#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি
পর্বঃ২৫
আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে৷ নিজের ভেতরকার সমস্ত কান্না গুলো উঁপচে আসছে৷ আমি অশ্রুসিক্ত চোখে উনার দিকে তাকাতেই ছোট করে হাসলেন উনি৷ শুধু বললেন,
–‘ রিলাক্স হৃদি! আ’ম ফাইন৷ ‘
কত অকপটে বলে দিলেন উনি৷ স্কাই ব্লু শার্টের জায়গায় জায়গায় হালকা রক্তের ছিটা লেগে আছে৷ ক্লান্ত মুখটা আরো ক্লান্ত লাগছে৷ আমার ইচ্ছা হলো উনাকে দুইহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি৷ নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে৷ শার্টের জায়গায় জায়গায় রক্তের ছাপ গুলো স্পষ্ট৷ আমি ব্যথিত কন্ঠে বললাম,
–‘ সত্যি করে বলুন তো আপনিও ব্যথা পেয়েছেন তাই না? ‘
–‘ তিন সত্যি আমি একদম ব্যথা পাই নি বরং ওই পিচ্চিটা অনেক ব্যথা পেয়েছে৷ রাস্তা পার হতে গিয়ে উপর হয়ে পরে যাবে গাড়ির সামনে ও নিজেও ভাবে নি ৷ আর গাড়িটাও আরেকএকটুর জন্য পিষিয়ে দিতো ভাগ্যিস আমি অপজিট থেকে দেখে দৌড়ে গিয়েছিলাম৷ পিচ্চিটার মাথা ফেটে গেছে পরে যাওয়া পরেই৷ সেই রক্তের ছিটা আমার শার্টে৷ ‘
উনি হাত দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে গেলেই হাতের পিঠে দেখতে পেলাম অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিলে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে৷ আমি তাড়াহুড়ো করে উনার হাত টেনে নিয়ে অস্থির কন্ঠে বললাম,
–‘ মিথ্যা বলছেন কেন? দেখুন তো কতোটা জায়গা জুড়ে ছিলে গিয়েছে৷ আর কোথায় ব্যথা পেয়েছেন দেখি৷ খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার?? ‘
আমার নানা প্রশ্নে জর্জরিত উনি৷ তার চোখে আমার ভয় আর ব্যস্ততা দেখে এক রাজ্যের খুশি উঁপচে পরছে৷
–‘ ব্যথা আমি পেয়েছি না তুমি??’ উনি মুচকি হেসে বললেন৷ আমার চোখ দুটো থেকে টলমল করা পানির ফোঁটা গড়িয়ে পরতেই উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
–‘ আরে কাঁদছো কেন বাচ্চাদের মতো?? আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে আছে দেখো৷ কি ভাবছে তারা? আমি বোধহয় হাফ মরে গেছি আল্লাহ! এই মেয়ে এতো বাচ্চা কেন তুমি??আমি ভেবেছিলাম ম্যাচিউর কারো সাথে প্রেম করছি শেষে কিনা কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ করা মেয়ে জুটলো কঁপালে৷ এই অতি কষ্টে আমার আরেকদফা কাউকে দরকার৷ ‘ উনি আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন৷ আমি উনার হাতে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছি৷ তার এহেন কথা গুলো শুনে কটমট চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘ মুখ দিয়ে আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করলে…! ‘
–‘ তারপর??’ আমি থেমে যেতেই উনি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন৷ এর পরের শব্দ আর আসছে না মাথায় আপাতত৷ আমি উনার দৃষ্টি উপেক্ষা করে টেনে নিয়ে এলাম ফুড কর্ণারে৷ তার সামনে হাটু গেড়ে বসতেই মৃদু চিৎকার করে বললেন, ‘ আরে আরে ওখানে কেন বসছো? চেয়ারে উঠে বস৷ ‘
আমি উনার কথায় একদম পাত্তা দিলাম না৷ আবারো দাঁড়িয়ে শাসিয়ে বললাম,
–‘ এখান থেকে এক পাঁ বাড়িয়েছন তো আপনার শান্তি আমি হারাম করে দিবো৷ ‘
উনি হতবিহ্বল ভাবে বসে আঁছেন৷ আমি দ্রুত পাঁ ফেলে ফুড জোনে গেলাম ওখানে গিয়ে গরম পানি নিয়ে আবারো হাটু গেড়ে উনার সামনে বসে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
–‘ হাত দিন এখানে৷ ‘
–‘ পানি লাগলে জ্বলবে বুঝতে পারছো তুমি??’ উনি বাচ্চাদের মতো বললেন৷ আমার ঠোঁটের কোণে হাসিরা জড়ো হতেই ইচ্ছা করে তাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বললাম,
–‘ জ্বলবে না আরাম পাবেন৷ ‘
উনি আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলেন৷ হাত দিতে চেয়েও ফিরিয়ে নিলেন৷ আমি হাসি আটকানোর হাজার চেষ্টায় আছি৷ উনার হাত ধরে আস্তে করে পানিতে রাখতেই চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেন৷ আমি সশব্দে হেসে উঠলাম৷ উনি যখম দেখলেন ব্যথা লাগছে না আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন৷ আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম,
–‘ বাই এনি চান্স আপনি কি ইঞ্জেকশনে ও ভয় পান?? ‘
উনি আমার প্রশ্ন শুনে গলার নট টা ঢিলে করে দিয়ে বললেন,
–‘ প্রেমিকার সামনে প্রেম আদায় করার জন্য হলেও মাঝে মাঝে স্ট্রোং প্রেমিক পুরুষদের ন্যাকা হতে হয়৷ তাহলে নাকি ভালোবাসা বেশি পাওয়া যায়৷ ‘ আমি উনার কথা শুনে ‘ থ ‘ মেরে বসে রইলাম৷ আমাকে অবাক হয়ে বসে থাকতে দেখে উনি পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙিতে বসে ব্যথাতুর কন্ঠে বললেন,
–‘ স্বামীর সেবা সারাজীবন করতে পারবে যত্ন করে কিন্তু প্রেমিকের সেবা কত জনের ভাগ্যে জুটে?? তাই সেবা করো রমণী৷ আমি দোয়া করছি, তোমার স্বামি মানে মেহেরাব হোসেন অতিরিক্ত মানে মাত্রাতিরিক্ত রোম্যান্টিক হয়৷ ‘
উনার কথা শুনে আমার মুখ হা হয়ে গেছে৷ কার জন্য কেঁদে কেটে বুক ভাসাচ্ছিলাম আমি?? এতো বদের হাড্ডি৷ এই ইনোসেন্ট তো এই লাগামছাড়া শুভ্র প্রেমিক৷ যার ভেতর শুভ্রতা আছে সেই সাথে হুট করে লজ্জায় ফেলার মহৎ গুণ৷
________________________________
বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে থেকেও বিরক্ত লাগছে৷ মানুষের কোলাহল যেন বেড়েই চলেছে৷ ফুড কোর্ট না মনে হচ্ছে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বসে আছি৷ নীতিকে পেলে আমি আস্ত কাঁচা চিবিয়ে খেতাম৷ দু ঘন্টা হয়েছে ও লাপাত্তা৷ ওর ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে,পার্মানেন্ট জামাই ছাড়া শ্বশুড় বাড়ি চলে গেছে৷ আমার বিরক্তির কারণ শুধু নীতিতে সীমাবদ্ধ না৷ সামনে থাকা মানুষটা মহা বিরক্তির কারণ সাথে আমার পাশে হুট করে উড়ে আসা মাধবী নামক মাছি টা৷ চারদিকে ভনভন করে ঘুরছে আর একটু পর পর আমাকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে,
–‘ স্নিগ্ধ স্যারের সাথে তুই এখানে কেন??’ এই প্রশ্নটা টানা চৌদ্দবার করেও যখন আমার মুখ খুলাতে পারলো না তখন হাসি হাসি মুখ নিয়ে উনার সাথে গল্পে বিভোর হয়ে পরেছে৷ আর উনিও হেসে হেসে তাল মিলাচ্ছেন৷
আমি পাস্তা এক ধ্যানে খাচ্ছি আর উনার দিকে তাকিয়ে আছি৷ হঠাৎ করেই পা বাঁড়িয়ে উনার পাঁ খুজলাম আর পেয়েও গেলাম৷ মুখে বিশ্বজয়ের হাসি দিতেই উনি ভ্রুকুটি করে বললেন,
–‘ এনিথিং রং?? ‘
–‘ নো৷ ক্যারি অন ভাইয়া৷ ‘ আমার কথা শুনে মাধবী উৎসাহ পেলো৷ তার মনে হাজার ভোল্টেজের লাড্ডু ফুঁটছে৷ উনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে ভাবগতি বুঝার চেষ্টায় আছেন৷ আমি আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম৷ সসের বাটিটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে আস্তে করে টেবিলের নিচে নিয়ে ইচ্ছা করে উনার জুতোর উপর ঢেলে দিয়ে বাটিটা শব্দ করে নিচে ফেলে দিতেই দুইজন সহ বাকিরা আমার দিকে তাকাতেই আমি ইনোসেন্ট ফেস করে বললাম,
–‘ সসের বাটিটা পরে গেছে হাত পিছলে৷ ‘
স্নিগ্ধ স্যার মাথা নীচু করে দেখলেন তার জুতো সসে মাখামাখি৷ উনি আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,
–‘ ইট’স অকে৷ তোমরা বসো আমি ক্লিন করে এখুনি আস ছি৷ ‘
আমি দুদিকে মাথা দুলিয়ে ‘ আচ্ছা ‘ বলতেই উনি উঠে চলে যান৷ আমি মাধবীর দিকে তাকিয়ে দেখি ও উনার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ ইচ্ছা হচ্ছে,কাটাচামচ ওর চোখে ঢুকিয়ে দেই৷ হাত উঠিয়ে উক্ত ভাবা কাজ করতে গিয়েও নামিয়ে আমিও ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
–‘ ইশ! আমার শাড়িও সসে মাখামাখি৷ এখন না ক্লিন করলে দাগ উঠবে না৷ দোস্ত, তুই একটু ওয়েট কর আমিও ক্লিন করেই আসছি৷ ‘
–‘ কিন্তু….’
–‘ জাস্ট ফাইভ মিনিট দোস্ত৷ যাবো আর আসবো৷ ‘ আমি বলেই দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলাম৷ ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে সস টুকু মুছে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমার তার জন্য৷ আজ একদম শেষ করে ফেলবো৷ কত বড় সাহস! আমাকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে কথা বলছে৷
উনি পাঁ ঝারতে ঝারতে বের হয়ে আসতেই হাত টেনে এক কোণায় এসে দাঁড়িয়ে শাসিয়ে বললাম,
–‘ ফারদার আপনাকে আমি ছাড়া কোনো মেয়ের সামনে হাসতে দেখলে মেরে দিবো৷ ‘
আমার কথা শুনে এক ঝাটকায় তার জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে আর আমার জায়গায় সে দাঁড়িয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
–‘ কি করবে?? ‘
–‘ ম..ম…ম! ‘ আমি ভড়কে গিয়ে কথা উচ্চারণ করতে পারছি না৷ উনি হাসছেন আমার অসহায়ত্ব কন্ঠের স্বরে৷ উনি আমার দিকে ঝুকে আসছেন৷ আমি মাথা একদম দেয়ালের সাথে লাগিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি৷ অঘটন হবে যাকে বল মস্ত বড় অঘটন৷ আর সেই অঘটনে নিজের নাম লেখানো থেকে আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে উনি ফিসফিস করে বললেন,
–‘ you feel jealous?? I can’t believe! ‘
আমি পিটপিট চোখে সাহস নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম উনি মিটিমিটি হাসছে৷ লজ্জা পেলেও আমি অস্বীকার্য করতে গেলেই তীব্র আওয়াজে মোবাইল বেজে উঠতেই উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ রিসিভ করো৷ ‘
–‘ করছি তো আপনি সরে দাঁড়ান৷ ‘
আমার কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে আমার দুইপাশে দেয়ালে হাত রেখে আরো আটকিয়ে দাঁড়ালেন৷ মূহুর্তে আমার মনে হলো,কেউ এসে দেখে নিলে উল্টো পাল্টা ভাববে৷ আমি মোবাইল বের করে অনুনয়ের সুরে বললাম,
–‘ সাইড দিয়ে দাঁড়ান৷ ‘
উনি ঘাড়ত্যাড়ামি করে আরো ঝুকে দাঁড়ালেন৷ মাধবী এইভাবে দেখলে পরপর দুইবার স্ট্রোক করবে৷ ভেবেই আফসোস হলো আমার৷ ইশ! বেচারি, ক্রাশ তার বাশ এইটা ভাবলে কি করবে ও??
–‘ রিসিভ করো ফোন৷ কোন দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছো বারেবারে?? তোমার দুনিয়া সামনে তোমার একদম কাছে আছে তাকে রেখে কই যাও বারবার?? দেট’স নট ফেয়ার৷ ‘
উনার তীব্র মেজাজ আর রসিকতা করা কথায় জবাব দেওয়ার আগেই দেখলাম নীতি ফোন করছে৷ আমি দ্রুত হাতে উঠিয়ে ঠাটিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলা শুরু করলাম,
–‘ পার্মানেন্ট শ্বশুর বাড়ি চলে গেছিস হারামি?? মিরপুর স্টেডিয়ামে থেকে মিরপুর-৭ এ যেতে আড়াইঘন্টা লাগে বেদ্দপ? ‘
–‘ টিএসসি তে আসতে পারবি আর্জেন্ট?? ‘
ওর কথা শুনে চোখ কঁপালে আমার৷ এখান থেকে ওখানে কেন গেছে আল্লাহ মালুম৷ আমি দ্বিগুণ চিল্লিয়ে বললাম,
–‘ ওখানে কি ঘাস কাটতে গিয়েছিস?? তোকে নাম্বার আর এড্রেস আনতে পাঠিয়েছি টিএসসি তে তোর হবু জামাইয়ের সাথে প্রেম করতে না৷ ‘
–‘ আ..রি..ফ ভাইয়ার সাথে আমি৷ তুই টিএসসি তে আয়৷ আমি রাহাতকে ফোন করে দিচ্ছি তোর সাথে আসতে৷ ‘
–‘ পাঠাতে হবে না৷ আমি আসতে পারবো৷ আর উনাকে পেলি কোথয় তুই? ভাইয়া না চট্রগ্রাম?? ‘
–‘ প্লিজ জলদি আয়৷ ‘ ফোন কাটতেই দেখি সে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে আছেন৷ আমি নীতি আর আরিফ ভাইয়ার কথা গুলো খুলে বলতেই উনার কঁপালে চিন্তার ভাজ পরলো৷ আমার থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
–‘ ভালোবাসা থাকলে পরিণতি হতে হবে এইটা কোথায় লেখা আছে! দূরে থেকেও কাছে থাকার চেয়ে বেশি ভালোবাসা যায়৷ কিন্তু দুজন মানুষ যদি একে অপরের সাথে থাকতে চায় তাহলে পরিবারের মেনে নেওয়া উচিৎ৷ তবে পরিবারের অমতে কখনো ভালো থাকা যায় না৷ আরিফ আর নীতির পরিবার মেনে নেয় তাহলে আগানো উচিৎ৷ এখানে দুজন মানুষ না দুটো ফ্যামিলি জড়িয়ে আছে সেই সাথে সবার সুখ৷ ‘
উনার কথা বাস্তবিক হলেও আমি একদম সন্তুষ্ট হতে পারলাম না৷ আমার সাথে হলে আমি কি করবো?? এইটা ভেবেই নির্লিপ্ত ভাবে বললাম,
–‘ নীতি আর আরিফ ভাইয়াদের জায়গায় আমরা থাকলে কি করতেন?? সব ছেড়ে দিতেন এইভাবেই?? ‘
উনি আমার অভিমানী কন্ঠের স্বর বুঝতে পেরে আবারো আগের পজিশনে দাঁড়িয়ে কঁপালে গভীর ভাবে চুমু দিয়ে বললেন,
–‘ আমাদের পরিণতি এমন টা হবে না যদি হয় তাহলে সেটা হবে শুভ্র রঙের প্রেমের পরিণতি৷ ‘
চলবে…..
#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি
পর্বঃ২৬
স্নিগ্ধময় আবেগ স্নিগ্ধ ব্যাক্তির আশেপাশেই থাকলে হয়৷ একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন উনি৷ আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে পাশ ফিরে৷ হাজারো অনুভূতি হচ্ছে, সেই সাথে হচ্ছে হৃৎস্পন্দনেট ধাক ধাক শব্দ৷ আমি নির্লিপ্ত, ভাষাহীন,নির্বাক চোখে তাকিয়ে আমার তাকে দেখে চলেছি৷ উনি মুচকি হেসে আরিফ ভাইয়ার সাথে কথা বলছেন আর নীতি মাথা নীচু করে হাত খুঁটছে৷
–‘ ঠিক আছো তুমি?? ‘ উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন৷ আরিফ ভাইয়া আর নীতি আমার দিকে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৃঢ়ভাবে বললাম,
–‘ ইয়াহ! ‘ আমার বলা কথায় সে সামনে তাকিয়ে টেবিলে হাত রেখে শান্ত সুরে আরিফ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
–‘ আমি হৃদির কাছে আপনাদের ব্যপারে সব কিছু শুনেছি৷ নীতি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে আপনি জানেন?? ‘
আরিফ ভাইয়া অবাক দৃষ্টিতে নীতির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,’ উনি কি সত্যি বলছে নীতি?? ‘
নীতি উত্তর না দিয়ে কেঁদে দিলো৷ উফফ! এই মেয়েটা এতো কাঁদতে পারে৷ কথায় কথায় কাঁদে৷
–‘ তোমার থেকে অত্যন্ত কম৷ ‘ ফিসফিস আওয়াজে বলতেই আমি বিষ্ময়ে হা হয়ে যাই৷ আমি নিজের মনে কথা গুলো বলছি কিন্তু সে শুনলো কি করে?? উক্ত প্রশ্ন আর করা হলো না নীতির ফুঁপিয়ে কান্নার স্বরে৷ আমি উঠে ওর কাছে যেতে গেলেই হাত ধরে ইশারায় বসতে বলেন আমাকে৷ আরিফ ভাইয়া থমথমে মুখে বললেন,
–‘ বিয়ের ডেট কবে?? তোমায় আমি বারবার ফোন করতাম নীতি একটা বার কথা বলার জন্য৷ ভালোবাসি তোমায় দোহাই দিয়ে ফেলে চলে যেতাম না৷ একটাবার ফোন উঠিয়ে বলতে তোমার পরিস্থিতি আমি নিজের সব উজাড় করে তোমার ফ্যামিলির কাছে ছুটে যেতাম৷ তারা অবশ্যই মানতেন আমার মতে৷ ‘
–‘ আপনাকে বলার সাহস হয় নি আরিফ ভাই৷ আমি তো ভীতু বরাবরের মতো তবে এখন পিছিয়ে যেতে পারছি না ভয় পেয়ে৷ আমার বড্ড কষ্ট হয় আপনার কথা ভাবলে৷ ‘
–‘ পুরাতন সিম এক্টিভ করো আমার হাজার হাজার ম্যাসেজের ভীড়ে তুমি হারিয়ে যাবে নীতি৷ তোমার অতিরিক্ত চিন্তার জন্য সব কিছু কঠিন হয়ে গেছে৷ ‘ আরিফ ভাইয়া আফসোসের সুরে বললেন৷ নীতির কান্নার পরিমাণ আরো বাড়ছে৷ আমি চুপ থাকতে না পেরে বললাম,
–‘ এখনো কিছু শেষ হয় নি ভাইয়া৷ সব আপনাদের মুঠোয় আছে৷ বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে বিয়ে তাকে করতে হবে এটার মানে তো নেই৷ আপনি নীতির বাসায় যাবেন ওর মা আর মামার সাথে কথা বলুন ইন শা আল্লাহ,আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হবে৷ ‘
–‘ যদি না মানে?? ‘ নীতি ভেজা কন্ঠে বলতেই আমি কটমট চোখে তাকালাম৷ এই মেয়েটা ডাফার৷ সব কিছুতে নিজেকে গুটিয়ে গুমরে মরবে৷ নীতির কথা শুনে উনি বললেন,
–‘ পরিণতি না হোক চেষ্টা করতে তো আর ক্ষতি নেই৷ আর মি.আরিফ প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছেন ইভেন উনার কথা অনুযায়ী ফ্যামিলি আই মিন আন্টি রাজি তাহলে সমস্যা হান্ড্রেড পার্সেন্ট থেকে টুয়েন্টি পার্সেন্টে নেমে এসেছে৷ উই উইল ডু ইট৷ ‘
উনার ভরসা পূর্ণ কথায় আমার আর নীতির মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠলো৷ দুইজনের প্রিয় মানুষ দুটো একসাথেই আছে সব ঠিক হবে৷
___________________________
ঝড়ের পূর্বাভাসে আকাশে কালো মেঘ গুলো দূর থেকে উড়ে উড়ে এই ব্যস্ত শহর ঢাকার আকাশের আনাচে-কানাচে ছেয়ে গেলো৷ বহুদিন মেঘ বৃষ্টির অনাহারে ব্যস্ত রাস্তাঘাট ধূলিময় রাজ্যে থেকে আজ স্নিগ্ধ সতেজ হওয়ার জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় সময় গুনছে৷ শুষ্ক পরিবেশে ধূলিকণা লাগামছাড়া ভাবে ঝাপিয়ে আসছে৷ আমরা বিরক্তি নিয়ে টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ নীতি আরিফ ভাইয়ার পাশে মুখ কাঁচুমাচু করে আর আমি উচ্ছ্বসিত চোখে সামনের ঝড়ো হাওয়া আএ ধূলিকণার প্রতিযোগিতা দেখতে ব্যস্ত৷ একটু পর আকাশ ভেঁদ করে ঝপাৎ ঝপাৎ করে বৃষ্টিরা ধূলোদের মিশিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিবে আমি সেই মূহুর্তে নিজেকে তুলে ধরবো৷ কিন্তু পাশে থাকা ব্যক্তি আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে সবার মাঝেই হাত ঠেসে ধরে কড়া নজরে তাকিয়ে বললেন,
–‘ মনের ইচ্ছা মনেই রাখো৷ প্রকাশ করতে গেলে তোমার দুনিয়া অন্ধকার করে দিবো একদম৷ ‘
–‘ আপনার হুমকি তে আমি ভয় পাই নাকি? একবার বৃষ্টিকে নামতে বলুন আমি বাঁধান ছেড়ে একছুটে চলে যাবো৷ ‘
উনি হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে ধরে রাখলেন৷ মহা মুশকিল তো! আমি নিজেকে সংযত করে ইনোসেন্ট ফেস করে বললাম,
–‘ রিক্সায় ঘুরবেন? এই ঝড়ো হাওয়ায় রিক্সায় ঘুরার মতো মহৎ কাজ আর দুটো নেই৷ ঘুরবেন প্লিজ? নীতিদের বাসা গুলশান টিএসসি থেকে যেতে খুব একটা খারাপ লাগবে না৷ ‘
–‘ শর্ত নংঃ১
বৃষ্টিতে ভিজবে না
শর্ত নংঃ২
একদম ভিজবে না
শর্ত নংঃ৩
আমি যা…
উনি আমার কথা শুনে শর্ত জুড়ে দিলেন৷ আমি তৃতীয় শর্ত না শুনে উৎফুল্ল ভাবে বললাম,
–‘ আমি তিনটা না আপনার হাজার শর্তে রাজি শুধু রিক্সায় উঠার বাকি৷ এইবার তো চলুন৷ ‘
–‘ ঠিক তো?? শর্ত না শুনেই রাজি? পরে পিছপা হলে কিন্তু হবে না৷ ‘ উনি ঠোঁট বাকা করে হেসে বললেন৷ আমি বোকার মতো না শুনেই বললাম,
–‘ একবার রাজি, দুইবার রাজি, তিনবার রাজি৷ আর আমি কথার খেলাপ করি না তাই নিশ্চিন্তে থাকেন৷ ‘
–‘ ওকে, ফাইন! আমিও রাজি৷ ‘ আবারো বাকা হেসে আরিফ ভাইয়াদের কাছে গেলেন৷ আমি মহা আনন্দে লাফাচ্ছি৷ কিছুক্ষণ বাদে নীতি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
–‘ আমার সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে৷ ‘
–‘ তুই বুঝি ঘুমিয়ে আছিস? ‘ আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম৷ নীতি রেগে তাকালেও মূহুর্তেই ঠান্ডা স্বরে বলল,
–‘ আমি ওখান থেকে বেরিয়ে আরিফ ভাইয়াদের বাসায় গিয়ে দেখি উনি বাসায় আছেন৷ জানিস, আমার তাকে দেখে মনে হয়েছে আবারো,উনাকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারবো না৷ খালাম্মা আমাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছেন জানিস? উনাদের ভালোবাসা দেখে আমি হতবাক৷ যখন আরিফ ভাইয়াকে বললাম উনার সাথে কথা আছে তখন উনি বিনাবাক্য বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে বললেন, ‘ আসো তোমাকে দিয়ে আসি৷ ‘ সেই কথাটা আমাকে আরো দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে৷ আমি নিজ ইচ্ছা ভয়ে ভয়ে উনাকে আমার বিয়ের কথা বলতেই টিএসসি তে নিয়ে আসেন আমায়৷ তোর কথা আর সাপোর্ট আমাকে তাকে পাওয়ার একটুকরো আশা দেখিয়েছে৷ জানি না কি হবে তবে সব কষ্টা আজ ধুয়ে মুছে গিয়েছে৷ তুই শুধু স্নিগ্ধ ভাইয়ার শুভ্র পরী না আমার লাইফের ও একজন পরী যার তেজ আর কনফিডেন্স সাহস জোগাড় করতে সক্ষম৷ ‘
প্রশংসা শুনে কি করবো ভেবে পেলাম না৷ কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা যেমন আমার ভান্ডারে নেই তেমনি কিছু কিছু কথার জবাব দিতে চেয়েও দিতে নেই৷ আমিও দিলাম না৷
নীতি আর আরিফ ভাইয়াদের রিক্সা আমাদের সামনে৷ আমি উনার থেকে যতদূর সরে বসতে চাই উনি আরো আমার সাথে চেঁপে বসেন৷ চারদিকে ধূলোময়লার জন্য হূড তোলা৷ হাতুড়ি পিটা বাঁজখাই শব্দ আমার বুকের মাঝে হচ্ছে৷ এই বুঝি হৃৎপিন্ড বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খেলো৷
–‘ শর্ত না শুনেই এই অবস্থা আর শর্ত শুনলে বোধহয় তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে নামতে৷ ‘
–‘ এক্সপ্লেইন করুন কি শর্ত আমি শুনবো এখন৷ ‘ আমি সাইডে সরে যেতে যেতে বললাম৷ কিন্তু সে যেতে না দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে কাট কাট গলায় বললেন,
–‘ আমি খেয়ে ফেলবো তোমায়?? আরেকটু পর তো পরেই যাবা৷ কাছে এসো বসো না হলে কিন্তু… ‘
–‘ ন..না হলে কি?? ‘ আমি ভয় পাওয়া সুরে বললাম৷ উনি মুচকি হেসে বললেন,
–‘ ওইটাও শর্তের সাথে জুড়ে দিলাম৷ ‘
আমি আর কিছু বলার আগেই উনি একটানে তার সাথে মিশিয়ে নিলেন৷ আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি৷ রিক্সায় আসার জন্য শর্ত তার উপর এমন পরিস্থিতি
আমার উপর প্রচুর ভারী পরবে৷ নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারলাম না তো????
_____________________________
পরিবেশে ঝড় উঠছে করুন ভাবে৷ এক নিমিষেই সব তছনছ করে দেওয়ার মতো শক্তি যেন ঝড়ের শক্তি৷ ভেজা মাটির সুন্দর সুবাসে ভরে উঠেছে আশপাশ৷ ছোট বসার ঘরে আমরা চারজন সাথে নীতির মা আর মামা গম্ভীর ভাবে বসে আছেন৷ নীতি একটু পর পর আমার হাত চেপে ধরছে আবার কখনো করুন চোখে তাকাচ্ছে৷ আমি অভয় দিলাম৷ আমাদের চোখাচোখির মাঝে নীতির মামা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
–‘ নীতি তুই আগে কেন বলিস নাই?? সব ঠিক হওয়ার পর বললেই হবে নাকি! আজকালকার ছেলেমেয়ারা সব ফাউল৷ এইযে রেজিনা তোর মেয়েও তার উদাহরণ৷ ‘
আন্টি ও আমার আম্মুর মতো তাকিয়ে আছেন নীতির দিকে৷ নীতির মতো আমারো হাসফাস অবস্থা৷ ওর মামা স্নিগ্ধ স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ উনি কে?? ‘
–‘ হৃদির হাসবেন্ড৷ ‘ তার সহজ স্বীকারোক্তিতে আমার দম আরো আটকে এলো৷ হাসবেন্ড নামক শব্দটা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে৷ আমি বিষ্ময় নিয়ে তাকাতেই আন্টি প্রশ্ন করলেন,
–‘ তোমার আম্মু তো কিছু বললো না আর নীতিও না বিয়ে কবে হলো তোমার? ‘
–‘ গতকাল হয়েছে আর তাড়াহুড়ো ঘরোয়া ভাবেই
হয়েছে তাই কাউকে জানানো হয় নি৷ ‘ উনি আবারো অকপটে বলে দিলেন৷ ছুটে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা থাকলে আমি পালিয়ে যেতাম৷ এখানে নীতির বিয়ের আলোচনা না আমার না হওয়া বিয়েকে টেনে টুনে সত্যতা দেওয়ার আসর বসেছে বুঝতে পারছি না৷ আমি সাহস জুগিয়ে বললাম,
–‘ আন্টি এইসব কথা বাদ দিন৷ আরিফ ভাইয়া সত্যি নীতিকে ভালো রাখবে৷ আর ওরা দুইজন দুজনকে ভালোবাসে৷ ‘
আমার কথায় সায় দিয়ে আরিফ ভাইয়া গলা পরিষ্কার করে বললেন,
–‘ আপনার মেয়েকে আমি সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখবো৷ আমার ব্যাপারে আপনারা জানেন আমি কেমন বা কি করি আমার ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড৷ আমার আগে প্রস্তাব নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো কিন্তু আমি পারি নি সেটা আমার ব্যর্থতা৷ তবে এইবার আর সেও সুযোগ আমি করে দিবো না৷ নীতিকে আমার বউয়ের মর্যাদা দিতে চাই এবং তা শুধুই আপনাদের সম্মতিতে৷ আপনি ফিরিয়ে দিলে আমি কষ্ট পাবো না তবে সুখেও থাকতে পারবো না নীতিকে ছাড়া৷ ‘ আরিফ ভাইয়া একনাগাড়ে বলে দম ফেললেন৷ বাইরের ঝড়ো বাতাসের দাপট ঘরের গুমোট পরিবেশে আঘাত হানতে পারলো না৷
নীতির মামা গাই-গুই করছেন আর শাসাচ্ছেন নীতিকে৷ আরিফ ভাইয়া প্রচন্ড অসহায় চোখ করে তাকিয়ে আছেক একটুকরো আলোর আশায়৷ নীতির আম্মু উঠে দাঁড়াতেই প্রত্যেকের মন বিষিয়ে গেলো৷ শেষ রক্ষা বুঝি হলো না আর?
আমাদের দুশ্চিন্তা কমিয়ে উনি গম্ভীর ভাবেই বললেন,
–‘ আরিফ ভাবিকে নিয়ে বিকেলে বাসায় আসিস৷ তখুনি সব আলাপ-আলোচনা হবে৷ ‘
আন্টির কথায় লাফিয়ে উঠলাম আমি৷ উনি আবারো হাত চেপে ধরে কটমট চোখে তাকালেন৷ আমি দাঁত বের করর হেসে জোরে জোরেই বললাম,
–‘ আলহামদুলিল্লাহ! ‘
চলবে…