#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|অন্তিম পর্ব|
আকাশে থেমে থেমে ডাকতে থাকা মেঘপুঞ্জ থেকে আচমকা ঝুম বৃষ্টি নেমে মাটি ছুঁলো। প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেল। গুমোট পরিবেশটা কিঞ্চিৎ শীতলতার ছোঁয়া পেল। সবেতে কেবল শান্তি! রোমান্টিক একটা আবহাওয়া। নিশানের খোঁচা খেয়ে নীহিন প্রিয়কে ডাকতে রুমে চলে গেছে।
ভীষণ মনোযোগী সেজে মুভি শেষে সে মুরুব্বিয়ানা দেখাতে নিউজ চ্যানেলগুলো পালটাতে লাগল, সেই সঙ্গে বলতে লাগল,
-“আজকালকার পোলাপানগুলো কী বেয়াদব, কী বেয়াদব! মুরুব্বিদের সম্মানটা অবধি করতে জানে না? চ্যাহ!”
যদিও নিশানের এমন কথা-বার্তাগুলো কারো কাছ থেকেই পাত্তা পেল না, তবুও সে তার মতো বকবক করতে করতেই চ্যানেল পালটাচ্ছিল, এরপর হুট করে একটা জায়গায় গিয়ে শরতের চোখ টিভির পর্দায় আটকে গেল। হাতের ইশারায় নিশানকে থামতে বলল। নিশান থেমে নিয়ে তাকাল টিভিতে। উৎসুক হয়ে বলল,
-“দাদাভাই, এঁর সাথে আমি ফেসবুকে কানেক্টেড আছি, জানিস?”
শরৎ দৃষ্টি টিভির পর্দায় স্থির রেখে মিহি হাসল। তার সাথে সম্পর্কযুক্ত সকলের সাথেই পর্দার ওপাশে থাকা রমনীটি সংযুক্ত রাখে নিজেকে। এতে কোনো লাভ নেই, লস নেই। আছে এক অদ্ভুত শান্তি।
টিভিতে দেশের সাম্প্রতিক একটি ফ্যাশন ইভেন্টের ফুটেজ দেখানো হচ্ছে। সেখানে সাংবাদিক একজন মডেল ও ডিজাইনারকে বিভিন্ন বিষয়াদি জিজ্ঞেস করছেন। ক্যামেরা স্থির আছে সেই নারীতে। নারীটির বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। অথচ দেখতে কী চোখ ধাঁধানো! পরনে কালো স্লিভলেস গাউন। গলায় রাউন্ড চেইন ও মাঝে একটা ছোট্ট গোল পেন্ডেন্ট। অতি সূক্ষ্ম পেন্ডেন্টটার খুব গোপনে ‘N’ অক্ষরটা লুকায়িত আছে, কেউ ধরতেই পারবে না এভাবে। বাদামী রঙের চুলগুলো মাঝসিঁথি করে ছেড়ে দু-পাশে এনে রাখা। চোখ ভর্তি কাজল, ঠোঁটে গ্লোসি নুড লিপস্টিক। মুগ্ধতা যেন সমগ্র গায়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে।
সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“মিস. কুহকিনী! এই অল্প বয়সেই এত সাফল্য আপনার। এর সিক্রেট কী?”
কুহক কিঞ্চিৎ হাসল,
-“সিক্রেটস আর সিক্রেটস। বলা বারণ।”
-“আচ্ছা, ডিজাইনার হিসেবে এত খ্যাতি আপনার। অসংখ্য অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। সেসবের পর মডেলিংয়ে আসাটা কেন?”
-“ইচ্ছে হলো, তাই।”
-“অ্যাজ অ্যা মডেল অর অ্যাজ অ্যা ডিজাইনার, যেহেতু আপনি দুটোতেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন, কোনটাকে বেশি ইম্প্রেসিভ লাগে আপনার কাছে?”
-“নিজেকে, কেননা আমি সবেতেই পার্ফেক্টলি নিজেকে মানিয়েছি।”
সব ত্যাড়া উত্তর! শরৎ হেসে ফেলল মুখের সামনে হাত রেখে। সাংবাদিক আবার জিজ্ঞেস করল,
-“তো মিস. কুহকিনী! বিয়ে-শাদির ব্যাপারে কিছু ভাবেননি? আপনার ফ্যানস আপনার লাভ-লাইফ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাদের জন্য কিছু বলুন।”
-“বিয়ের ব্যাপারে ভাবা হয়নি।”
-“লাভ-লাইফ?”
-“আই লাভ মাইসেলফ্, ইজন্ট দ্যাট এনাফ ফর লাইফ?”
সাংবাদিক নুর ইসলাম এই পেশায় বেশ নতুন। কিছুক্ষণ আগেই তার এক কলিগ তাকে জানিয়েছিল, ইভেন্টে একজন মডেলের কাছে তাকে নাকানিচুবানি খেতে হবে। তখন হেসে উড়িয়ে দিলেও, এখন সে ব্যাপারটা হারে হারে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে সে এক অসম্ভব অসরল মানবীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে প্রশ্নের ধাঁচ পরিবর্তন করল সে,
-“মিস. কুহকিনী! জীবনের সংজ্ঞা কী আপনার কাছে?”
কুহক হাসল আরও খানিকটা। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আসুন, আমার লাভ-লাইফ রিভিল করি।
হ্যাঁ, আমিও একজনকে ভালোবাসি। নিজেকে যতটা ভালোবাসি, ঠিক ততটা, ঠিক সমান সমান। আমাকে আমি কতখানি ভালোবাসি—তা সকলে জানে, আমার সব কথাতেই প্রকাশ পায়। অথচ এত বেশি ভালোবেসেও মানুষটাকে আমি পাইনি। আর এখানটাতেই জীবনের আসল মানেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। তাকে পাইনি, তবুও নিজেকে ভালোবাসা বাদ দিইনি। কেননা আমার কাছে জীবন মানে সুন্দর করে বাঁচা।”
নুর ইসলাম অবাক হয়,
-“আপনাকেও কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারে?”
-“পারে তো! সে করেছে।”
-“কোনো পুরুষের সাধ্যি আছে?”
-“তার আছে। আমি কুহকিনী প্রেমে পড়েছিলাম এমনই এক বিচিত্র সুন্দর পুরুষের, সে আর বাকি দশজনের মতো কোনো অংশেই ছিল না। দেখতে সুদর্শন, কাজে সকলের আদর্শ, স্বভাবে অনড়, শান্ত-শিষ্ট ও ভীষণ ম্যাচিউর। সে একজন নিঁখুত পুরুষ। আমি প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম…”
কুহক থামল, প্রশস্ত হেসে বলল,
-“অ্যা শর্ট ম্যাসেজ ফর হিম। মাই লাভ, একদিন আমাদের দেখা হোক। আমাকে তৈরি করার জন্য তুমি একটা ধন্যবাদ পাওনা আছো আমার কাছে।”
নুর ইসলাম হেসে শুধাল,
-“তার মানে, আপনার আজ এই অবস্থানের পেছনের অবদানটা তাঁর?”
-“মেবি ইয়েস, অর মেবি নট। শুরুটা তার জন্য ছিল। শেষটা নিজের। একান্ত নিজেকে ভালোবেসে আমি নিজের এই হ্যাপি এন্ডিং লিখেছি..”
অবাক হয়ে নিশান বলল,
-“দাদাভাই! জোস তো! এটা কি কোনো মহাপুরুষ ছিল? নয়তো কুহকিনীকে প্রত্যাখ্যান করার মতো সাহস এই পৃথিবীতে কার বুকে আছে? মানতে হবে ভাই, বুকের পাটা আছে!”
শরৎ জবাবে মুচকি হাসল। নীহিনের কথাতে প্রিয় শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজতে গুঁজতে এসে পড়ল এখানটায়, ক্লান্ত স্বরে শুধাল,
-“ডাকছিলেন কেন?”
শরৎ তাকাল ওর দিকে। হাত বাড়িয়ে দিলো অজানা কারণবশত। প্রিয় সে হাত ধরে শরতের পাশে এসে বসল। লোড শেডিং হলো ঠিক সেই মুহূর্তে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠল ক্ষণিকেই। প্রিয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই শরতের তর্জনী প্রিয়র ঠোঁটের ভাঁজ ছুঁয়ে ফেলল সোজাসুজিভাবে। ফিসফিস করে চুপ থাকতে বলল,
-“হশশশ্…”
প্রিয় চুপ হয়ে গেল। অন্ধকারের তীব্রতায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিশানের ফোন রুমে। আরহা আর সে বিভিন্ন কথপোকথন চালিয়ে যাচ্ছে লাইট খোঁজা নিয়ে। এক পর্যায়ে নিশান উঠে চলে গেল রুমের দিকে। দু-বার সামনের এটা-সেটায় বাড়িও খেল সে। আরহা অন্ধকারে ভয় পায় না৷ সে হাসতে লাগল।
শরৎ ও প্রিয় তখন নিশ্চুপ। তাদের নিঃশ্বাসেরা টুকরো টুকরো শব্দে কথপোকথন চালিয়ে যাচ্ছে। শরৎ আস্তে-ধীরে প্রিয়র খুব কাছে এসে পড়েছে। অনুমানভিত্তিক স্পর্শে প্রিয়র সামনে ফেলানো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো। এরপর মুখ এগিয়ে ঠিক কানের নিচের অংশে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“পৃথিবী জেনে যাক, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলটাকে আমি পেয়ে গেছি। আমার কামিনীফুল!”
প্রিয় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। শরৎ হেসে সরে গেল। ক্ষণকালের ব্যবধানে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে এলো। আবারও বিভিন্ন গল্প-স্বল্প হতে লাগল। প্রহরের সাথে কথা বলে এসে নীহিনও বেশ হাসিখুশি আচরণ করল। ধীরে ধীরে সময় যত যাচ্ছে, শরৎ ততটাই মুখ গম্ভীর বানাচ্ছে আগের মতো। রাতের শোবার পালা এলো। সবাই যে যার ঘরে চলে গেল। শরৎ দেরি করল। পেঁচার মতো মুখ নিয়ে প্রায় কুড়ি মিনিট পর অন্য রুমে গেল। নিশান ঘুমিয়ে আছে। শরৎ লাইট অফ করে নিশানের পাশে শুয়ে পড়ল। ওমনিই ঘুমন্ত নিশান একহাত ও একপা শরতের ওপর তুলে দিয়ে, শরৎকে কোলবালিশ বানিয়ে বলে উঠল,
-“আই মিসড্ ইউ ডার্লিং, আসো চুমু দিই। গরম চুমু। ইউ নো না, হট কিস?”
ঠোঁট এগোতেই শরতের আত্মা ছলকে উঠল, তড়িঘড়ি করে উঠে বসল,
-“হারামজাদা, সর এখান থেকে। ছিহ! আমার পবিত্র দেহকে এভাবে অপবিত্র বানাতে তোর বিঁধছে না?”
নিশানের ঘুম আবছা ভেঙে এলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-“কী বিঁধবে? সেফটি পিন?”
শরৎ চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
-“একটা কথা বলবি তো লাত্থি দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবো।”
নিশান উঠে হাঁটু গেড়ে বিছানায় বসে দু-হাত ওপরে তুলে বলল,
-“ইয়া আল্লাহ! আমার বড়ো ভাই, আমার রক্তের বড়ো ভাই, আমার মায়ের পেটের বড়ো ভাই, আমার বাপের বড়ো সন্তান! সে কি না আমাকে হত্যা করতে চাইছে? আল্লাহ, তোমার কাছে বিচার দিলাম!”
শরৎও একই ভঙ্গিমায় বলল,
-“আমার ছোট ভাই, আমার রক্তের ছোট ভাই, আমার মায়ের পেটের ছোট ভাই, আমার বাপের ছোট সন্তান! সে কি না আমাকে গরমচুমু, আই মিন হটকিস দিতে চাইছে? ছি! আল্লাহ, তোমার কাছে এর বিচার দিলাম।”
আঁতকে উঠল নিশান,
-“আমাকে ছোট, সুশীল ও ভদ্র পেয়ে এমন ব্যভিচার করতে তোর লজ্জা লাগছে না? আমি চুমু খেতে.. নাউজুবিল্লাহ! এমন মিথ্যা শোনার আগে আমার যকৃত কেন ফাটল না?”
শরৎ পাশ থেকে একটা কোলবালিশ নিয়ে একনাগাড়ে চোদ্দবার নিশানকে মেরে ঘটনাস্থল থেকে প্রস্থান ঘটাল। যাওয়ার আগে বিরবির করে বলে গেল,
-“শালা বজ্জাতের চোদ্দগুষ্টি দিয়ে আমার লাইফটা ফুলফিল!”
শরৎ ড্রইং রুমের জিরো পাওয়ারের লাইট অন করে ডিভানে শুয়ে পড়ল একটা কুশন জড়িয়ে। মিনিট দুয়েক যেতেই ফোন ওঠাল, ম্যাসেজ করল প্রিয়কে,
-“ঘুম?”
ত্রিশ সেকেন্ড গেলেও রিপ্লাই এলো না বলে শরৎ ধরে নিল প্রিয় ঘুমিয়েই পড়েছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশ্যে আবার ম্যাসেজ পাঠাল,
-“ঘুমাসছেন?”
এবারও রিপ্লাই এলো না। শরৎ আবার বহুত ধৈর্যবান পুরুষ। গুনে গুনে আগের চেয়ে দ্বিগুণ সময়, অর্থাৎ ষাট সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর লিখল,
-“আমাকে রেখে ঘুমাতে আপনার বুক কাঁপল না, প্রিয়? নিষ্ঠুর রমনী! পাষাণ প্রিয়তমা!”
প্রিয় শাওয়ার নিয়ে বেরোল সবে। গরম লাগছিল বিধায় একটা ছোট্ট শাওয়ার নিল। এদিকে এসে দেখে শরতের তিনটা ম্যাসেজ আর আরেকটা টাইপিংয়ে আছে। এত ম্যাচিউর মানুষটার এই বাচ্চামোতে প্রিয় হাসবে কি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না।
এর মধ্যে শরৎ আবারও ম্যাসেজ করল,
-“মিসেস নীরজ শিকদার, ঘুম থেকে ওঠেন! নয়তো গিয়ে তুলে নিয়ে আসব!”
প্রিয় হেসে হেসে রিপ্লাই লিখল,
-“আপনার ধারণা মতে আমি তো ঘুমাচ্ছি। তো ঘুমন্ত আমি কীভাবে আপনার এই হুশিয়ারি বার্তা দেখব?”
-“ওহ, তার মানে জেগেই আছেন!”
-“জি।”
-“বেশি কথা না, বাইরে থেকে দরজা আটকে চুপিচুপি বসার ঘরে চলে আসেন।”
-“জি না, মশাই। আমি এখন ঘুমাব।”
-“ঠিক আছে, ওরা ঘুমাসছে?”
-“হ্যাঁ।”
শরৎ আর কিছু লিখল না। প্রিয়ও লাইট অফ করতে এলো। যখনই সুইচবোর্ডের কাছে এলো ওমনিই দরজাটা কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে মাথাটা ভেতরে গলিয়ে দিলো শরৎ,
-“হাই, ভালো আছেন, প্রিয়?”
প্রিয় ছিটকে দু-কদম পিছে সরে গেল। বুকে হাত রেখে শ্বাস ছাড়তে লাগল। শরৎ দরজা পুরো খুলে দুম করে ভেতরে এসে চুপিচুপি বলল,
-“কোনো আওয়াজ করবেন না, মিসেস! যা করছি করতে দিন।”
প্রিয় বলার সুযোগও পেল না। শরৎ তাকে কোলে তুলে নিল। তারপর সুইচবোর্ডের সামনে এনে বলল,
-“লাইটটা অফ করে দিলে সুবিধা হয়।”
হা হয়ে আছে প্রিয়, সেভাবেই লাইট অফ করে দিলো। শরৎ আস্তে করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। তারপর প্রিয়কে এনে সোজা বসারের ঘরের ডিভানে বসিয়ে দিলো। এতক্ষণে প্রিয় কথা বলল,
-“মতলবটা কী?”
-“কোনো মতবল নেই।”
শরৎ উঠে প্রিয়র কোমর জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। প্রিয় নড়চড় করতেই শরৎ বলল,
-“নড়বেন না, আমি ঘুমাব।”
প্রিয় মুখে হাত রেখে হাসতে লাগল। শরৎ আবারও বলল,
-“এত হাসবেন না, আমার ঘুমের বদলে অন্য কিছু পায়।”
থতমত খেয়ে প্রিয় বলল,
-“কী পায়?”
-“বললে আপনার লজ্জা পাবে। তাই চুপ!”
শরৎ আরও আষ্টেপৃষ্ঠে প্রিয়কে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল। বৃষ্টি থেমেছে। প্রিয় একহাতে জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে শরতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ঝুঁকে শরতের কপালে চুমু খেল। মনে মনে বলল,
-“আমার সুদর্শন বর!”
________
চারদিকে কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঝে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তুশি। শ্রেয়ান রেডি হয়ে বসার ঘরে বসেছিল এতক্ষণ। তুশি রেডি হয়েছে কি না দেখতে এখানে এলো। অথচ মেয়েটা বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে অগোছালো কাপড়ে ছড়িয়ে রেখে বসে আছে। শ্রেয়ান মিটিমিটি হেসে একটা সাদা শাড়ি ও নীল ফুল স্লিভসের ব্লাউজ তুলে তুশির দিকে এগিয়ে দিলো।
একগাল হেসে তুশি বলল,
-“থ্যাংক ইউ!”
তারপর ঝটপট করে রেডি হয়ে নিল। আজ তারা দু-জন শহর ঘুরতে বেরোবে। বিকেল, সন্ধ্যা শেষে ঢের রাত অবধি তারা রাজধানীর বুকে দৌড়ে বেড়াবে! কী সুন্দর কল্পনা তার!
তুশি তৈরি হয়ে নিল, শ্রেয়ানও সঙ্গে বেরোল। এপার্টমেন্টের নিচে আসতেই তুশি বলল,
-“চলুন না, আজ রিকশায় যাই!”
শ্রেয়ান মানা করতে পারল না। হাত উঁচিয়ে একটা রিকশা ডাক দিলো। রিকশাচালক জিজ্ঞেস করলেন,
-“কই যাবেন, মামা?”
তুশি হেসে বলল,
-“মামা, এক ঘন্টা ঘুরব। যেখানে ভালো লাগে, চলুন।”
রিকশাচালক ব্যাপারটা বুঝে হেসে বললেন,
-“চলেন।”
তুশি আগে উঠে পড়ল। শ্রেয়ান তুশির পড়ে থাকা শাড়ির আঁচল কোলে তুলে দিয়ে উঠে পাশে বসল। এরপর রিকশা চলতে লাগল। তুশি আলতো করে নিজের মাথাটা শ্রেয়ানের কাঁধে এলিয়ে দিলো। এভাবে গোটা এক জনম কেটে যাক!
প্রিয় অফিস থেকে বেরোতেই সামনে শরৎকে বাইকসহ দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“কী ব্যাপার, নীরজ সাহেব? এদিকে কেন?”
-“বাড়িতে বিবাহিত নীরজ সাহেব নিজেকে এতিম এতিম অনুভব করে। তাই বউ নিয়ে একটা ডেইট প্ল্যান করেছেন আজ। কি? আপনি রাজি?”
প্রিয় হেসে বাইকের পেছনে উঠতে উঠতে বলল,
-“রাজি না হলে তো তুলে নিয়ে যাবেন। জেনে-বুঝে পাগল ক্ষেপাব কেন বলেন তো?”
-“ব্রিলিয়ান্ট! ধরে বসেন।”
-“ধরেছিই তো।”
-“আরেহ, বাইক না। বাইক জড় বস্তু, আপনার ধরাতে সে এনার্জেটিক হবে না। আমাকে ধরেন, শক্তি পাব। বোঝেন না ব্যাপারটা?”
প্রিয় হেসে শরৎকে ধরে বলল,
-“হয়েছে ঢং? এবার চলেন।”
শরৎ বাইক স্টার্ট দিলো। খুবই ধীরগতিতে চালাচ্ছে। প্রিয় কিছুক্ষণ পর বলল,
-“এভাবে চালালে তো পৌঁছাতে দিন পেরোবে!”
-“পেরোক। বউ আছে, আমি আছি, দুনিয়াতে আর কী দরকার?”
-“মশাই, আপনি যে দিনকে দিন বউ-পাগল হয়ে যাচ্ছেন, টের পাচ্ছেন?”
-“পাচ্ছি। হলে হচ্ছি, আপনার কী?”
-“আমার কী মানে?”
প্রিয় তেজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল। শরৎও পালটা জবাবে বলল,
-“প্রিয়, আপনি যে দিনকে দিন পাড়ার কাকিমাদের মতো ঝগড়ুটে হয়ে যাচ্ছেন, সেদিকে খেয়াল আছে? উফফ প্রিয়, এসব তো ভালো লক্ষ্মণ না। বয়স বাড়ার লক্ষ্মণ! দু’দিন পর দাদি দেখাবে আপনাকে। এদিকে আমাদের বেবিও অন প্রসেসিং।”
-“থামেন থামেন।”
-“বাইক?”
-“না, আপনার এই খাটাশ মার্কা কথাগুলো থামান।”
-“টেবিলের চিপার মাধ্যমে ঘুষ দিয়েও থামাতে পারবেন না, প্রিয়। আমি বাংলাদেশের একজন সৎ ও আদর্শবান নাগরিক।”
-“নীরজের বাচ্চা!”
-“অন প্রসেসিং, ডার্লিং।”
-“ছাতার মাথা।”
-“এখানে আমার মাথা আছে, ছাতা নেই।”
-“উফ! মাথা গরম হচ্ছে।”
-“ইশ! পানি ঢালব? পুকুর দেখে বাইক থামাই?”
-“তোরে অশ্লীল তিনটা গালি, হারামজাদা। আরেকবার কিছু বলবি, গলা টিপে ধরব। তারপর সোজা নানির কাছে চলে যাবি।”
শরৎ হো হো করে হেসে উঠল। বাইক জ্যামে আটকে গেছে। শরৎ পিছে ঘুরে মুচকি হেসে বলল,
-“আমার রণচণ্ডী বউ, আর কত রূপ দেখাবেন? পাগল হয়ে গেলে?”
সামান্য আহ্লাদে প্রিয় রাগ ভুলে লজ্জা পেয়ে শরতের পিঠে মাথা এলিয়ে দিলো। এই যে খুনসুটিগুলো, টক-মিষ্টি আহ্লাদগুলো! এই লোকটাকে না পেলে প্রিয় এসবের উপলব্ধি করত কী করে? প্রিয় পিঠে মাথা রাখা অবস্থায় সোজা রাস্তায় তাকাল। ঢাকা শহরের জ্যাম মানেই বিরক্তিকর কিছু একটা। অথচ প্রিয়র বিরক্তি লাগে না। এই জ্যামটাও তার পছন্দের। এখানে বসে বসে হরেক রকমের মানুষ দেখা যায়, মানুষদের মুখের অভিব্যক্তি পড়া যায়। শহরের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে সেরা বলতে গেলে প্রিয় এই জ্যামকে দেখাবে। কী হাস্যকর কথা!
প্রিয় এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। সবচেয়ে কমন যেই বিষয়টা সে নিশ্চিত করতে পেরেছে, তা হলো—সবার চেহারাতেই বিরক্তি স্পষ্ট। প্রিয়র অবাক লাগে। এটা কোনো বিরক্তির বিষয়? কতটা উপভোগ্য তা কি জানে না তারা?
এসবের মাঝে প্রিয়র চোখ গিয়ে আটকাল বিপরীত দিকের রিকশায় বসে থাকা এক হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের দিকে। গোধুলির মিষ্টি রোদ্দুর কী দারুণভাবে তার হাসতে থাকা মুখে লেপটে আছে! আচ্ছা, মেয়েটাও কি জ্যাম উপভোগ করে? কী সুন্দর, কী সুন্দর!
প্রিয় মাথা উঁচিয়ে মেয়েটার পাশেরজনকে দেখার তাগিদ দেখালো। ঠিক সেই সময় তার চোখাচোখি হয়ে গেল এক সুতনু পুরুষের সাথে। আশফিক রহমান শ্রেয়ান! এতক্ষণে সে টের পেল পাশের এই মিষ্টি শুভ্রাঙ্গী মেয়েটি শ্রেয়ানের স্ত্রী। একসাথে কী ভীষণ মানাচ্ছে!
এসবের সাথে প্রিয়র মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল সেদিন ক্যাফে থেকে বেরোনোর আগমুহূর্তে শ্রেয়ানকে লেখা তার চিরকুটের শেষাংশটি,
-“আবার দেখা হবে একদিন। একই শহরের তো? দেখা হবে এরকমই কোনো ক্যাফেতে, কিংবা রাজধানীর ভীষণ রকমের জ্যামে। সেদিন আমরা দু’জনই পূর্ণ থাকব.. পরিপূর্ণ থাকব। কীভাবে? বলব না। তুমি মিলিয়ে নিয়ো…”
শ্রেয়ান মিলিয়ে নিতে পেরেছে কি? সম্ভবত পেরেছে। তাই তো প্রিয়কে দেখে শুরুতে কিঞ্চিৎ অবাক হলেও পরক্ষণে মিষ্টি করে হাসল। দু-ধারে মাথা নেড়ে বোঝাল,
-“ভালো আছি।”
প্রিয় নিজেও হাসল। বিরবির করে উচ্চারণ করল,
-“আমিও ভালো আছি।”
|সমাপ্ত|