শুচিস্মিতা পর্ব-৫+৬

0
129

#শুচিস্মিতা -৫
Tahrim Muntahana

~ তোমার হাতের ভাঁজের শিউলি ফুলটা যদি আমি হতে পারতাম! তুমি এভাবেই মুচকি হেসে যত্ন নিয়ে ছুঁয়ে দিতে; জীবন ধন্য হয়ে যেত!

গেইটের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো শিউলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ফুল হাতের মুঠোয় নিয়েছে মাত্র, এরমধ্যে চমৎকার ভঙ্গিমায় কথাগুলো শুনে ঈষৎ কেঁপে উঠলো আনতারা। নিজের হাতে থাকা ফুল গুলোর দিকে একপলক তাকালো, তারপর দৃষ্টি ফেললো হাঁটু সমান প্যান্ট, পাতলা গেঞ্জি পড়া রাশিদের দিকে। বেশ সুদর্শন, যেকেউ ই প্রথম দেখায় বলতে পারবে। ছোট প্যান্ট পড়ায় আনতারা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই প্যান্ট গুলো একদম পছন্দ নয় তার। বড় মানুষ বড়দের মতো পোশাক পড়বে, পা দেখিয়ে এমন স্টাইলের পুরোপুরি বিপক্ষে সে। কপালের ভাঁজ দৃঢ় করে বললো,

~ কি পড়েছেন রাশিদ ভাই? জঘন্য দেখতে!

রাশিদ নিজেকে দেখে নেয়। আনতারা’র মতো তার‌ও কপালে ভাজ পড়ে। ঘুম থেকে উঠে শুধু গেঞ্জি টা পড়ে দৌড় দিয়েছে সে, নাহলে তার অপরূপা কে কি করে দেখতো? এখন তো মনে হচ্ছে, না আসাই ভালো ছিল। এমনিই পছন্দের লিস্টে নেই, তার‌উপর অপছন্দের কাজ করে বসলো। নিজের উপর‌ই চরম বিরক্ত হয়ে কোনো কিছু না বলেই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে রাশিদ। আনতারা মুচকি হাসে, সে জানে এরপর এমন পোশাকে রাশিদ ভাইকে আর দেখা যাবে না। পাগল লোকটা! আনতারাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে দেখে ফাতিন কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে। হাসিটা দেখে মাথায় আসে না, একা একা হাসছেই বা কেন।‌ সে পুরোপুরি কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটির মাঝে ডুবে যায়। হর্ণের শব্দে ঘোর থেকে‌ বের হয় সে। আনতারা কে নিয়ে গঞ্জে যাবে, কয়েকটা ব‌ই কিনতে। যদিও তার যাওয়ার কথা ছিল না, ছোট চাচা’ই যেতে চেয়েছে। তবে হঠাৎ করেই তার ইচ্ছে হলো আনতারা কে নিয়ে যেতে। দু’দিন হলো ফারাহ চলে গেছে। তার ও ছুটির সময় প্রায় শেষ, আবার শহরের ভিড়ে হারিয়ে যেতে হবে। ভিষণ ইচ্ছে করলো কাউকে নিয়ে গ্রামের প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে। ইচ্ছে টা পূরণ করতে একপ্রকার ছোট চাচা’র অফার টা লুফে ই নিলো সে। আনতারা যদিও দ্বিমত পোষণ করেছিল, ফাতিন এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। মেয়ে বেশি কথা বলে! গাড়িতে উঠে বসে দুজন। মাঝে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রাখে আনতারা। ধাক্কা লেগে যেতে পারে।

আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘের ভেলা। অনেকক্ষণ হলো সূর্যের দেখা মিলেছে, খুশি মনে আলো ছড়াচ্ছে। মাঠ ভরা ফসল, ছোটো ছোটো ঘর, এখানে ওখানে সবুজ গাছ গুলো কে পেছনে ফেলে ছুটে চলছে গাড়ি। আনতারা’র হাতে থাকা শিউলি ফুলের দিকে তাকায় ফাতিন। শব্দহীন হাত বাড়িয়ে দুটো শিউলি ফুল নিজের হাতে তুলে নেয়, প্রভাতের শিশিরভেজা শিউলি গুলো কতটা স্নিগ্ধ লাগছে! এর থেকেও বেশী স্নিগ্ধ লাগছে সামনের মেয়েটিকে। আনতারা খানিকটা চমকালেও চুপ থাকে। কথাই কথা বাড়ে, এর থেকে নিশ্চুপতাই ঢের ভালো।
নদীর পাড় ঘেঁষে যাওয়ার সময় কাশফুল দেখে ফাতিন মুগ্ধ হয়। মৃদু বাতাস সাদা এলোকেশ গুলোতে কেমন দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ফাতিন গাড়ি থামায়, নেমে পড়ে। বড় বড় পা ফেলে কাশফুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তিন চারটে কাশফুল তুলে দেখে নেয়। একত্রে বাঁধলে ভালো লাগবে। দূর্বাঘাসে শিশিরের ফোঁটা, সূর্যের কিরণ লেগে কেমন চিকচিক করে। বড় দুটো ঘাস তুলে নিয়ে এবড়োথেবড়ো ভাবেই পেঁচিয়ে নেয়। মুখে বিরাজ করছে মুচকি হাসি। আবার এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। আনতারা’র কোলের উপর কাশগুচ্ছ দিয়ে নরম স্বরে বললো,

~ তোর আবদার গুলো কখনোই শোনা হয়নি আনতারা, না কখনো পূরণ করেছি। এবার একটু বুঝতে পারলাম। তোর আবদার না থাকলেও, পূরণ করা উচিত।

আনতারা অবাক হয়েই কাশগুচ্ছ হাতে তুলে‌ নেয়। এবার যেন কাশগুচ্ছ গুলো‌ পূর্ণতা পেল, ফাতিনের কাছে তো তাই মনে হচ্ছে! ফাতিন আবার বললো,

~ আচ্ছা নাম তো দেখি, কাশফুল সহ কয়েকটা ছবি ক্যাপচার করে নিই!

আনতারা নেমে পড়ে, হঠাৎ কি হলো আনতারা জানে না। তবে অনলাইন প্লাটফর্মে যখন হাজার হাজার পোষ্ট, ছবি দেখতো একটুর জন্য হলেও মনের মধ্যে বাসনা গুলো উঁকি দিতো। আজ যখন‌ পূরণের‌ সময় এলো, তখন আর না‌ করতে পারলো না। কয়েকটা ছবি তুলে ঝকমকে হাসলো ফাতিন, এগিয়ে গিয়ে আনতারা কে দেখালো। সত্যিই ভিষণ সুন্দর হয়েছে।‌ আবার চেপে বসলো গাড়িতে। নিরবতার মাঝেও অনুভূতি গুলো যেন খেলা করছিল, হাত পা নাড়িয়ে ছুটোছুটি করছিল। সময় টা বেশ যাচ্ছে!

~ ভাই, তোমার জন্য নাকি মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে?

ছোট ভাইয়ের কথায় রনি লাজুক হাসলো। ছেলেটা নিতান্তই সহজ সরল, মাস্টার্স কমপ্লিট করে কলেজের লেকচারার পদে জয়েন হয়েছে। বিয়ের বয়স সত্যিই হয়ে গেছে, সেও আজকেই শুনলো‌। বড় ভাইয়ের মুখে লাজুক হাসি দেখে রাশিদ শব্দ করে হেসে উঠলো।‌ রনি বললো,

~ আম্মা তো তাই বললো। আমার বিয়ের পর‌ই তোমার বিয়ে সেটাও বলেছে। প্রস্তুত থাকো এখনি।

রাশিদ হেসে উড়িয়ে দিলো কথাটা। তার এখনো অনেক অপেক্ষা করা বাকি। ভাইয়ের সাথে এটা ওটা বলে মজা করতে লাগলো। অপরাহ্নের শুরু, যোহরের আযান দিয়েছে সবে। রাজিব তালুকদার নামাযের জন্য বের হবে এখন। দুই ভাই কে একসাথে দেখে তিনি একটু বসলেন। গম্ভীর নয়নে রাশিদ কে পরখ করে বললেন,

~ তোমার ফুফু অসুস্থ, তোমাকে দেখতে চাইছে। আজ রাতের টিকিট কেটে রাখছি, সময় মতো পৌঁছে যাইয়ো।

কথাটা বলেই তিনি উঠে পড়লেন। রাশিদ কিছু বলার সুযোগ ও পেল না। হাসি খুশি মনটা বিষিয়ে গেল। রনি ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা শ্বাস ফেললো। ভাইয়ের মনের খবর সে জানে, তার কিছু করার নেই। মেয়েটি রাজি থাকলে সে চেষ্টা করতো মা কে বুঝানো, তবে মিসেস মমতা বুঝবে কিনা সে জানেনা।‌ রাশিদ রেগে নিজের ঘরে চলে যাবে, রনি হাত ধরে তার পাশে বসালো‌ কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে বললো,

~ সামনে মাস্টার্স ফাইনাল এক্সাম, এবার একটু পড়াশোনায় মন দাও। প্রিয়জনের ভরণপোষণের জন্য হলেও খানিকটা গুছিয়ে নাও নিজেকে। এমন ও সময় আসতে পারে, আজকের গুছিয়ে নেওয়া তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট হলো।

রাশিদ অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। প্রিয়জন! ভাই কি তাহলে জানে? রাশিদের ভাবনা টা সত্যিই করে দিয়ে মুচকি হাসে রনি। রাশিদ‌ লজ্জা পেয়ে যায়। লাজুক হেসে তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবে। এবার সত্যিই একটু গোছানো দরকার‌। তার শুচিস্মিতা নিশ্চয় অগোছালো পছন্দ করবে না। অপরূপার সকল আবদার পূরণ করতেও তাকে সিরিয়াস হতে হবে। সে যে ওই মেয়েটিকে সব সুখ ঢেলে দিতে চেয়েছিল!

ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলা পাখপাখালির ঝাঁক, বিলঝিলের ডুবো ডুবো জলে জড়িয়ে থাকা শালুক পাতা দেখতে দেখতে গ্রামের পথে হাঁটছে আনতারা‌। সূর্য যেন নিজের তেজ দেখাতে ভুলছে না। ঘামে চিপচিপে শরীর, উটকো গন্ধ বের হচ্ছে। তবুও যেন আলাদা এক শান্তি অনুভব করছে সে। নিঃসন্দেহে আজকের দিনটা স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে। সবটা সময় কথা শোনানো ফাতিন ভাই তাকে নিয়ে শহর ঘুরেছে, ভাবতেই ভালো লাগা ছেঁয়ে যায়। হুট করেই আবার আপায়ের কথা মনে পড়ে, চাপা শ্বাস ফেলে মন খারাপটাকে স্বচ্ছ সাদা-নীল আকাশে উড়িয়ে দিতে চায়। আপায় টা থাকলে কত ভালো হতো, আপায় ও তাদের সঙ্গী হতো। ভাবতে ভাবতেই রাজিব তাজ‌ওয়ারের সামনে পড়ে যায় আনতারা। বিব্রত হয়ে, ঝটপট নিচু স্বরে সালাম দেয়। নামাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি‌। মেয়েটাকে তো রাজিব তাজ‌ওয়ারের বেশ লাগে। নাচুনী মেয়েদের তিনি একদম পছন্দ করেন না। মেয়ে রা ঘরে থাকবে, নিচু স্বরে কথা বলবে, গুরুজন দশটা আঘাত করলেও মুখে রা শব্দ করবে না! এই জন্য‌ই মেয়েটা তার পছন্দের তালিকায়। তিনিও হেসে সালামের জবাব দেন। বলেন,

~ ক‌ই গেছিলা আনতারা?

~ কিছু ব‌ই কিনতে গঞ্জে গিয়েছিলাম চাচা।

শান্ত স্বরের জবাবে খুশি হতে পারলেন না তিনি। মেয়েদের এত পড়াশোনার কি আছে? স্বামীর ঘর ই ঠিকানা! বলেন,

~ এত পড়ে কি হবে? শশুড়বাড়ি বিয়ের পর চাকরি বাকরি করতে দিবো?

~ সংসার কেমন হবে জানি না তো চাচা। কে জানে ভালো করে সংসার করতে পারি কিনা? ধরেন বিয়ের পর ছাড়াছাড়ি হলো, তখনের গতির জন্য‌ই পড়ছি চাচা!

উত্তর টা ভালোয় লাগলো রাজিব তাজ‌ওয়ারের। মেয়েটা তো ঠিক‌ই বলেছে। সংসার তো সবার টিকে না, তখন মেয়েটার গতি কি হতো? তার‌উপর বাপ টা দেখতে পারে‌না, তখন তো আরো দূর দূর করবে। প্রসন্ন কন্ঠে বললেন,

~ ঠিক, ঠিক বলছো তো। ভালো করে পড়াশোনা ক‌ইরো।‌ আমার ছোট ছেলেটা যে কেন এমন হলো! কত ভালো ছাত্র ছিলো। যাই হোক বাড়ি যাও মা।

আনতারা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে হাঁটতে থাকে। তার বলতে ইচ্ছে করে,
“আপনার ছেলের এমন করার পেছনের মেয়ে টা আমি। আমার জন্য‌ই পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছে।‌ আমার জন্য‌ই সমাজে তার সম্মান কমেছে। আমার জন্য‌ই আপনার ছেলের ভবিষ্যত চরম আশঙ্কায় পড়েছে। আমার জন্য‌ই ধীরে ধীরে আপনার ছেলের জীবন টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাকে আটকান, বুঝান, নাহলে বেঁধে রাখুন; তবুও ছেলেটার জীবন সুন্দর হোক।”
আনতারা বলতে পারে না, লুকায়িত দহন গুলো লুকিয়েই রাখে‌। মানুষ ভালোবাসার কাঙাল অথচ সে না চাইতেও এত এত ভালোবাসা পেয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে! ভালোবাসা তার সাথে খাপখায় না!

~ আম্মা তুমি সত্যিই রাজি নাকি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হচ্ছো?

বড় ছেলে নাহিদের প্রশ্নে বিরক্ত হলেন মিসেস নাজমা। মেজ, সেজ দুজন’ই বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছে, সেও হাসি মুখে জবাব দিয়েছে।‌ এখন আবার বড় ছেলে! কি মুসিবত!

~ রাজি হ‌ইলেও দোষ, না হ‌ইলেও দোষ হ‌ইতো। কোন দিকে যাই এহন? তোমাদের পছন্দের দাম আমার কাছে আছে।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিবিড় হাসে। নিয়ন দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে‌। এই খবর দেওয়ার খুশিতে ব‌উ যদি জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, তার‌ই লাভ! ফারাহ নিয়নের জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলো, আসতেই চেপে ধরতে হয় না। বরং এসেই গড়গড় করে বলে দেয়,

~ আম্মা রাজি হয়ে গেছে ফারাহ‌। কালকেই নাকি তোমাদের বাড়ি যাবে। খুশি তো তুমি?

ফারাহ সত্যিই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে নিয়ন কে। নিয়ন টাশকি খেয়ে কিছুক্ষণ হা করে রয়। ফারাহ লজ্জা পেয়ে যখন সরে আসতে নিবে, নিয়ন শক্ত করে চেপে ধরে‌। আর ছাড় নেই, অনেক ছাড় দিয়েছে‌। নিজে থেকে এসে আবার দূরে চলে যাওয়া? সবসময় তো ব‌উয়ের কথায় চলতে পারে না। পুরুষ মানুষ! ব‌উয়ের সান্নিধ্য পেতে বড়‌ই ইচ্ছা করে!

মিসেস নাজমা নিজের ঘরে আয়েস করে বসে পান বানাচ্ছিলেন‌‌। হন্তদন্ত হয়ে মেজ ছেলের ‌ব‌উ রিনু কে ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ বেঁকিয়ে তাকালেন। খেঁকিয়ে বললেন,

~ কুত্তায় দাবড়ানি দিছে? ঘরের জিনিস তো ভাইঙ্গা ফেলবা।

শাশুড়ির কথায় রিনু কিছু মনে করলো না।‌ বিয়ের পর থেকেই এমন শুনে আসছে। বরং রঙচঙ করে বললো,

~ আম্মা আপনি রাজি হলেন? এত্ত সুন্দর একটা পোলা, শেষমেষ ওমন কালির লগে বিয়া দিতাছেন! প্রতিবেশী রা নাক ছিঁটকাবো।

~ তোমার প্রতিবেশীর নাক ছিঁটকানে ওত সমস্যা, যাও প্রতিবেশীর কাছে যাও, এক দিন দুই দিনের বেশী মুখে ভাত দিবো কিনা দেখ।

~ আম্মা আপনে বুঝতে পারতাছেন না। ওই মেয়ের মধ্যে এমন কি দেখছেন?

~ আরে বুদ্ধু, সেজ টারে বিয়া করাইয়া একটা কানাকড়িও আনতে পারিনাই, শুধু কয়েকটা গহণা ছাড়া। এইবার ছোট টা বিয়ে করবে, এবার অন্তত কিছু নিবোই।

শাশুড়ির কথায় রিনু হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ শাশুড়ির সাথে খোশগল্প করে নিজের ঘরে চলে গেল। বড় ব‌উ পারভিন রান্না ঘর থেকে একনজর দেখে চাপা শ্বাস ফেললেন। শাশুড়ি, জা এর মতিগতি একটু হলেও বুঝেছে সে, কম সময় তো হয়নি সংসারে আছে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে এখন পর্যন্ত ঘর করে যাচ্ছে, না হলে সেই কবেই আলাদা হয়ে যেত। সংসারের এত কাজ, একা একা করতে হয়। মেজ টা হয়েছে ফাঁকিবাজ; কাজ দেখলেই পালায় পালায় করে, মাথা ব্যাথা করে, পেট ব্যাথা করে। কত বাহানা! বিতৃষ্ণা মনে কাজ করতে লাগলো পারভিন। এমন সময় রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো ফারাহ। পারভিন ফারাহ কে দেখে মুচকি হাসলো, বিনিময়ে ফারাহ’ও হাসি উপাহার দিয়ে কাজে হাত লাগাতে যেতেই পারভিন তড়িঘড়ি করে বলল,

~ এ মা কি করছো, তুমি নতুন ব‌উ কাজ করতে হবে না এখনি, অনেক সময় পড়ে আছে‌। এখন একটু রেস্ট নাও।

ফারাহ মানলো না। জোর করে তরকারি কাটতে কাটতে বললো,

~ সময় তো বেশী নেই বড় ভাবী। একটু পরেই খেতে আসবে সবাই, রান্নাও শেষ হয়নি। না করো না!

পারভিন দেখলো আসলেই সময় নেই। তাই আর না করলো না, নিজের জন্য‌ই ভালো। দু জা গল্প করতে করতে কাজ করতে লাগলো। হঠাৎ করে মেজ জা এর কথা মনে হতেই ফারাহ বললো,

~ মেজ ভাবী কে দেখছি না যে‌। সে ক‌ই?

~ আছে নিজের ঘরেই, দেখ গিয়ে ফোন টিপছে।

ফারাহ অবাক হলো। এই দুই দিন নিজের ঘর থেকে তেমন বের হয়নি বলে বিষয়টা জানা হয়নি। এবার বুঝলো সংসারের প্রায় সব কাজ পারভিন করে, শাশুড়ির তো এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরতেই যায়।‌ এটা নিয়ে তার সমস্যা না, বয়স হয়েছে এখন ঘুরবেই । কিন্তু মেজ জা’র এ কেমন বিচার! এমন তো না যে সংসার শুধু বড় ভাবীর। হাতের কাজ টা শেষ করে ফারাহ রান্নাঘর থেকে বের হয়, মেজ জা’র ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,

~ মেজ ভাবী রান্না ঘরে আসেন তো।

শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল রিনু। ফারাহ’র ডাক শুনে বিরক্ত হয়। ফোন রেখে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। ফারাহ ততক্ষণে রান্না ঘরে চলে গেছে। পারভিন ফারাহ’র মতিগতি বুঝতে পারে না, তবে চুপ করে থাকে। রিনু রান্না ঘরে আসলেই ফারাহ মুচকি হেসে বললো,

~ খাবার গুলো টেবিলে রাখেন তো ভাবী। দেরী হয়ে যাচ্ছে।

রিনু মুখ বেঁকিয়ে কাজ করে। পারভিন বেশ খুশি হয়। সে তো কথা বলতে পারে না, ফারাহ’‌ই পারবে এই মেয়েকে সোজা করতে। পুরুষ রা এসে খাবার টেবিলে বসে। ফারাহ’র শশুড় জাতে কৃষক, বাবার থেকে বেশ জমি পেয়েছে। কামলা নিয়ে ফসল চাষ করে, নিজের একটা গুদামঘর ও আছে। সকল চাষী’রা নিজেদের ফসল বিক্রি করে তার কাছেই। সেগুলো তিনি একত্রে শহরে নিয়ে যান বিক্রি করতে। গুদামঘর টা বড় ছেলে নাহিদ দেখাশুনা করে। মেজ ছেলেকে জমি দেখাশুনার কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। সেজ ছেলেকে গঞ্জে কাপড়ের দোকান কিনে দিয়েছেন, সেটাই দেখাশুনা করে। ছোট টা পড়াশোনা শেষ করে নি, হয়তো চাকরি করবে। বেশ নামী পরিবার‌ই বলা চলে।
সবাই একে একে টেবিলে বসতেই বড়‌ব‌উ পারভিন খাবার বেড়ে দেয়। ফারাহ নিজেও খেতে বসেছে। বড় ভাবীকে খেতে বসতে না দেখে ফারাহ বললো,

~ বড় ভাবী তুমিও খেতে বসো।

~ তুমি খাও, পারভিন খাইতে বসলে বাইড়া দিবে কে?

শাশুড়ির খেঁকিয়ে উঠায় ফারাহ খানিকটা ভয় পেল। নাহিদ একপলক ব‌উয়ের দিকে তাকিয়ে আবার খেতে শুরু করলো। মেয়ে টা কেমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাহ’র শশুড় একটা কথাও বললেন না। রাগ হলো ফারাহ’র,

~ বড় ভাবী তুমি খেতে বসো, আমি বেড়ে দিচ্ছি। একটা কথাও বলবে না, যা বলছি তাই করো।

জোর করে বসিয়ে দিলো পারভিন‌ কে। নাহিদের কেন জানি ফারাহ কে খুব ভালো লাগলো। মেয়েটা তাহলে তার ব‌উ য়ের বোন হয়ে এসেছে। পারভিন আড়চোখে বরের খুশি মুখটা দেখে তৃপ্তি পেলো। এই মানুষটার জন্য ‌ই এত কিছু করা। অন্যদিকে মিসেস নাজমা ক্ষেপে গেলেন, দুই দিন আসতে না আসতেই এই মেয়ে তার উপর কথা বলে। সাহস কে দিয়েছে? নিয়নের দিকে কড়া চোখে তাকায়, তবে নিয়ন বুঝি আগেই বুঝতে পেরেছিল মায়ের চোখ রাঙানির সম্মুখীন হতে হবে তাই তো ভুলেও মাথা উপরের দিকে তুললো না। চুপচাপ ঘাপটি মেরে খেতে থাকলো। ফারাহ শাশুড়ির থালায় আরেকটু ভাত দিয়ে বললো,

~ আম্মা, রাগ করবেন না। ভাবি একটু অসুস্থ, একা একা কাজ করে তাই ভাবলাম এইটুকু আমি করি। আপনার সংসার আপনিই তো সব সিদ্ধান্ত নিবেন।

এতক্ষণের রাগ যেন সব হাওয়া হয়ে গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে খেতে লাগলেন‌ তিনি। ফারাহ হাসলো, যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে, মা চাচি দের থেকেই এসব শেখা। এখন যদি কাজে লাগাতে না পারে সংসার তো হাতের বাইরে চলে যাবে। তালুকদার বাড়ির মেয়ে হয়ে তো ঝি গিরি করতে আসেনি। নিয়ন এবার মাথা তুললো, ব‌উয়ের হাসি হাসি মুখটা দেখে আত্মা যেন শান্তি হয়ে গেল। এভাবে মানিয়ে নিলে, সে মেয়েটিকে দুঃখ পেতে দিবে না, পেলেও তার ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দিবে। ফারাহ’র মেজ ভাসুর নিরবের মনে হলো এখন নিজের অভিব্যক্তি না প্রকাশ করলেই নয়। সংসারে তার যে একটা পজিশন আছে বুঝাতে হবে তো,

~ তিন ব‌উ মিলেই কাজ করবা, তোমরা দুইজন বড় ভাবীকে সাহায্য করলে উনার কাজটাও সহজ হয়।

বরের কথায় রিনু আড়ালে চোখ রাঙালো। ব‌উয়ের চোখ রাঙানোতে আর কিছু বলার সাহস করলো না নিরব। আর কেউ না দেখলেও ব্যাপার টা নিবিড়ের কাছে ধরা পড়লো। হাসতে গিয়ে বিষম গেয়ে কাশতে লাগলো সে। মিসেস নাজমা পাশেই ছিলেন তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। পানি টুকু খেয়ে জোরে শ্বাস নিলো নিবিড়। বিড়বিড় করে বললো,

~ পুরুষ মানুষ এভাবেই ব‌উয়ের কাছে ভেজা বিড়াল হয়ে থাকে। আমি আমার ব‌উকে থাপ্রা*নির উপর রাখবো।

গোধূলি বিকেল। পশ্চিম দিগন্তে তেজী সূর্য ঝুলে আছে আপন মনে। তার যাওয়ার তাড়া নেই। নানা রঙের পাখপাখালি ছুটোছুটি করে ডাকছে। আনতারা’র শখ জেগেছে নদীপাড়ে ঘুরতে যাওয়ার। এসময় একা যাওয়া যাবে না ভেবেই ফাতিন কে খুঁজছে সে। দেখা যাক আবদার টা পূরণ হয় নাকি।

~ বড়চাচি তোমার ছেলে কোথায়?

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে দুই জা টিভি দেখছিলেন। এই টুকু সময় ই একটু টিভি দেখেন তারা‌। আনতারা’র কথায় দুজন‌ই অবাক হয়। এই প্রথম ফাতিনের খোঁজ করলো আনতারা। মিসেস সেলিনা অবাক হয়েই বললেন,

~ বাড়ির বাইরের মনে হয়, দেখ গিয়ে।

মাথায় উড়নাটা ভালো করে দিয়ে বাইরে চলে যায় আনতারা। বাগানের এক কোণায় বসে ফোন টিপছে ফাতিন। আনতারা’কে তার কাছে আসতে দেখে ভিষণ রকম অবাক হয়। তাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে আনতারা বলে উঠে,

~ ফাতিন ভাই, নদীপাড়ে ঘুরতে যাবো। নিয়ে যাবেন?

আবদার! ফাতিনের চোখ মুখে খুশিরা খেলা করে। এক কথাতেই উঠে দাঁড়ায়। কাঁধের উপর ঝুলে থাকা টিশার্ট টা পড়ে নিয়ে মাথা নাড়ে। আনতারা খুশি হয়, চিকচিক করে তার দৃষ্টি। দুজন তালুকবাড়ির গেইট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। উপর থেকে সবটাই পরখ করেন মিসেস সেলিনা। ছেলের খুশি দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ে। ভাঁজ দ্বিগুন হয় দুজন কে একসাথে বেরিয়ে যেতে দেখে। কোথায় যাচ্ছে? হুট করেই এত মিলমিশ! ছেলের দৃষ্টি তার ভালো ঠেকছে না। কথা বলতে হবে!

~ একটু নিচে আসবে শুচিস্মিতা? প্লিজ! একটু দেখেই চলে যাবো, জানি না আবার কবে দেখতে পারবো। প্লিজ আসবে?

পড়তে বসেছিল আনতারা। এর মধ্যে ফোনের মেসেজ টুন বেজে উঠতেই ফোন টা হাতে নেয়। রাত সোয়া এগারোটা বাজে‌। এত রাতে রাশিদের আবদার দেখে আতকে উঠে সে। কি বলে এসব কথা? নিচে যাবে মানে? বিরক্ত হয়ে ফোন টা আবার আগের জায়গায় রেখে পড়ায় মন দেয়। নাহ, মাথায় ঢুকছে না কিছু। পরপর দু’বার মেসেজ টুন বেজে উঠে। অজানা কৌতুহল রা ঘিরে ধরে তাকে। ফোন টা হাতে তুলে নিয়ে দৃষ্টি ফেলে স্কিনে,

~ একটু আসো। আধাঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
~ আসবে? নিষিদ্ধ আবদার করছি। এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না অপারূপা, মরে যাচ্ছি!

চোখ বুজে নেয় আনতারা। চোখের কার্ণিশে তপ্ত জলের প্রবাহ টের পায়। এমন আবদার নাকচ করতেও যে সাহস লাগে। সে সাহস আনতারা করে উঠতে পারছে না। উড়না দিয়ে শরীর ভালো ভাবে ঢেকে আস্তে আস্তে পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বাজারে মাঝারি সাইজের একটা সারের দোকান আছে তাদের, আনতারা’র ছোট চাচা দেখে। সে এখনো ফেরে নি, তাই সদর গেইট তালা দেওয়া হয়নি। আনতারা চুপিসারে বাইরে বের হতেই শিউলি তলায় পুরুষালি অবয়ব দেখতে পায়। ভয় হয় আনতারার, কেঁপে উঠে বারবার। বাঁশবনে ডাহুকেরা ডাকাডাকি করছে, ঝিঁঝিঁ পোকারা চিঁচিঁ করছে। অন্তরীক্ষে মোহনীয় রূপালী থালার মতো চাঁদ, জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে পৃথিবীর বুকে। আলো-আঁধারি এই পরিবেশ আরেকটু আলোকিত করতে জোনাকিরা তাদের রুপালি সেলাই বুনে যায়। আনতারা দেখে, মুগ্ধতায় ঘেরা দৃষ্টি তার উপরেই নিবদ্ধ। শরীরের কাঁপুনি বৃদ্ধি পায়, আরেকটু এগিয়ে যায় সে। আনতারা কে দেখে থমকে যায় রাশিদ, আবদার করে বসলেও, সে ভাবেনি তার ডাকে সাড়া দিবে। তবে কি তার অপরূপা’র মনেও তার প্রতি অনুভূতি আছে? কথাটা ভাবতেও যেন একবুক সুখে সে মরে যায়, ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে পড়ে তৃপ্তির হাসি।

~ আমার অপ্রাপ্তির খাতা আজ এখানেই বন্ধ হয়ে গেল শুচিস্মিতা, তোমার পায়ের ছাপ যে আমার আবদারে পড়েছে!

আনতারা নিশব্দে কেঁদে উঠে। মানুষ টার এমন ভালোবাসা বারবার প্রত্যাখ্যান করতে বুক পুড়ে। তবুও মানুষ টা বুঝে না, তাকে বার বার পোড়াতে আসে। মাথা নিচু রাখায় আনতারা’র নিঃশব্দের আত্মচিৎকার টের পায় না‌। আবার বলে,

~ আমার অপরূপা’র প্রেমে আবার‌ও পড়ে গেলাম। চাঁদ ও যে হিংসা করছে এমন রূপে। ইশ যদি পারতাম, একদম বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখতাম। কারোর দৃষ্টিই আমার শুচিস্মিতার উপর না পড়ুক।

~ চুপ করুণ রাশিদ ভাই। আমার মতো শুচিস্মিতাদের উপর দৃষ্টি টা শুধু আড়‌ই থাকে, যেখানে বিদ্রুপ মিশে থাকে‌।

রাশিদ হাসে। একটু এগিয়ে এসে বলে,

~ চলো বিয়ে করে ফেলি। মধুর সংসারে ভেসে যাই!

কয়েক পা পিছিয়ে যায় আনতারা। দূর থেকে টর্চের আলো ভেসে আসছে। আমির তালুকদার এসে পড়েছে। আনতারা’র চোখ থেকে আবার তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে। পাগল হয়ে গেছে রাশিদ ভাই, নাহলে তাকে এসব বলতো? তেজি কন্ঠে বলে উঠে,

~ আপনি উন্মাদ হয়ে গেছেন রাশিদ ভাই। তাইতো ভালো খারাপের পার্থক্য টা বুঝতে পারছেন না। আমার মতো শুচিস্মিতা রা সংসার করার জন্য জন্ম নেয়নি।

চলবে…?

#শুচিস্মিতা -৬
Tahrim Muntahana

~ তোর হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না ফাতিন। মনে কি চলতাছে জানতে চাই‌।

ফাতিন চমকায়। দৃষ্টি ঘুরায় বারংবার। ধরা পড়ার ভয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে।‌ মিসেস সেলিনা আবার বলেন,

~ খবর দার, মিথ্যা বলবি না। এমনি এমনি চুল পাঁকে নাই, এমন হাবভাব শত শত দেইখা আইছি‌।

ফাতিন হতাশ হয়, মা ধরে ফেলেছে আর লুকিয়ে কি হবে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয় সে। মিসেস সেলিনা যা বুঝার বুঝে নেন। শান্ত স্বরে বললেন,

~ আনতারাও?

~ না আম্মা।

নিচু স্বরে কথাটুকু বলেই আবার মাথা নিচু করে নেয়। নিজের ভালোবাসার কথা মা কে বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। এতক্ষণের পুষে রাখা রাগটা আর ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে না। খেঁকিয়ে বলে উঠেন,

~ যে পর্যন্ত গেছ ওই পর্যন্ত‌ই থাকো। সংসারে অশান্তি আমি চাই না। এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না মাথায় ঢুকাইয়া নেও। অবাধ্য হলে খুব খারাপ হবে। রেডি হ‌ও চাকরি তে ফিরা যাবা।

মিসেস সেলিনা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ফাতিন স্তব্দ হয়ে মায়ের যাওয়া দেখে। সে তো ভেবেছিলো মা মেনে নিবে, মেয়েটাকে খানিক সমিহ তো সে করে। কিন্তু ভুল, তার মা রেগে গেছে। তার এই অনুভূতি মেয়েটার জন্য কাল হলো না তো? ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে ফাতিনের। বড্ড ভুল করে ফেলেছে। একদিকে প্রেয়সী কে না পাওয়ার ব্যাথা, আরেকদিকে প্রেয়সীর জন্য ভীতি; কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ফাতিন। কয়েকবার ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সকাল হলো কিছুক্ষণ, ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়লো ছুটি শেষ তার। বস কে ফোন দিয়েই ছুটিই বাড়িয়ে নিচ্ছিলো, এর মধ্যে মিসেস সেলিনা ঘরে ঢুকেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে চলে গেল। আর ফাতিন কে ফেলে গেল এক অসহনীয় ব্যাথার কবলে। এই ব্যাথা যে সারার নয়, এই ব্যাথা শুধু বাড়বেই‌। হুট করেই জীবন টা তার রঙ্গীন হয়ে উঠেছিল, সেই পূর্ণিমা রাত তাকে জীবনের আরেকটা মানে বুঝিয়েছিল, বাঁচার আরেকটি কারণ দেখিয়েছিল, কৃষ্ণবর্ণের উপর অগাধ মায়া টের পেয়েছিল, সর্বোপরি হুট করে মায়ায় পড়েছিল, ভালোবেসেছিল কৃষ্ণমায়া কে! এখন মেয়েটি কে দেখে যখন সে মুগ্ধ হবে, খানিক পরেই মনে পড়বে মেয়েটি তার না, তার হবে না, তখন হয়তো সে মরে যাবে। প্রতিনিয়ত মরবে। যত দিন নিঃশ্বাস আছে ততদিন মরবে!

~ আমি ভালোবেসে বেঁচেছি, আবার ভালোবেসে মরেছি। জীবন মরণের এই সন্ধিক্ষণে আমি তোমাকেই চেয়েছি কৃষ্ণমায়া!

কথাটা বলে চাপা শ্বাস ফেলে উঠে বসে ফাতিন। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি বুঝি হবে না? চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই তো। মা কে যদি মানানো যায়!

~ তুমি হীনা প্রতিটা ক্ষণ আমার কাছে মরণ যন্ত্রণা শুচিস্মিতা! খুব কি ক্ষতি হতো? আমার বুকে মুখ লুকিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলে!

দু বছরে আজকের সকাল টা ভিন্ন! একদম অন্যরকম। আজ সকাল যে রাশিদের অপারূপা কে দেখা হয়নি। চোখের তৃষ্ণা মেটানো হয়নি। এই সকাল টা তার কাছে অর্থহীন। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেই হাতে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি ঘোরালো। স্কিনে ভাসছে কলেজ ড্রেস পড়া কৃষ্ণবর্ণ মেয়ের ছবি। যাকে রাশিদ ভালোবেসে শুচিস্মিতা বলে ডাকে। রাশিদের মন পড়ে আছে সেই পরমানন্দপুর নামক ছোট্ট গ্রামে যেখানে তার অপরূপার গায়ের গন্ধ মিশে আছে, পায়ের ছাপ আঁকা আছে। ভাবনায় ব্যস্ত রাশিদ টের পায় নি তার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। যখন টের পেল বড্ড দেরী হয়ে গেছে, মানুষ টার চোখ ও যে মেয়েটির উপর পড়েছে। তড়িঘড়ি করে ফোন লুকিয়েও বিশেষ লাভ হলো না রাশিদের, সেই ফুফুর কাছে ধরা খেয়ে গেল। তবে রাশিদের মাথা নিচু হয়নি, শূণ্যে দৃষ্টি ফেলে‌ নিরবতা পালন করছে। রাশিদের ফুফু মিসেস রাবেয়া বললেন,

~ মেয়েটা আনতারা না? আহনাফ ভাইয়ের মেয়ে! বেশ মিষ্টি হয়েছে তো আগের থেকে।

রাশিদ অবাক হয়। তাকায় ফুফুর দিকে। মহিলার ঠোঁটের কোণে হাসি। কেন জানি রাশিদের মনে হয় অন্তত তার ফুফু ভেদাভেদ করবে না। রাশিদের ভাবনাটাই সত্য করে দিয়ে মিসেস রাবেয়া বললেন,

~ খুব ভালোবাসিস মনে হচ্ছে! দুটো বছর ফুফুকে দেখতেও এলি না!

রাশিদ কিছু বলে না, শুধু মুচকি হাসে‌। মায়ের মতো ফুফুর কাছে এসব বলতেও লজ্জা লাগে‌‌। কিছুক্ষণ সময় চলে যায়। রাশিদ ফুফুর দিকে ঘুরে। আমতা আমতা করে বলল,

~ তোমার আপত্তি নেই তো ফুফু। আমার সাথে থাকবে তো?

~ ভাইয়ার অনেক বছর পর আমার জন্ম হয়েছিল। বলতে গেলে বাবা-মা’র বৃদ্ধ বয়সের সন্তান আমি। কি খুশি সবাই। তোর আর আমার বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ বছরের মতো হবে। বয়স যখন সতেরোর কাছাকাছি হঠাৎ করেই আমির ভাই কে মনে ধরে। আবেগের বয়স কত‌ই না পাগলামি করতাম। অযহত তার সামনে ঘুরঘুর করতাম, কারণ ছাড়ায় কথা বলতে যেতাম, আমির ভাই বুঝতে পেরেছিল। আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তালুকদার বাড়ির সাথে তাজ‌ওয়ার বাড়ির মিলমিশ থাকলেও কোনো রকম সম্বন্ধ সম্ভব না। কি কান্নায় না সেদিন কেঁদেছিলাম। ভাই যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, আমাকে মেরেছিল। মায়ের লাঠি টা দিয়ে এমন‌ ভাবে মেরেছিল পনেরো টা দিন বিছানা থেকে উঠতে পারি নি। ভাই কিন্তু ভালো ছিল না, আমাকে মেরে সেও কষ্ট পেয়েছিল। বাবারও এক কথা তালুকদার’রা সম্বন্ধ করার জন্য নয়। ছোট্ট মন ভেঙে গেল, পড়াশোনায় খারাপ করলাম। বিয়ের ব্যবস্থা করলো, নতুন ঘর নতুন মানুষ টাও একসময় আপন হয়ে গেল। ভালোবাসা জন্ম নিলো, মানুষ‌টা পরিবারের সবার অমতে আমাকে পড়াশোনা করালো। তার ত্যাগ দেখে আমিও ঝুঁকে পড়লাম সংসারে। আজ দেখ আমি একজন সফল মানুষ। কিন্তু মাঝে মাঝে ওই মানুষ টা মনের কোণে উঁকি দেয়। তবে আফসোস হয় না। আমি চাই না আমার ছেলের মনে এই আফসোস থাকুক। যে ছেলে মেয়েটার জন্য ভবঘুরে হয়ে গেল তার ভালোবাসা’র উপর প্রশ্ন তুলতেও তে সাহস লাগে বাপ। আমাকে পাশে সবসময় পাবি। তবে বলবো মেয়েটাকে কষ্ট দিস না! ছোট থেকে অপ্রাপ্তি তে বড় হয়েছে।

রাশিদ তাকিয়ে রইল ফুফুর দিকে। মানুষ টা আসলেই সফল, কলেজে শিক্ষকতা করছে, স্বামী সন্তান নিয়ে ভালো আছে। কিন্তু সে ভালো থাকবে না, ওই‌ মেয়েটিকে ছাড়া তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। মিসেস রাবেয়া ফিরে যেতে গিয়েও থেমে গেলেন। হঠাৎ করেই তার আরেকটি কথা মনে হলো। আবার রাশিদের বরাবর দাঁড়িয়ে বললেন,

~ আহনাফ ভাইয়ের আনতারা কে অবহেলা’র কারণ জানিস?

~ গাঁয়ের রং কালো, তাছাড়া কি?

হাসলো মিসেস রাবেয়া। শুধু মাত্র এর জন্য? হয়তো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

~ আয়েশা ভাবির মৃত্য’র কারণ আনতারা, রাশিদ!

চমকায় রাশিদ। তিন বছরের মেয়ে মায়ের মৃত্যর কারণ হলো কি করে? মিসেস রাবেয়া শূণ্যে দৃষ্টি মেলে বললেন,

~ আনতারা’র বয়স তখন তিন। আহনাফ ভাই তো মেয়ে কে চোখে হারাতেন। মাটিতে পা পড়লে মাটি লেগে যাবে! এমন ভাব। আয়েশা ভাবি পুকুরের কাপড় ধুতে গিয়েছিল, ছোট্ট আনতারা খেলতে খেলতে আয়েশা ভাবি কে ধাক্কা দিতেই আয়েশা ভাবির মাথাটা শানের সাথে লেগে যায়‌। যদিও ওতটুকু বাচ্চা’র ধাক্কায় তেমন ক্ষতি হ‌ওয়ার কথা ছিল না তবে আয়েশা ভাবির যে মাথায় আগে থেকেই সমস্যা ছিলো। আনতারা পেটে থাকতে পা পিছলে ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে মাথায় যন্ত্রণা হতো আবার ব্যাথা পেয়ে যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। কয়েকদিন পরেই প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেই অজ্ঞানেই পৃথিবী ছেড়েছে। এটা যদিও আনতারার দোষ‌ নয়, সৃষ্টি যেমন উপর ওয়ালা করেছেন, মৃত্য ও তার হাতে। তবে গ্রামের মহিলাদের টিটকারি, কুসংস্কার; আহনাফ ভাইয়ের মনেও আনতারা’র জন্য বিরূপ প্রভাব পড়ে। সেই দুরত্ব যে তৈরি হয়েছে, এখন পর্যন্ত স্থায়ী। দেখ যদি মেয়েটার দুঃখ ঘুচাতে পারিস!

মিসেস রাবেয়া চলে যায়। আহনাফ তালুকদারের উপর বেজায় রাগ হয় রাশিদের। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এমন ব্যবহারের জন্য সে আগে থেকেই দেখতে পারতো না, আজকের পর যেন আরো চোখের কাটা হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

~ একবার শুচিস্মিতা বিয়েতে রাজি হোক, মাস কেন বছরেও মেয়ের মুখ দেখতে পারবেন না। তখন বুঝবেন জ্বালা।

~ তোমার কাপড় গুছিয়ে দিয়েছি, তোমার বাবা ২ টাই বাসের টিকিট ও কেটে রেখেছে, তৈরি হয়ে নাও।

মিসেস সেলিনা’র কথায় ফাতিনের মুখশ্রী মলিন হয়ে এলো, করুণ দৃষ্টি ফেলে মায়ের দিক তাকালো। তার মা এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলো? ছেলের করুণ দৃষ্টিও মিসেস সেলিনা কে ছুঁতে পারে না, ঠেলেঠুলে তৈরি হতে পাঠায়। বুকের ব্যাথা গোপন করে তৈরি হয়ে নেয় ফাতিন। কিছু বলতে চায় মা কে, মিসেস সেলিনা যেন আজ পণ করেছে যাই হয়ে যাক ছেলের সাথে আলাদা কথা বলবেন না। শেষ মেষ হতাশ হয়ে ফাতিন সবার থেকে বিদায় নিয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা ধরে। মেয়েটাকে দেখা হলো না। আফসোস গুলো পূরণ হবার নয়!

বেলকনির পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ফাতিনের চলে যাওয়া দেখে আনতারা। কেমন যেন মন খারাপ অনুভব করে‌। ফাতিন ভাইয়ের সাথে ঘুরাঘুরি গুলো মিস করবে। তাকে একবারো জানিয়ে গেল‌না ভেবেও অভিমান হয়। কারণ খুঁজে পায় না, এর আগেও তো না বলে গিয়েছে। তখন তো এমন মনে হয়নি। তাহলে? মানুষ টা দুটো দিন ভালোবাসা দিয়েছে বলে এমন হচ্ছে বুঝি? হয়তো তাই। ভালোবাসার কাঙাল রা একটু এরকম‌ই হয়‌। ফাতিন কে যতদূর দেখা যায় আনতারা দেখে, বড়চাচী কে ঘরে ফিরতে দেখে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আনতারা। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বলে উঠে,

~ ফাতিন ভাই কে এবার বিয়েটা করাও বড়চাচী। বয়স তো কম হলো না। ব‌উ থাকলে ঘন ঘন বাড়ি ফিরবে। ফাতিন ভাই থাকলে ভালো লাগে‌।

মিসেস সেলিনা হা না কিছুই বললেন‌ না, নিজের ঘরে চলে গেলেন। আনতারা বুঝলো না বিষয়টা। অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলো। মিসেস কামরুন্নাহার আনতারা’র পাশে বসে বললেন,

~ মন খারাপ ভাবির, ছেলে মেয়ে দুটোই বাইরে। তুই কিছু খাবি?

আনতারা মাথা নেড়ে না করে মিসেস কামরুন্নাহারের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। হুট করেই চোখ ভিজে আসে তার, বাবার আদর বুঝি মিষ্টি হয়? ভেজা কন্ঠে বলল,

~ আচ্ছা ছোটচাচি, বাবা’র আদর কেমন হয়?

মিসেস কামরুন্নাহার আনতারা’র মুখের দিকে তাকালেন, আরেকবার তাকালেন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আহনাফ তালুকদারের দিকে। আনতারা জানে না তার বাবা আজ বাড়িতেই আছে‌। জানলে হয়তো ঘর থেকেই বের হতো না। মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আহনাফ তালুকদারের বুকটা মুচড় দিয়ে উঠে। তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যান ঘর থেকে। কামরুন্নাহার কিছু বলবেন এমন সময় তড়িঘড়ি করে ফরিদ তালুকদার বাড়িতে ঢুকে। স্ত্রীকে হাঁক ছেড়ে ডেকে বলে উঠেন,

~ ক‌ই গো ফাতিনের মা, এদিকে আহো। মেয়ের শশুড়বাড়ি থেকে লোক আসতাছে। রান্না চাপাও।

মেয়ে আসবে শুনে মিসেস সেলিনা হাসি মুখে বের হয়। ফরিদ তালুকদার সাথে করে বাজার নিয়েই এসেছেন। বোনের আসার কথা শুনে আনতারা’র মন টাও ভালো হয়ে যায়। বড়চাচির আগেই বাজারের ব্যাগ নিজের হাতে তুলে‌ নেয় সে। রান্না ঘরে ছুটে যায়, বিকেলের দিকে আসবে, এখন তো দুপুর হয়ে এলো। অনেক কাজ!

তিন নারীর হাতে হাতে কাজ করায় সময় কম ‌ই লেগেছে। তবে আনতারা একটু বেশীই ক্লান্ত। আজ বড়চাচির ব্যবহার আনতারা’র খটকা লাগছে। প্রয়োজনের তুলনায় তাকে আজ বেশীই কাজ করালো। যদিও আনতারা’র আপত্তি নেই তবে কিন্তু একটা থেকেই যায়। মিসেস কামরুন্নাহার ভাবির ব্যবহার শুধু ঠোঁট কামড়ে দেখে গেলেন। মেয়েটার দোষ না থাকা সত্তেও মেয়েটাকে শাস্তি দিচ্ছে। প্রথম বার বলে মেনে নিয়েছে, এরপরের বার এমন করলে সে কিছুতেই মানবে না। ফাতিন কে বাড়ি এনে ঠাস ঠাস করে চড় লাগাবে, তখন বুঝবে জ্বালা। কাজ শেষ হতেই রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে ঢুকলেন মিসেস কামরুন্নাহার। আমির তালুকদার একটু আগেই এসেছেন ভাতিজির আসার খবর শুনে‌। ব‌উয়ের রাগি মুখ দেখে হা হয়ে গেলেন‌। এমন রাগ তার ব‌উয়ের কোনো দিন দেখে নি। শান্তশিষ্ট নরম মনের মেয়েটা রাগ যেন করতেই জানে না। স্বামীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস কামরুন্নাহার বলে উঠলেন,

~ আমার মেয়ের উপর বিনা কারণে চোটপাট করলে আমি কিন্তু মেনে নিবো না। অনেক দেখেছি এদের স্বার্থপরতা। চুপ থাকি বলে এই না যে আমি কথা বলতে পারি না। সংসার একত্র করতে চাইলে তোমার বড় ভাই ব‌উ কে বুঝাও। মেয়ের এক মা মরলেও আমি কামরুন্নাহার কিন্তু মরি নি।

ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন তিনি। আমির তালুকদার বুঝলেন বড়ভাবি আবার আনতারা’র সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। মাঝে মাঝে নিজের‌ও রাগ হয় তবে বড়ভাইয়ের উপর কথা বলতে পারে না বলেই চুপ থাকে‌। আজ মনে হয় একটু বেশীই করে ফেলেছে নাহলে তার ব‌উ এতটা ক্ষেপে যেত না। নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আনতারা’র ঘরের দিকে হাঁটা ধরে সে। একটু সময় কাটানো যাক মেয়েটার সাথে‌।‌ এমনি তো সময় ই হয়ে উঠে না।

বিকেল চারটের মতো বাজে। ফারাহ’র শশুড় বাড়ির লোকজন সবে এলো। লোকজন বলতে ফারাহ, শাশুড়ি, দুই জা, নিরব, নিয়ন, নিবিড়। শশুড়, বড়ভাসুর আসে নি, সবাই আসলে কাজগুলো কে করবে! ফারাহ এসেই বোনের ঘরে ঢুকেছে‌ খোশ গল্পে মেতে উঠেছে। কিছুটা সময় পেরিয়ে যেতেই আনতারা কে সুন্দর একটি থ্রি পিস পড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসে। যদিও আনতারা চাইছিল না। সবার সামনে এসেই আনতারা’র সালাম দেয়। ফারাহ’র শাশুড়ি তীক্ষ্ম চোখে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করে, নাহ চলে! সালামের জবাব দিয়ে বসতে বলে, আনতারা ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকায়।‌ ফারাহ জোর করে বসিয়ে দেয়, ফারাহ’র শাশুড়ি বলে উঠেন,

~ ভাইসাব আপনারে তো বলছিই একটু। আমার ছোট ছেলে রে দিয়া আপনার ভাতিজি কে চাই। কি বলেন?

আনতারা সহ মিসেস কামরুন্নাহার চমকে উঠেন‌। নিতে চায় মানে? আজ তাকেই দেখতে এসেছে? এর জন্য‌ই ফারাহ’র মুখে এত হাসি। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তে ফারাহ’র দিকে তাকালো। ফারাহ তার মায়ের সাথে কথা বলছে। আনতারা আরেক পলক বাড়ির পুরুষদের দিকে তাকালো, তারা স্বাভাবিক। মানে আগে থেকেই জানতো। মিসেস কামরুন্নাহার স্বামীর দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই তার মুখটা অসহায় হয়ে যায়, সে একটু আগেই জানলো। ফরিদ তালুকদার বললেন,

~ আপা আপনাদের সম্পর্কে সব‌ই জানি। তবে মেয়ের সাথে আগে কথা বলা দরকার। আলোচনা করে নাহয় পরে আগাবো।

~ ভাইসাব কি বলেন, আপনেরা যা বলবেন মাইয়া তাই মানবে‌‌। গুরুজন দের উপর মাইয়ার আবার কি কথা থাকবো? আমার পোলা লাখে এক।

আহনাফ তালুকদার ফরিদ তালুকদার কে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। মহিলাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এসেছে। ফরিদ তালুকদার বলেন,

~ কি বলমু আহনাফ। না করে দিলে তো ফারাহ’র উপর অশান্তি হ‌ইতে পারে। কিন্তু আনতারা যে পড়বো।

~ ভাই আমাদের ভাবতে হবে কেন? যেখানে ফারাহ আছে সেখানে আনতারার অসুবিধা হ‌বে না। ছেলে ভালো, বিয়ের পর পড়াবো মনে হয়। আর না করে দিলে সংসারে টিকতে ফারাহ’র সমস্যা হ‌ইবে‌। দুজনের কথায় ভাবা লাগবো।

আহনাফ তালুকদারের কথায় ফরিদ তালুকদার বুঝে তার ভাই রাজি। খুশি হন তিনি। কোনো বাবাই চায় না মেয়ের সংসারে অশান্তি হোক। আবার সবার সাথে গিয়ে বসেন। আহনাফ তালুকদার বলেন,

~ দিন তারিখ কি আজ‌ই ঠিক করবেন আপা?

আনতারা আতকে উঠে। তার একটা কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না‌। বাবার দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকায়। বোঝা তাহলে হয়ে গেছে। নিবিড়ের মুখে চ‌ওড়া হাসি‌। মিসেস নাজমা বললেন,

~ বিয়ের তারিখ ও ঠিক হবে। বলতেছিলাম মেয়ের সাথে কিছুমিছু দিবেন না, সরাসরি কথা বললে ভালা হয় আরকি। বুঝতেই পারতেছেন মেয়ে একটু নিম।

হাসিখুশি ফারাহ’র মুখটা চুপসে যায়। আনতারা মুচকি হেসে আপায়ের দিকে তাকায়, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত নোনা জল। জল টুকু যেন বলছে, এটাই তো চেয়েছিলে আপায়, আমাকে অপমানিত হতে দেখতেই চেয়েছিলে! ফারাহ কথা বলার ভাষা খুঁজে পায় না। স্বামীর দিকে তাকায়, নিয়ন ও যে চমকে গেছে সে বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে‌। পারভিন শাশুড়ির মতিগতি আগেই বুঝেছিলেন, তাই তো নাহিদ কে নিয়ে আসতে তার এত সমস্যা। নাহিদ আসলে যৌতুকের কথা বলতেই পারতো‌ না। নিবিড়ের কোনো হেলদোল নেই। রিনু বলে উঠে,

~ আপনাদের মেয়ের‌ই তো থাকবে, দুই মেয়ে একি বাড়িতে থাকবে কত ভালো হলো আপনাদের। ফারাহ’র বেলায় তো কথা ছিল না তবে আনতারা গাঁয়ের রং এর জন্য একটু তো ছাড় দিতেই হবে বলেন। হয়েই আসছে এরকম।

ফরিদ তালুকদার বুঝেন। আনতারা কে ছাড়াতে এমনিও টাকা লাগতো, তাদের এতে সমস্যা নেই। তবে মেয়েটা কি মেনে নিবে? আনতারা একপলক নিবিড়ের দিকে তাকায়, মাথা নিচু করে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। এই ছেলে কখনো তার যোগ্য হতে পারে না! উঠে দাঁড়ায় আনতারা, ফারাহ হাত টেনে ধরতেই মুচকি হেসে হাত ছাড়িয়ে নেয়। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠে,

~ এভাবে নিলামে তুলার হলে আগেই তুলতে আপায়, ঘটা করে তোলার কি ছিল!

চলে যায় আনতারা। ফারাহ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আনতারা’র যাওয়ার দিক। মিসেস নাজমা ফারাহ’র দিকে কটমট করে তাকায় , তা দেখে ফারাহ আনতারা’র থেকে নজর ঘুরিয়ে বাবাকে বলে,

~ আব্বা সব তো আমাদের‌ই থাকবে, রাজি হয়ে যাও।

~ রাজির পর্ব পরে হবে ফারাহ। আগে খাওয়ার পর্ব শেষ হোক। আমার মেয়ে জলে ভেসে যায়নি, তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।

রান্না ঘরের দিকে চলে যান মিসেস কামরুন্নাহার। মিসেস সেলিনাও পিছু নেন। ডাইনিং সাজিয়ে খেতে ডাকতেই সবাই উঠে আসে। খাবার শেষ হয়। মিসেস নাজমা আর আগের মতো আলাপ জমাতে পারে না। ফারাহ থেকে যায় দু’দিনের জন্য। আর সবাই চলে যেতেই মিসেস সেলিনা মিসেস কামরুন্নাহার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

~ হেরে নাহার, জলে ভেসে যায় নি মানে? আমরা কি জলে ভাসিয়ে দিতাছি নাকি? বেয়ানের সামনে কি বললি? নতুন সংসার, যদি অশান্তি করে।

~ আমি সেসবে এগোতে চাচ্ছি না ভাবি। আমি শুধু জানতে চাই আমার মেয়ের বিয়ের জন্য রাজি হ‌ওয়া হলো অথচ কেউ আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো কি কারণে?

~ তোর মতামত নিতে হবে কেন? ফাতিনের বাপ, আনতারা’র বাপ আছে না?

মিসেস সেলিনা’র এই কথায় মিসেস কামরুন্নাহার হেসে উঠলো‌। স্বামীর দিক তাকিয়ে বলল,

~ তোমার কিছু বলার নেই এখানে?

আমির তালুকদার মাথা নিচু করে নেয়, নরম সুরে কিছু বলবে তার আগেই আহনাফ তালুকদার বলেন,

~ কারো কিছুই বলা লাগবো না। ফারাহ’র সংসার জড়িয়ে আছে এখানে। ছেলে ভালো, না করবো কেন? আমার মেয়ে আমি রাজি।

~ বাপের অধিকার দেখাবেন না ভাই, আপনি বাবা হিসেবে কেমন অনেক দেখছি। ভাতিজির জন্য‌ই তো এত চিন্তা? আর বড়ভাই তো কিছু বলবে না আমি জানি, তার মেয়ের সংসার বাঁচাতে আমার মেয়েকে বলি দিবে। আমি এটা কিছুতেই হতে দিবো না সাফ সাফ বলে রাখলাম। আর তুমি? মিওমিও করা বাদ দাও, এসব আমার একদম পছন্দ না।

নিজের ঘরে চলে যায় মিসেস কামরুন্নাহার। ফরিদ তালুকদার আর আহনাফ তালুকদার স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে আছে। সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। মিসেস সেলিনা তো রাগে ফুঁসফুঁস করতে করতে নিজের ঘরে চলে যান। এই মেয়েকে বিদায় করতে পারলেই তার ছেলের জন্য ভালো। ওমন কালি কে ছেলের ব‌উ করবে না সে। ফারাহ ভাবছে নতুন সংসার, শাশুড়ির কথায় চলে, না করা হলে সংসারে যে ফারাহ’র দাম থাকবে না ঢের বুঝতে পারছে সে। নিবিড় ও গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারবে না যেখানে নাহিদ ই চুপ থাকে। এতক্ষণ আড়াল থেকে সব‌ই শুনছিলো আনতারা। তার মনে হচ্ছে মিসেস কামরুন্নাহার ছাড়া আর কেউ ই তার আপন না, কেউ না। নিজের ঘরে চলে যাবে এমন সময় ফারাহ গলা শুনে থেমে যায় সে,

~ আমার তো সংসারে টিকে থাকা মুশকিল হবে আব্বা। এখন আমি কি করবো? আনতারা একবারো ভাবলো না।

~ আড়াল থেকে বের হয় আনতারা। ফারাহ’র মুখোমুখি দাঁড়ায়। মুখে মুচকি হাসি বজায় রেখেই বলে উঠে,

~ যে আমার আত্মসম্মানের কথা ভাবে না তার সংসারের কথা আমি ভাববো, ভাবলে কি করে আপায়?

চলবে..?