শুচিস্মিতা পর্ব-১০

0
152

#শুচিস্মিতা -১০
Tahrim Muntahana

~ আম্মা কয়েকটা কোম্পানিতে চাকরির আবেদন করে এসেছি। খুব শীঘ্রই ঢাকা যেতে হবে!

ছেলের কথায় মিসেস মমতা খানিক সময় তাকিয়ে র‌ইলেন ছেলের দিক। ছেলে তার চাকরি করবে? হঠাৎ এমন সুবুদ্ধি হলো কি করে সেটাই ভাবছে। মায়ের তীক্ষ্ম দৃষ্টি কোনো পরোয়া করলো না রাশিদ। বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল। মিসেস মমতা তখনি চিৎকার করে বলে উঠলেন,

~ ক‌ই গো রনির বাপ, এদিকো আহো, দেহ দেহ তোমার পোলা কি কয়! মতিগতি ভালা হ‌ইছে, চাকরি করবো নাকি!

হাঁক ছেড়ে ডাকায় রাজীব তাজ‌ওয়ার কিছুটা ভয় পেলেও পরের কথাগুলো শুনে স্তব্দ হয়ে গেলেন। সত্যি নাকি বিষয়টা পরখ করতেই রাশিদ কে ডেকে বললেন,

~ এদিকে আসো রাশিদ। সত্যি চাকরি করবা? নাকি ঢপ দিতাছো আমাদের?

~ কোনো দিন দেখছেন আব্বা এরকম ঢপ দিতে?

~ ভালো সিদ্ধান্ত নিছো বাপ। কয়দিন পর নতুন মেহমান আসলে কি খাওয়াইবা? তা কবে নাগাদ যাবা?

বাবার কথায় হাসলো রাশিদ। ভেবেছিল কাল‌ই যাবে, কিন্তু বড় ভাইয়ের বিয়ে মিস করা যায় না তো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের দুদিন পরই র‌ওনা হবে! আয়েশ করে সোফায় বসে বললো,

~ ভাইয়ার বিয়ের পর‌ই যাবো আব্বা। ততদিনে ইন্টারভিউয়ের ডেট ও ফিক্সড হয়ে যাবে।

মিসেস মমতা আর দাঁড়ালেন না। খবরটা তো পাশের বাড়ির মহিলাদের দিতে হবে। কত টিটকারি করেছে, এবার সেও মুখের উপর বলে আসবে তার ছেলে মস্ত বড় চাকরি করতে ঢাকায় যাবে! যেতে যেতে তালুকদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

~ এইবার কালির ভুত মাথা থেকে নামবো। ফকাফকা সুন্দর দেখে ব‌উ আনমু আমি!

~ শুনলাম ঢাকা যাচ্ছেন রাশিদ ভাই?

পাড়ার মোড়ে ক্যারাম খেলছিল রাশিদ, বাম হাতে আধ খাওয়া সিগারেট, ধোঁয়া উঠে নিঃশেষের পথে। সাথে পাড়ার ‌ই কিছু উঠতি বয়সের ছেলেপেলে। আনতারা কে দেখে বাকি ছেলে গুলো নিজেদের সিগারেট ফেলে মাটিতে পিষলেও রাশিদের কোনো ভাবাবেগ হলো না। বরং বাকি অংশ টুকু ঠোঁটের ভাঁজে ফেলে টান দিল, অন্যসব মেয়ের মতো চোখ মুখ কুঁচকে নিলো না আনতারা‌। এই ছেলের সিগারেট খাওয়ার স্টাইল টাও যেন সবার থেকে আলাদা, আনতারা’র কাছে তো তাই মনে হচ্ছে! নিজের স্থানে অন্যকে দাঁড় করিয়ে আনতারা’র পাশে দাঁড়ালো রাশিদ। প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,

~ ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?

এবার চোখ মুখ কুঁচকে এলো আনতারা’র। ছেলের ভাব দেখেছো! একা থাকলে তুমি, কত মধুর মধুর কথা; অথচ মানুষের সামনেই ভালো সাজা। বিরক্তি কন্ঠে বললো,

~ কয়েকটা সিট কপি করতে হবে। বাজারে যাচ্ছি!

এক টানে সিটের ফাইল টা নিজের হাতে নিয়ে নিলো রাশিদ, চোখ বুলিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,

~ এই রোদের মধ্যে তোর যেতে হবে না, বাড়ি যা। আমি বিকেলের মধ্যে দিয়ে আসবো। পশ্চিম বাড়ির রাব্বির কাছেই নিয়েছিস তো? পৌঁছে দিবো, যা বাড়ি যা। বেশ গরম!

আনতারা’র ভিষণ ইচ্ছে করছিলো ছেলেটার সাথে কিছুটা সময় কাটানোর। বাড়িতে তো সম্ভব না, তাই এইদিকে আসতে দেখেই এখন এসেছে সে, না হয় ছোট চাচা কে বললেই করে দিতো! সব পরিকল্পনা এই ছেলের জন্য‌ই নষ্ট হলো। রাগ হলো খুব, রাশিদের থেকে ফাইল টা নিয়ে বলে উঠলো,

~ আমার আরো কিছু পার্সোনাল দরকার কাছে। আপনি আসলে আসেন, নাহয় সিগারেট গিলুন। আমি যাচ্ছি!

চমকালো রাশিদ। মেয়েটার আচরণ স্বাভাবিক লাগছে না তার! ‘আপনি আসলে আসেন’ মানে মেয়েটি তাকে সাথে যাবার অনুমতি দিলো? ভাবতে ব্যস্ত রাশিদ টের পেল না কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছে। যখন টের পেল একপ্রকার দৌড়েই পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। আনতারা নিজের অনুভূতি লুকাতে ব্যস্ত, রাশিদ পাশে হাঁটতে থাকা মেয়েটির আচরণের কারণ ভাবতে ব্যস্ত! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আনতারা বললো,

~ সত্যিই ঢাকা যাচ্ছেন?

~ ইচ্ছে আছে!

~ হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন? আপনি ঢাকায় গেলে পাড়ার মোড় টাকে জলসা বানাবে কে? মতিন চাচার ফলের বাগান থেকে ফলগুলো চুরি করবে কে? নিজেদের পুকুরে মাছ থাকতে বশির দাদা’র পুকুর থেকে মাছ চুরি করে বারবিকিউ পার্টি করবে কে? ওইবাড়ি বুড়িকে জ্বালাবে কে? ভারী অন্যায় হচ্ছে রাশিদ ভাই, আপনার যাওয়া একদম উচিত নয়!

কথাগুলোই কিরকম অবজ্ঞা মেশানো। দুই বছরে যে গ্রাম টাকে অতিষ্ঠ করে রেখেছে এটাই যেন মেয়ে টি তাকে বুঝালো। তার‌ই বা কি দোষ, তার কথায় ছেলেগুলো পেছনে পেছনে ঘুরে, মতিন চাচা’র হুমকি ধামকির জন্য‌ই তো ফলগুলো চুরি করতে হয়, বশির দাদার পুকুরে মাছের অভাব নেই, দু একটা চুরি করলে কি এমন ক্ষতি হবে? বুড়ি টা অযহত ঝগড়া করে সবার সাথে, একজনের কথা আরেকজনের কানে লাগাতে ব্যস্ত; সে শায়েস্তা করবে না? এগুলো অন্যায়? বেশ সে অন্যায় করেছে, আরো করবে! ঢাকা থেকে এসেই করবে। কিছুটা অভিমান মেশানো গলায় বললো,

~ যার জন্য এই জীবন সেই পাখিই তো খাঁচা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, খাঁচা টা আকড়ে ধরেই বা কি লাভ? তাই আমিও খাঁচা পাল্টালাম, পাখি সাথে থাকলেই হলো, খাঁচা দিয়ে কি করবো?

~ রাগ করতেছেন কেন আম্মা? বেশীদিন থাকবো নাহ, এই ধরেন একসপ্তাহ! তারপরেই চলে আসবো।

ফারাহ’র কথায় মিসেস নাজমা আতকে উঠলেন। এক সপ্তাহ! আবার বলছে বেশীদিন না? এই মেয়ে তাকে বোকা পাইছে? গমগম কন্ঠে বললো,

~ আমার লগে মশকরা করো সেজ ব‌উ? সাহস তো কম না! তিন দিনের বেশী একটা দিন‌ও থাকা যাইবো না।

~ বড়ভাবী আটদিন থাকতেছে আম্মা, মেজ ভাবী তো গেলে আসতেই চায় না, এখন আমি থাকবো। আপনার আদরের মেজ ব‌উ তো আছেই আম্মা, আপনার সব কাজ করে দিবে। আর আমি রাতের রান্না করেই রাখছি।

ফারাহ কে তাড়া দিতেই ঘরের দিকে আসছিলো নিয়ন। মা-ব‌উয়ের কথা শুনেই পিছিয়ে গেল সে। ওখানে যাওয়া মানে নিজে থেকে ফেঁসে যাওয়া। এর থেকে দ্বিগুণ অপেক্ষা করা ঢের ভালো। আবার বাড়ির বাইরে চলে গেল নিয়ন। মিসেস নাজমা ফারাহ’র কথায় আরো তেতে উঠলো। এ কেমন আদব কায়দা, শাশুড়ি কে মানে না,

~ বেশী বেশী করবা না সেজ ব‌উ।‌ সবকটা যদি এইভাবে বাপের বাড়ি পড়ে থাকে সংসার চলবে কি ক‌ইরা?

~ আম্মা আমি বিয়ে খেতে যাচ্ছি, চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। যাওয়ার সময় এমন করবেন না তো। তাড়াতাড়িই চলে আসবো। আপনিও কিন্তু কয়েকদিন আগে তিন বোনের বাড়ি থেকে আসলেন।

মিসেস নাজমা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে আসলেন। একটা ব‌উ ও তার কথা শুনে না, পোলা রাও হ‌ইছে ব‌উ পাগল; এমনটাই ধারণা তার। শাশুড়ির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো ফারাহ। শাশুড়ির কথা তার গাঁয়ে লাগে না, আগের যুগের মানুষ রা এমন‌ই। স্বামী ভালো থাকলে আর কি লাগে! ভাদ্র মাসের শেষ, প্রকৃতি এখন উত্তাপ। কালকেই ফোন এসেছে রাজীব তাজ‌ওয়ার নিজে বলেছে তাকে আর তার স্বামীকে যেতে, না গেলে খারাপ দেখাবে না? চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে সে যাবে না? শাশুড়ির কথা অমান্য করেই চললো। নিজের বুঝটা নিজেকেই নিতে হয়।

আশ্বিন! শরতের সূচনা পর্বে ভাদ্র প্রকৃতিতে নিয়ে আসে অপূর্ণতা, আশ্বিন তার নিজস্ব আগমনে পূর্ণতা দেয়। শরতকে পরিপূর্ণ করে। এজন্য‌ই হয়তো আশ্বিনকে শরতের পরিপূর্ণতার সুহৃদ বলা হয়। আশ্বিন আবারো এসেছে পূর্ণতা নিয়ে, দুটো হাত কে একত্রে বাঁধতে। প্রেমে ভেসে যাওয়া দুজন কুপোতকুপোতি কে বৈধতা দিতে। তাজ‌ওয়ার বাড়ি আজ নানান রকম আলোকসজ্জায় সজ্জিত। রঙ বেরঙের লাইটিং, ফুলের সমারোহ, মানুষে গিজগিজ করা বাড়িটাকে প্রাণোচ্ছল লাগছে। বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা। এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আনতারা। একটু পর পর রাশিদ খাবার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে, কখনো হেসে কাজিন দের সাথে সেলফি তুলছে, আবার কখনো বিরক্তি দৃষ্টি ফেলে মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে। নিবিড় চোখে সবটাই অন্তরের মাঝে গেঁথে নিচ্ছে আনতারা। প্রেমের ফুল তার মনে সেই কবেই ফুটে গেছে, অথচ ফুলের গন্ধ ছড়াতে নারাজ সে‌। এই ফুলের গন্ধ ছড়াতে গেলে যে অনেক সাহস লাগে, যা আনতারা’র মাঝে নেই। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দৃষ্টি ঘুরায় আনতারা। মিসেস মমতা কে দেখে বিচলিত হয়, দৃষ্টি নত রাখে। মিসেস মমতা গদগদ কন্ঠে বললো,

~ভাবছিলাম রাশিদ রে বিয়া করামু এই মাইয়া দিয়া, কিন্তু বড় পোলা ক‌ইলো পছন্দ। তাই বিয়া ডা করাইয়া নিলাম। দেখছস কত্ত সুন্দর। কয়দিন পর রাশিদ রেও বিয়া করামু, এর চেয়ে সুন্দর মাইয়া দেইখা।

আনতারা কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার খুঁজে পেল না, চুপ করে র‌ইলো। মিসেস মমতা আবার বললেন,

~ আজ কাইল কার যুগের পোলা রা সুন্দর মাইয়া ছাড়া বিয়া করবার চায় না‌। যদি কালা মাইয়া পছন্দ হ‌ইয়াও যায় একসুম দেখা যায় আর ভাল লাগে না। তখন কালা মাইয়া ছাইড়া আবার আরেকটা বিয়া করে‌।

~ কি যে বলেন না চাচি! যে খাঁটি পছন্দ করে সে সবসময় ই পছন্দ করবে।

আনতারা’র কথা পছন্দ হলো না মিসেস মমতা’র। ঠেস দিয়া বললেন,

~ এহন ওমন আশা করা যায় না‌। তুই কি ভাবছস আমি কিছু বুঝি না? আমার ছোট পোলা ডা তোর মধ্যে কি দেখছে কে জানে? কয়দিন পর পস্তাবো। পোলা মাইষের সুন্দর ছাড়া চলে না‌। কয়দিন পর ভাল লাগবো না, অন্য মাইয়ার কাছে যাবো।

~ যে ছেলে কে নিজের মা’‌ই বিশ্বাস করতে পারে না, সেই ছেলেকে আমি বিশ্বাস করবো কি করে চাচি? চিন্তা নেই, আপনি যা ভাবছেন ওসব কিছুই হবে না।

কথাটা বলতেও যেন আনতারা’র গলা কাঁপে।‌ বলতে ইচ্ছে করে, ‘আপনার ছেলে বিশ্বাসযোগ্য, আপনার ছেলেকে আমি বিশ্বাস করি, হয়তো ভালো‌ওবাসি!’ বলতে পারে না আনতারা, চাপা শ্বাস টা নিজের ভেতরেই গোপন করে মিসেস মমতা কে বলে উঠে,

~ চাচা আপনাকে তাহলে সুন্দরী দেখে ভালোবাসছিল চাচি? এখন তো আর আগের‌ মতো সুন্দরী নেই, চুলে পাক ধরেছে, চামড়ায় ভাজ পড়েছে, চোখের নিচে গর্ত হয়ে গেছে; আপনাকে চাচা ভালোবাসে তো? নাকি এই বয়সেও সুন্দরী যুবতী খুঁজে?

ভাদ্রের সাথে শরতের নিবষ্টতা প্রগাঢ় হওয়ার আগেই আশ্বিন যেমন বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায় ভাদ্রের স্বপ্নকে তেমনি আশ্বিন আনতারা’র স্বপ্নটাকেও বিচ্ছিন্ন করে দিলো। সে ভুলেই গিয়েছিল তার মতো শুচিস্মিতাদের এমন‌ স্বপ্ন দেখতে নেই। এমন স্বপ্ন বিলাসীতা ছাড়া কিছু নয়, স্বপ্ন গুলো কখনো বাস্তবতায় ধরা দেয় না। আর দাঁড়ায় না আনতারা, মিসেস মমতা’কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হাঁটা ধরে। চোখের কোণে তপ্ত জলটা গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নেয়। পাছে না কেউ দেখে নেয়! মিসেস মমতা চরম রেগে গেছেন। দু দিনের এই মেয়ের কত গুমোরের কথা, তাদের সংসার নিয়ে প্রশ্ন তুলে! বিয়ে বাড়ি বলে নিজেকে সংযত করে নিলেন তিনি। ননদের শশুড় বাড়ি বেশ দূরে না বলেই এখনো বরযাত্রী যাওয়া হয়নি। একটু পরেই বের হবে। সেসবের ব্যবস্থা করতেই চলে যায় সে। আনতারা গেইট দিয়ে বের হবে তার আগেই মেয়েলি হাত তাকে আটকায়। ফারাহ কে দেখে হাসার চেষ্টা করে আনতারা, আবার মিল হয়ে গেছে বোনদের মাঝে। দুদিন খুব চেষ্টা করে মানিয়েছে ফারাহ। বুঝিয়েছে নিজের‌‌ ভুল। আনতারা’‌ও আর মনে রাখে নি। কিছু বলবে তার আগেই ফারাহ বিচলিত কন্ঠে বললো,

~ কিসব বলছিলি চাচি কে? তোর মাথা খারাপ তারা? হবু শাশুড়ির সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? এমনি সে রাজি না তার উপর তুই আরো রাগিয়ে দিচ্ছিস। এমন করলে কি করে হবে?

আনতারা অবাক হয়। আপায় জানে? লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয় সে। হয়তো ফারাহ’র ভালোবাসা সম্পর্কে না জানলে লজ্জা টা কম পেত। ফারাহ বুঝতে পেরে নিজেও খানিক অস্বস্তি তে পড়ে যায়। আনতারা কে তার জানার কথা বলা উচিত হয় নি এখন বুঝতে পারে। আবার ভুল করে ফেললো সে। এর মধ্যে আনতারা বললো,

~ কি যে বলো না আপায়, হবু শাশুড়ি? সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব না। বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা মানায় আপা?

~ নিজেকে ছোট করছিস কেন তারা? তুই চমৎকার একজন মেয়ে নাহলে রাশিদ ভাই তোকে ভালোবাসতো?

~ নিজেকে ছোট আমি কোনো সময়‌ই করি না আপায়। আমি সবার থেকে আলাদা। চাচির ক্ষেত্রে বললাম আরকি! তোমাকে রাশিদ ভাই বলেছে?

ফারাহ, মাথা নাড়ে। কোথাও একটা চিনচিনে ব্যাথা টের‌ পায় সে। তবে পাত্তা দেয় না। ইদানিং নিয়ন নামক পুরুষ টাকে মনে ধরেছে তার। সাথে থাকলে কেমন শান্তি শান্তি লাগে, দূরে গেলেই মনের মধ্যে উঁকি দেয়। তবে প্রথম ভালোবাসা টা যে ভুলার নয়! আনতারা বললো,

~ তোমার কষ্ট হয় না আপায়?

শব্দ করে হেসে উঠে ফারাহ। কষ্ট হয় হঠাৎ করেই, তবে তার কাছে এই কষ্টের ঔষধ আছে!

~ তোর দুলাভাই কষ্ট পেতে দেয় না! কেমন আগলে রাখে‌। তবে তোর মানুষ টার কিন্তু আগলে রাখার মানুষ নেই, তোকে ছাড়া।

আনতারা’র চোখ ছলছল করে উঠে। তার মানুষ? শব্দ দুটোই কি ছিলো? শরীর কাঁপছে কেন তার? মনের মধ্যে কি রকম এক অনুভূতি কড়া নাড়ছে! শব্দহীন হেসে চুপ থাকে, এর মধ্যে ভেসে আসে পুরুষালি কন্ঠস্বর,

~ দু বোন এখানে কি করছো? রেডি হ‌ওনি এখনো, জলদি করো, একটু পরেই বের হবো আমরা।

রাশিদের কথা শুনেই ফারাহ আর কথা বাড়ায় না। বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে, রেডি হতে হবে। তবে আনতারা নড়ে না, দাঁড়িয়ে থাকে। রাশিদ আরেকটু কাছে আসতেই আনতারা বললো,

~ আমি যাবো না রাশিদ ভাই, জোর করবেন না প্লিজ!

~ আচ্ছা জোর করছি না, তবে তুমি না গেলে আমি কি করে যাই বলো। আমার তো শুচিস্মিতা ছাড়া চলে না!

ফুস করে শ্বাস ফেললো আনতারা। এই লোক আবার তাকে ফাঁসিয়ে দিলো। নরম কন্ঠে বললো,

~ পুরুষ রূপের নাহয় দেহের পূজারী, আপনি কোনটা রাশিদ ভাই? রূপ তো সেই অন্ধকার, দেহ তো আবর্জনা!

~ আমি রূপের পূজারী, দেহের পূজারী আবার তোমার ওই হাসির পূজারীও‌!
কি করবো বলো? ভেতর টা যে মানতে চায় না। আমার একটাই অপরূপা, শুচিস্মিতা!

চোখ বুজে নেয় আনতারা। এই লোক কে কোনো ভাবেই টলাতে পারবে না। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলে উঠলো,

~ এই শুচিস্মিতা রা বুকে নয় মুখেই শোভা পায়, রাশিদ ভাই!

হাঁটার গতির সাথে টের পেল, রাশিদ ক্ষীণ কন্ঠে বলছে,

~ আমার শুচিস্মিতা যে শুধু বুকে নয়; মস্তিষ্কে, মুখে, নয়ন যুগলে, আমার সারা অঙ্গে শোভা পায়। সুবাসিত করে!

ভাদ্রের স্বপ্নকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে নিবিড় করে তুলতে যেমন তৎপর হয় উঠে আশ্বিন তেমনি আনতারা’র ওসব বিরক্তিময় কথাগুলো কে ছুড়ে ফেলে নিজের নিবিড়তা, ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশে তৎপর হয়ে উঠেছে রাশিদ। যার রেষ এখন আনতারা মনে! আশ্বিনের সময়সীমা যেমন খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না তেমনি এই আশ্বিনের কষ্টটাও আনতারা’র মনে দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বরং আশ্বিনের মতো নিজেকে শরতের সুরভিতে জড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি রাশিদ নামক পুরুষ কে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতে ব্যস্ত। ভাদ্র-আশ্বিনের উদারতায় বিমুগ্ধ প্রকৃতিও যেন কিছুটা কেঁপে উঠলো শান্ত, নিরব মেয়েটির কথায়,

~ এতদিন আপনি পাগলামি করেছেন, ভালোবাসার গভীরতা দেখিয়েছেন; এখন সময় হলো আমার পাগলামি করার। আমার জন্য যা যা হারিয়েছেন একে একে সব কিছু ফেরত দিবো আপনাকে। সর্বোপরি আমার ভালোবাসায় ভাসতে প্রস্তুত হন রাশিদ তাজ‌ওয়ার!

চলবে…?