#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১০+১১|
-“খারাপ হয়ে যাবে, প্রিয়।”
-“খারাপ হতে আর বাকি রেখেছেন কিছু?”
-“ফর গড সেক, কল রিসিভ করো। নয়তো সব শেষ করে দেবো..”
-“দিন।”
শ্রেয়ানের মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে এলোমেলো হয়ে উঠল ক্ষণিকেই। জলদি গায়ে শার্ট জড়িয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। বেরোতে বেরোতে ম্যাসেজ করল,
-“মিট করো।”
-“কেন?”
-“কেন আবার? আমি বলেছি, তাই।”
প্রিয় ম্যাসেজ সিন করেও রিপ্লাই দিলো না। শ্রেয়ান নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“প্রিয়শ্রী, রাগ বেশি হয়েছে এবার, তাইনা? রাগ ভাঙাচ্ছি। এসো।”
-“না।”
-“এতবার বলা লাগছে কেন? কথা বুঝতে পারছ না? তুমি কি চাইছ, আমি রেগে যাই? কলে আসো।”
প্রিয় ফোন থেকে মেসেঞ্জার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারসহ প্রায় সব সোশ্যাল অ্যাপগুলো আনইন্সটল করে দিলো। কন্ট্যাক্ট থেকেও ব্লক করে দিলো। নয়তো শ্রেয়ানের আর কিছু ম্যাসেজ এলেই সে আর রিপ্লাই না দিয়ে পারবে না। আবার দূর্বল হয়ে পড়বে। এর চেয়ে এ-ই ভালো হলো। ব্যাপারটা বুঝতে শ্রেয়ানের সময় লাগবে অনেকটা। ততক্ষণে প্রিয় নিজেকে সামলে নিতে পারবে।
এরই মধ্যে ফোনে তার বড়ো খালার কল আসে। সে সময় নিয়ে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে জেসমিন বলল,
-“হ্যালো।”
-“আসসালামু আলাইকুম, খালামণি। ভালো আছ?”
-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?”
-“ভালো আছি।”
-“তোর আম্মার হাঁটু ব্যথা কমছে?”
-“হ্যাঁ, কিছুটা।”
-“দুলাভাই ভালো আছে?”
-“হ্যাঁ। ভালো আছে, আব্বু।”
-“প্রহরের অবস্থা কী?”
-“ওই তো, পড়াশোনা আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে।”
-“লাখে একটা ছেলে তোর ভাই। কী সুন্দর সবাইকে মান্য করে চলে। কোনো আজে-বাজে নেশা নাই। এমন ছেলে পাওয়া যায়? দেখিস, আমাদের প্রহরের জন্য এমনই লাখে একটা মেয়ে আনব।”
প্রিয় হাসল,
-“এনো।”
-“দুপুরে খাইছিস?”
-“হুঁ, তোমরা?”
-“খাইলাম একটু আগেই।”
-“শোন, যেটা বলার জন্য কল দিলাম। মেয়ের বিয়ে ঠিক করতেছি, বুঝছিস? সব ঠিক থাকলে বছর ঘুরে আসতে না আসতেই ডেইট ফালাব।”
-“বাহ! এটা তো ভালো খবর। রিধি আপু কই?”
-“ও গোসলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে জোর করে কল দেওয়াইলো তোকে। বলল এখনই জানাইতে। তোর নাকি কেনাকাটা করতেই মাস লাগে!”
-“হুহ! মিথ্যা বলে তোমার মেয়ে।”
আরও অনেক ধরনের কথা হলো। সব শেষে জেসমিন বলল,
-“তোর আম্মাকে ফোনটা দে তো, কথা বলি।”
-“আম্মুর ফোনে কল দাও।”
-“প্রত্যেকের ফোনে আলাদা আলাদা করে কল দেওয়া লাগবে ক্যান? যা, দিয়ে আয় ফোন।”
প্রিয় কিছু না ভেবেই বের হলো রুম থেকে। নাহারা কখনও তার ফোন চেক করে না। তার এসব পছন্দ না।
প্রিয় রুম থেকে বেরিয়ে দেখল নাহারা ড্রয়িংরুম গোছাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“আম্মু, খালামণি কল দিয়েছে। কথা বলো।”
প্রিয় ফোন দিয়ে রুমে চলে এলো। নাহারা কথা বলা শেষ করে ফোন সোফার ওপর রেখেই কাজ করছিল। এরই মধ্যে নাম্বারে আবার কল আসে। নাম্বারটি সেভ করা একটা লাভ ইমোজি দিয়ে।
নাহারা প্রিয়কে ডাকতে গিয়েও ডাকল না। কল রিসিভ করে কানে তুলল। তখনই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পুরুষালি স্বর,
-“আমার এই নাম্বারটার কথা ভুলে গেছিলে নাকি? হা হা! এত জ্বালাচ্ছ কেন, সোনা? বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়েছি। জলদি আসো তো। আজ সারাদিন আমার সাথে ঘুরবে। খুব মিস করেছি ক’দিন তোমায়। খু–ব… ভালোবাসি, জান।”
নাহারা জিজ্ঞেস করল,
-“কে?”
ওপাশে ক্ষণকাল কোনো আওয়াজ এলো না। কিছুটা সময় কাটতেই শ্রেয়ান বলল,
-“প্রিয়র ফোন আপনার কাছে? কে আপনি?”
-“আমি ওর মা।”
-“ও আচ্ছা। আন্টি, আমি ওর ফ্রেন্ড। ওর কাছে ফোনটা দিন।”
-“একটু আগে যেসব কথা বলছিলে..ওসব ফ্রেন্ডরা বলে?”
-“তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন—আমি কে? বুঝে নিন কী লাগি ওর। আর হ্যাঁ, বিনা পারমিশনে অন্য কারো কল পিক করাটা ব্যাড মানার্স, আন্টি। ও কোথায়? ওকে ফোন দিন।”
-“চুপ বেয়াদব! তোমার থেকে ম্যানার্স শিখব?”
-“তো আপনার জন্যই তাহলে মেয়েটা সকাল থেকে এরকম করছে? বুঝলাম! দেখুন, আন্টি। মেয়ে আপনার এডাল্ট, সে নিজের বুঝ বোঝে। তার কান ভাঙানো বন্ধ করুন।”
-“তুমি বাড়াবাড়ি করছ!”
-“উফ! ভালো লাগছে না, আন্টি। দুইদিন পর তো মেয়ে দিয়েই দেবেন। তার আগে এমন বাংলা সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো করছেন কেন?”
-“মরে গেলেও তোমার কাছে মেয়ে দেবো না। এটুকু সময়ে তোমার শিক্ষাটা যথেষ্ট অবজার্ভ করে ফেলেছি। যেই ছেলে বড়োদের সম্মান দিতে জানে না, সেই ছেলে আমার মেয়েকে কেমন সম্মান করে—আমার বোঝা শেষ। ওমন ছেলের কাছে মেয়ে দেবো না।”
-“আপনি দিতে বাধ্য। যদি না দেন, তবে হয়তো আপনার মেয়ে উড়াল দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে, নয়তো মরে যাবে।”
-“এর চেয়ে ওর গলা টিপে আমিই ওকে মেরে ফেলব।”
-“উঁহু আন্টি, সাবধান!”
-“আমার মেয়েকে আমি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব, তাও তোমার হাতে দেবো না। খবরদার যেন এই ফোনে তোমার আর কল না আসে।”
-“আসবে।”
নাহারা কল কেটে দিলো। রাগে তার গা থরথর করে কাঁপছে। সোফায় বসে পড়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দুহাতে মাথা চেপে ধরে রাখল। কিছুক্ষণ পর প্রিয়র ফোনটা ঘাটতে লাগল। কল-লিস্ট ঘেটে একটা নম্বরকে অসংখ্যবার রিপিট হতে দেখল। তার সাথে কল ডিউরেশন ঘন্টার পর ঘন্টা। রাত-দিন নেই।
যেহেতু প্রিয় কিছুক্ষণ আগেই সোশ্যাল অ্যাপগুলো ডিলিট করে দিয়েছে, তাই আর সেসব দেখতে পেল না। তবে গ্যালারিতে গিয়ে অসংখ্য ছবি দেখল ওদের। বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল দুজনের মাঝে। এসব দেখে নাহারের মাথা আরও গরম হয়ে গেল। সে চিৎকার করে প্রিয়কে ডাকতে লাগল।
অসহনীয় রাগে কাঁপছে সে। মেয়ে তাহলে এই ছেলের জন্য বিগড়ে গেছে? প্রিয়র বদলে যাওয়া নিয়ে ওর ফুপিরা প্রায়শই বলত, মেয়ে বড়ো হয়েছে, কিছু ঘটিয়েছে কি না দেখতে। নাহারা সেসব আমলে নেয়নি। সে বরাবরই বলে গেছে, “আমার মেয়ে বড়ো হলেও, ওসবে নেই। আমরা ওভাবে মেয়েকে মানুষই করিনি। তাছাড়া মেয়ে আমার সাথে সবকিছুই শেয়ার করে।”
এত এত বিশ্বাস ভেঙে গেল ক্ষণিকেই। প্রিয় শুধু প্রেমে জড়ায়নি, ছবিগুলো আরও অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। ছবিগুলো জানাচ্ছে, এটা তার প্রিয় হতেই পারে না। নাহারা দিশেহারা। এসব দেখতে হলো তার?
প্রিয় এসে ড্রয়িং রুমে দাঁড়াতেই তার ফোন সেন্টার টেবিলের ওপর থাকতে দেখল। ডিস্প্লে জ্বলজ্বল করছে তার আর শ্রেয়ানের একটা ছবি দিয়ে। ছবিটা শ্রেয়ানের এক ফ্রেন্ডের বিয়েতে তোলা হয়েছিল। প্রিয়কেও নিয়ে গিয়েছিল সে। সন্ধ্যা সন্ধ্যা নাগাদ শ্রেয়ান তাকে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে প্রিয়র কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। প্রিয় তখন ছবিটা তুলেছিল।
ভয় পেল প্রিয়। এসব মা দেখে নিয়েছে! ফোন লক করার অভ্যেস তার নেই। অন্তত গ্যালারির ছবিগুলো হাইড রাখত! তাছাড়া প্রহর সব ছবি, কনভারসেশন ডিলিট করতে বলেছিল। প্রিয় পারেনি। স্মৃতি হত্যার মতো কাজ প্রিয়র দ্বারা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটাই যে এখন কাল হয়ে দাঁড়াল।
প্রিয়র উপস্থিতি অনুভব করে নাহারা বেগম উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। অবিচল গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“ওগুলো সত্যি?”
প্রিয় কথা বলছে না। সে আশঙ্কনীয় হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আসলে কী বলবে? মিথ্যেমিথ্যি ‘না, ওসব মিথ্যে’ বলে লাভ নেই, কেননা ছবিগুলো স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, ওগুলো সত্যি। আবার ‘হ্যাঁ’-ও প্রিয় বলতে পারছে না। কেননা সম্পর্কটা নড়বড়ে, দূরত্ব অসীম, মধ্যবর্তী দেয়াল আকাশসম, যোগাযোগ ছিন্নতা ৫৪ দিনের; এক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
নাহারা ধমকে উঠল,
-“উত্তর চাইছি আমি!”
প্রিয় কেঁপে উঠল, স্বীকারোক্তিও দিলো,
-“সত্যি..
পরক্ষণে নিজেকে এক্সপ্লেইন করার তাগিদে বলে উঠল,
-“কিন্তু মা..”
নাহারা সেই কিন্তুকে পরোয়া না করে পুনরায় শুধাল,
-“কয়দিনের সম্পর্ক?”
-“সাড়ে চা..চার..”
কম্পনরত আওয়াজটি থেমে গেল, আর কিছু বলতে পারল না। শক্ত হাতের একটা থাপ্পড় এসে খুব জোরে প্রিয় ডান গালে এসে পড়ল। ঝুঁকে পড়ল বাঁ দিকে। ব্যাপারটা বোঝার আগেই নাহারের উত্তেজিত আওয়াজ সে শুনতে পেল,
-“জানোয়ারের বাচ্চা, পেলেপুষে বড়ো করছি এসবের জন্য?”
প্রিয় মানতে পারছে না এখনও এসব তার সাথে হচ্ছে। খানিকক্ষণ আগেও সব স্বাভাবিক ছিল। অথচ এখন? এসব কী হচ্ছে? চুপ থেকে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। নাহারের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। একটা থাপ্পড় দিয়ে সে শান্তি পেল না। দুই হাত দিয়ে এলোমেলোভাবে মারতে লাগল প্রিয়কে। প্রিয় কান্না করতেও ভুলে গেছে। গায়ে একেকটা আঘাত বেশ সুচারুভাবে লাগছে। দূর্বল শরীর তার, সামান্যতেই ব্যথা পায়। সেখানে একনাগাড়ে এত মার সইতে পারছে না। পা ভেঙে আসে। মেঝেতে বসে পড়তেই সে আওয়াজ দিয়ে ওঠে,
-“মা, লাগছে..ছেড়ে দাও, মা…”
উদ্ভ্রান্তের মতো মারতে মারতে নাহার বলে,
-“শরীরের আগুন এত বেশি হইলে আগেই বলে দিতিস, খাইয়ে-পড়িয়ে জানোয়ার পালতাম না। বিয়ে করতে চাস না এর জন্য? এত সাহস পেলি কই তুই? কে দিলো তোকে? কী ভাবছিস? বড়ো হয়ে গেছিস? শেয়ানা হয়ে গেছিস? যা ইচ্ছা করতে পারবি? নির্লজ্জ মেয়ে!”
নাহারা নিজের রুমে গেল। সেলাই মেশিনের পাশে বেশ বড়োসড়ো একটা কাঠের স্কেল ছিল। সেটা তুলে ফিরে এসে প্রিয়কে মেঝেতে এলোমেলোভাবে বসে কাঁদতে দেখল। ধৈর্যের বাধ ভাঙল। সেই স্কেল দিয়ে মেয়েকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগল। প্রহর ছাদে ছিল সে সময়। তাছাড়া বাড়িতে আপাতত আর কেউ নেই।
প্রিয় আর পারছে না মার নিতে। সে অসংখ্যবার বলতে চাইল, এখন আর শ্রেয়ানের সাথে তার কনট্যাক্ট নেই। কিন্তু নাহারা শুনল না। মেয়েকে ঘিরে তার অনেক বিশ্বাস ছিল। হুট করেই সেই বিশ্বাসটা চোখের সামনে বেশ চমকপ্রদভাবে ভাঙতে দেখে তার কলিজা কেঁপে উঠেছিল। তারপর শুনল, বিশ্বাস তো ভেঙেছে আরও সাড়ে চার বছর আগে। এত বছর সে ভ্রান্তিতে ছিল। বিশ্বাসঘাতক! বেঈমান! কতশত শব্দ উচ্চারণ করছে প্রিয়কে মারতে মারতে।
রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের স্বাধীনতা নেই, বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ-এর সুযোগ নেই, তাদের ওড়ার অধিকারও নেই। দুঃসাহসী প্রিয় সেখানে প্রেমে পড়ে বসল! সাহসের সীমা সে অতিক্রম করেছে বহু আগে।
অবশেষে প্রহর ছাদ থেকে নামল। দরজার কাছে এসেই প্রিয়র আহাজারি শুনল। পা থমকে গেল। ক্ষণকাল বিলম্বে ত্বরিতে আরও গতি বাড়াল সে। বসার ঘরের মেঝেতে বোনকে পড়ে থাকতে দেখে সে দ্রুত পা চালিয়ে মায়ের কাছে যায়। বুঝতে পারছে না কিছু। তবে আপাতত মা’কে থামানো দরকার। একহাতে নাহারকে আগলে ধরে প্রিয়র থেকে দূরে সরিয়ে নিল। অন্যহাত দিয়ে স্কেলটা আলগোছে সরিয়ে নিল।
নাহার চিল্লিয়ে যাচ্ছে,
-“বান্দির বাচ্চা সব ডুবাইছে। ওরে জবাই না করা অবধি শান্তি পাইতেছি না। প্রহর, তুই ছাড় আমারে। ওর বাপের কথা একবারও ভাবে নাই? এত ছাড় তো ওরে ওর বাপই দিছে? জান দিয়ে দিছে ওর জন্য। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে ঘুমানোর আগে প্রতিদিন নিয়ম করে জিজ্ঞাসা করে—ছেলে-মেয়ের কী কী লাগবে। এত কষ্ট করে মানুষটা! তাও মুখে হাসি রেখে বলে, আমার ছেলে-মেয়ের কষ্ট না হইলেই হইলো। একবার জানলে মানুষটা বাঁচবে? মাথার ঘাম পায়ে ফালাইয়া ওর বাপ ওর চাহিদা পূরণ করছে। আর ও বিনিময়ে এ-ই দিলো? নিমকহারাম! আমি সহ্য করতে পারতেছি না ওরে। কম খাঁটি ওর জন্য? কম? সারাদিনে এক মুহূর্ত বসি না! কিছু চাওয়ার আগেই এনে দিই। পরীক্ষার সময় ওর রাত জাগতে হয়। যাতে কোনো সমস্যা না হয়, কিছু খাইতে ইচ্ছা করলে আমারে বলতে পারে, তাই পাশাপাশি আমিও রাত জাগি। ফজর ওয়াক্ত থেকে রাত অবধি ওর ফরমায়েশ খাঁটি। আল্লাহর বারো মাসে অসুস্থ থাকলেও মুখ ফুটে উচ্চারণ করি না। সারাজীবনে ওর শখ-আয়েশ পূরণ করতে গিয়ে নিজেরটা ভাবি নাই। কার জন্য করছি এগুলা? কার জন্য? এই হারামির জন্য? বদলে কী পাইলাম? আল্লাহ!”
নাহার তেড়ে যায় আবার। প্রহর আটকায়। প্রিয় কান্না করছে না আর। এক ধ্যানে নিচের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা শুনছিল। এক বিন্দুও মিথ্যা বলেনি ওর মা। অনুশোচনায় পুড়ছে প্রিয়। মেঝেতে নখ দিয়ে খুড়ছে। নাহারা রাগে চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছে। এমন সময় প্রহর বলে ওঠে,
-“আম্মু, ও সত্যিই আর যোগাযোগ রাখেনি।”
পিনপতন নিস্তব্ধতা। নাহার থমকেছে। অবিশ্বাস্য নজরে প্রহরের দিকে তাকাল। দ্বিধায় পড়ে শুধায়,
-“তুই জানতিস, প্রহর?”
-“জানতাম।”
নিজের থেকে প্রহরকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নেয় নাহারা। উলটো দিকের এক সিটের সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। হার্টে সমস্যা আছে তার। এতক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচির কারণে হাঁপাতে লাগছে। নিঃশ্বাস থমকে থমকে আসছে। আস্তে করে প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“পানি দে।”
আওয়াজ কাঁপছে তার। কেমন একটা অশান্তভাব। প্রহর পানির গ্লাসে পানি ভরে এগিয়ে দিলো নাহারের দিকে। নাহার পানি পান করল। তারপর গ্লাসটা পূনরায় প্রহরকে ধরিয়ে দিলো। কারো দিকে তাকাচ্ছে না সে। বেশ অনেকটা সময় গেল। প্রিয় স্থির হয়ে বসে আছে। প্রহর দাঁড়িয়ে বোনকে দেখছে। এলোমেলো চুল আর হাতে, পায়ে, গলার অনাবৃত অংশে নীলচে দাগ, সেই সাথে ঠোঁটের কোণায় রক্ত। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত প্রিয় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
সবকিছু যখন থমকে আছে, নাহারা হুট করেই প্রহরকে আবার বলল,
-“ওকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বল। আমি এতক্ষণ যেসব কথা বলেছি, সেসবও ভুলে যেতে বল। আমি বলেছি, আমি নিঃস্বার্থভাবে ওর সুখ-আহ্লাদ দেখেছি। ব্যাপারটা ভুল। নিঃস্বার্থভাবে হলে আমি ওকে এখন মারতে পারতাম না। আমি এখানে সবার আগে আমার নিজের স্বার্থ দেখেছি। একটা মা সবসময় চায়, তার সন্তানেরা আদর্শবান হবে। আশেপাশের মানুষজন সেই মাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, ‘এনার সন্তানেরা এনার গর্ব। এত সুন্দরভাবে সন্তান মানুষ করতে পেরেছেন ইনি। ছেলে-মেয়ে দুইটাই চাঁদের টুকরা।’
গর্বে তখন বুকটা ফুলে উঠবে সে মায়ের। আমারও সেই চাওয়া ছিল। এতকাল সবাই যখন আমাকে বলত, আমার মেয়ের আচরণ, স্বভাব সবার পছন্দ; আমার অহংকার হতো মেয়েকে নিয়ে। আমি ভেবেছিলাম, আমি ওকে মানুষ করতে পেরেছি, ওকে সৎ চরিত্রের অধিকারী বানিয়েছি। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের থেকে আমার ছেলে-মেয়েরা ভিন্ন। আমার ছেলে নেশা করে না, বন্ধুদের সাথে অযথা আড্ডা দেয় না, মেয়েকাণ্ড নেই। কী সুন্দর! মেয়েটাও ওমন। আমার কী যে সুখ লাগত। মা হিসেবে আমার সাকসেসটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। সবাই বলত, আমি একজন সার্থক মা।”
নাহারা থামল। তার গলা অত্যন্ত স্বাভাবিক, অবিচল কণ্ঠ তার। আওয়াজে কোমলতা। সে আবার বলল,
-“কিন্তু ভুল! আমি পারিনি। আমার দ্বারা কিছুই হয়নি। নিজের ব্যর্থতা সহ্য করতে পারিনি বলে ওকে মারলাম। আমি অবশ্যই স্বার্থপর একজন। নিজেরটা সবার আগে বুঝেছি। যাই হোক..”
-“আম্মু, থামো।”
প্রহরের কথায় নাহারা মলিন হাসল। ওর দিকে তাকাল একবার। প্রহর দেখল, মায়ের চোখে জল। সে জল চোখের সাথে লেগে আছে। সে এখন জানে, মায়েদের চোখ ছলছল করলেও অশ্রু গড়ায় না। স্বাভাবিকভাবেই এই জল নিচে নামবে না।
নাহারা বলে উঠল,
-“তোকেও ওর মতোই বিশ্বাস করি। এটাও ভাঙবে, বাবা?”
প্রহর শক্ত গলায় বলল,
-“না।”
-“মানলাম। আচ্ছা, টেবিলের ওপর ওর ফোন আছে। ওকে দে।”
তারপর সাইড ড্রয়ার থেকে এক গোছা চাবি প্রহরকে দিয়ে বলল,
-“এটাও দে। এখানে আলমারির চাবি আছে। ওর বিয়ের জন্য ওর বাবা লাখ বিশেক টাকা রেখেছিল, সাথে চৌত্রিশ ভরির মতো গয়না আছে। ওকে গুছিয়ে নিতে বল। আমার খুব ক্লান্তি লাগছে, বাবু। ওকে বল, যা যা লাগে প্যাক করে নিয়ে ছেলেটার কাছে চলে যেতে। আমি আটকাব না আর।
আর যদি না যায়, তবে স্বার্থপর মায়ের স্বার্থ মেনে নিতে বল। ওই ছেলের সাথে সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে আমার লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যেতে বল।”
চলবে…