শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-১০

0
196

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ১০)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
শুভ্রতা বেকুবের মতো বোকা বোকা চাহনিতে মেসেজটি বার দুয়েক পড়লো। তার মনে হলো সাঁই সাঁই করে একটা রকেট তার মাথায় উপর দিয়ে চলে গেলো বাজখাঁই শব্দ করে।

আয়মান আসার আগেই মুঠোফোনটি পূর্বের স্থানে রেখে শুভ্রতা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো উপলার রুমে। শুভ্রতা চুপ থেকে আয়মানের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। বুঝতে চায় মেসেজের কথাগুলো সত্যি না মিথ্যা।

কিছুসময় পর আয়মান ঘরে এলো। এসেই বোনের রুমে ঢুকলো। দেখলো শুভ্রতা ও উপমা কথা বলছে। শুভ্রতাকে উদ্দ্যেশ্য করে বোনকে বলল আয়মান ,

” উপমা আমার রুমে এক মগ কফি নিয়ে আয়তো বানিয়ে। ধোঁয়া উঠা হতে হবে। বাইরে হালকা শীত পড়েছে। কফি খেয়ে শরীর মন চাঙ্গা করা অত্যাবশ্যক। ”

উপমা ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি তাক করে ধরলো। আঙ্গুল উঁচিয়ে বোবা ভাষায় জিজ্ঞেস করলো,

” ইউ আমাকে বলছো কফি বানাতে ও নিয়ে যেতে?”

” হুম। তোকেইতো বলছি।”

শব্দ করে বলেই আয়মান পা বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

উপমা শুভ্রতার চিবুক নেড়ে বলল,

” যাও সখী। স্বামীর আদেশ পালনে সদা সচেষ্ট হও।”

” বলছে তোমাকে। আমাকে নয় ননদী। ”

‘” ‘বৌকে মেরে ঝিকে শেখানো ‘ বাগধারা এটা পড়নি? যাও বলছি। ফাজিল। বেত্তুমিজ নারী। স্বামী সেবায় মগ্ন হও।”

নাক কুঁচকে আদেশ করে বলল উপমা।

এখন শুভ্রতার মন ভালো নেই।
আয়মানের সামনে তার যেতে ইচ্ছে করছেনা। কেনো যে এই মানুষটাকে অপছন্দ করার কারণগুলো সেই শুরু থেকেই ঘটে যাচ্ছে। কোন জনমের শত্রুতা স্বামীরূপী এই আয়মানের সাথে। ভাবতেই অস্থির হয়ে এলো তার চিত্তখানি।

শুভ্রতা উপয়ান্তর না পেয়ে উঠে গেলো। সিলেন্ডারের গ্যাসে পানি ফুটিয়ে কফি বানিয়ে নিলো। আয়মানের সামনে গিয়ে কফি মগ রাখলো। আয়মান পিসি টেবিলে বসা। হাত চলমান কিবোর্ডে। টাইপিং এ বিজি। শুভ্রতা পা ঘুরিয়ে নিতেই তার একহাতে টান পড়লো পিছন থেকে। আয়মানের বলিষ্ঠ হাতের চাপায় মুঠোবন্দী হয়ে গেলো শুভ্রতার কোমল হাতখানি। হ্যাঁচকা টানে শুভ্রতাকে নিজের দিকে ভিড়িয়ে নিলো আয়মান।

” প্রেমিককে এখনো ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধায় আছো প্রেমিকা?”

গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।
” এখন কিসের প্রেমিক আপনি? এখন হলেন কারো বর।”

আয়মান হোহোহো করে হেসে উঠলো। বলল,
” ওরেব্বাস! যাক তবুও এই অধমের শান্তি। স্বামী মানো বলে। নইলে চৈত্রের শিমুল তুলার মতো উড়ে উড়ে যেতাম কোন সূদুরে। যেহেতু প্রেমের কালে প্রেম করতে পারিনি। তাই এখন সেই প্রেমের সাধ মিটাতে হচ্ছে এভাবেই। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাকে বলে।”

” আপনার ধোঁয়া উঠা কফি জুড়িয়ে শরবত হয়ে যাচ্ছে। ”

” ওহ হো! তাইতো। তুমি একটু খেয়ে দাওতো প্লিজ।”

আয়মানের সাথে অহেতুক কথা পেঁচানোর রুচিবোধ নেই এখন শুভ্রতার। তাই ঝটপট দু’চুমুক কফি খেয়ে দিলো। আয়মান সেই কফি মুখে দিয়েই আবেদনমাখা কন্ঠে বলল,
আহ শান্তি! জীবন যেনো মধুর পেয়ালা। প্রতি চুমুকেই দারুণ স্বাদ। এবার যেতে পারো। রাতে বেশী অপেক্ষায় রেখনা। চলে এসো। আমার মোবাইলইটা দাওতো।

শুভ্রতা আয়মানের মোবাইলটা হাতে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অসহিষ্ণু মনে। আয়মান হোয়াটসঅ্যাপে আসা নিউ মেসেজটায় ক্লিক করলো। চোখ কপালে তুলে বার কয়েক পড়লো। শরীরের র’গগুলো দাপাদাপি করছে তার। মস্তিষ্কের সমস্ত মগজগুলো টগবগ করে ফুটছে ফুটন্ত পানির ন্যায়। কোন হারামী করলো এই নিকৃষ্ট কাজ। এটা বের করতেই হবে, ভেবে মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল হাতে নিয়ে মা বাবার রুমে গেলো। যাওয়ার সময় উপমাকেও ডাক দিলো।

গরম কফি খেয়ে তোমার জামাইর মেজাজ হট হলো কেনো? দেখিতো বলে উপমা মা বাবার রুমে গেলো।

আয়মানের কন্ঠের উদ্বিগ্নতা দেখে শুভ্রতা বুঝে নিলো যে মেসেজটা এখন দেখেছে। শুভ্রতা বিড়াল পায়ে শশুর শ্বাশুড়ির রুমের পাশে গিয়ে লুকিয়ে তাদের কথা শুনার চেষ্টার করলো।

” মা, আমার কি কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো যেটা তুমি জানো?”

” তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলামনা। কি হয়েছে খুলে বল?”

” অনেক আগে না ছোট খালার মেয়েকে বিয়ের কথা বললা তুমি? তাই জানতে চাচ্ছি।”

” আরেহ ওটাতো ফাজলামো ছিলো। ওরতো বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনেই মাসেই বিয়ে।ছেলেকে সে ভালোবাসে।”

” ওহ। বুঝলাম। ”

আয়মান মেসেজটা ওপেন করে ওদের সামনে ধরলো। পড়ার পর তারা তিনজনেই চমকে উঠলো চরম উৎকন্ঠায়। লতিফ খান বলল,

” এটা তুই যে ছেলেদের পুলিশে দিয়েছিস তাদের কারো কাজ নিশ্চিত। তুই রিপ্লাই দে। যে দিয়েছে তাকে।”

” বাবা ফেইক প্রোফাইল। আমি রিপ্লাই দিতে গিয়েই দেখি ব্লক করে দিয়েছে আমাকে।”

” ভাইয়া আব্বার কথাই ঠিক। সেই পশুগুলোর কেউই তোমাকে মেন্টালি প্রেসারে রাখার জন্য ভুয়া মেসেজ পাঠালো। আর কিছুটা মিলেছে এইজন্য, তুমি এমন কারো কাছে হয়তো বলছ যে আর বিয়ে করবেনা। যেটা মেসেজদাতা জানে। ব্যাস। ভেরি সিম্পল। এত অরিড হওয়ার কিছুই নেই। খাল্লি বাল্লি। রিমুভ করে দাও ভাবি দেখার আগেই।”

” থ্যাংকস গড! শুভ্রতা দেখেনি। ”

আয়মান মেসেজ রিমুভ করে দিলো। শুভ্রতা লম্বা লম্বা পায়ে উপমার রুমে চলে গেলো । নিজের মাথায় চাটি মেরে হেসে ফেলল মিটমিটিয়ে, ভুল বুঝতে যাচ্ছে বলে আয়মানকে।

রাতের নৈশভোজ সম্পন্ন হলো পারিবারিক নানা গল্পগুজবে। শুভ্রতা হাতের কাজ সেরে নিজেদের রুমে গেলো। শুয়ে পড়ল। আয়মান শুভ্রতার আঙ্গুল, চিবুক,চুল ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল। শুভ্রতার প্রতিটি ভাঁজে শিহরণ জাগাতে চায় সে এই নিরব আঁধার কালো রাত্রিতে। পবিত্র ভালোবাসার অজস্র শৈল্পিক কারুকাজে সাজিয়ে তুলবে কামনার অনুভবকে। শুভ্রতা কলার মোচার মতন অগুনতিবার পাক খাচ্ছে বিছানার এপাশ ওপাশ করে। তীব্র স্বাসে বুক উঠানামা করছে তার।

আয়মান শুভ্রতার মাথাকে নিজের বাহুর উপরে টেনে নিয়ে আসলে। নেশাতুর কন্ঠে বলল,

বিয়ের দ্বিতীয় রাতেও যদি বাসর না হয়। মানায় বলো। আমরা দুজনেই এডাল্ট। ক্ষতিটা কি বল। শোন মোর রমনী, উতলা করো এই রজনী।

নিশি উতলা হলো। এক মানব প্রেম পূর্ণতা পেলো। পরিপাটি বিছানা এলোমেলো হলো। একে একে স্বর্গের অন্দরমহলের প্রতিটি দ্বার ভালোবাসার চাবি দিয়ে উম্মুক্ত করে ফেলল আয়মান। সঙ্গী হলো শুভ্রতা নামের এক মানবী। তলিয়ে গেলো দুজনে সুখের অতলান্তে।

ভালো হোটেল বুক করা যায়নি বলে আয়মান ও শুভ্রতার হানিমুনের ডেট হলো এক সপ্তাহ পরে। লোকাল বাসে না গিয়ে কার ভাড়া করে নিলো আয়মান। কারণ শুভ্রতার যেনো এতটুকু অস্বস্তি না লাগে পথে। যেনো চাইলেই গাড়ি থামানো যায়। বিবর্ণ শীতের আগমনী সুর প্রকৃতিজুড়ে। গাড়ি ছুটে চলছে দুর্বার গতিতে। নিদিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলো দুজন। আয়মান এক পৃথিবী আনন্দ ও সুখ সুখ মনে শুভ্রতাকে নিয়ে সমুদ্রবিলাস করলো। এবং শপিং করলো সবার জন্য।

চারদিন পর কক্সবাজার থেকে আয়মান শুভ্রতাকে নিয়ে রওনা দিলো গ্রামের উদ্দেশ্যে। লোকাল বাসে না চড়ে একটি প্রাইভেট জীপ ভাড়া করে নিলো আরামে আসার জন্য। শুভ্রতা আয়মানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কথাপ্রসঙ্গে শুভ্রতা আয়মানের হাত পেঁচিয়ে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,

” আপনার আবেগ, ভালোবাসা দেখলে মনে হয় কোন তরুণ ছেলে প্রেম করছে।”

গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে আয়মান বলল,

” শুভ্রতা তুমি এটা বোঝো?”

” খুউব। না উপলব্ধি করতে পারলে বললাম কিভাবে? ”

” অসম্ভব প্রিয় কিছু হারাতে হারাতে হঠাৎ পেয়ে গেলে সেই অনুভূতি দারুণ সুখের। সীমাহীন আবেগের।”

অনুভব করে দেখনা। বলল আয়মান।

” অবশই অনুভব করতে পারি।”

” ভালোবাসি তোমাকে আমি লবনের মতো। বুঝলে আমার স্বপ্নের মানসকন্যা। প্রেমের কল্পতরু। এই বেপরোয়া আনন্দ। লাগামহীন উচ্ছ্বাস শুভ্রতা তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। ”

আয়মানের বুকের গহীনে প্রণয়ের উথাল-পাতাল সুখ। যার কোন থই নেই। কূল নেই। সীমানা নেই। এ যেনো মহাকালের দিকে যাত্রা করা এক দিগন্ত হারা পথিক। যার বুকে এক সমুদ্র পিপাসা। যার তৃষ্ণার্ত হৃদয় জল পান করতে চায় আজলা ভরে। শুভ্রতাও প্রচন্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছে আয়মানকে। ভালোবেসে সুখী করতে চায় তার এই প্রেমিক পুরুষটাকে।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে দোল খেতে খেতে দুজনের চোখজুড়ে গভীর ঘুম নেমে এলে।

গন্তব্যর কাছাকাছি আসতেই আকষ্মিক গাড়ি ব্রেক ফেল করলো। শুভ্রতা আয়মান জেগে গেলো চালকের ডাকে। আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। চালক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রাণপণ চেষ্টা করেও। গাড়ি গিয়ে রাস্তায় ধারের বিশাল এক গাছের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো। উল্টে পড়ল গভীর শুকনো খালের ভিতরে।

আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। রাস্তার কর্তব্যরত পুলিশ এগিয়ে এলো। তিনজনকেই নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করলো। আয়মানের মোবাইলের ডায়াল নাম্বার চেক করে ফোন করা হলো তার পরিবারের কাছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আয়মান ও শুভ্রতা।

চলবে…১০