শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-১২

0
250

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ১২)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” জীবনটা এমন কেনো বোন বলতে পারিস? কেনো আমরা পেতে পেতে হারাই? হারাতে হারাতে পাই? আবার সেই পাওয়ার মাঝেও শত ঝড় ঝাপটা। কি অপরাধ আমাদের? জানিনা সামনে আরো বড় কোনো অশুভ কিছু হায়েনার মতো ওঁৎ পেতে আছে কিনা আমাদের জীবনে। ”

” ভাইয়া প্লিজ চুপ করো। একবার ভাবো। যদি তোমার শুভ্রতা এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরদিনের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেতো। তখন তোমার কি হতো? তার চেয়ে সে বেঁচে আছে। আমাদের কাছে আছে। হাঁটবে। চলবে। হাসবে। বলবে। এই কি কম? আমরা এই নিয়েওতো শুকরিয়া আদায় করতে পারি ভাইয়া। তুমি এমন করলে আমাদের মা কিভাবে বাঁচবে বলো। শুভ্রতার পাশাপাশি মা কি কম তোমার আমার জীবনে? ”

বেদনার্ত সুরে বলল উপমা।

” তুই আমার বড় লক্ষি বোনরে। আমার ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার সময়গুলোতে তুই ছোট হয়েও বড়র মতো কিভাবে যে আমাকে সামলে নিস। তোর মতো একটা বোন যেনো আল্লাহ সব ভাইদের জীবনে দেয়। স্রস্টার কাছ থেকে পাওয়া তুই আমার অনন্য উপহার। নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করেও ভাই ভাবিকে নিয়ে পড়ে আছিস। আর আমাদের মা। মা আমার কাছে গোটা পৃথিবী। মা আমার প্রাণ। মা ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার। শুভ্রতা হলো আমার হৃদয়টাকে টাটকা রাখার মেডিসিন। আমার সুখের শুকতারা। বাবাও কি কম বল। বাবা আছে বলেই আমাদের যত দম্ভ। যত শক্তি। ”

আয়মান বোনের কপালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলো। উপমা ভাইয়ের দৃষ্টির অগোচরে ক’ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। মনে মনে বলল,

” এক ভাইকে অকালে হারিয়েছি। আরেক ভাইয়ের সুখ দেখাটাই যে আমার ভালো থাকা। নয়তো আমিই বা কিভাবে ভালো থাকবো।”

আয়মান নিজেও অসুস্থ। তবুও শুভ্রতার জন্য রয়ে গেলো হাসপাতালে। গ্রামে চলে গেলো তার মা, বাবা ও শুভ্রতার মা। তার সাথে রয়ে গেলো উপমা ও শিউলি অর্থাৎ শুভ্রতার বড় বোন।

শুভ্রতার শারিরীক অবস্থা উন্নতির দিকে। সেলাইগুলো শুকিয়ে আসছে। শারিরীক ব্যথাগুলো সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। এক সপ্তাহ পরে তার রিলিজ হলো। গ্রামে চলে গেলো আয়মানসহ বাকি সবাই শুভ্রতাকে নিয়ে। সকাল বিকাল নিয়ম করে শুভ্রতা ও আয়মানের সেবা, যত্ন চলছে। ভাই ভাবির জন্য সবটুকুই করছে উপমা। আমিনা বেগমের গৃহকার্য সামলাতেই নাভিস্বাস উঠে যাচ্ছে। কেননা আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী রাতদিন আসা যাওয়া করছে। দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা লতিফ খানের পুত্র ও স্মৃতিশক্তি হারানো পুত্রবধূকে দেখতে সবার আনাগোনা তার ঘরে। আমিনা বেগম মসজিদে একটি খাসি দান করলেন এতিম বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। দূর্ঘটনার সংবাদ পেয়েই তিনি মানত করেছেন ছেলে ও ছেলের বউয়ের জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য। আয়মানের বাবাও দানা খয়রাত করেছেন দুহাত ভরে। শুভ্রতার মা বাবাও মানত করেছেন। তারাও সেই মানত পূরণ করেছেন মেয়ে ও মেয়ের জামাইর জীবন ফিরে পেয়ে।

পনেরো দিন পরে জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে আয়মান নিজের হাতের প্লাষ্টার খুলে নিলো। সে এখন অনেকটাই সুস্থ। শরীরে ব্যথা,বেদনা নেই বললেই চলে। শুভ্রতার শারিরীক অবস্থাও উন্নতির দিকে। তবে ধীর গতিতে হচ্ছে। নিদিষ্ট সময়ে শুভ্রতাকে নিয়ে আয়মান আবার ঢাকায় গেলো। শুভ্রতার শরীরের বিভিন্ন স্থানের সেলাইগুলো খুলে নিলো। ডাক্তার জানালো, স্মৃতিশক্তি ছাড়া বাকি সব ঠিক আছে। আর কোনো সমস্যা হবেনা আশাকরি। আর মেমোরিও ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বহুদিন পরে। এমনকি কয়েকবছর ও লেগে যেতে পারে।

আয়মান কোথাও গেলে শুভ্রতার গা ঘেঁষে বসার বা কথা বলার চেষ্টা করেনা খুব দরকার না হলে। পাছে যদি শুভ্রতা চিৎকার দেয়। তখন ভারী বিব্রতকর সিচুয়েশনে পড়তে হবে। এই ভিতরেই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে আয়মান। পরে বোনকে জিজ্ঞেস করলো,

” এই উপমা শোন। আচ্ছা শুভ্রতার সাথেতো কারোই কোনো সমস্যা হচ্ছেনা জীবনযাপনে। কিন্তু আমি তাকে ছুঁতে গেলেই সে সরে যায়। আজবনা বল? এভাবে কিভাবে কি হবে আমারতো মাথায় ধরছেনা?”

” আমরা কেমন চলি? খুব বেশী ভিড়িনা তারসাথে। তুমিও এমন চলো। এতেই কাজ হবে আস্তে আস্তে। মন খারাপ করোনা ভাইয়া। শুভ্রতা বেঁচে আছে। তোমার ঘরে আছে। তোমার বউ এখন সে। এই কি কম?”

” তা অবশ্য মন্দ বলিসনি তুই।”

বিরস কন্ঠে মলিন বদনে বলল আয়মান।

আয়মান ওদের মতই শুভ্রতার থেকে দূরে দূরেই থাকে। অসুস্থ হওয়ার পর হতে একই রুম হলেও আলাদা বিছানায় ঘুমায়। এছাড়া উপায়ও নেই। শুভ্রতা প্রায় সুস্থ এখন। তার বাবার বাড়ি গিয়েও বেড়িয়ে আসলো কিছুদিন। মা বাবা বোনকে সে কিছুটা চিনে এখন। আয়মান তাকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় সিনেমা দেখতে গেলো। সিনেমা দেখা শেষে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেলো। নিরব রাস্তায় দুজন কপোত-কপোতী দেখে পুলিশের সন্দেহ হলো। পুলিশ তাদের আটকালো। পরিচয় জানতে চাইলো। আয়মান বলল,
“আমরা স্বামী স্ত্রী। সিনেমা দেখে ফিরছি।”

পুলিশ শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করলো,

” উনার কথা সত্যি?”

” নাহ। আমি উনাকে চিনিনা।”

” তাহলে অপরিচিতজনের সাথে সিনেমা দেখতে গেলেন কেনো?”

আয়মান পুলিশকে ঘটনা খুলে বলল। তারা বিশ্বাস করলনা। পরে আয়মানের বাড়িতে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলো এবং সরি বলল। আয়মান বাড়ি এসে শুভ্রতাকে ইচ্ছেমতো বকা দিলো রাগত স্বরে।

আমাকে চিননা তুমি? নাহ? নাকি হেয়ালি করছো? চেনার চেষ্টাটুকুও করছনা। যেহেতু চিনইনা। আমিও আজ থেকে তোমার সম্পর্কে আর কিছুই জানিনা। কোনো কথা নেই আর। অনেক জ্বালিয়েছো। অনেক। আর টলারেট করতে পারছিনা শুভ্রতা। কি পাপ করলাম জীবনে। কি পাপের শাস্তি খোদায় আমাকে দিচ্ছে জানিনা। কতটা কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তোমাকে পেতে। তাতো কেবল আমিই জানি। কত স্বপ্ন ছিলো তোমাকে নিয়ে। কত প্ল্যান ছিলো ছোট বড়। এটা করবো। ওটা করবো। এভাবে এনজয় করবো। ওভাবে দুষ্টমি করবো। সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। স..অ..ব। এই পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই ঢের ভালো ছিলো। সামনে আছো। অথচ তোমাকে ধরা যায়না। ছোঁয়া যায়না। শোয়া যায়না। ভালো করে কথাও বলা যায়না। থাকো তুমি তোমার মতো করে। আমি গেলাম বলে আয়মান তার বালিশ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

তার পরেরদিন শেষ বিকেলের দিকে উপমা শুভ্রতাকে বলল,

” জানি তোমার মন ভীষণ খারাপ। ভাইয়া রাতে বকা দিয়েছে। আমি মা সব শুনেছি। কিন্তু আমরা গেলে ভাইয়া আরো ক্ষেপে যেতো।”

শুভ্রতা এদেরকেও এখন কিছুটা চিনে। শুভ্রতা উপমাকে বলল,

” আচ্ছা আমি না বিধবা। উনি না আমার ভাসুর?”

” ভাবি সে তোমার ভাসুর ছিলো। সেটা অতীত। বর্তমান হলো সে এখন তোমার বিয়ে করা স্বামী। এটা মাঝখান দিয়ে ঘটে যাওয়াতে তুমি কানেক্ট করতে পারছনা। আমাদেরকে বহুদিন ধরে দেখেছো। কাছে পেয়েছো। তাই অনেকটা চিনতে পারছো। কিছুদিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ। আমি বাজারে যাবো একটু দরকারে। তুমিও চলো ঘুরে আসবে। ভালো লাগবে তোমার।”

” আচ্ছা চলো।”

শুভ্রতা ও উপমা মাথায় ওড়না দিয়ে তাদের স্থানীয় বড় বাজারের দিকে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে। গ্রামের নির্জন অন্ধকার মেঠোপথ। কিছুদূর যেতেই শুভ্রতা ও উপমাকে পিছন থেকে কেউ টেনে ঝোপের ভিতরে নিয়ে গেলো। তারা চিৎকার দেওয়ার আগেই কোনো বলিষ্ঠ হাতের চাপায় পড়ে গেলো তাদের দুজনের মুখ। অপরিচিত তিনটি ছেলে। তাদের মুখ ঢাকা। আবছায়াতে চেনাও যাচ্ছেনা। একজন উপমাকে শুইয়ে দিলো। উপমার কামিজের চেইন খুলতে খুলতে বলল,

তোর ভাইয়ের জন্য আমরা জেল খেটেছি। আমাদের আড্ডার আসর শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ছোট ভাইয়ের বউকে বিয়ে করে তোর ভাই। শখ কি তার। সেতো আমাদের চেয়েও খারাপ। গ্রেট নাম্বার লুইচ্চা। তোরা দুই ননদ ভাবির থেকে আজ এর বদলা নিবো সুদে আসলে। আমাদের ধরার সুযোগ নেই। দুদিন পর ফ্লাইট। বিদেশ চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোদের থেকে মজা নিয়ে নিই। কি বলিস। আর তোর ভাবিতো এখন কাউকেই চিনেনা। সুবর্ণ সুযোগ।

চলবে…১২ ( ১৩ তে শেষ হবে)