অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০১

0
189

অপ্রিয় প্রাক্তন
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“নিজের দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করে ছ্যাঁকা খাওয়ার পর এখন কেমন বোধ করছো?” নিয়নের প্রশ্নে বিব্রতবোধ করলো তিরা। প্রাক্তন সাপ হয় এ ধরনের কথা সে আগেও শুনেছে কিন্তু তার প্রাক্তন যে কালসাপ এবং অতীব নির্লজ্জ তা আজ প্রত্যক্ষ করলো সে। খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যেতেও পারছে না সে, অভদ্রতা মনে হবে তবে নিয়নের প্রশ্নের জবাব দিল না তিরা। বরং মাথা নিচু করে খাবার খেতে লাগলো। নিয়নের ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসিটুকু প্রশস্ত হলো তিরাকে বিব্রত করতে পেরে।

-“তিরা কিছু নিচ্ছিস না যে? মাংস নে আরেকটু।”

-“আমি আর কিছু নিব না ফুপ্পি। উঠলাম আমি।”

-“খাবারটুকু শেষ তো কর।”

-“আর খেতে পারছি না।”

শেষ কথাটুকু নিয়নের দিকে তাকিয়ে বললো তিরা। অতঃপর খাবার টেবিল ছেড়ে বেসিনের দিকে এগোলো। আঞ্জুমান আরা নিজের ননদের ছেলের দিকে তাকালেন। তিরাকে নিয়নের সাথে খাবার টেবিলে বসানোই ভুল হয়েছে বুঝতে পারলেন তিনি। এখন অবশ্য সেসব ভেবে লাভ নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়নের পাতে আরেকটু তরকারি দিলেন তিনি।

-“তোমার ভাতিজিকে খাওয়াও বেশি করে, মামী। আমাকে কেন খাওয়ায়ে খাওয়ায়ে মোটা করতেছো? এমনিই আমার ওয়েট বাড়তেছে।”

-“নিয়ন, চুপচাপ খাও। বাড়িতে অনেক মানুষজন আছে। ঝামেলা করো না।”

নিয়নের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি যেন আঞ্জুমান আরা খুব হাস্যরসের বস্তু বলেছেন। নিয়ন আর ঝামেলা- শব্দ দুটো ভিন্ন নাকি? এরা তো ওতপ্রোতভাবে পরস্পরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এই ঝামেলা শব্দটার কারণেই তো তিরা নামক মানুষটার সাথে নিয়নের ক্ষণিকের এক গল্প শুরু হয়েছিল।

হাত ধুয়ে ছাদে এসে বসে তিরা। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। নিয়ন এখানে আসবে জানলে তিরা ভুলেও এ বিয়েতে আসতো না। বিয়েটা তিরার ফুপ্পির দেবরের। এ বিয়েতে তিরার আসার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। তিরার আফসোস হচ্ছে কেন সে এলো এখানে!

-“একা বসে কী করছো?” নিয়নের ডাকে ঘোর কাটে তিরার।

-“আপনি এখানে কেন এসেছেন? আমি কী করছি না করছি সেটা তো আপনার দেখার বিষয় না!”

-“জেদ এখনো কমেনি! এখনো জিলাপির প্যাঁচই আছো।”

-“তাতে আপনার কী? আমি যাই হই না কেন, আপনার কী সমস্যা? আপনি দয়া করে এখান থেকে যান।”

-“এই ছাদেই তোমায় প্রথম চুমু খেয়েছিলাম মনে আছে?”

তিরার অশ্রুসজল চোখ মুহূর্তেই যেন অঙ্গারে রূপ নিলো। নিয়নের শার্টের কলার ধরে সজোরে দূরে সরালো তাকে।

-“ন্যূনতম লজ্জা থাকলে আমার সামনে আসার সাহস করবেন না আর। একটা মানুষ কতটা নাটক করতে পারে তা আপনাকে দেখে আমার শেখা হয়ে গেছে। আপনার ওয়াইফ কোথায়? সে আসেনি? আসেনি বলেই এখন আমার জন্য মন টানছে? অসভ্য কোথাকার!”

তিরা আর ছাদে দাঁড়ালো না। এ বাড়ির প্রতিটা ইট-পাথর তাকে পীড়িত করছে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে। নিয়ন সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর সামনে ফিরে একটা সিগারেট ধরালো। ছাদের চারপাশে ঘেরা নেই। একদম কিনারে বসে নিচে পা ঝুলিয়ে দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় কিছুক্ষণ স্বস্তি খুঁজলো সে।

তাহযীব আদওয়া তিরা, এই মেয়েটা একসময় তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। এখনো বাসে তবে তা আর স্বীকার করে না। হয়তো কখনো করবেও না আর। একটা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরায় নিয়ন।

_________________

আজ আঞ্জুমান আরার ছোট দেবর মহসিনের বিয়ে। অল্প আয়োজনেই বিয়ে হচ্ছে। বাড়ির পাশের ফাঁকা উঠোনটাতে একপাশে স্টেজ বসানো হয়েছে আর বাকি অংশ জুড়ে খাবার খাওয়ানোর চেয়ার-টেবিল। তিরার জন্য আঞ্জুমান আরা ঘরেই খাবার পাঠিয়েছিলেন। সেসময় নিয়নও খেতে বসে পড়ে। ছেলেটা দীর্ঘদিন পর বাড়িতে এসেছে বিধায় আঞ্জুমান আরাও নিষেধ করতে পারেন না। বিপত্তি তো সেখানেই বাঁধলো।

বাড়ি এখন ফাঁকা বলা চলে। সবাই বর-বউয়ের ওখানে। তিরা নিজের ফুপ্পির ঘরে বসে আছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কোনোরকম কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে সে। চোখের সামনে বারবার তিন বছর আগের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে। কত তারিখ ছিল যেন দিনটা? পহেলা আগস্ট, ২০২০ না?
______________

১লা আগস্ট, ২০২০||

ফুপ্পির বাড়িতে আসার পর উত্তেজনা খানিকটা ম্লান হয়ে এলো তিরার। বাড়িতে মেহমানভর্তি। মানুষের ভীড় বরাবরই অপছন্দ তিরার। দাদী এবং দুই চাচাতো ভাইয়ের সাথে এখানে বেড়াতে এসেছে সে। ফুপ্পির এক নিকটাত্মীয়ের বিয়ে আগামীকাল, এ কথাও জানলো আসার পর। মানুষজন দেখেই মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে তার। একটুও যেন দম ফেলার অবকাশ নেই।

-“এই তিরা, ধর নুডলস খা। নিয়ন রেঁধেছে।” ফুপ্পির ডাকে সেদিকে ফিরলো তিরা।

-“নিয়ন মানে তোমার …”

-“আরে নিয়নকে ভুলে গেছিস? আমার ননদের ছেলে, ঢাকায় থাকে এখন। একাই রান্নাবান্না করে, মিডিয়া সেক্টরে কাজ করছে।

-“ওহ।”

-“নুডলস খেয়ে দেখ।”

নুডলসের বাটিটা তিরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল আঞ্জুমান আরা। তিরা এক চামচ মুখে নিয়েই দেখলো নুডলসে লবণ বেশি। আর খেতে পারলো না সে। একটু আগে ফুপ্পির বলা ‘একাই রান্নাবান্না করে’ কথাটা কেন যেন হাস্যকর মনে হলো তিরার। নুডলস রেখে ফোন বের করে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো সে। একজন ভদ্রমহিলা এসে তিরার থেকে অল্প দূরত্বে বসলো। তিরা চেনে তাকে, ইনি আঞ্জুমান আরার ননদ যার ছেলের গুণগান এতক্ষণ তার ফুপ্পি করে গেল।

-“তুমি তিরা না?”

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। অনেক বড় হয়ে গেছো তো!”

তিরা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। সে বরাবরই স্বল্পভাষী। এরই মধ্যে এক চেনা মুখের উপস্থিতিতে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগলো। ইসমাম আবরার নিয়ন, তিরার ফুপ্পির ননদের ছেলে। ছেলেটাকে তিরা ছোটবেলায় একবার দেখেছিল, সে সময়কার অল্প কিছু স্মৃতি মাথায় টোকা দিতে লাগলো। তিরা মনে মনে তীব্রভাবে চাইলো ছেলেটা যেন এখানে বেশিক্ষণ না থাকে। সে আর কিছুক্ষণ থাকলে তিরা নিশ্চিত বিব্রতবোধ করবে।

-“মা, নাফসি কই? খাইছে কিছু?”

-“না, তুই কোথায় এত ঘুরতেছিস? বসে থাক তো একটু। পাইছে এক বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।”

নিয়ন চুপচাপ ফোন বের করে বিছানার একদম কোণায় গিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। তিরা ঢোক গিলল। সে বিছানার এক কোণে, তার পাশে নিয়নের মা এবং তার কোণাকুণি বরাবর নিয়ন বসে। তিরার বড্ড অস্বস্তিবোধ হলো। নিয়নের মা, মেহবুবা খানম কোমল মনের মানুষ। খানিকটা মিশুক এবং অনেকটা আন্তরিক স্বভাবের কিন্তু তিরা অন্তর্মুখী। সে বাক্যালাপে অস্বস্তি বোধ করছে, বুঝে উঠতে পারছে না কী বলবে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে নজর গেল মেহবুবা খানমের। ছোট বাটি ভর্তি কিসের যেন রস।

-“তিরা, এই বাটিতে এসব কী?”

-“ওহ এটা? আর বলিয়েন না আন্টি, ফুপ্পির চুল দিন দিন পড়তে পড়তে নাই হয়ে যাচ্ছে সেজন্য ইউটিউব দেখে কী না কী বানাইছে আল্লাহ’ই জানে! নিজের চুলে তো দিছে, জোর করে আমার চুলেও লাগায়ে দিছে।” অনেকটা প্রাণবন্ত স্বরে কথাটুকু বললো তিরা।

নিয়ন বাঁকা চোখে তাকালো তিরার দিকে। এতক্ষণ পর সবে মাত্র মেয়েটা মুখ ফুটে একটু কথা বলেছে। নিয়ন খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এই মেয়েটাকে সে দেখেছিল ছোট্টবেলাতে। মেয়েটা তখন স্কুলে পড়তো। স্কুলড্রেসে তরকারি মাখিয়ে এসেছিল একবার। রোজ দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠে সীট নিয়ে ঝগড়া করতো কারো না কারো সাথে। সেই মেয়েটা বড্ড বড় হয়ে গেছে। মেয়েটার কি মনে আছে তার ছোট্টবেলার গল্পে একজন রাজপুত্র ছিল যে আড়াল থেকে সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখতো কিন্তু কখনো সামনে এসে কিছু বলতে পারেনি?

______________________

“তিরা জলদি উঠ! নিয়ন বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।” আঞ্জুমান আরার ধাক্কাধাক্কিতে তিরার ধ্যান ভাঙলো। নিয়ন নামটাই কেবল কানের পর্দায় সজোরে আঘাত করলো। পরবর্তী শব্দগুলো বুঝতে তার অল্পবিস্তর সময় লাগলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগলো তার, “নি…নিয়ন অ্যাক্সিডেন্ট করে।

চলবে,,