এবার বোঝ মজা। আমার সাথে লাগার মজা এবার হারে হারে টের পাবি। ভাইয়া উঠে বেসিনের দিকে যেতেই খাবার টেবিলে উচ্চ হাসির রোল পরলো।

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_33
#Writer_NOVA

এক্স মানেই হলো কালসাপ। এতদিন আমি এই কথা বিশ্বাস না করলেও এখন তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। যখুনি আপনি সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করবেন তখুনি আপনার জীবনটাকে তেজপাতা থেকে বাঁশপাতা বানাতে এদের ফের আগমন হবে। আপনি যদি তার মিষ্টি কথার ফাঁদে পরে যান তাহলে আরেকটা বাঁশ পাওয়ার জন্য তৈরি হোন। অবশ্য বৈইমানকে তো কখনো দুটো সুযোগ দিবেন না। যে আপনাকে চরম মুহুর্তে ফেলে নিজে গা-সারা ভাব নিয়ে পালিয়েছিলো তাকে ২য় বার বিশ্বাস করলেন তো ২য় বার ঠকলেন।কালসাপকে বিশ্বাস করলে আপনার ছোবল খেতে হবে। তেমনি এই এক্স নামক মানুষটাকে বিশ্বাস করলেও ধোকা পাবেন। তবে সবাই এক নয়। কিন্তু সিংহভাগই কালসাপের সাথে তুলনীয়।

ক্যাফেতে বসে আছি আমি ও শারমিন। দুজন একসাথে ফুচকা খেতে এসেছি। তায়াং ভাইয়ার থেকে ৫০০ টাকা লাভ করেছি শুনেই শারমিন জেঁকে ধরলো ট্রিট দিতে হবে। এরকম দু-একটা বেস্টফ্রেন্ড থাকলে সাইড ব্যাগ খালি হতে দুদিনও লাগে না। মনটা বেশি একটা ভালো নেই। সকালে নূর আপি ও মামী চলে গেছে। বাসায় থাকলে খারাপ লাগবে বলে কলেজে চলে এসেছি। তন্বী আসেনি। ওর ক্লাশে স্যার ঢুকে গেছে। নয়তো আমাদের সাথে চলে আসতো।বিজনেস ম্যাথ ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছি ক্যাফেতে। মোবাইল স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ শারমিন বললো,

— এই নোভা দেখ।

— কি দেখবো?

—মোবাইলের থেকে চোখ তো উঠা তবেই না দেখতে পাবি। মোবাইলটা একটু রাখ।

— এভাবেই বল না।

— তুই কি মোবাইলের থেকে মাথা উঠাবি।

আমি ঈষৎ বিরক্তমাখা মুখ নিয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ঐ ছেমরি হইছো কি?

— কোণার টেবিলের দিকে তাকা। সাদা কালার ফুল হাতা টি-শার্ট পরা ছেলেটার দিকে একটু ভালো করে নজর রাখ।

আমি সেদিকে না তাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—এতো বড় গদ্য না বলে সারাংশ বল।

— ঐ ছেলেটা কিছু সময় পরপর তোর দিকে তাকাচ্ছে। হাবভাব ভালো ঠেকছে না আমার।

— ছেলেটা না হয় আমার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু তুই এতো ঐ ছেলের দিকে তাকাচ্ছিস কেন? আমার তো তোর হাবভাব ভালো মনে হচ্ছে না।

— এর জন্য কারো ভালো করতে নেই।

— আচ্ছা বল কোন ছেলে?

— কোণার টেবিলে একটা ছেলে বসে আছে।

— কোন ছেলে না কোন ছেলে বসে…..

কথা পুরো শেষ করতে পারলাম না। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই সারা শরীরের রক্ত গরম হয়ে গেলো। কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই বেশরম ছেলে আমাকে ফলো করা ছাড়েনি। আমি তাকাতেই রোশান এক ভুবন ভুলানো হাসি দিলো। তাতে রাগ কমার বদলে আরো বেশি বেড়ে গেলো। দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে ফুঁসতে লাগলাম। শারমিন আমাকে এই অবস্থায় দেখে বললো,

— এই তুই ঠিক আছিস তো? মাঝে মাঝে তোর কি হয়? তুই কি ছেলেটাকে চিনিস?

— হুম।

— কে উনি?

— তোকে আমার বিষাক্ত অতীতের কথা বলছিলাম না। সেই বৈইমান ছেলে।

আমার কথা শুনে শারমিনও ফোঁস করে রেগে গেলো।ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— ঐ হারামজাদায় এখানে কি করে? ওর সাহস কি করে হয় তোকে ফলো করার। ইচ্ছে তো করছে গিয়ে ঠাটিয়ে এক চড় মেরে আসি। ছেলে মানুষ যে এতটা খারাপ হতে পারে তা এর কথা তুই না বললে জানতেই পারতাম না।

— বাদ দে। ঐদিকে আর তাকাস না।

— এখন কি চলে যাবি?

— প্রশ্নই উঠে না। আমি পিছুটান রাখি না। অতীত নিয়ে মন খারাপ করে পরে থাকার মতো মেয়ে এই নোভা না। ফুচকা দিয়ে গেলে খেয়ে এখান থেকে বিদায় হবো। একে দুচোখে আমি সহ্য করতে পারি না। ফুচকা অর্ডার দিয়েছি। না খেয়ে কি করে যাই। তুইও না কি যে বলিস?

— ওকে তুই যা ভালো মনে করিস।

মোবাইল ব্যাগে রেখে শারমিনের সাথে কথা বলায় মনোযোগ দিলাম। মুখে যতই অস্বীকার করি অতীত নিয়ে মন খারাপ করি না। কিন্তু যখন মনে পরে তখন নিজেকে আটকে রাখা খুবই দুঃসাধ্য হয়ে যায়। আমি যে আমার মাঝে থাকি না। ভেতর থেকে কান্নাগুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

💖💖💖

ফুচকা দিয়ে যেতেই আমি ও শারমিন দুজন হাসি-ঠাট্টা করতে করতে ফুচকা মুখে পুরতে লাগলাম। না চাইতেও চোখেটা রোশানের দিকে বারবার চলে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে চোখে বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি, নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি। বিনিময়ে নিজের চরিত্র নিয়ে মিথ্যে অপবাদ ও ধোকা ছাড়া কিছু পেলাম না। দ্রুত খাওয়া শেষ করে ফেললাম। শারমিনের হাতে টাকা দিয়ে ওকে বিল পে করতে বলে আমি ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। রোশান আমাকে একা দেখে দ্রুত আমার সামনে এসে বললো,

— কেমন আছো রাই?

আমি তার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো।

— আমাকে জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি?

— প্রয়োজন মনে করছি না।

— আমাকে কি মাফ করে দিয়ে আরেকবার সুযোগ দেওয়া যায় না?

— জীবনেও না।

— আমাকে তো ভুল বোঝানো হয়েছিলো। তুমি তো সব জানো। তবুও কেন আমার ওপর এতো আক্রোশ তোমার?

— আপনার মতো বেহায়া না দুটো দেখিনি আমি। মানুষ কতটা নির্লজ্জ্ব, বেশরম হলেও নিজের চেহারাটা আমাকে দেখাতে আসতে পারে তা আমি ভেবে পাই না। হ্যাঁ, মানলাম আপনাকে ভুল বোঝানো হয়েছিলো। আচ্ছা আমায় বলুন তো,আপনি কি অবুঝ? নাবালক বাচ্চা ছেলে? আপনাকে কেউ মিথ্যে বানিয়ে বলবে, এডিট করা ছবি দেখাবে, চোখের ধোকা দিবে আর আপনি যাচাই-বাছাই না করে একটা মেয়েকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিবেন। ওসব মনগড়া কাহিনি না আমায় শুনাতে আসবেন না প্লিজ। আপনাদের তিনজনকে আমি কখনো মাফ করতে পারবো না। ভেতর থেকে মাফ নামক শব্দটাই আসে না। আমি এতো মহান মানুষ নই। যার কাছ থেকে সামান্য আঘাত পাই তার দিকে ২য় বার ঘুরে তাকাই না। আর আপনারা তো আমার চরিত্রে দাগ লাগিয়েছেন। আমাকে আপনারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন আর আমি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে মাদার তেরেসা হয়ে সব ভুলে আরেকবার সুযোগ দিবো? হাহ ভাবেন কি করে এসব? আমি এতো দয়ালু মানুষ নই। যে আমার সাথে যেমন করবে আমি তাকে তেমন ফেরত দিতে পারি। আমার কাছে নিজের সেল্ফ রেসপেক্ট অনেক বড়। আর হ্যাঁ, যেখানে আপনাদের মাফ করার প্রশ্ন উঠে না সেখানে আরেকবার সুযোগের কথা কোথা থেকে আসে? মানুষকে সুযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষরূপী কালসাপকে নয়। একবার দূরে ছুঁড়ে মেরেছেন তাই বলে ২য় বার মারবেন না তার গ্যারান্টি কি? ভালো চাইলে নিজের ঐ বদনখানি আমাকে দেখাতে এসেন না। নয়তো সেটা নষ্ট হতে একদিনও লাগবে না।

— আমি জানি রাই আমার মাফ হবে না। তবুও বেহায়ার মতো তোমার কাছে ছুটে আসি। তোমার যদি আমার প্রতি একটু দয়া হয় তার জন্য।

— রাস্তার কুকুরগুলোও না আপনাদের থেকে অনেক ভালো। ওদের একদিন যত্ন করলে বহুদিন মনে রাখবে। কিন্তু আপনাদের ২য় বার সুযোগ দিলে যতটুকু আমার সেল্ফ রেসপেক্ট আছে তাও খোয়াবো। আপনি না কতবড় আত্মসম্মানী লোক! তা কোথায় গেলো আপনার আত্মসম্মান? আমি তো আমার চেহারা আপনাকে দেখাতে যাইনি। তাহলে আপনি কেন ইউ.কে থেকে ফিরে এসে আমার কাছে চলে এসেছেন। আমি হলে তো জীবনেও আসতাম না। থুথু ফেলি আপনার ঐ আত্মসম্মানের। একটা কথা জানেন তো মিস্টার রোশান দেওয়ান। নকলের পেছন ছুটতে ছুটতে মানুষ এক সময়ে বুঝতে পারে সে কি পেতে গিয়ে কি হারিয়ে ফেলেছে! দুটো সময় মানুষ অন্যকে মূল্য দেয়। ১.পাওয়ার আগে ২. হারিয়ে যাওয়ার পর। থাকতে তো মূল্য দেননি। তাই হারিয়ে যাওয়ার পর আমার মূল্য বুঝে কি লাভ হবে?।সত্যি কথা বলতে আপনি আমায় কখনো ভালোই বাসেননি। ভালো বাসলে কখনো আমার সাথে এমনটা করতে পারতেন না। আপনার বুক কেঁপে উঠতো। মিথ্যে অপবাদগুলো দেওয়ার আগে, আমার চরিত্র কালি লেপ্টানোর আগে সব যাচাই-বাছাই করতেন। আপনি আমার সাথে অভিনয় করেছেন। খুব সুক্ষ্ম অভিনয়।
আর আমি আপনার অভিনয় বুঝতে না পেরে পাগলের মতো আপনাকে ভালোবেসেছি। কারো ওপর বেশি গললে তাকে ভেঙে পরতেই হয়। তাহলে আমার ক্ষেত্রে কেন হবে না বলুন? জীবনে এরকম দু-একটা আঘাত পেতে হয়। নয়তো ঘুরে দাঁড়ানো যায় না। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া যায় না। আমি মনে করি প্রত্যেকের বড় আঘাত পাওয়া উচিত। এতে কাছের মানুষগুলো কে তো চেনা হয়।

— সব তুমি বলবে আমায় কিছু বলতে দিবে না?

— বলার মতো কিছু বাকি রেখেছেন? আমি জানি আপনি আমাকে কখনি ভালোবাসেন নি। আপনি এখন আমার কাছে এসেছেন অনুশোচনার কারণে। যখন থেকে জানতে পেরেছেন আমার সাথে আপনি অন্যায় করেছেন তখন থেকে আপনি ভেতরে ভেতরে দাবানলে দগ্ধ হচ্ছেন। সেই দাবানলের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমার পানে ছুটে এসেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে, জারাকে,আর ৩য় সেই দুমুখো সাপকে কখনই মাফ করবো না। পুড়তে থাকুন আগুনে। দেখুন কিরকম লাগে। এর থেকে বহুগুণ বেশি আমি জ্বলেছি,পুড়েছি।তখন তো বেশ মজা নিয়েছিলেন। আমিও নিতে থাকি।আপনাদের মাফ করলে আমি নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবো। তাতো আমি চাই না। নাও গেট লস্ট। আমি চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান। দয়া করে আমাকে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে দিন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।

চোখ দিয়ে পানি পরছে। কিন্তু তবুও আমি থেমে নেই। এত কথা শোনাই তারপরেও এর শরম হয় না। শারমিন চলে এলো। আমি ওর সাথে বের হতে নিলেই রোশান আমার হাত ধরে আটকালো। আমি রাগে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলাম। কিন্তু এক চুলও নাড়াতে পারলাম না। চেচিয়ে বললাম,

— হাত ছাড়ুন আমার। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামী। পাবলিক প্লেসে আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইছিনা রোশান। হাত ছাড়ুন বলছি।

শারমিন রেগে বললো,
— নিজের মঙ্গল চাইলে ওর হাত ছেড়ে দিন। নয়তো অনেক খারাপ হয়ে যাবে বলছি।

কিন্তু রোশান কোন কথা না বলে শক্ত করে আমার হাত ধরে টেনে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি আরেক হাতে ওর হাত টেনেও ছুটাতে পারছি না। কালো একটা প্রাইভেট কারের সামনে এসে দরজা খুললো। আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার আগেই আরেকটা হাত এসে ঝাটকা মেরে রোশানের থেকে আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে বললো,

— কি হচ্ছে এখানে টিডি পোকা?

আমি তাকিয়ে দেখি এনাজ রাগী চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে আছে।আমি বিস্মিত চাহনিতে বললাম,

— আপনি এখানে? কোথা থেকে ডাউনলোড না থুরি আমদানি হলেন? একদম হিরোর মতো এন্ট্রি মারলেন যে তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি😑।

এনাজ আমাকে চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— কেন খুব বেশি অসুবিধা হয়ে গেছে তোমার?

— কি যা তা বলেন? আপনি এসে বরং ভালো করেছেন৷ দেখুন না উনি আমার সাথে কিরকম অসভ্যতামী করছে।

— তাতো দেখতেই পাচ্ছি। (রোশানের দিকে তাকিয়ে) সমস্যা কি আপনার? রাস্তার মাঝখানে ওর হাত ধরে টানাটানি করছেন কেন?

রোশান কোন কথা বললো না। ভ্রু কুঁচকে এনাজ আমাকে যে হাতে ধরে রেখেছে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এনাজ রাগী কন্ঠে বললো,

— আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি? কি সমস্যা আপনার? কোন সাহসে আপনি ওর হাত ধরেছিলেন।

রোশান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
— যেই সাহসে আপনি ওর বাহুতে হাত রেখেছেন সেই সাহসে।

এনাজ রেগে গেলে কেন জানি আমার ভীষণ ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি আমার গালে ঠাস করে একটা দিয়ে বসলো। কিন্তু এনাজ সেরকম কিছু এখনো করেনি। তবুও মনের ভয়। এনাজ কিছুটা দম নিয়ে বললো,

— মুখ সামলে কথা বলুন। পাবলিক প্লেসে চুপচাপ আছি বলে আপনি যা খুশি তা বলে যাবেন আর আমি সবকিছু হজম করে নিবো। এমনটা যদি ভাবেন তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন।

রোশান হাত মুঠ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। এনাজ আমার বাহুতে তার এক হাত পেচিয়ে জোরে নিজের সাথে চেপে ধরে রোশানকে আঙুল দিয়ে শাসালো। তারপর উল্টো দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। রোশান একবারের জন্য আটকালো না। জোরে গাড়ির দরজায় লাথি মেরে রাগে ফুঁসতে লাগলো। এনাজ দুই আঙুল দিয়ে আমার মুখটা পেছন থেকে ঘুরিয়ে সামনের দিকে নিলো।আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ তার সাথে চলতে লাগলাম। মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু এত দ্রুত ঘটলো যে আমার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে গেলো।

#চলবে