#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি
পর্বঃ২১
বিরতহীন ভাবে হেসে চলেছেন উনি কিন্তু চোখেমুখে কেমন বিষাদের ছায়া৷ চাঁদের আলোয় চোখের কোণে পানির চিকচিক গুলো আমার ভেতরের সমস্ত খুশি এক নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে দিলো৷ আমি প্রশ্ন করার আগেই সে কাঁপা কন্ঠে বললেন,
–‘ আমি তোমাকে ভুলতে চাই না হৃদি! একদম ভুলতে চাই না৷ ‘
–‘ আপনার চোখে পানি কেন??’ আমার কথা শুনে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে নিজেই পানিটুকু মুছে নিলেন৷ সমস্ত উপশিরা গুলোতে রক্তের গতি দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলো৷ একমুঠো ভালোলাগায় শরীরের ভেতর কম্পন জানান দিলো৷ ভালোলাগা গুলোকে দূরে ঠেলে আমি বিচলিত গলায় বললাম,
–‘ শরীর খারাপ লাগছে আপনার?? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? নোমান ভাইয়াদের ডাকি আপনি একটু অপেক্ষা করুন৷ ‘ বলেই আমি সামনে যাওয়ার জন্য পাঁ বাড়ালাম৷ কিছু দূরেই নোমান ভাইয়ারা আছে৷ অজানা আশংকায় ভেতরটা হু হু করছে৷ আমি দু পাঁ বাড়াতেই হাত ধরে টেনে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
–‘ নোমান কিছু করতে পারবে না৷ কিন্তু আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা সব করতে পারবে৷ মুছে দিতে পারবে আমার আমিকে৷ খুজে দিতে পারবে আমার সুখ গুলোকে৷ ‘
–‘ দিবো আমি৷ আপনার আমিতে থাকবো আমি৷ কিন্তু হয়েছে আপনার? আমার বড্ড টেনশন হচ্ছে৷ ‘
আমার বিচলিত কন্ঠের প্রত্যেকটা কথা তার মুখের তৃপ্তির হাসিতে ভরে উঠছে৷ জানার আগ্রহ থাকলেও আমি উনার সুস্থতা কামনা করছি৷ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন উনি৷ আমি খানিকটা অবাক হলাম৷ উনার অতিরিক্ত অসুস্থ বোধ হচ্ছে কি?? আমি কিছু বলতে গেলেই ইশারায় থামিয়ে দিলেন৷
অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলছে৷ আকাশ জুড়ে দু চারটে তারার মেলা বসেছে৷ গ্রাম বাংলায় মেলার শেষ দিনে যেমন ছাড়া ছাড়া ভাব থাকে সেই তারা গুলোর মাঝেও ছাড়া ছাড়া ভাব৷ যেন কিছু মূহুর্ত পরেই তারা সব ভেঙে নতুন উদ্দেশ্যে পারি জমাবে৷ হঠাৎ চোখে পড়লো দূরে একটা শুটিং ষ্টার৷ নিমিষেই হাওয়া হওয়ার আগে আমি একনাগাড়ে বললাম,
‘ আমার উনাকে চাই! ‘ ‘ আমার তোমাকে চাই! ‘
‘ আমার উনাকে চাই! ‘ ‘ আমার তোমাকে চাই! ‘
‘ আমার উনাকে চাই! ‘ ‘ আমার তোমাকে চাই! ‘
তিনবার বলেই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম৷ মনে হচ্ছে,এইতো পেয়ে গেছি তাকে৷ আমি আকাশ পানে থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি৷ এইভাবে কেউ বলে?? আমি তো বিরবির করে বলেছিলাম তবে সে উচ্চস্বরে মোবাইল হাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছেন৷ ইশ!
–‘ লুক এট৷ ‘
আমি চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেই ছবিটা৷ কুঁকড়ো চুল গুলো নুডুলসের মতো প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে আছে৷ সাদা রঙের জর্জেটে শাড়ির আঁচলটা মাটিতে ল্যাপ্টে আছে৷ এই ছবিটা দেখেই মনে পরলো,আমি তখন আঁচল টেনে উঠাচ্ছিলাম৷ জীবনের প্রথম শাড়ি পরার ঝামেলায় রাগান্বিত ছিলাম তবে এখন সাদা আর শাড়ি মানেই খুশিতে লাফানো টাইপ ফিলিংস৷ আমাকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি হঠাৎ করেই মোবাইল অফ করে ফেললেন৷
–‘ একদম নজর দিবা না সে আমার৷ ‘
–‘ নজর কোথায় দিলাম৷ ছবির মালিক আপনার সামনেই দাঁড়ানো৷ ‘
–‘ বিশ্বাস করা যায় না কাউকে তাই আমি সবসময় সেফ থাকি কে আবার নজর টজর দিয়ে দেয়৷ ‘
মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে এলো আমার৷ ইচ্ছামতো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হলেও চুপ থেকে থমথমে গলায় বললাম,
–‘ অনুমতি বিহীন ছবিটা তোলার অপরাধে আপনার জেল হতে পারে সেটা জানেন??’
–‘ তোমার মনের জেলে বদ্ধ হতে আমি প্রস্তুত ৷ পড়াও হাত কড়া আমি আটকে থাকতে রাজি৷ ‘
আমি সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ কে বলবে একটু আগে তার চোখে পানি ছিলো?? আমি ঝাঁঝালো কন্ঠে কিছু বলার আগে সে বলল,
–‘ এই ছবিটা ভুল করে আমার কাছে এসে পরেছিলো জানো?? ‘
–‘ আমি জানতাম আপনি চিনেন আমায়৷ ‘
মন খারাপ করে বললাম৷ বুক পকেট থেকে একটা চিরকুট বারিয়ে দিলেন আমার সামনে৷ আমি পরিশ্রান্ত হাতে তুলে নিয়ে খুলে দেখলাম আমার হাতের লেখা একটা চিরকুট৷ আমি আবার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ এইটা পেলেন কোথায়?? ‘
–‘ ওইযে বললাম ভুল করে! ‘
আমি নির্বাক৷ একরাশ অভিমানের পাহাড় জমা হলো৷ মুখ ফুঁটে প্রশ্ন করলাম, ‘ আর ভালোবাসা?? ‘
আমার কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলেন উনি৷ অভিমানের পাহাড় গুলোকে এক নিমিষেই ভুলিয়ে দিয়ে উনি বললেন,
–‘ নিজেকে ভুলে যাবো তবুও তোমাকে না৷ ‘
আমি হাসলাম৷ সূক্ষ্ম কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, ‘ কি ভাবে ভুল করে পেয়েছেন?? ‘
–‘ তুমি সুগন্ধা বিচে গিয়েছিলে তিন ইয়ার আগে আমি প্রকৃতির ছবি ক্যাপচার করছিলাম উদাসীনতা নিয়ে আর তখন ক্যামেরায় এক পরী আবদ্ধ হয়৷ আমি তখনো ক্যামেরা ঘেটে দেখি নি পরে হোটেলে ফেরার পর চেক করতে গিয়ে শুভ্র পরীরে খুজে পাই৷ তড়িৎ গতিতে ব্রেন জানান দেয়,তাকে আমার চাই৷ ছুটে বিচে এলেও তার দেখা না পেয়ে এই ছোট চিরকুটের মধ্যে তার ছোঁয়া পাই৷ ‘
–‘ ওয়েট ওয়েট! সুগ্নধা বিচ?? আমি কখনো যাই নি৷ এইবার গিয়েছি আপনাদের সাথে৷ এই ছবিটা হাতিরঝিলের৷ আর ওই চিরকুট আমি হাতিরঝিল ফেলেছিলাম৷ এই প্রথম আমি কক্সবাজার এসেছি৷’
আমার কথা শুনে উনার হাসি মুখ নিমিষেই কালো হয়ে গেলো৷ মাথা চেঁপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো৷ আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি৷ উনি আস্তে-ধীরে বালুর উপর বসে পরলো আমি ভয় পেয়ে যাই৷ আমিও উনার পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখতেই ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,
–‘ আদি বা নোমানকে ফোন করো৷ আমি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না৷ ‘
–‘ কি হয়েছে আপনার?? ‘ আমার কথার উত্তর দিলেন না উনি৷ আমি মোবাইল বের করে ফোন দিলাম আদি ভাইয়ার নাম্বারে৷ কাঁপা কন্ঠে বললাম,
–‘ ভ..ভাইয়া উনি অসুস্থ ! প্লিজ জলদি আসুন৷ ‘ আর একটা কথাও আমি বলতে পারছি না৷ শরীর হাত-পাঁ কাপছে উনার দিকে তাকিয়ে৷ সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনে৷ উনি বলেছিলেন,সহ্য করতে পারবে তো?? তারমানে বড় কোনো অসুখ বুঝি তার?? ভেবেই বুকের মাঝে ছ্যাৎ করে উঠলো৷
আমি তার হাত নিজে থেকে ধরে বললাম,
–‘ আমি সব সহ্য করতে পারবো৷ বলুন প্লিজ আমায়৷ আমি জানি না আপনি হাতিরঝিলের সাথে কক্সবাজার মিলাচ্ছেন কেন?? ‘
–‘ মস্তিষ্কের স্নায়ুর কার্যক্ষমতা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়৷ ছোট থেকে বিষন্নতায় ভুগে চলেছি আর সেইটা ধরে রেখেই আজ এই পর্যন্ত এসেও সাফার করতে হচ্ছে৷ ডাক্তারের ভাষায় ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি রয়েছে৷ আর যেটার মূল কারণ হাজার থাকলে ডিপ্রেশন প্রভাবিত করছে আমায়৷ ইম্পোর্ট্যান্ট জিনিস গুলো একটার সাথে আরেকটা মিলিয়ে ফেলি৷ দিনে দিনে সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ কিন্তু স্পেশাল মানুষ আর স্পেশাল মোমেন্টে আমার ব্রেনের কার্যক্ষমতা কম হবে আমি বুঝতে পারি নি৷ আমি মনে করতে পারছি না হৃদি৷ হাতিরঝিলের ঘটনা আমি কক্সবাজারর উদাসীনতায় ভেবেছিলাম বলেই আমার কাছে মনে হচ্ছে, তোমাকে আমি এখানে দেখেছি৷
চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পর হাতিরঝিলের পরন্ত বিকেলে ভুল করে ক্যামেরায় বন্ধি হয়েছিলে তুমি আর দেখো,আমার স্পেশাল ঘটনা কোন জায়গার আমি মনেই করতে পারছি না৷ দোটানায় ভুগছি৷ ‘
আমি কাঁদছি তবে তার দোটানার জন্য নয়! তার চোখে হাজার বেদনা দেখে৷ মনের মাঝে বলছে,সে ভালো নেই৷ আমি কেঁপে উঠা কন্ঠে বললাম,
–‘ সব সময় এমন হয়?? ‘
–‘ যখন অতিরিক্ত বিষন্নতায় ঘিরে থাকি তখন এই সমস্যা দেখা দেয়৷ ‘
–‘ মাঝে মাঝে??’
আমার কথা শুনে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন আমার দিকে৷ মাথা ঝাকিয়ে বললেন,’ হুম !’
চুপ করে গেলাম আমি৷ উনি আবার বললেন,
–‘ জানো?? তুমি রেস্টুরেন্টে চড় মারলে তখন আমি চিনতে পারি নি৷ তোমায় আমি খুজেছি তিনটে বছর৷ সাদা শাড়ি পরে যখন ভুল করে মেরেছিলে তখন মনে হয়েছিলো তোমাকে জাস্ট ফিনিশ করে দেই৷ কতো বড় স্পর্দা ভাবো তোমার??বাট পেছন ফিরে খোলা কুঁকড়ো চুলে যখন ঘুরলে মন জানান দিলো,এইতো সেই আমার শুভ্র পরী যাকে খুজেছি প্রত্যেক মিনিট, প্রত্যেক সেকেন্ড৷ ‘
–‘ আপনার ভালোবাসা গুলো সত্য আর আমি সেইটা মানি৷ তাই আর কিছু ভাবতে চাই না৷ আপনি ভালো থাকবেন এখন থেকে প্রত্যেক টা সেকেন্ড৷ আর সেই ভালো থাকার কারণ হবো আমি৷ ‘
–‘ বিষন্নতার গল্প শুনবে না?? ‘
–‘ না আমি সুখের গল্প শুনবো আর সেই গল্প গুলা আপনার আর আমার হবে৷ ‘
_____________________________
কক্সবাজার থেকে ফিরেছি দুদিন হয়ে গেলো৷ সেন্টমার্টিন যাওয়া ক্যান্সেল করা হয়েছে স্নিগ্ধ স্যারের অসুস্থতার জন্য৷ সেদিন রাতে ফিরে আরো অসুস্থ হয়ে পরেন উনি৷ আমার হাঁসফাস অবস্থা তাকে দেখে৷ নোমান ভাইয়ারা সিলেট ফিরে গেছেন কাল৷ আমি আজ ভার্সিটি থেকে সোজা বাসায় এসে উঠতেই আম্মু কিঁছু বলার আগেই আমি বললাম,
–‘ আম্মু কিছু একটা চাইলে তোমরা আমাকে দিবে?? ‘
আম্মু হাতের কাজ রেখে বলল,
–‘ ভার্সিটি থেকে না বলে এসেছিস কেন?? ‘
–‘ আমার কথা শুনো আগে৷ আমি থাকতে পারছি না আর৷ ‘
আমি কান্নার সুরে বললাম৷ কি ভাবে বলবো কথাটা ভেবেই গলা শুকিয়ে এলো৷ পাশে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
–‘ আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি আম্মু৷ তোমরা সাপোর্ট করবে কিনা জানি না তবে আমি সেই সিদ্ধান্ত থেকে একদম নড়চড় হবো না৷ ‘
–‘ কি সিদ্ধান্ত৷ ‘ আম্মু সন্ধিহান চোখে তাকাতেই আমি বললাম,
–‘ আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো আম্মু৷ ‘
চলবে…
#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি
পর্বঃ২২
চারদিকে থমথমে ভাব জানান দিচ্ছে আমার বলা শব্দ গুলো ঝড়ের পূর্বাভাস৷ দক্ষিণের জানালা দিয়ে মৃদু বাতাসের সাথে ভ্যাপসা গরম ঠিকরে পরছে৷ আমি বারবার শুকনো ঢোক গিলছি৷ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সারা ঘরময় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ আম্মু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে আমি বরাবর পরাজিত সৈনিকের ন্যায়৷ আম্মু ধারালো কন্ঠে বলল,
–‘ ফাজলামো করছিস আমার সাথে? ‘
–‘ আমি ফাজলামোর মুডে নেই আম্মু৷ সিরিয়াস ভাবে বলছি আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো৷ ‘
–‘ গত বার যখন রেনুকা ফুপু ওই জাপানি ছেলের খোজ দিলো মানা করলি কেন?? পরিবার উচ্চশিক্ষিত সাথে ছেলেও লাক্ষে একটা ছিলো৷ ওই ছেলের বিয়ে হলো গত সপ্তাহে! আর এখন হুট করে এসে বলছিস বিয়ে করবি৷ বললেই হয় নাকি? ‘
আমি আবারো পানির গ্লাস উঠিয়ে গলা ভেজালাম৷ শব্দ আটকে আসছে৷ গুছিয়ে রাখা শব্দ গুলো অগোছালো৷ মায়ের সামনে এইভাবে বলা যায় বুঝি? তবে আমি নিরুপায়৷ গলা কাঁপছে তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম,
–‘ আমি একজন কে ভালোবাসি আম্মু আর তাকেই বিয়ে করতে চাই৷ ‘
আমার কথা শুলো আম্মুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো৷ দুনিয়া থমকে যাক৷ দৃষ্টির সামনে টিকে থাকার সাহস পাচ্ছি না৷ তবুও আমার তাকে চাই আর তাকে চাওয়ার সকল ক্ষেত্রে আমি হাজার বাঁধা অতিক্রম করবো৷
–‘ ছেলেটা কে? ‘ আম্মু থমথমে গলায় প্রশ্ন করতেই আমি চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে বললাম,
–‘ আ..আমা..আমাদের ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়৷ ‘
–‘ সে তোকে ভালোবাসে?? ‘
আম্মুর স্বাভাবিক কন্ঠের কথায় আমার সাহসিকতা এক নিমিষেই ভেঙে দিলো৷ আমি মাথা দুদিকে হেলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
–‘ রুমে যা, এই বিষয়ে আর একটাও কথা আমি শুনতে চাই না৷ ভার্সিটি প্রেম করার জন্য পাঠিয়েছি তোকে? কতোটা বেয়াদব ভাবো,মুখের উপর বলছে ও ।প্রেম করছে ভালোবেসেছে৷ ঠাটিয়ে চড় মারবো৷ অসভ্য, ফাজিল৷ যেখানে যেতে চায় ,যা চায় সব চাওয়ার আগে হাজির৷ ভার্সিটি উঠার পর হোস্টেলে থেকে বিগড়ে গেছে একদম৷ কক্সবাজার ওই ছেলে গিয়েছিলো?? কি হলো জবাব দে! ‘
–‘ উনি স্যার আমাদের৷ সেই হিসেবে যেতেই পারে৷ সব কিছু না শুনেই বেশি বলছো তুমি৷ ‘
–‘ চুপ! একদম চুপ৷ তোর আব্বু আজ আসুক দেখুক মেয়ে কতো শিক্ষিত হচ্ছে৷ পড়ার নামে প্রেম করে বেড়াচ্ছে৷ মুখে মুখে আর একটা কথা বললে মার খাবি হৃদিয়া৷ তুই বড় হয়ে গেছিস বেশি?? ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ তোর৷ অনেক হয়েছে পড়ালেখা৷ ‘
এতোক্ষণ ভয় লাগলেও রাগের হলো৷ আমি নিজেও চিল্লিয়ে বললাম,
–‘ ভার্সিটি যাবো আর তুমি না শুনেই বেশি চিল্লাচিল্লি করছো আম্মু৷ আমি কি দোষ করেছি? পালিয়ে গিয়েছি? না তোমার ভাইয়ের মেয়ের মতো বিয়ে করে বাসায় উঠেছি…’
আর কিছু বলার আগেই আম্মু তেড়ে এসে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়ে সমানতালে চিল্লিয়ে বলল,
–‘ বেশি কথা বলা একদম পচ্ছন্দ করি না আমি৷ তোমার ভার্সিটি অনেক যাওয়া হয়েছে৷ ঘরে পরে থাকবে৷ পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিবে৷ ব্যাস শেষ৷ অতিরিক্ত উড়ছো ডানা কাঁটার সময় হয়েছে৷ বহু দিন ধরে দেখছি আজ মুখের সামনে বলছো ভালোবাসো কাউকে৷ এই শিক্ষা দিয়েছি? ‘
সেন্টার টেবিলটা পা দিয়ে ধাক্কা মেরে দূরে সরাতেই তীব্র আওয়াজ হতেই আমি একছুটে রুমের দিকে পা বাড়াই৷ দরজা জোরে বন্ধ করে দিয়ে আরেকদফা চিল্লয়ে বললাম,
–‘ তুমি যা বলার বলো৷ আমি ভার্সিটি ফিরে যাবো আর আমার সিদ্ধান্ত তোমার মেনে নিতেই হবে৷ এইটাই লাস্ট কথা৷ ‘
আমার কথা শুনে অনবরত বকে চলেছে আমায়৷ আমি সেইদিকে পাত্তা দিচ্ছি না৷ আমার শুধু মনে হচ্ছে তার সাথে থাকা প্রয়োজন আর সে আমার৷ হারাতে পারবো না আমি৷ ডুকরে কেঁদে উঠলাম৷ উদ্দেশ্য বিহীন কাজ করেছি৷ সবাই মেনে নিবে তাকে?? এই সব কিছুর সমাধান একমাত্র আব্বু দিতে পারবে৷
ইচ্ছা হচ্ছে,ছুটে ভার্সিটি চলে যাই আম্মু অতিমাত্রায় রেগে আছে৷ আমি রাগ দেখিয়ে ভার্সিটি চলে গেলে আমার পিছু পিছু যাবে৷ অহেতুক সিনক্রিয়েট হবে৷ আবার রাগের মাথায় উনাকে ভুল-ভাল কিছু বলে দিলে সে যে আরো বিষন্নতায় ডুবে যাবে৷ কি করবো আমি?? আমার তাকে চাই আব্বু-আম্মুর সম্মতিতে৷
কক্সবাজারের সেই রাত থেকে অনবরত ভেবেই বাসায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ আমার বিশ্বাস সে বড্ড একা তার মনের কোণে হাজারো একাকিত্বের বাস আর সেইগুলো দূর করার জন্য উনার কাউকে চাই আর সেই চাওয়াটা আমি৷
উনার সাথে দেখা না করেই চলে এসেছি৷ এখন না দেখা করে আসাটা কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো৷ আম্মুর প্রতি রাগে,তার বিষন্নতা আমার সব কিছু বিষিয়ে দিয়ে যাচ্ছে৷ সব পেয়েও হারাবো??
_________________________________
মাগরিবের আজান পরেছে কখন সেটা জানি না৷ হালকা অন্ধকারেও বাইরে হলুদ আভা ছড়িয়ে কালো আর হলদে মিলিয়ে নতুন রঙ সৃষ্টি করেছে৷ দরজার সামনে বসে থেকে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না৷ ব্যাগে থাকা মোবাইলের ভাইব্রেশনের শব্দে কেঁপে উঠে বসতেই মাথা ব্যথায় টনটন করে উঠে৷
মাঝে একবার রাফিন দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে গেছে৷ মোবাইলের ভাইব্রেশন আবার হতেই দরজায় কেউ আঘাত করে৷ আম্মু কিছুটা আদুরে আর শাসন মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–‘ হৃদিয়া,বাইরে বেরিয়ে আয়৷ ‘
–‘ এখান থেকে যাও আম্মু আমার কিছু ভালো লাগছে না৷ ‘ ভেঙে যাওয়া কন্ঠে জবাব দিতেই আম্মু আবারও রেগে উঠলো৷ ঝাঁঝালো কন্ঠে জবাব দিলো,
–‘ লাগামছাড়া হয়ে গেছিস সেই সাথে বেয়াদব৷ তোর আব্বু ফিরুক বেয়াদবির বিহিত করবো আমি৷ ‘
গজগজ করতে করতে চলে গেলেও ড্রয়িং রুমে বসে একনাগাড়ে কথা শোনাচ্ছে৷ আমি মাথা চেপে ধরে বসে আছি৷ বাইরে থেকে ফিসফিস আওয়াজে রাফিন বলল,
–‘ ঘাপটি মেরে বসে থাকলে আম্মুর বকার হাত থেকে রেহাই পাবি না গাঁধি৷ আই উইল ম্যানেজ ইউর মাদার৷ তবুও তব্দা মেরে বসে থাকিস না৷ ‘
–‘ ভালো লাগছে না রাফিন৷ চলে যা এখান থেকে৷ শুধুমাত্র আব্বু আসলে ডাকবি আমায় আর তোর মাকে বল আমার গুষ্ঠি উদ্ধার না করতে৷ ‘
–‘ আব্বু কাল বিকেলে আসবে৷ গ্রাম থেকে দাদুনকে আনতে গিয়েছে৷ ‘ রাফিনের কথায় ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ আম্মুর মুখোমুখি হওয়া মানেই কথা শোনা৷ কাল যে করেই হোক ভার্সিটি যেতে হবে৷
ক্লান্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ ফোন কে দিয়েছে বেমালুম ভুলে গিয়েছি৷
মনে পরলো পাক্কা এক ঘন্টা পরে৷ মোবাইল হাতে নিয়ে মাথায় হাত, ২২৫+ কল সেই সাথে ২০+ ম্যাসেজ৷ ১৮৯+ কল ফ্রম, ” একান্ত আপনজন ”
৩০+কল নীত র সাথে জান্নাত আর রাহাতের৷
এর মাঝে ১২+ ম্যাসেজ রাহাতের,” ওই হারামি ” দিয়েই ভরপুর৷ সাথে একটা সুন্দর ভাষায় গালি৷
৭ টা ম্যাসেজে অতি সুন্দর করে একান্ত আপনজনের ম্যাসেজ,
‘ অকালেই মেরে ফেলতে চাও বুঝি?? ‘
‘ পুরো বারো ঘন্টা ছাপান্ন মিনিট চার সেকেন্ড উফফস পাচ সেকেন্ড ধরে দেখি না৷ ‘
‘ না বলে বাসায় যাওয়ার অপরাধে তোমাকে স্নিগ্ধের স্নিগ্ধতার জেলের আসামি করা হবে৷ ‘
‘ চারদিকে স্নিগ্ধ বাতাস কিন্তু স্নিগ্ধতায় আচ্ছাদিত হওয়া শুভ্র পরীটা কোথায়?? ‘
‘ ইউ ক্যান ফীল মাই হার্টবিট? তারা তোমার অপেক্ষায় স্পন্দন করছে৷ কিছুঘন্টা না দেখেই থেমে থেমে যাচ্ছে। ‘
আরো ম্যাসেজ একের পর এক পড়ার পর নিমিষেই সমস্ত কষ্ট মুছে গেলো৷ আমি বারবার উচ্চারণ করে পড়ছি৷ আবারো মোবাইল বেজে উঠতেই কাঁপা হাতে রিসিভ করতেই নিঃশ্বাসের শব্দ ব্যাতিত আর আর কিছুই কানে এলো না৷ শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে কিছু বলার আগেই ওইপাশ থেকে জবাব এলো,
–‘ সমস্ত রঙ, রঙহীন সাদা শাড়িতেই মুড়িয়ে নিয়ে গেছো বুঝি? ‘
–‘ রঙ গুলো তো আপনার কাছেই রেখে এসেছি বরং আমিই রঙহীন হয়ে রয়েছি৷ ‘
–‘ হুশশ! একদম কথা বলবে না ৷ ক্যান ইউ ফিল মাই পেইন?? ‘
কেমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন উনি৷ আমি চুপ মেরে আছি৷ অভিমান বুঝি ছেলেরাও করে? তার প্রত্যেক টা কথায় অভিমান ফুঁটে উঠছে৷ আমি কল্পনা করছি,সে হয়তো ছাঁদের কিনার ঘেঁষে বসে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমানের পাহাড় ভাঙছে৷ আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,
–‘ আপনি ছাঁদে বসে আছেন?? ‘
–‘ কেন? যেখানেই বসে থাকি তোমার দরকার কি?তুমি থাকো তোমার বাসায়৷ আমি কে তোমার?? আমাকে নিয়ে কেন ভাবতে হবে? ‘
উনার বাচ্চামো কথায় আমি মুখ টিপে হাসছি৷ নিঃশব্দের হাসির শব্দ নেই তবে সেই হাসির সুপ্ত অনুভূতি দূরত্ব ছাপিয়ে তার কাছে গিয়েছে উনি আরো অভিমানী কন্ঠে বললেন,
–‘ একদম হাসবে না হৃদি৷ তোমার মুখের হাসি একদম সহ্য হয় না আমার৷ কেন হাসো তুমি?হাসবে একদম না৷ ‘
আমার হাসি আরো প্রশস্ত হলো৷ তবুও নিজের হাসিকে দমিয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললাম,
–‘ ভালো আছেন আপনি??শরীর ঠিক আছে? ‘
–‘ আমার ভালো থাকা নিজের সাথে বদ্ধ করে রেখেছো তুমি। মুক্তি দাও সেই বদ্ধ সুখ গুলোকে আমি ভালো থাকতে চাই৷ ‘
কান্না পাচ্ছে তার বলা প্রতিটি কথায়৷ কথার টোনে আবেগ সব ঢেলে দেন উনি৷ যে কেউ শুনলে নির্ঘাত পাগল টাগল হয়ে যাবে৷ চোখ বেয়ে টুপ করর পানি গড়িয়ে পরলো৷
” নিঃশব্দের হাসি গুলো সুখের আভাস তেমনি নিঃশব্দের কান্না গুলো হাজার বেদনার প্রকাশ৷ ”
আঙুলের ডগা দিয়ে পানি টুকু মুছে বললাম,
–‘ রুমে যান! আর আপনার সুখ গুলো চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে তাই সুখের সুদ হিসেবে ডাবল সুখের রাজ্য পাবেন৷ ‘
–‘হুকুম কবুল মহারাণী! সেই সুখ গুলোর সকল পাতা উৎসর্গ করলাম আমার পরীকে শুভ্র রাঙা পরীকে৷ ‘
আমি একহাতে মুখ ঢাকলাম লজ্জায়৷ চারদিকে তার বলা কথা স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে৷ ফোন রাখার আগে শুধু বললেন,
–‘ ভার্সিটি চত্ত্বরে কাল দেখতে না পেলে হবু শ্বশুর বাড়ি বিনা টিকেটে এন্ট্রি নিবো বলে দিলাম৷ ‘
আমি স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ তারপর সশব্দে হেসে উঠলাম৷ আম্মুর রাগী চেহারা মনে পরতেই থেমে গিয়ে শুয়ে পড়তেই হাজার ঘুমের প্রজাপতি চোখের ডানায় ভর করে৷
চোখ বন্ধ করতেই,উনার ক্লান্ত চোখ,মুচকি হেসে উঠা ঠোঁট আর হঠাৎ করে বলা আমাকে লজ্জায় ফেলা কথা৷ সব কিছু এক ভালোলাগার অংশ৷ যেন কিছুই হয় নি৷ সব ঠিক আছে৷ আমার শুভ্র শাড়ির মতো স্পষ্ট সব !
__________________________
খিদেয় পেটের মাঝে চোঁ-চোঁ শব্দ করছে৷ কাল দুপুর থেকে না খাওয়ার দরুন মাথা একটু পর পর চক্কর দিচ্ছে৷ সকালে আম্মুর না ডাকার জন্য রাগের মাত্রা হু-হু করে বেড়ে চলেছে৷ রাফিন স্কুলে চলে গেছে৷ সকাল থেকেই বন্ধ করে বসে আছি। দেয়াল ঘড়িতে সময় বারোটা পার হয়ে গিয়েছে দেখে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চারদিকে উঁকি দিলাম৷ কোথাউ আম্মুকে দেখছি না৷ কালকের ব্যবহার বাজে ছিলো ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো৷ ম্যানেজ করে আজকে ভার্সিটি যেতে পারলেই হবে৷ আমি মিনমিনে স্বরে বার দুয়েক ডাক দিয়েও সারা পেলাম না৷ কিচেনে গিয়েও খুজে না পেয়ে রাগ লাগলেও টেনশন হতে শুরু করলো৷ আমাকে বাসায় রেখে যাওয়ার মানুষ আম্মু না৷
দৌড়ে দরজার সামনে যেতেই দেখলাম মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে৷
আমি কন্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বললাম,
–‘আম্মু আমি ভার্সিটি যাচ্ছি৷ ‘
আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আম্মু বলল,
–‘ এই দেখ কারা এসেছে৷ ‘
আমার কোনো আগ্রহ নেই কারা এসেছে দেখার৷ আম্মুর ফ্যাসফ্যাসে ওই ফুঁপু নয়তো ভাই এসেছে৷ অসহ্য! আমি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছি৷ আম্মু হাসি মুখে কথা বলে চলেছে৷ উফ! দরজার সামনে থেকে না সরলে যাবো কি ভাবে আমি? দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
–‘ সামনে থেকে সরে আর না হলে বেডরুমে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলো আই হেভ নো প্রবলেম বাট এখন আমাকে যেতে দেও! ‘
আমার কথা শুনে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আম্মু তাকালেন আমি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে যাওয়ার জন্য পাঁ বাড়াতেই নীতি আর রাহাত হুড়মুড় করে ঢুকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
–‘ কই যাস হারামি? ‘
–‘ রাহাত চুপ কর আন্টি আছেন৷ ‘ নীতি ফিসফিস করে বলতেই রাহাত কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–‘ সব দিকে এই হারামির জন্য প্যারা৷ ভার্সিটি তে উনার দেবদাস আর বাসায় রণমূর্তি আন্টি৷ ‘
ওদের দেখে ‘ থ ‘ মেরে দাঁড়িয়ে আছি৷ অন্যকিছু না বলে তাড়াহুড়ো করে বললাম,
–‘ উনি ঠিক আছেন তো?? ‘
–‘ ইয়াহ আ’ম ফাইন৷ ‘ উক্ত কথা শুনে হৃৎপিন্ডের রক্তসঞ্চালন মনে হচ্ছে আটকে যাচ্ছে বারেবারে৷
চলবে….